(১) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : কখন কিভাবে আপনার সাংগঠনিক জীবনের যাত্রা শুরু হয়?
আমীরে জামা‘আত : সাংগঠনিক জীবন বলতে যেটা বুঝায়, তার সূচনা হয়েছে খুলনা এম এম সিটি কলেজে ডিগ্রীর ছাত্র থাকা কালে ১৯৭৪ সালে ‘আঞ্জুমানে শুববানে আহলেহাদীছ’ গঠনের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৮ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারীতে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ নামে ঢাকা থেকে যার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। আলহামদুলিল্লাহ, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
(২) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠনের স্বপ্ন দেখেন কোন ঘটনার প্রেক্ষিতে?
আমীরে জামা‘আত : প্রত্যেক কাজের পিছনে কিছু পরোক্ষ ও কিছু প্রত্যক্ষ কারণ থাকে। এখানেও সেটা ছিল। পরোক্ষ কারণ ছিল বিরূপ রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিবেশে খাঁটি ইসলামের প্রচার ও প্রসারে হৃদয়ের ব্যাকুলতা। যেজন্য ছাত্র জীবনে বিভিন্ন দল আমাকে তাদের মধ্যে ভিড়াতে চাইলেও অন্তর থেকে কখনো সাড়া পাইনি। আর প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসিন হলে (১৯৭৬-৭৭) এক বছরের জীবনে ঘটে যাওয়া পরপর কয়েকটি ঘটনা। যেমন-
(১) একদিন পত্রিকায় দেখলাম জাসদ ছাত্রলীগ সরকারের কাছে দাবী করেছে রাজধানীর মোড়ে মোড়ে নেতাদের মূর্তি স্থাপন করতে হবে। আমি এর প্রতিবাদে পত্রিকায় স্বনামে বিবৃতি দিলাম। ওরা আমাকে শাস্তি দেবার জন্য আমার ৫৩৮ নং রুমে এল। কিন্তু আমাকে না পেয়ে আমার রুমমেটকে মারপিট করে মাথা ন্যাড়া করে মুখে চুনকালি মাখিয়ে গলায় টিন ঝুলিয়ে সারা ক্যাম্পাস ঘুরায়। আমি ঐদিন সকালে যাত্রাবাড়ী গিয়েছিলাম। সেখানে ড. রহমানী স্যার আমাকে বললেন, তোমার হলে কিয়ামত হয়ে গেল, তুমি কিছুই খবর রাখ না? বিকালে ফিরে এলে গার্ড আমাকে নিষেধ করে বলল, ভাই আপনাকে পেলে ওরা শেষ করে ফেলবে। আপনি ভিতরে যাবেন না। আমার যিদ চাপল। বললাম, ওরা কোন রুমে থাকে জানো? বলল, ৩৪৮ নম্বরে। সোজা উঠে গেলাম তিন তলায়। সিঁড়ির মুখেই এদের রুম। ভিড়ানো দরজা ঠেলে ঢুকেই সালাম দিলাম। নেতারা সব বসে আছে। আমাকে দেখেই হতবাক। অবশেষে বসতে বলল। বললাম, আমাকে না পেয়ে নিরীহ ছেলেটাকে মেরেছেন। কি অপরাধ আমাকে বলুন? নেতা ফেরদৌস বলল, আপনি প্রতি বৃহস্পতিবারে মসজিদে তাফসীর করেন। আপনার ব্যাপারে আমাদের ভাল ধারণা ছিল। কিন্তু আপনি হঠাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেন কেন? বললাম, আমি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেইনি। বরং মূর্তি বানানোর বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছি। আর মূর্তিপূজা ইসলামে নিষিদ্ধ। সে বলল, পীরপূজা, কবরপূজা কি তাহলে