গত ১০ই মার্চ হ’তে ২৩শে মার্চ পর্যন্ত ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ডঃ মাওলানা মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব সউদী সরকারের রাজকীয় মেহমান হিসাবে হজ্জব্রত পালন উপলক্ষে সউদী আরব সফর করেন। সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর পক্ষ হ’তে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। নিম্নে সাক্ষাৎকারের সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হলঃ
১. আত-তাহরীক : বাংলাদেশ থেকে আপনারা কতজন সফরে গিয়েছিলেন?
মুহতারাম আমীরে জামা‘আতঃ বাংলাদেশ থেকে আমরা মোট ৫ (পাঁচ) জন গিয়েছিলাম। আমি বাদে বাকী ঢাকার চারজন হ’লেন- (১) মাওলানা যিল্লুল বাসেত (টঙ্গী) (২) মাওলানা দেলোয়ার হোসায়েন সাঈদী (৩) মাওলানা আবুল কালাম আযাদ এবং (৪) অধ্যাপক হারূনুয্যামান। (ইনডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটি, ঢাকা)।
২. আত-তাহরীক : আপনার সাথীদের সাথে কখন আপনার সাক্ষাৎ হয়?
আমীরে জামা‘আত : বিমানবন্দরে তাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। যথারীতি ‘সউদিয়া’ ফ্লাইটে আরোহণ করার কিছুক্ষণ পরেই খ্যাতনামা বাগ্মী মাওলানা দেলোয়ার হোসায়েন সাঈদী ও এ,টি,এন টেলিভিশনে নিয়মিত ইসলামী প্রোগ্রামকারী খ্যাতিমান আলেম মাওলানা আবুল কালাম আযাদ উপস্থিত হন। তাদেরকে পেয়ে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হই। ১৯৭৬ সালের ৬ই ডিসেম্বরে সাতক্ষীরায় অনুষ্ঠিত এক ইসলামী জালসায় একমঞ্চে বক্তব্য দেওয়ার পর সাঈদী ছাহেবের সাথে পবিত্র হজ্জের : সফরের দীর্ঘ সাথী হিসাবে পাওয়াটা ছিল বড়ই আনন্দের। কুশল বিনিময়ের কিছুক্ষণ পরেই আমি তাকে মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী-২০০০ সংখ্যা পড়তে দিলাম। তিনি একমনে জাতীয়তাবাদ শিরোনাম যুক্ত দরসে কুরআন পড়ে শেষ করেন। তিনি আমার দিকে ফিরে বলেন, লেখাটি অত্যন্ত চমৎকার এবং জামে‘ মানে (সারগর্ভ) হয়েছে। তার কাছ থেকে নিয়ে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ ছাহেব প্রশ্নোত্তর কলাম সহ পুরো পত্রিকাটি পড়ে শেষ করেন। পড়া শেষে উভয়ই অত্যন্ত সুন্দর মন্তব্য করেন।
৩. আত-তাহরীকঃ আপনাদের সফর সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করলে খুশী হব।
আমীরে জামা‘আত : ১০ই মার্চ শুক্রবার বিকাল ৪ টায় ‘সউদিয়া ফ্লাইটে আমরা রওয়ানা হই। আমাদের ভিসা ছিল ‘যায়ফু খাদেমিল হারামায়েন আশ-শারীফায়েন’ হিসাবে। এটি সউদীদের নিকটে অত্যন্ত মর্যাদামন্ডিত ভিসা। পৌনে ছয় ঘন্টা চলার পর স্থানীয় সময় রাত পৌনে ৮-টায় জেন্দা অবতরণ করি। অতঃপর সউদী বাদশাহের পক্ষ হ’তে নিয়োজিত অভ্যর্থনাকারীগণ বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে আমাদেরকে নাস্তা-পানি করিয়ে রাত ১০-টার দিকে বিশেষ গাড়ীতে করে মক্কার পথে রওয়ানা হন। ৯০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে ঘণ্টাখানেক পর আমরা মক্কায় আমাদের থাকার জন্য নির্ধারিত অবস্থান স্থল ‘হাই আয-যাহের’ এলাকার আল-মাহাদ আল-ইলমীতে পৌছে যাই। নামার পরে খানাপিনা করে তওয়াফ করতে যাওয়ার জন্য আমাদেরকে প্রস্ত্তত হ’তে বলা হয়। একটু পরেই আমাদেরকে কাবা শরীফে নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা যথারীতি তৃওয়াফ ও সাঈ সেরে ওমরা শেষ করে ফিরে আসি। আমরা তিনজন ৩য় তলায় ২২নং কক্ষে এবং তার বিপরীতে ১৭ নং কক্ষে মাওলানা দেলোয়ার হোসায়েন সাঈদী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদ অবস্থান করেন।
৪. আত-তাহরীক : আপনারা কোন স্থান থেকে এহরাম বাধেন।
আমীরে জামা‘আতঃ আমার সাথীরা সবাই ঢাকা থেকে এহরাম বেঁধে এসেছিলেন। কিন্তু আমি জেদ্দা অবতরণের আধা ঘন্টা পূর্বে আমাদের জন্য নির্ধারিত মীকাত ‘ইয়ালামলাম পাহাড় অতিক্রমের কিছু পূর্বে বিমানেই এহরাম বেঁধে নেই। উল্লেখ্য যে, মীক্বাতে পৌছবার প্রায় আধা ঘন্টা পূর্ব থেকেই মাইকে বলা হয় ও টিভি পর্দায় ছবিতে বিমানের গতিপথ বর্ণনায় তা দেখানো হয়।
৫. আত-তাহরীকঃ মোট কয়টি দেশ হ’তে কতজন এবারে সউদী বাদশাহের বিশেষ মেহমান হিসাবে হজ্জ করেন?
আমীরে জামা‘আতঃ ১৫টি দেশ হ’তে মোট ৮৫ জন মেহমান আসেন। তার মধ্যে ৪০ জন মেহমান ছিলেন শুধু ইন্দোনেশিয়া থেকেই। এতদ্ব্যতীত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, কোরিয়া, কেনিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড প্রভৃতি দেশ থেকে বাকীরা আসেন। উল্লেখ্য যে, এই ১৫টি দেশ ছিল শুধু এশিয়া মহাদেশ থেকে। এদের দায়িত্বে ছিল বাদশাহর পক্ষ থেকে রিয়াদের জামে‘আতুল ইমাম মালেক সউদ বিন আবদুল আযীয ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এমনিভাবে আফ্রিকা মহাদেশের মেহমানদের দায়িত্বে ছিল মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এশিয়া মহাদেশের হাজীদেরকে নিয়ে কয়েকটি গ্রুপ করা হয়। তার মধ্যে বাংলাদেশ ও শ্রীলংকাকে নিয়ে নয়জনের একটি গ্রুপ করা হয়। শ্রীলংকার ৪ জন মেহমানের মধ্যে দু’জন ছিলেন সে দেশের দুই প্রতিমন্ত্রী। এতদ্ব্যতীত আমেরিকান মেহমানরাও ছিলেন যারা মিনাতে আমাদের ক্যাম্পে এসে আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।
৬. আত-তাহরীকঃ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের কারু কারু নাম বলুন।
আমীরে জামা‘আতঃ ইন্ডিয়া থেকে বিহারের বিখ্যাত আহলেহাদীছ প্রতিষ্ঠান দারুল হাদীছ আহমাদিয়া সালাফিইয়াহুর পরিচালক ডাঃ আব্দুল আযীয সালাফী সহ অন্যান্য আরও কয়েকজন। পাকিস্তান থেকে মাওলানা এরশাদুল হক আছারী (মন্টগোমারী বাজার, ফায়ছালা বাদ)। ইনি ইদারা উলুমুল আছারিয়াহর পরিচালক, লাহোরের সাপ্তাহিক আল-ই‘তিছাম পত্রিকার সম্পাদক এবং পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শরীয়া বোর্ডের সদস্য। এতদ্ব্যতীত ২- মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ আমজাদ শায়খুল হাদীছ, মারকায দা‘ওয়া সালাফিইয়াহ, ফায়ছালাবাদ ৩- হাফেয মাওলানা আব্দুল হান্নান, শায়খুল হাদীছ জামে‘আ মুহাম্মাদিয়া গুজরানওয়ালা ৪- সাইয়িদ মুহাম্মাদ হানীফ, ধত্বীব জামে মসজিদ তাওহীদিয়াহ আহলেহাদীছ, বেলালগ ১ম গলি, ফায়ছালাবাদ প্রমুখ।
এতদ্ব্যতীত বিভিন্নভাবে যাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত ও আলোচনা হয়েছে তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’লেন ডঃ ছুহায়েব হাসান (লন্ডন)। ইনি গ্রেট বৃটেন জমঈয়তে আহলেহাদীছের সাবেক আমীর, বাহরায়েনের নাছের মুহাম্মাদ লোরী (মানামাহ)। ইনি ওখানকার আহলেহাদীছ সংগঠন জমঈয়ত তারবিয়া ইসলামিয়াহর মুদীর, আবদুল্লাহ আবদুল হামীদ (মানামা), ভারতের শায়খ আবদুল মতীন আবদুর রহমান আস-সালাফী, রাবেতা আলম আল-ইসলামীর এশিয়া বিভাগের মুদীর এবং ডঃ আবদুল মালেক বিন দুহায়েশ (মক্কা) প্রমুখ। শেষোক্তজন সউদী আরবের খ্যাতনামা বিদ্বান, লেখক, গ্রন্থকার ও ব্যবসায়ী। এতদ্ব্যতীত সউদী আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম শায়খ মুহাম্মাদ উছায়মীন ও মুফতীয়ে আম শায়খ আবদুল আযীয বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খের সাথে মুলাকাতের ও অতি নিকট থেকে তাদের কথা শানোর সুযাগে হয়েছে।
৭. আত-তাহরীকঃ সউদীতে কত তারিখে হজ্জ হয় এবং হজ্জের খুৎবা কে প্রদান করেন?
আমীরে জামাআতঃ ১৫ই মার্চ বুধবার পবিত্র হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়। আমরা যথারীতি সকাল ৯টার মধ্যেই। আরাফার ময়দানে পৌছে যাই। বেলা ১২টায় খুৎবা শুরু হয় এবং ১টা ২০ মিনিট পর্যন্ত দীর্ঘ খুৎবা প্রদান করেন বর্তমান মুফতীয়ে ‘‘আম শায়খ আবদুল আযীয বিন। আব্দুল্লাহ আলে শায়খ। ইনি সাবেক গ্রান্ড মুফতী শায়খ আবদুল আযীয বিন বায (রহঃ)-এর নায়েব ছিলেন এবং ইনিও সাবেক মুফতীর ন্যায় অন্ধ বিদ্বান’ (সংক্ষিপ্ত জীবনী আগষ্ট ’৯৯ পৃঃ ৪৩ দ্রষ্টব্য)। অতঃপর ১টা ২৫ মিনিটে প্রথমে। দু’রাকআত যোহর এবং পরে দু’রাক‘আত আছর দুই ইকামতের মাধ্যমে জামাআতের সাথে আদায় করি। তারপর বাদ মাগরিব আমরা মুযদালিফার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। সেখানে গিয়ে মাগরিবের তিন রাকআত ও এশার দুই রাকআত ছালাত পৃথক ইকামতের মাধ্যমে জামাআতের সাথে আদায় করি। অতঃপর এক রাকআত বিতর পড়ে তাসবীহ, তেলাওয়াত ও দোআ-ইস্তেগফারে লিপ্ত হই। সবশেষে ফজরের ছালাত জামা'আতের সাথে আদায় করে মুযদালিফা থেকে রওয়ানা হয়ে আমরা মিনাতে মসজিদে খায়েফ-এর দক্ষিণ পার্শ্বের প্রধান রাস্তার বিপরীতে আমাদের নির্ধারিত সরকারী মেহমানখানায় পৌছে যাই। উল্লেখ্য, এর পূর্বদিকে অনধিক ১০০ গজ দূরেই ‘রাবেতাতুল আলামিল ইসলামীর স্থায়ী মেহমানখানা অবস্থিত।
৮. আত-তাহরীকঃ সরকারীভাবে আয়াজিত কি কি অনুষ্ঠানে আপনারা যাগে দিয়েছিলেন?