সিদ্ধ? আমি বললাম, না। এসময় আমি তাকে রবীন্দ্রনাথের একটা কবিতা শুনিয়ে দিলাম-‘রথ যাত্রা সমারোহ মহা ধূমধাম। ভক্তেরা সব লুটায়ে শির করিছে প্রণাম। রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি। মূর্তি ভাবে আমি দেব, হাসে অন্তর্যামী’। রবীন্দ্রনাথ মূর্তিপূজা পসন্দ করতেন না। আপনারা কেন করেন? তারপর ওকে যুক্তি দিয়ে বুঝালাম, নিষ্প্রাণ একটা মূর্তির চাইতে জীবন্ত একটা মানুষের মূল্য কি অধিক নয়? একটা মূর্তি তৈরী, স্থাপন, রক্ষণাবেক্ষণ ও বছরের পর বছর ধরে তার সংরক্ষণ ও মাল্যদানে কত পয়সা ও সময় অনর্থক ব্যয় হবে ভেবেছেন কি? ঐ মূর্তিটির মাথায় যখন কাক পায়খানা করবে ও পায়ে কুকুরে পেশাব করবে, তখন আপনার কেমন লাগবে? এই মূর্তিগুলোর জন্য ঢাকা শহরের কত মূল্যবান জমি ব্যয় হবে চিন্তা করেছেন কি? যদি বলেন, শ্রদ্ধা নিবেদন, তাহলে বলব সেটা তো অন্তরের ব্যাপার! তাতে লোক দেখানো কিছু থাকলে তো সেটাকে প্রকৃত অর্থে শ্রদ্ধা প্রদর্শন বলা যায় না। বরং ঐ সব ত্যাগী নেতাদের ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে দেশ ও জনগণের সেবা করাটাই তো তাদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন হবে। আর এ জন্যই তো নবী রাসূলদের কোন মূর্তি দুনিয়াতে নেই। অথচ তাঁরা সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। সর্বোপরি এই মূর্তির জন্য পরকালে আমাদের জাহান্নামের আগুনে পুড়তে হবে। এরপরও কি বলবেন আমরা এটা করতে পারি?’ তখন সে বলল, আমি করাচী ইউনির্ভাসিটিতে পড়ার সময় ওখানে একদল লোককে দেখেছি, যাদেরকে ‘আহলেহাদীছ’ বলা হত। ওরা এসবের বিরুদ্ধে বলত। বন্ধুরা বলত, ওরা লা-মাযহাবী। তবে ওরাই খাঁটি মুসলমান। বাংলাদেশে কি এ দল নেই? বললাম, আছে। বলেই আর এগোলাম না। কারণ ড. বারী ছাহেবকে ওরা ‘রাযাকার’ বলে। আমার কথায় তারা এমনই প্রভাবিত হল যে, কোন দ্বিরুক্তি করার সুযোগ পেল না। আমি নিরাপদে রুমে ফিরে এলাম।
(২) তাবলীগ জামা‘আতের ছাত্ররা একদিন ফজর বাদ দাঁড়িয়ে বলল, ছাত্র ভাইয়েরা! আসুন আমরা সবাই মিলে ৪১ বার সূরা ইয়াসীন খতম করি। তাতে আমাদের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। আগামী সপ্তাহে আমাদের অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। আমরা যেন সবাই ফার্ষ্ট ক্লাস পাই। আসুন আমরা সেজন্য সূরা ইয়াসীন খতম করে দো‘আ করি। এরপর সবাই পড়া শুরু করল। কিছু পরে ওদের একজন প্রত্যেকের কাছে গিয়ে চুপে চুপে জিজ্ঞেস করতে লাগল, আপনার কয় খতম হয়েছে? আমার কাছে আসলে বললাম, কিছুই হয়নি। হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তখন আমি ওদের পাগড়ীধারী আমীর, যে অর্থনীতি শেষ বর্ষ সম্মান পরীক্ষার্থী তাকে বললাম, আপনি যে কথাটা বললেন, ওটা কোথায় পেলেন? সে তখন কুরআন বের করে বলল, এই দেখুন কুরআনে আছে। আমার তখন ঔৎসুক্য