আমীরে জামা‘আতঃ ১৩ই মার্চ মামেবার দিবাগত রাত ৯-৩০ মিনিটে আমাদের অবস্থানস্থল আল-মাহাদ আল-ইলমীর বক্তৃতা কক্ষে মেহমানদের সম্মানে আলোজজিত একটি অনুষ্ঠান হয়। সেখানে ১০-৫০ মিঃ পর্যন্ত দীর্ঘ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন সউদী আরবের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য শায়খ মুহাম্মাদ উছায়মীন। তিনি মেহমানদের বিভিন্ন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেন। তিনি তার বক্তৃতায় বিভিন্ন দেশের মুসলিম সরকার ও ইসলামী নেতৃবৃন্দকে ইসলামের স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানান এবং চেচনিয়া, বসনিয়া, কাশ্মীর প্রভৃতি অঞ্চলের নির্যাতিত মুসলিম ভাই-বোনদের সাহায্যে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তিনি বলেন, হজ ইসলামের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন সমূহের অন্যতম। বছর শেষে হজ্জের বিশ্ব সম্মেলন মুসলিম উম্মাহকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ও একটি দেহের রূপ ধারণ করার অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। আসুন! আমরা একে অপরের দুঃখ-বেদনার শরীক হই ও পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যাই। অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ইমাম মুহাম্মাদ বিন সউদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদীর (চ্যান্সেলর প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ বিন সা'দ আল-সালেম, ওয়াকীলুল জামে'আ (ভাইস চ্যান্সেলর) ডঃ সুলায়মান বিন আবদুল্লাহ আল খায়েল। ইনি পুরা মওসুম তার সহকর্মী শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে আমাদের সাথে ছিলেন। তাঁর নিরহংকর ব্যবহার আমাদের হৃদয় আকর্ষণ করে। অনুষ্ঠানে মেহমানদের পক্ষ থেকে পূর্ব নির্ধারিত একমাত্র বক্তা ছিলেন পাকিস্তানের মাওলানা এরশাদুল হক আছারী (ফায়ছালাবাদ)। শুরুতে কুরআন তেলাওয়াত করেন ইন্দোনেশিয়ার মেহমান শায়খ আমান আবদুর রহমান।
আরেকটি অনুষ্ঠান হয় হজ্জের পরের দিন ১৬ই মার্চ বৃহস্পতিবার বাদ এশা রাত্রি ৯-টায় মিনাতে মসজিদে খায়ফের নিকটস্থ একটি মিলনায়তনে। এখানে সউদী সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুফতীয় ‘আম শায়খ আবদুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ আলে শায়েখ ও ইসলামী বিষয়ক মন্ত্রী ডঃ ছালেহ বিন আবদুল আযীয আলে শায়েখ বক্তব্য রাখেন। মাননীয় মন্ত্রী স্বীয় বক্তৃতায় বিশ্বের সর্বত্র ইসলামের সঠিক আকীদার প্রচার ও প্রসারে সউদী সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ব্যাখ্যা ও এ ব্যপারে বিশ্বের ইসলামী নেতৃবৃন্দের সহযোগিতা কামনা করেন। অতঃপর মাননীয় গ্রান্ড মুফতী স্বীয় স্বভাবসুলভ হাস্যোজ্জ্বল ও ওজস্বিনী বক্তৃতায় আল্লাহর মেহমানদেরকে পবিত্র ভূমিতে স্বাগত জানান এবং ছহীহ শুদ্ধভাবে হজ্জ সমাপনে। সরকারীভাবে বিভিন্ন প্রচেষ্টা ব্যাখ্যা করেন। এই অনুষ্ঠানে মেহমানদের পক্ষ হ’তে বক্তব্য রাখেন কম্বাডডিয়ার সিনেটর ও সে দেশের সর্বোচ্চ ওলামা পরিষদের সদস্য মুহাম্মাদ। মারওয়ান ও শুরুতে কুরআন তেলাওয়াত করেন চীনের মঙ্গোলিয়া মসজিদের ইমাম ও খত্বীব শায়খ আইয়ুব যাকারিয়া।
আরেকটি অনুষ্ঠান ছিল একই দিনে বাদ যাহের মিনাতে। বাদশাহ ফাহদের বাড়ীতে। যেখানে বাদশাহ স্বয়ং ছিলেন বলে শুনেছি। বিভিন্ন দেশের মন্ত্রী ও এম, পিরাই মূলতঃ সেখানে যোগদান করেন। আমাদের কাফেলা থেকে শ্রীলংকার দুই প্রতিমন্ত্রী ও মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী এম,পি সেখানে দাওয়াত পেয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ কারণে উনি অনুষ্ঠানের শেষে গিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। ১৮ই মার্চ শনিবার বাদ যোহর মিনা থেকে মক্কায় ফিরে আসার দিন আমরা ১২টার দিকে পুরা কাফেলা মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলরের নেতৃত্বে শায়খ মুহাম্মাদ উছায়মীন ও মুফতীয়ে ‘আম শায়খ আবদুল আযীয আলে শায়খের তাবুতে গিয়ে তাদের সাথে বিদায়ী সাক্ষাত ও দো'আ নিয়ে আসি। অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে এই বিদায়ী অনুষ্ঠান ছিল সত্যিই স্মরণীয়।
আরেকটি বিষয় আমার নিকটে বড় করুণভাবে ধরা পড়েছিল। সেটা হল ঐদিন শেষ পাথর মারার পরে বিদায়ী জনতার বিরাট ঢল। যদিও আগের দিন পাথর মেরে সন্ধ্যার পূর্বেই অনেকে মক্কায় চলে গিয়েছিলেন। প্রচন্ড ভিড়ে গাড়ী চলা মুশকিল। আমাদের গাড়ীরও একই অবস্থা। সাথে ছিল মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্নেহাস্পদ মিয়া হাবীবুর রহমান, মুশফিকুর রহমান, আখতার ও নছরতুল্লাহ। সিদ্ধান্ত নিলাম হেঁটেই চলে যাব মক্কায়। ৯ কিঃমিঃ পথ এমন কোন ব্যাপার নয়। তাই-ই করলাম। ওদের সাথেই চললাম। মক্কা মুখী জনতার স্রোত এগিয়ে চলেছে পায়ে হেঁটে। সরকারের পক্ষ থেকে হাঁটা পথের উপর দিয়ে পুরা রাস্তা টিনশেড দেওয়া আছে। যাতে রোদে-বৃষ্টিতে হাজী ছাহেবদের কষ্ট না হয়। গাড়ী চলার পথ আলাদা। পিছন দিকে তাকিয়ে বড় খারাব লাগল ঐ সময়। হায় মিনা! সব মিলে এক সপ্তাহ হবে না, তোমার বুকে ছিল সারা বিশ্বের লাখ লাখ মুমিনের ঈমানী পদচারণা। সেই সাথে হাযার হাযার সর্বাধুনিক গাড়ীর ব্যস্ত ও ধীর পরিচালনা। অথচ নেই কোন হর্ণের শব্দ দূষণ, নেই ট্রাফিক পুলিশের অযথা বাড়াবাড়ি। অনিচ্ছাকৃত ক্রটি ঘটলেই প্রত্যেকে সাবধান হয়ে যাচ্ছে। বান্দা ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে নিজের জীবনের এই শ্রেষ্ঠ ইবাদতকে নিষ্কলুষ করার চেষ্টা সবারই। হায় মিনা! তুমি আজ খালি হয়ে যাবে আগামী এক বছরের জন্য। তামোর শূন্য বুকে তৃষিত মুমিনের ঈমানী বারি সিঞ্চন প্রতি বছর বৃদ্ধি পাক- এই দোআ করি।
৯. আত-তাহরীকঃ আপনারা কখন মদীনায় গেলেন ও সেখানে কি কি দেখলেন জানাবেন কি?
আমীরে জামাআতঃ ১৯শে মার্চ রবিবার দিবাগত রাত সাড়ে ৮ টার দিকে আমরা মক্কা থেকে বাসে রওয়ানা দিয়ে রাত ১ টার দিকে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গেষ্ট হাউসে পৌছি। সোয়া চারশ কিঃমিঃ রাস্তা রাতের বেলা দিন মনে হয়। উষ্ণ অঞ্চল হওয়ার কারণে আরবরা রাতের বেলা কাজ করে বেশী। বাস থেকে নেমেই হাবীব ও আবদুল হাইকে পেয়ে গেলাম। প্রাটোকলে বাধা দিলেও ওদের ভিতরে ঢাকোর অনুমতি আদায় করা গেল। সেবা-যত্নের সব ব্যবস্থা থাকলেও তাদেরকে পেয়ে নিজ বাড়ীর মত মনে হ’তে লাগল। পরে মুশফিক, আখতার সহ অন্যান্য দেশী ছেলেরাও আসল। ওরা তাদের কক্ষে দাওয়াত দিল। সেখানে পেয়ে গেলাম প্রিয় বন্ধু আবদুল মতীন সালাফীকে। ইতিপূর্বে মিনা ও মক্কাতে তার সাথে সাক্ষাত হয়েছিল। তাঁর পুত্র মতীউর রহমান বাপের মতই স্মার্ট হয়েছে। সে বর্তমানে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ণরত। পিতা আবদুল মতীন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফারেগ হয়েছেন ১৯৮০ সালে। রাতে বাংলাদেশী আহলেহাদীছ ছাত্ররা আমাকে ও জনাব যিলুল বাসেতকে নিয়ে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান করল। পরদিন সকালে আমরা দু’জনসহ মাওলানা সাঈদী ও মাওলানা আবুল কালাম আযাদকে নিয়ে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার ছাত্ররা আরেকটি সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান করল। দুঃখের বিষয় মাওলানা আবুল কালাম অসুস্থ হয়ে পড়ায় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
কি কি দেখলামঃ
(১) প্রথম দিনই অর্থাৎ ২০শে মার্চ সোমবার সবাইকে হারাম থেকে ৩ কিঃ মিঃ দূরে শোহাদায়ে ওহোদ (مقبرة الشهداء) যিয়ারতের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। ওহাদে পাহাড়ের পাদদেশে ওহাদে যুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই কবর স্থানে শুয়ে আছেন সাইয়িদুশ শুহাদা রাসুল (ছাঃ)-এর চাচা বীরবর হামযাহ ইবনে আব্দুল মুত্তালিব (রাঃ) ও অন্যান্য ৭০ জন শহীদ। চারদিকে পাকা পাচিল দিয়ে ঘেরা। কোন কবরের চিহ্ন নেই। দিনরাত লোক আসছে যেয়ারত করছে। এই সুবাদে সেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে শোহাদা মার্কেট। ১৯৯৩ সালে স্বস্ত্রীক হজ্জে এসে এখানে প্রিয় ছাত্র হাফেয রফীকের পারিবারিক বাসায় আমরা কয়েকদিন ছিলাম।
(২) ২১শে মার্চ মঙ্গলবার সকাল ৯-৩০ মিঃ আমাদেরকে নিয়ে যাওয়া হ’ল মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৫ কিঃমিঃ পশ্চিম-উত্তর দিকে ফাহদ-কুরআন কমপ্লেক্সে যাকে আরবীতে مجمع ملك فهد لمصحف القرانالكريم বলা হয়। ১৪০৫ হিজরীতে বাদশাহ ফাহদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই বিরাট কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠিত হয়। নিরব-নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশে রকমারি ঘাস ও ফুলগাছের মধ্যে পানির ফোয়ারা মিলিয়ে এলাকাটিকে মনোমুগ্ধকর করে তুলেছে। এযাবত দেড় কোটি মুছহাফ মুদ্রিত হয়েছে। তন্মধ্যে ১ কোটি ৩০ লক্ষ কপি কেবল হাজী ছাহেবদের মধ্যেই বিতরণ করা হয়েছে। বাকী ২০ লক্ষ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের মাধ্যমে। যাগ্যে নিরীক্ষকদের দ্বারা নিরীক্ষিত হওয়ার ফলে এযাবত মুদ্রণে কোন ভুল ধরা পড়েনি। একবার মাত্র একটা ش (শীন) س (সীন) হয়েছিল। এখানে ছুটির দিন ব্যতীত সর্বদা ২৪ ঘন্টা কাজ চলে। সর্বশেষ আধুনিক প্রযুক্তির সফল ব্যবহারে কমপ্লেক্সটি সদা তৎপর ও আকর্ষণীয়। মুদ্রণ ছাড়াও ক্যাসেট বিভাগ থেকে সর্বদা কুরআনের ক্যাসেট করা হচ্ছে ও তা বিতরণের জন্য প্রস্ত্তত করা হচ্ছে।
৩. হারামে মদীনার সম্প্রসারণ কর্মসূচীঃ
(১) মসজিদে নববী (ছাঃ) : বাদশাহ ফাহদের আমলে বর্তমানে মসজিদে নববীর আয়তন বহুগুণ বেড়েছে। ১৪০৬ হিঃ মোতাবেক ১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাস থেকে মসজিদে নববীর সম্প্রসারণ কর্মসূচী শুরু হয়। যদিও ১৯৮৪-এর নভেম্বরে এই কর্মসূচীর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। মসজিদে নববীর শুরু থেকে এযাবত কাল পর্যন্ত সম্প্রসারণের ইতিহাস এক নযরে নিম্নরূপঃ
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে খায়বার যুদ্ধের পরে ৭ম। হিজরী সনে ২,৪৭৫ বর্গমিটার ।
(২) ওমর ফারুক (রাঃ)-এর সময়ে ১৭ হিঃ ১,১০০ ,,
(৩) ওছমান গণী (রাঃ)-এর সময়ে ২৯-৩০ হিঃ ৪৯৬ ,,
(৪) উমাইয়া খলীফা ওয়ালীদ বিন আব্দুল। মালিক-এর সময়ে ৮৮-৯১ হিঃ ২,৩৬৯ ,,
(৫) আববাসীয় খলীফা মাহদী-এর সময়ে ১৬১-১৬৫ হিঃ ২,৪৫০ ,,
(৬) সুলতান আশরাফ কাবতাঈ-এর সময়ে ৮৮৮ হিঃ ১২০ ,,
(৭) ওছমানীয় খলীফা সুলতান আব্দুল মজীদ-এর সময়ে ১২৬৫-৭৭ হিঃ ১,২৯৩ ,,
(৮) বাদশাহ সউদ বিন আবদুল আযীয-এর সময়ে ১৩৭২ হিঃ ৬,০২৪ ,,
(৯) বাদশাহ ফাহদ বিন আবদুল আযীয-এর সময়ে ১৪০৬ হিঃ ৮২,০০০ ,,