বেড়ে গেল। সোজা উঠে ওর কাছ থেকে কুরআনটা নিলাম। দেখলাম, ভূমিকায় হাদীছের কোটেশনের বাইরে ওগুলি প্রকাশকের নিজস্ব কথা। বললাম, আপনি হয় বাংলা বুঝেন না, নয়তো ইচ্ছাকৃত ভাবে ধোঁকা দিচ্ছেন। তখন ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললাম, ৪১ বার সূরা ইয়াসীন খতম করলে যদি অনার্সে ফার্ষ্ট ক্লাস পাওয়া যায়, তাহলে তাবলীগের এই আমীর ছাহেব কেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছেন? বাড়ী বসে খতম করলেই তো উনি ডিগ্রি পেতেন! দেখুন, কুরআনে এসব কথা লেখা নেই। এর ফলে যারা ৪১ বার খতম করেও ফার্ষ্ট ক্লাস পাবেনা, কুরআনের উপর তাদের বিশ্বাস উঠে যাবে। বরং কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মানুষ তার চেষ্টার বাইরে কিছুই পারেনা’ (নাজম ৫৩/৩৯)। অতএব আপনারা রুমে গিয়ে পরীক্ষার প্রস্ত্ততি নিন। ছেলেরা চলে গেল। তাবলীগের আমীর ক্ষেপে গেল। কয়দিন পরে দেখি আজমল নেই। চার তলায় ওর রুম কয়দিন থেকে বন্ধ। আমি মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। বিএ-তে ভাল রেজাল্ট করে ইংলিশে ভর্তি হয়েছে। সাতক্ষীরা কাজীরহাটের ছেলে আমার বন্ধু সে। এম এ-তে সেকেন্ড ক্লাস না পেলে কোথাও ‘লেকচারার’ হতে পারবেনা। কয়েক দিন পরে ফিরল। জানলাম, ঐ আমীর ওকে কাকরাইল নিয়ে গিয়েছিল। সেখান থেকে চিল্লায়। কিন্তু ফাইনাল পরীক্ষার কথা বলে কোনমতে পালিয়ে চলে এসেছে। ওরা ওকে বলেছে, যে আল্লাহ তোমাকে ১০০ এর মধ্যে ৩০ দেন। সেই আল্লাহ তোমাকে ১০০ এর মধ্যে ১০০ দিতে পারেন। তবুও ওর কথা মানেনি। তাই এক প্রকার পালিয়ে চলে এসেছে। আমাকে না বলে যাওয়ায় ক্ষমা চাইল। আমি বললাম, তোমাকে রুমে তালা দিয়ে রাখব। কেন্টিন থেকে আমি খাবার এনে দেব। মসজিদে যাওয়া বন্ধ। রুমেই ছালাত আদায় করবে। তাবলীগের কেউ যেন তোমাকে দেখতে না পায়। এভাবে কয়দিন এক নাগাড়ে পড়াশুনা করল ও পরীক্ষা দিল। কোন রকমে থার্ড ক্লাস পেল। অথচ সে মেধাবী ছেলে। সেকেন্ড ক্লাস পাওয়া তার জন্য খুবই সহজ ছিল। সৎ ও ভাল ছেলে। কিন্তু ভীরু প্রকৃতির। শুনেছি সে এখন বাংলাদেশ সরকারের যুগ্মসচিব। জানিনা এখন অবসরে গেল কি-না।
(৩) শবেবরাতের মৌসুম আগত। সাপ্তাহিক আরাফাতে শায়খ বিন বায এর ‘বিদ‘আত হইতে সাবধান’ বইয়ের ‘শবেবরাত’ অংশটি অনুবাদ করে দিলাম ও যথাসময়ে তা প্রকাশিত হল। কয়েক কপি এনে মুহসিন হলের মসজিদে ও আমাদের বিভাগীয় সেমিনারে দিলাম। ড. মুস্তাফীয স্যারের বাসায়ও দিয়ে এলাম। একদিন হঠাৎ ২২ জন মৌলবী ছাত্র যারা অধিকাংশই কামিল পাস, আমার রুমে হাযির। ভীষণ রাগ। উচ্চ কণ্ঠ, হুমকি-ধমকি। পরে বুঝল। কিন্তু বলল ভাই! আপনি শবেবরাতের বিরুদ্ধে লিখছেন, অথচ আপনাদের বংশালের আহলেহাদীছরা রীতিমত রাস্তা আটকে দিয়ে বিশালাকারে শবেবরাতের ওয়ায মাহফিল করে। আমরা না হয় একটু হালুয়া-রুটি খাই, তারা তো বিরিয়ানী পাকিয়ে খায়। হতবাক হয়ে গেলাম। চলে গেলাম বংশাল। কথা ঠিক। ছেলেদের নিয়ে রাত ১০-টার পর মসজিদগুলিতে তালা মারলাম। নিজ হাতে কয়েকটি পোষ্টার লিখে ছেলেদের দিয়ে মসজিদগুলোতে মেরে দিলাম এই মর্মে যে, ‘শবেবরাত কোন ইসলামী পর্ব নয়’। ‘শবেবরাত একটি বিদ‘আতী প্রথা’। তাতে কাজ হল। আহলেহাদীছদের মধ্যে চেতনা ফিরল।
(৪) ছাত্র ইসলামী মিশন-এর ছেলেরা আমাকে ধরার জন্য নানা কৌশল করে। কারণ নিয়মিত সাপ্তাহিক তাফসীর করার কারণে এবং প্রতিদিন ফজরের আগে রুমে রুমে গিয়ে ছালাতে ডাকার কারণে আমি ছাত্র-শিক্ষকদের কাছে সুপরিচিত ছিলাম। তাবলীগ বা কোন রাজনৈতিক দল না করাতে বরং সকল ছাত্রের কাছেই গ্রহণযোগ্য ছিলাম। একদিন ওদের ডাকে যাব বলে মনস্থ করলাম। বগুড়ার সুজাউল করীমকে সাথে নিয়ে ইউনিভার্সিটি কেন্দ্রীয় মসজিদে গেলাম। রাত ২-টায় মাসআলা শিক্ষা ক্লাস শুরু হল। একজন ছাত্র বলল, হুযুর! আমি আজ মাগরিবের ছালাত মীরপুরের এক মসজিদে পড়লাম। কিন্তু আমার কামিল পাস বন্ধু আমাকে নিয়ে পুনরায় ছালাত পড়লেন ও বললেন ওরা লা-মাযহাবী। ওদের পিছনে আমাদের ছালাত হয় না। হুযুর! আমার প্রশ্ন হল, ওরা কি মুসলমান নয়? হুযুর বললেন, ‘তোমরা আমাকে বেশী ঘাটিয়োনা। আমাকে যদি হক কথা বলতে হয় তাহলে বলব যে, ওদের আক্বীদা এতই খারাপ যে, ওদের মুসলমানই বলা যায় না’। আমি তখন হাত উঠিয়ে পরিচালকের কাছে সময় চাইলাম। কিন্তু দিলেন না। ফলে আমি উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম এবং হুযুরকে উদ্দেশ্য করে সক্রোধে বললাম, আপনি কি কুরআন-হাদীছ কিছু পড়েছেন মুফতী ছাহেব! বলেই কুরআনের একটি আয়াত ও একটি হাদীছ শুনিয়ে দিয়ে বললাম, আহলেহাদীছরা যদি মুসলমান না হয়, তাহলে হানাফী ও আহলেহাদীছ-এর মধ্যে বিয়ে-শাদী চলছে কিভাবে? আমরা একে অপরের আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ। আমার কথার সাথে সাথে অনেক ছেলে সমর্থন দিল। অতঃপর আমি সোজা গিয়ে হুযুরের জামার কলার ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে মসজিদের অনুচ্চ প্রাচীরের ধারে এনে ধাক্কা মেরে বাইরে ফেলে দিলাম। হুযুর কোন মতে মাটি থেকে উঠে দৌঁড়ে তার প্রাইভেট কারে উঠে পালিয়ে গেল।
পর পর চারটি ঘটনা এভাবে ঘটে গেল। চিন্তা জগতে তোলপাড় হতে লাগল। প্রথমটি একটি সেক্যুলার ছাত্র সংগঠন। দ্বিতীয়টি অরাজনৈতিক ইসলামী সংগঠন। তৃতীয়টি ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু ডিগ্রীধারী মূর্খ বিদ‘আতী। চতুর্থটি ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠাকামী ইসলামী দল। এরা সবাই ইসলামকে ভালবাসে। কিন্তু ইসলাম জানেনা। পাশাপাশি এরা আহলেহাদীছকে খাঁটি দল ভাবে। কিন্তু আহলেহাদীছরাই খাঁটি নয়। বরং তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লেজুড়। ফলে সবার আন্দোলনের ফলাফল জিরো। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রচলিত জাতীয়তাবাদী আহলেহাদীছ নয়, বরং সত্যিকার আহলেহাদীছ আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। যেখানে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ায় বিশ্বাসী দলমত নির্বিশেষে সকলে সমবেত হবে। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করব এবং ইসলামের আদি রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরাই হবে আমার পরবর্তী কর্তব্য। শুরুতেই লিখলাম বই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ এ ছোট বইয়ে আহলেহাদীছদের প্রকৃত আক্বীদা ও চিন্তাধারা তুলে ধরলাম। যার বিস্তৃত রূপ ছিল এই বিষয়ে পরবর্তীতে আমার কৃত ডক্টরেট থিসিস। অতঃপর তার সাংগঠনিক বাস্তবতা হ’ল ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’। আলহামদুলিল্লাহ আহলেহাদীছকে একটি ‘আন্দোলন’ হিসাবে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা বেশ দ্রুতই ফলবান হয়েছে এবং তা সমাজের নানামুখী জাহেলিয়াতের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংস্কার আন্দোলন হিসাবে ইতিমধ্যে দ্বীনদার ভাই-বোনদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। যদিও কায়েমী স্বার্থবাদীরা ক্ষেপে গেছে এবং নানা মিথ্যাচার ও যুলুম-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আলহামদুলিল্লাহ ব্যাপকার্থে এতে আন্দোলন লাভবানই হয়েছে এবং ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে গেছে। ফালিল্লাহিল হামদ!
(৩) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ‘যুবসংঘ’ প্রতিষ্ঠার সময় মুরববী সংগঠন জমঈয়তে আহলেহাদীছের সমর্থন এবং নেতৃবৃন্দের অংশগ্রহণ ছিল কি?
আমীরে জামা‘আত : মুরববী সংগঠন বলতে যা বুঝায় সেটা ছিল না। আমরা আন্তরিকভাবে তাদের সমর্থন ও সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কিন্তু সেভাবে কখনও পাইনি। শুরুতে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৭৮, উত্তর যাত্রাবাড়ী জামে মসজিদে জমঈয়ত সেক্রেটারী জনাব আব্দুর রহমান বিএবিটি ও সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ (কুমিল্লা) উপস্থিত ছিলেন। আর আমাদের খবরগুলি জমঈয়ত মুখপত্র সাপ্তাহিক আরাফাতে দিলে তা প্রকাশ করা হ’ত। তাছাড়া আমি তখন আরাফাতে নিয়মিতভাবে লিখতাম।
(৪) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : বাংলাদেশে কুয়েত ভিত্তিক সমাজ কল্যাণ সংস্থা ‘এহইয়াউত তুরাছ’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আপনার কোন ভূমিকা ছিল কি? আপনার প্রতিষ্ঠিত অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেই তো উক্ত সংস্থার নেমপ্লেট আছে।