বর্গফুটের হিসাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে গড়া মসজিদে নববীর আয়তন ছিল ২৪৭৫ বঃমিঃ × ১০.৭৬৪ বঃফুঃ = ২৬,৬৪০.৯ বর্গফুট। তার সাথে এযাবত যোগ হয়েছে মোট ৯৫,৮৫২ বঃমিঃ। যা একত্রে ৯৮,৩২৭ বঃমিঃ হয়। এক্ষণে বর্গফুটের হিসাবে বর্তমান আয়তন দাঁড়াবে ১০,৫৮,৩৯১.৮ বর্গফুট। এযাবত বৃদ্ধি ৯৫,৮৫২ বর্গ মিটারের মধ্যে কেবল সউদী শাসনামলেই বৃদ্ধি পেয়েছে ৮৮,০২৪ বঃমিঃ। এতদ্ব্যতীত বর্তমানে উক্ত মূল মসজিদ ও তার ভালো আঙিনা সমেত সর্বমোট আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩,০৫,০০০ বর্গ মিটার বা ৩২,৮৩,০২০ বর্গফুট। এখানে আঙিনাসহ স্বাভাবিক অবস্থায় ৬,৫০,০০০ মুছল্লী ছালাত আদায় করে থাকেন এবং রামাযান ও হজ্জ মওসুমে ১০ লক্ষাধিক মুছল্লী একত্রে ছালাত আদায় করতে পারেন।
এই বৃদ্ধির সাথে সত্বর যোগ হ’তে যাচ্ছে আরও ২,০৬,০০০ বর্গমিটার এলাকা। যেখানে আরও ৪ লক্ষ মুছল্লীর স্থান সংকুলান হবে। যার চারপাশে দেওয়াল ও দরজা বসানো ছাড়াও ইসলামী স্থাপত্য অনুযায়ী রঙ্গীন মার্বেল পাথর ও গ্রানাইট পাথর বসানোর কাজ সত্বর শেষ হবে। চারদিকে খেজুরের গাছও লাগানো হবে।
(২) মিনারঃ নতুন বৃদ্ধিতে প্রত্যেক স্তম্ভের উপরে মিনার রয়েছে। এছাড়াও উত্তর দিকের মধ্যবর্তী বাদশাহ ফাহদ গেইটের দু’টি মিনার সহ প্রধান ৬টি মিনারের প্রতিটির উচ্চতা উপরের বাকা চাদসহ ১০৪ মিটার। বাঁকা চাঁদগুলির প্রতিটির উচ্চতা ৬ মিটার এবং ওযন ৪.৫ টন। ব্রোঞ্জ নির্মিত এই চাঁদগুলির প্রতিটি ২৪ ক্যারেট-এর স্বর্ণ দ্বারা মোড়ানো।
(৩) গেইট সমূহঃ ৩টি উত্তর দিকে এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ২টি করে মোট ৭টি প্রধান গেইট রয়েছে। প্রতিটির কাছাকাছি দু’পাশে ৭টি করে দরজা রয়েছে। প্রতিটি দরজার উচ্চতা ৬ মিটার ও প্রস্থ ২ মিটার। এছাড়া দক্ষিণ দিকে ২টি পৃথক প্রবেশপথ রয়েছে। যার প্রতিটির সাথে তিনটি করে দরজা রয়েছে। এভাবে পুরা হারামের বর্তমান দরজা সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৮৫টি।
হারামে মদীনার বর্তমান আয়তন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সময়কার পুরা মদীনা শহর জুড়ে নিয়েছে বলে গাইডগণ আমাদের জানালেন। ‘যাওরা’ বাজারের অবস্থান সম্পর্কে তাদের জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু তারা বলতে পারলেন না।
(৪) বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রঃ কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের সাথেই ৮টি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। যার প্রতিটি ২.৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সম্পন্ন। এগুলির স্রেফ মসজিদে নববীতে ও তার আনুসঙ্গিক ট্যাঙিষ্ট্যান্ড ইত্যাদিতে সাময়িক লোডশেডিংয়ের সময় যরূরী অবস্থায় বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্যই তৈরী করা হয়েছে।
(৫) কৃত্রিম পাথর তৈরী কারখানাঃ মদীনা তাইয়েবা থেকে ২০ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত এই কারখানাটির কাঁচামাল ও অধিকাংশ প্রযুক্তি সউদী আরবের নিজস্ব। এখানে (বছরে) ৫ লক্ষ ও উন্নতমানের কৃত্রিম পাথর তৈরী হয়। যা বর্তমান বিশ্বের সেরা পাথর তৈরী কারখানা হিসাবে বিবেচিত। মক্কা ও মদীনার দুই হারামের চতুরে বিছানাসোদা ও পুরু মার্বেল পাথরগুলির উপরে প্রচন্ড রোদের সময় খালি পায়ে চললে তাতে ঠান্ডা অনুভূত হয়। অথচ অন্য পাথরে খালি পা রাখার প্রশ্নই ওঠেনা। ঐসময় পার্শ্ববর্তী পাহাড়গুলির দিকে তাকানাযোয় না। মনে হয় যেন অসহ্য রৌদ্রতাপে পাহাড়গুলি থরথর করে কাঁপছে। কৃত্রিমভাবে তৈরী ঐসব উন্নত মানের পাথরের বদৌলতেই আজ লাখ লাখ মুছল্লী নির্বিঘ্নে সেখানে ছালাত আদায়ে সক্ষম হচ্ছে ও কা'বা চত্বরের মাত্রাফে খোলা আকাশের নীচে দিন-রাত সর্বদা ত্বাওয়াফ করতে পারছে।
(৬) চলমান গুম্বজঃ নীচে কারুকার্য খচিত পাথর ও উপরে সিরামিক এবং মধ্যে বিশেষ ধরনের কাঠ দিয়ে তৈরী ২৭টি চলমান গুম্বজ রয়েছে। যা দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে ১৮×১৮ বঃ মিঃ ও উচ্চতায় ১৩ মিটার এবং প্রতিটির ওযন ৮০ টন। যা মাত্র ৪টি চাকার উপরে চলাচল করে। মসজিদের ভিতরকার আবহাওয়া নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে গুম্বজ নিঃশব্দে সরে যাচ্ছে। আবার পূর্বের স্থানে ফিরে আসছে। পুরা গুম্বজটি সরে যেতে মাত্র ৬০ সেকেন্ড সময় লাগে। মাথার উপরে তখন থাকে কেবলই নীলাকাশ। পরক্ষণেই আবার বন্ধ হয়ে গেল। একটু আগে যে এখানে শূন্য ছিল সেকথা কল্পনা করতেও তখন কষ্ট লাগে।
(৭) ছাতাঃ মসজিদের মাঝামাঝি রয়েছে ৬টি অটোমেটিক Fire Proof ছাতা। যা ইচ্ছামত খোলা ও বন্ধ করা যায়। আমাদেরকে গুম্বজ ও ছাতার ব্যবহার দেখানো হ'ল। বাদশাহ ফাহদ নিজে এসে বহু সময় বসে থেকে পুরা সিস্টেম তদারক করেছেন।
(৮) ট্যাঙি স্ট্যান্ডঃ মূল মসজিদ বাদ দিয়ে আঙিনার নীচে আধুনিক কম্পিউটারাইজড দোতলা ট্যাঙি স্ট্যান্ড রয়েছে। যার আয়তন ২,৯২,০০০ বর্গ মিটার। যেখানে একত্রে মাটে। ৪৫০০ ট্যাঙি দাঁড়াতে পারে। উপরতলায় তিনটি ও নীচতলায় তিনটি মোট ছয়টি প্রবেশ ও বহির্গমন পথ রয়েছে। প্রত্যেক গাড়ীর জন্য পৃথক পার্কিং নম্বর রয়েছে। অগ্নি প্রতিরোধের এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে, এক এলাকায় আগুন ধরে গেলে অন্য এলাকায় যেতে পারবে না। কোন গাড়ীতে আগুন ধরে গেলে ছাদ থেকে এমন ব্যবস্থা রয়েছে। যে, মুহুর্তের মধ্যে গাড়ীটিকে একদিকে সরিয়ে নেবে ও আগুন নিভিয়ে দেবে। আন্ডার গ্রাউন্ড এই ট্যাঙি স্ট্যান্ড ২৪ ঘন্টা খোলা থাকে। পৃথক আরেকটি ট্যাঙি স্ট্যান্ড দর্শনার্থী, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও কর্মকর্তাদের অফিস সংলগ্ন স্থানে রয়েছে।