আমীরে জামা‘আত : ১৯৮৪ সালে ঐ সংস্থার মুদীরসহ ৪ জন এদেশে আসেন। যুবসংঘের রাবি শাখার একটা ছেলের হাতে পাঠানো ডঃ রহমানীর লিখিত একটা চিঠি পেয়ে আমি সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় যাই এবং ড. বারী ছাহেবের ঝিকাতলার বাসায় গিয়ে মেহমানদের সাথে সাক্ষাত করি। তারপর তাঁদের নিয়ে সপ্তাহব্যাপী দেশের গুরুত্বপূর্ণ আহলেহাদীছ মারকাযগুলিতে সফর করি। ওনারা এদেশে সমাজকল্যাণমূলক কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। আমরা বললাম, সবকিছু জমঈয়তের মাধ্যমে করতে হবে। ওনারা তাই করলেন। প্রথমে সাভারের বাইপাইলে জমঈয়তের মাটিতে একটা ইয়াতীমখানা বিল্ডিং করলেন। যা আমরা আজও দেখিনি। মাঝে একদিন ইউজিসি চেয়ারম্যানের অফিসে ড. বারীর সাথে দাতা সংস্থার মুখপাত্রের টক-ঝাল কথাগুলি শুনে আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক সম্ভবত ওখান থেকে ব্যর্থ হয়ে তাঁরা আমাদের অনুরোধ করলেন ১৯৮৯ সালে। আব্দুল মতীন ভাই ছিলেন আরবীতে পটু এবং থাকতেন ঢাকাতে। ফলে তাঁর সঙ্গে দাতা সংস্থার সম্পর্ক গাঢ় ছিল। তিনি তখন জমঈয়তের কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছিলেন। এমনকি ১৯৮৫ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারীতে জমঈয়তে আহলেহাদীস ট্রাষ্টের নামে রেজিষ্ট্রিকৃত সাভারের জমি-জমার সনাক্তকারী ছিলেন আব্দুল মতীন সালাফী ও অধ্যক্ষ আব্দুছ ছামাদ। ফলে আব্দুল মতীন যা কিছু করতেন জমঈয়তের পক্ষে ও জমঈতের নামেই করতেন। পরে দাতাসংস্থার বিশেষ অনুরোধে আমরা ‘তাওহীদ ট্রাষ্ট’ রেজিষ্ট্রি করি ১৯৯৩ সালের ৩১ শে মে তারিখে। অতঃপর সরকারী আইন বজায় রেখে প্রতিবছর সরকারী অডিট ব্যবস্থাপনার মধ্যে সর্বত্র তাওহীদ ট্রাষ্ট্রের নামেই মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা, দাতব্য চিকিৎসালয়, নলকূপ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করা শুরু হয়। এহইয়াউত তুরাছ ছিল দাতা, আর তাওহীদ ট্রাষ্ট ছিল তাদের সহায়তাকারী। ১৯৯৬ সালে তারা ঢাকায় অফিস খোলে এবং নিজেরাই সবকিছু বাস্তবায়ন শুরু করে। তারা ছিল নিঃস্বার্থ সমাজসেবী প্রতিষ্ঠান। তাদের নামে যা কিছু রটানো হয়েছে, আমাদের জানা মতে সবই মিথ্যা ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। বিগত চারদলীয় জোট সরকার তাদের উপর যুলুম করেছে এবং এদেশের মানুষকে তাদের নিঃস্বার্থ সেবা থেকে বঞ্চিত করেছে। ২০০৫ সালের ১৩ই রামাযানে তৎকালীন সমাজকল্যাণমন্ত্রীর নির্দেশে পৌনে আটশত ইয়াতীমের বরাদ্দ বন্ধ করা হয়। যা ঐ এনজিওটি প্রদান করত। ফলে ইয়াতীমখানাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। যদিও কোন সূদী এনজিও-র গায়ে তারা হাত দেয়নি। অথচ তারা দাবী করত ‘ইসলামী মূল্যবোধের সরকার’।
(৫) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আব্দুল মতীন সালাফী (রহঃ) সম্পর্কে কিছু বলুন। তিনি কেন বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেলেন?