(৯) টয়লেটঃ ট্যাঙি স্ট্যান্ডের সাথেই ওযু-গাসেল ও পেশাব-পায়খানার তিনতলা বিশাল এলাকা রয়েছে। যেখানে বর্তমানে ২৫০০ বাথরুম রয়েছে। আরও রয়েছে। পৃথকভাবে ৬৮০০ ওযূর ট্যাপ ও ৫৬০টি পানি পানের ট্যাপসমষ্টি। যার প্রতিটিতে অনধিক ১০টি ট্যাপ সংযুক্ত রয়েছে। রয়েছে উঠানামার জন্য ৩০টি চলন্ত সিঁড়ি। স্রেফ । সিঁড়িতে দাঁড়ালেই সোজা নেমে যাবে টয়লেটের সামনে এবং উঠে আসতে পারবে একইভাবে। ইচ্ছা করলে এটি দিয়ে নীচে ট্যাঙি স্ট্যান্ডে ও যাওয়া যাবে।
(১০) কন্ট্রোল রুমঃ হারামের পুরা ইলেকট্রিক সিস্টেম, কম্পিউটার ও মাইক্রোফন ইত্যাদি হারামের নীচে অবস্থিত একটি কন্ট্রোল রুম থেকে মাত্র তিনজনের হাতে নিয়ন্ত্রিত হয়। মসজিদে কে কোন দরজা দিয়ে কিভাবে প্রবেশ করল। সব ওখানকার টিভি পর্দায় ভেসে উঠছে ও রেকর্ড হয়ে থাকছে। বলা আবশ্যক যে, বর্তমানে মক্কা ও মদীনার দুই । হারামের ইলেকট্রিক সিস্টেম বিশ্বের সবচাইতে সেরা।
(১১) দুরূসঃ হারামের মধ্যে ২৭টি দরস-এর স্থান রয়েছে। যেখানে যোগ্য প্রশিক্ষক দ্বারা নির্দিষ্ট সময়ে সর্বদা দ্বীনের তালীম চলছে। মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও হারামের যোগ্য ইমামগণ মূলতঃ এ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। হজ্জের মৌসুমে জামে'আর বিভিন্ন ভাষার ছাত্ররা হারামের আঙিনাতে এ দায়িত্ব অতিরিক্তভাবে পালন করেন।
(১২) স্বর নিয়ন্ত্রণঃ ইমামের গলার স্বর নিয়ন্ত্রণের জন্য কেন্দ্রীয় ভাবে মাইক্রোফন নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রয়েছে। যাতে মুছল্লীদের কিরাআত শুনতে ও বুঝতে কোন অসুবিধা না হয়।
(১৩) যমযমের পানিঃ মক্কা থেকে যমযমের পানি নিয়মিত সরবরাহের জন্য শত শত পানির ট্যাংকার মক্কা ও মদীনার মধ্যে সর্বদা পানি পরিবহণ করে থাকে। পাইপ লাইন বসানারে পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানা গেল।
(১৪) শীতাতপ নিয়ন্ত্রণঃ সবচাইতে আশ্চর্যজনক ও গুরুত্বপূর্ণ যে স্থাপনা, সেটি হ’ল হারামের শীতাতপ। নিয়ন্ত্রণ প্রজেক্ট'। যেটি হারাম থেকে পশ্চিমে ৭ কিলামমিটার দূরে ওহাদে হাসপাতালের সাথে সংলগ্ন। যা মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পশ্চিম-দক্ষিণ কোণে দুই কিলামমিটার দূরে অবস্থিত এবং যার আয়তন ৭০,০০০ । বর্গমিটার। ১৯৯২ সালে এটি চালু হয়েছে। এখান থেকেই পুরা হারামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখানে সর্বদা পানি ঠান্ডা ও গরম করা হয়ে থাকে। এত দূরে আনার কারণ হল, এখানকার আবহাওয়া অত্যন্ত স্বচ্ছ ও নির্দোষ। বৃহদাকারের সর্বাধুনিক ৬টি এয়ারকন্ডিশন মেশিন রয়েছে। প্রতিটি মেশিনের পানি ঠান্ডারণ ক্ষমতা ৩,৪০০ টন। তন্মধ্যে মাত্র ১টি মেশিন চালু আছে। বাকীগুলি প্রস্ত্তত রাখা হয়েছে। যাতে প্রথমটি খারাব হলে পরেরটি সাথে সাথে চালু করা যায়। কিন্তু সুখের কথা এই যে, ১৯৯২ সালে চালু হবার পর থেকে এযাবত ১ নং মেশিনটিই কাজ করছে। যা কখনাববিকল হয়নি বা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণেও কখনো এক সেকেন্ডের জন্য ব্যত্যয় ঘটেনি। ফালিল্লাহিল হামদ।
উক্ত মেশিনে এমন সিস্টেম করা আছে যে, গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের মৌসুম এবং সকাল-দুপুর-রাত্রি সময় বিবেচনা করে হারামের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করা হয়। যাতে মুছল্লীদের অধিক ঠান্ডায় সর্দি-কাশিতে কষ্ট না পেতে হয়। মেশিনটি ২৪ ঘন্টা একটানা চালু থাকে এবং ১০,০০০ ঘনফুট পানি সর্বদা ঠান্ডা হয়ে থাকে। এতদ্ব্যতীত মসজিদে নববীর নীচে ৭৩,৫০০ বর্গমিটার এলাকা জুড়ে যে বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, সেখানে ১৪৩টি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ মেশিন রয়েছে। যা সর্বদা মসজিদের ভিতরকার আবহাওয়া ঠিক রাখার কাজে তৎপর রয়েছে। উক্ত পানি পাইপ লাইনে সরবরাহের জন্য ৬টি শক্তিশালী মাটের রয়েছে। যার প্রতিটি ৪৫০ অশ্ব শক্তি সম্পন্ন। ৭ কিঃ মিঃ দীর্ঘ টানেলটির উচ্চতা ৪ মিটার ও প্রশস্ততা ৬ মিটার। বিশাল এই প্রজেক্টটি প্রস্ত্তত করতে সময় লেগেছে। কয়েক বছর। হাজীদের সেবায় বাদশাহ ফাহদের এটি একটি অনন্য অবদান বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়\ (সরকারী গাইডগণের মৌখিক বক্তব্য এবং মসজিদে নববী সম্প্রসারণ প্রকল্পের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাজমূ'আ বিন লাদেন আস-সাউদীয়াহ কর্তৃক প্রকাশিত তথ্যাবলীর আলাকে লিখিত)।
সরকারীভাবে পরিদর্শন শেষে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র স্নেহাস্পদ আবদুল হাইকে সাথে নিয়ে হারামে এদিন ২১শে মার্চ মঙ্গলবার আছরের ছালাত আদায় করলাম। অতঃপর তাকে সাথে নিয়ে বাকী গোরস্থান যেয়ারত করলাম। এখানে অসংখ্য ছাহাবী-তাবেঈ, মুজতাহিদ ইমাম ও বিদ্বানগণের কবর রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এখানে গিয়ে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে যেয়ারত করতেন ও চোখের পানি ফেলতেন।
(১৫) বাক্বী গোরস্থান (بقيع الغرقد) হারামের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে প্রায় এক মাইল ব্যাসার্ধ নিয়ে পাকা প্রাচীরে ঘেরা। যা মদীনার কেন্দ্রীয় কবরস্থান হিসাবে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে। ‘গারক্বাদ’ নামক স্থানটি জনৈক ইহুদীর খেজুর বাগান ছিল ও নিম্নভূমি ছিল। নিম্নভূমিকে বাকী (بقيع) বলা হয়। ফাতেমা (রাঃ)-এর কবর সেখানে থাকায় শীআরা এই গোরস্থানের নাম দিয়েছে ‘জান্নাতুল বাকী’। হাদীছে এই নামের কোন সমর্থন নেই। এই নাম বলা মোটেই জায়েয নয়। ফাতেমা (রাঃ)-এর কবর চিহ্নিত নেই। তবে ওছমান (রাঃ)-এর কবর মদীনার স্থানীয় বিদ্বানগণ তাদের জোরালে ধারণা মতে চিহ্নিত করেছেন। যা আবদুল হাই আমাকে দেখাল ও সাথে করে বেশ ভিতরে নিয়ে গিয়ে যেয়ারত করাল।
বর্তমানে এখানে বেশ কিছু বিদ‘আত চালু হয়েছে। যেমন ফাতিমা (রাঃ)-এর কবর মনে করে একদল লোক সেখানে গিয়ে কান্নাকাটি করছে। ধূলা নিচ্ছে। ফাতিমা (রাঃ)-এর কবুতর মনে করে হাযার হাযার কবুতরকে গম বিলানো হচ্ছে। যদিও সর্বদা এর বিরুদ্ধে প্রচার চলছে। কিন্তু কথায় বলে ‘ভক্তি যেখানে অন্ধ, যুক্তি সেখানে অচল’।
(১৬) বি‘রে বিযা-‘আহ’ ((بئر بضاعة) বা ‘বিযা’-‘আহ কূয়াটি বর্তমানে হারামের উত্তর-পশ্চিম কোণে আঙিনার নীচে ঢাকা পড়েছে। উপরে কোন নিদর্শন রাখা হয়নি। ‘সাক্বীফায়ে বনী সা‘এদাহ’ যেখানে আবুবকর (রাঃ)-এর হাতে খেলাফতের বায়‘আত হয়েছিল, ঐ স্থানটি একই দিকে আঙিনার বাইরে প্রাচীরে ঘেরা আছে। যা SAPTCO বাস স্টপেজের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত।
(১৭) প্রসিদ্ধ ‘বি‘রে রূমাহ’ (بئر رومة) বা রূমা কূয়া, যা হিজরতের পরে পানির কষ্ট দূর করার জন্য হযরত ওছমান (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কথামত খরিদ করে দান করে দিয়েছিলেন। উক্ত কূয়াটি এখন ‘বিরকা’ নামে পরিচিত। এটি হারাম থেকে অল্প দূরে মসজিদে ক্বিবলাতায়েন-এর উত্তর-পশ্চিম কোণে ‘হাই আল-আযহারিয়া’র মধ্যে অবস্থিত। বর্তমানে এটি ঘিরে দেওয়া হয়েছে। সেখানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।
১০. আত-তাহরীকঃ আপনার মূল্যবান অভিজ্ঞতা আমাদের অনেক কাজে লাগবে। এর বাইরে আপনার নিজস্ব কিছু অভিজ্ঞতা থাকলে আমাদেরকে জানান, যা আত-তাহরীকের পাঠকদের উপকারে আসবে।
আমীরে জামাআতঃ কিছু ছিটেফোঁটা অভিজ্ঞতা আছে। বৈকি! যেমন ধরুন, ১৯শে মার্চ রবিবার সকালে সিদ্ধান্ত নিলাম ‘গারে হেরা’-তে যাব। শেষ নবী (ছাঃ)-এর উপরে প্রথম ‘অহি’ যেখানে নাযিল হ’ল, সেই ঐতিহাসিক ‘হেরা’ গুহা দেখব। হাদীছে পড়া নুযূলে অহি-র স্মৃতি মনমুকুরে বারবার ভেসে উঠতে লাগল। একই কক্ষে অবস্থানরত আমরা তিনজন একমত হ’লাম। বেরিয়ে পড়লাম। হারাম শরীফে যোহরের ছালাত আদায় করে পার্শ্বেই ‘ঢাকা হোটেলে’ মাথা প্রতি ৯ রিয়াল (১২২/০০ টাকা) দিয়ে বেশ কয়েক দিন পরে বাঙ্গালী রান্নায় ভাতে-মাছে রসনা পরিতৃপ্ত করে ট্যাক্সি নিয়ে বের হয়ে গেলাম ১০ কিঃ মিঃ দূরে ‘জাবালুন নূর’ বা হেরা গুহার উদ্দেশ্যে। মজার কথা হ’ল যে, গাড়ীর ড্রাইভারেরা ‘গারে হেরা’ চেনেনা, তারা স্রেফ। ‘জাবালুন নূর’ বোঝে। যথাসময়ে ট্যাক্সি থেকে নেমে পাশেই এক পানীয়ের দোকানে বসলাম। দোকানী ছেলে দুটি সিলেটের। ওরা তিনভাই এখানে আছে। পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট দোকান। ভালই বেচাকেনা। দৈনিক আমাদের মত শত শত লোক সেখানে যায়। পানির বোতল ও জুস না নিয়ে সাধারণতঃ কেউ পাহাড়ে ওঠেনা। সকালে অথবা বিকালে সবাই আসে। রাতে পাহাড়ে ওঠা নিষেধ। কিন্তু আমরা এসেছি অসময়ে বেলা আড়াইটায়।
প্রচন্ড খরতাপ। রৌদ্র ঝলসানো পাহাড়ের দিকে তাকানো যায় না। ক্রুদ্ধ পাহাড় যেন রাগে থরথর করে কাঁপছে ও ফঁসে ফুঁসে উঠছে। জনাব যিল্লুল বাসেত ছাহেব (৬০) বলেই দিলেন যে, আমার ওঠার ক্ষমতা নেই। এই দোকানেই বসে থাকব। অধ্যাপক হারূণ ছাহেব (৪৯) সাহস করে পাহাড়ের ঢালু বেয়ে কিছুদূর উঠে বললেন, আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়। আপনি যান। আমরা নীচে অপেক্ষা করছি। অগত্যা একাই আল্লাহর নাম নিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে থাকলাম। সাথে পলিথিন ব্যাগে জায়নামায ও পানির বাতেল। পেট ভরে খেয়ে কোন কষ্টের কাজ করতে নেই। গাছে বা পাহাড়ে ওঠা তো একেবারেই অন্যায়। আজ সেটা হাড়ে-হাড়ে বুঝতে থাকলাম। কিন্তু যিদ বড় বালাই। আমাকে উঠতেই হবে। যেতেই হবে সেখানে, যেখানে আমার প্রিয়নবী (ছাঃ) প্রাপ্ত হয়েছিলেন। মানব জাতির কল্যাণের জন্য সেরা সম্পদ আল্লাহর ‘অহি’। পেয়েছিলেন জিব্রীলের সাক্ষাত। শুনেছিলেন মহাবিপ্লবের মহান বারতা ‘ইকরা’ সহ মাত্র পাঁচটি আয়াত। নেমে এসেছিলেন যেখান থেকে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রিয়তমা স্ত্রী খাদীজার কাছে। এই গভীর তাৎপর্যবাহী পাচটি আয়াত নাযিলের পরে আড়াই বছরের মধ্যে আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তাই লোকেরা নবীকে বিভিন্ন কথা বলে তোহমত দিয়েছিল। সেই স্বপ্নের হেরা গুহা পর্যন্ত আমাকে যেতেই হবে...।