আমীরে জামা‘আত : আব্দুল মতীন সালাফী ছিলেন আহলেহাদীছ অন্তপ্রাণ আলেম ও একজন নিষ্ঠাবান সমাজকর্মী। ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠনের খবর ‘আরাফাতে’ পড়ে তিনি মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠন করেন। তারপর সেখান থেকে ফারেগ হয়ে সঊদী মাবঊছ হিসাবে বাংলাদেশে এসে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয় ও ঘনিষ্টতা জন্মে। আমরা তাকে অন্যতম কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা করি। ‘জমঈয়ত’ তাকে কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করে নেয়। পরে আমাদের সাথে সাথে তিনিও জমঈয়ত সভাপতির রোষাণলে পড়েন। অতঃপর এরশাদ সরকারের মাধ্যমে তাঁকে ১৯৮৯ সালের ২রা জুলাই মাত্র ৩ ঘণ্টার নোটিশে সপরিবারে অত্যন্ত অমানবিকভাবে ঢাকা থেকে কলকাতার বিমানে উঠিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন জমঈয়তের কোন নেতা তাঁকে বিদায় দিতে যাননি। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে তাঁকে ‘কালো তালিকা’ভুক্ত করা হয়। একাজ কে করেছিল কিভাবে করেছিল সবই আমাদের জানানো হয়েছিল। সেসময়ের এক আহলেহাদীছ মন্ত্রীকে জমঈয়ত সভাপতি সরাসরি ফোন করেছিলেন এ ব্যাপারে আমাদেরকে সাহায্য না করার জন্য। তিনি আজও বেঁচে আছেন। তাঁর সরকারী বাসায় তাঁর টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে একথা শুনেছিলাম আমরা যে তিনজন, তাদের একজন মারা গেছেন। বেঁচে আছি আমরা এখনো দু‘জন। তাই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে পারি, আব্দুল মতীন ছিলেন নির্দোষ মযলূম। আমরা তাঁর রূহের মাগফিরাত কামনা করি।
(৬) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ১৯৮৯ সালে আপনি আহলেহাদীছদের মাঝে ফাটল সৃষ্টি করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কী?
আমীরে জামা‘আত : বরং এটাই সত্য যে, এই ফাটলের জন্য জমঈয়ত নেতৃত্ব নিজেই ছিলেন এককভাবে দায়ী। আর কিছু হঠকারী ও দূর্বলচেতা লোক ছিল তাঁর সাথী।
(৭) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : সম্পর্কহীনতা ঘোষণার পিছনে কী কারণ ছিল?
আমীরে জামা‘আত : তৎকালীন জমঈয়ত নেতৃবৃন্দের আদর্শহীনতা ও অদূরদর্শিতাই ছিল এর প্রধান কারণ। আর ‘আরাফাত’-এর ৩০ বর্ষ, ৪৮ সংখ্যা, ২৪ জুলাই ১৯৮৯, পৃঃ ৫, ৩-এর কলামে, ‘শুববান বিভাগের বর্তমান পরিচালক মওঃ মুহাঃ আসাদুল্লাহেল গালিব নিজের লেখাপড়া ও অন্যান্য কাজে বিশেষ ব্যস্ততা হেতু এদিকে প্রয়োজনীয় মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তাহাকে প্রদত্ত ফান্ডের হিসাব প্রদান না করায় এবং জমঈয়তের সহিত নিয়মিত সম্পর্ক বজায় না রাখায় তাহার স্থলে একজন যোগ্যতর ও জমঈয়তের প্রতি আনুগত্যশীল পরিচালক নিয়োগের জন্য সভাপতি মহোদয়কে অনুরোধ করা হয়’ মর্মে যে কারণ দেখানো হয়েছে, সেটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। স্রেফ মুখরক্ষার জন্যই তাঁদেরকে উক্ত বানোয়াট কারণগুলি খাড়া করতে হয়েছে।
(৮) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ১৯৯৪ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর আপনি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে মুরববী সংগঠন কায়েম করেন। সম্পর্কহীনতা ঘোষণার পর থেকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করলেন কেন? মাঝের দিনগুলো কেমন কেটেছে?