মাঝে দু’তিনটি ছোট স্টল সহ বিশ্রামের স্থল আছে। সেসব স্থানে বসেছি। পথিমধ্যে অনুরূপ এক স্থানে জামাআতের সাথে আছরের ছালাত আদায় করেছি। এইভাবে অবশেষে ঠিক এক ঘন্টা পরে ৪-১০ মিনিটে পাহাড়ের চূড়ায় উঠি। অতঃপর একটু নেমে হেরা গুহার মুখে পৌছে যাই। ফালিল্লা-হিল হামদ। প্রাণভরে দেখলাম ও কল্পনার চোখে হাদীছের পৃষ্ঠায় নযর রেখে চারদিকে পরখ করতে লাগলাম। নীচের দিকে তাকাতে ভয় হয়। মানুষ চেনা যায়। চলন্ত গাড়ীগুলিকে ছোট্ট ছোট্ট খেলনা গাড়ী মনে হয়। ১৪৩৪ চান্দ্র বর্ষ পূর্বে সুদূর মক্কার বনু হাশিম গোত্রপতি আবু জ্বালিবের গৃহ থেকে খাদ্য-পানীয় সাথে নিয়ে এসে এই বন্ধুর পাহাড় অতিক্রম করে এত উপরে উঠে গভীর ধ্যানে মগ্ন হওয়া ও দিনের পর দিন এভাবে অতিবাহিত করা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? মা খাদীজাই বা বৃদ্ধ বয়সে এতদূর খাদ্য-পানীয় বহন করে এনে কিভাবে স্বামীকে যোগান দিতেন। এযুগের খুব কম সংখ্যক ভাগ্যবান স্বামী-স্ত্রীই এটা কল্পনা করতে পারেন।
গুহাটির আয়তন কত জানা যায়নি। তবে সর্বোচ্চ শৃঙ্গের সামান্য নীচে এক পার্শ্বে পাহাড়ের কিনারা ঘেঁষে গুহাটির অবস্থান। ৮ হাত লম্বা ও পৌনে ৪ হাত চওড়া (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৪৭) অত্র গুহার মুখ বরাবর পাহাড়ের শৃঙ্গ উপরে উঠে গেছে। সেকারণ ঝড়-বৃষ্টি বা সূর্যতাপ সরাসরি গুহার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনা। গুহার ভিতরে অন্ধকার। গুহা মুখ দিয়ে আসা সূর্য বা চন্দ্রের আলোক আভাটুকুই ভরসা। অনুরূপ আলো-আঁধারী পরিবেশে একাকী নিঃসঙ্গ ধ্যান ও সাধনায় নিমজ্জিত হওয়া বাস্তবিকই অচিন্তনীয় ব্যাপার। তবে ধ্যানমগ্ন সাধকের জন্য এমন স্থানই কাম্য।
এখানে বেশ বড় একটা দোকান বসেছে। একজন একটি উট এনে লোকদেরকে তার পিঠে সওয়ার করিয়ে মাথা প্রতি ১০ রিয়াল করে নিয়ে বেশ পয়সা উপার্জন করছে। বুঝলাম না ঐ উট এত উপরে কেমনে উঠল। আবার নামবেই বা কেমন করে। কেননা ওঠার চেয়ে বরং নামাই বেশী ভয়ের কারণ। দেখলাম এখানেও শিরক ও বিদ‘আত আস্তানা গেড়েছে। কিছু পুরুষ ও মেয়ে লোককে দেখলাম হেরা গুহা অভিমুখে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছে। সামনে আনাড়ী হাতে পাথরের গায়ে উর্দূ টানে লেখা ‘আল্লাহ’ ও ‘মুহাম্মাদ’। সেখানে লোকেরা কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে। বরকত মনে করে ছোট্ট ছোট্ট পাথর কুড়িয়ে ব্যাগ ভরছে। অন্যদিকে চলছে গুহায় ঢোকার প্রাণান্তকর কোশেশ। এই দৃশ্য দেখে আমি গুহায় প্রবেশের ইচ্ছা বাদ দিয়েই ফিরে এলাম। ফেরার পথে মাত্র ৪০ মিনিটে ও সর্বসাকুল্যে ১ ঘন্টা ৫০ মিনিটে ‘হেরা’ ভ্রমণ সমাপ্ত করে নীচে অপেক্ষমান সাথীদের কাছে ফিরে এলাম। ফালিল্লা-হিল হামদ। পাহাড়টি যে কত ফুট উঁচু সে তথ্য পাইনি। তবে যথেষ্ট উঁচু এবং আশপাশের সমস্ত পাহাড় থেকে উঁচু।
(খ) মুযদালিফা পাহাড়ঃ ১৫ই মার্চ বুধবার হজ্জের দিন বাদ মাগরিব আমরা মুযদালিফা পৌছে মাগরিব ও এশার ছালাত জমা করে পড়ে বসে আছি। এমন সময় নযর পড়ল যে, সারা পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য সাদা মানুষ। জোরালো বিদ্যুতের আলোয় ঝলকানো পাহাড় গাত্রে সাদা কাপড়ের এহরাম পরা মানুষগুলো যেন আলোর বন্যায় একটা একটা মুক্তা বিন্দু। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (৫৩) ও মাওলানা সাঈদী ছাহেব (৬০) আমাকে উদ্বুদ্ধ করলেন। দেখুন তো লোকগুলো এত গভীর মনোনিবেশ সহকারে পাহাড়ের গায়ে কি কুড়াচ্ছে? হাতে রক্ষিত ছোট টর্চ লাইট মাঝে মধ্যে জ্বলে উঠছে। ব্যাপারটা কি? দেখছি মেয়েরাও আছে। মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগল। ভাই অধ্যাপক হারূণকে সাথে নিয়ে চললাম। পাহাড় বেয়ে কিছু দূর উঠেই একজন শিক্ষিত চীনা মুসলমানকে পেয়ে গেলাম। ভদ্রলোক অতি আগ্রহের সঙ্গে পাহাড়ের গা খুঁচে খুঁচে পাথরের ২১টি। বিশেষ ধরনের টুকরা সংগ্রহ করছেন, যা তিনি আগামী কাল থেকে প্রতিদিন ৭টি করে তিন দিন শয়তান মারার। কাজে ব্যবহার করবেন। ইংরেজীতে প্রশ্নোত্তরে তিনি বুঝালেন যে, শয়তান মারার জন্য সমস্ত পাথর এখান থেকেই নিতে হবে এবং তার ধরন হবে এমন যে, তা কয়েকটি ছোট্ট ছোট্ট ও চকচকে কুচি পাথরের যুক্ত সমষ্টি হবে। যা মাটিতে জোরে নিক্ষেপ করলে চূর্ণ হয়ে ছড়িয়ে যাবে।
তার বক্তব্যে আমরা হতবাক হ’লাম। কেননা হাদীছে এসবের কোন সমর্থন নেই। মুযদালিফা থেকে বা যেকোন স্থান থেকে ছোট্ট ছোট্ট কুচি পাথর ২১টি নিলেই হ’ল। কিন্তু কে শোনে কার কথা। আমাদের পরিচয় পেয়ে তিনি খুশী হয়ে কয়েকটি দিলেন। যার একটা আমি সাথে এনে বাসায় রেখেছি। দেখলাম তাওহীদ ও সুন্নাতের এত ব্যাপক প্রচার সত্বেও বিদ‘আতীদেরই জয়জয়কার সর্বত্র। জাহেলিয়াত গ্রাস করে নিচ্ছে সমস্ত পৃথিবীকে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। আমীন!!
মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের হজ্জব্রত পালনঃ একটি সাক্ষাৎকার
যা মাসিক, আত-তাহরীকের ৩টি সংখ্যায় পর পর প্রকাশিত হয়েছে