আমীরে জামা‘আত : ১৯৮৯ সালের ২১শে জুলাই ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘের’ সাথে জমঈয়ত একতরফাভাবে ‘সম্পর্কহীনতা’ ঘোষণা করে। তার আগেই আমাকে জমঈয়ত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। এরপর থেকে আমরা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করি। সাথে সাথে ঐক্যের প্রচেষ্টা শুরু করি। সাতক্ষীরা ও যশোর থেকে মুরববীদের দু’টি টীম জমঈয়ত সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অতঃপর যুবসংঘের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সবাইকে তাঁর নিকটে পাঠাই। তারপর আমি অনানুষ্ঠানিকভাবে সরাসরি তাঁর ঢাকার বাসায় গিয়ে অনুরোধ করি। স্যার! ‘যুবসংঘ’কে কাছে টানুন। তারা ময়দানে কাজ করছে। তাদের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। স্রেফ গীবত-তোহমত দিয়ে একটা চলমান আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায় না। দয়া করে সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করুন’। কিন্তু অনেক অনুরোধের পরও মন গলাতে ব্যর্থ হলাম।
১৯৮৯ সালের ১৯শে অক্টোবরের ঘটনা। তিনি রাজশাহীর রাণীবাজার এলেন। উত্তরবঙ্গের প্রায় সব যেলা জমঈয়তের নেতৃবৃন্দকে সেখানে জমা করে সেদিন আমার বিরুদ্ধে গীবতের বন্যা বইয়ে দেন। ঘটনাক্রমে আমার সাধুরমোড়ের বাড়ীওয়ালার বড় ছেলে ওয়ার্ড কমিশনার মসজিদে ছিল। সে এসব কথা শুনে সহ্য করতে না পেরে তখনই আমার বাসায় এসে আমাকে অনেকটা জোর করেই রাণীবাজার নিয়ে গেল। আমি মসজিদে ঢুকলে সবাই আমাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেন। জমঈয়ত সভাপতির উপস্থিতিতেই বক্তব্য শুরু করলাম। কয়েক মিনিটের বক্তব্যে এক পর্যায়ে ওনাকে উদ্দেশ্য করে বললাম, স্যার! জমঈয়ত রক্ষা করা ফরয না আহলেহাদীছ আন্দোলন করা ফরয? দু’তিনবার কথাটি পুনরাবৃত্তি করলাম। তিনি কোন জওয়াব না দিয়ে চুপচাপ উঠে চলে যান। উত্তপ্ত জনগণ নিমেষেই উল্টে গেল। অনেকেই ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরেন।
হঠাৎ একদিন আরাফাতে পড়লাম ২৮-২৯শে ডিসেম্বর ঢাকায় জেনারেল কমিটির সভা ডাকা হয়েছে। সেখানে ‘জমঈয়তে শুববানে আহলেহাদীছ’-এর আহবায়ক কমিটি গঠন করা হবে। দেখলাম উনি আরেকটি আত্মঘাতি পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছেন। গেলাম সেখানে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও রোধ করতে পারলাম না। ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র বিরুদ্ধে ১১ বছর পরে তিনি ‘শুববান’ সৃষ্টি করে আহলেহাদীছদের মধ্যে এবার সাংগঠনিকভাবেই ফাটল সৃষ্টি করলেন। এভাবে ঐক্যের সম্ভাবনা ক্রমেই বিলীন হতে লাগল। কিন্তু আমরা আশা ছাড়িনি। বিভিন্নভাবে ঐক্যের চেষ্টা করেছি। এ ব্যাপারে রাজশাহীর বর্তমান মেয়র খায়রুয্যামান লিটনের দাদা অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিট্রেট জনাব আব্দুছ ছামাদের কথা স্মরণ করতে হয়। তিনি ছিলেন আমাদের উভয়ের মুরববী। তাঁর বাড়ীতে তিনি আমাদের উভয়কে ডাকলেন। আমি গেলাম। উনি রাণীবাজার থেকে এলেন না। এটি ১৯৯২ সালের ঘটনা। এরপরেও চেষ্টা অব্যাহত থাকে নানা ভাবে। কিন্তু কোনটাতেই কোন ফলোদয় হয়নি। যিনি বা যারাই তাঁর কাছে ঐক্যের ব্যাপারে আলোচনা করেছেন, তিনিই ব্যর্থ হয়েছেন।
অবশেষে সোয়া পাঁচ বছর পর কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা ও সুধী পরিষদের সম্মেলনে আগত চার শতাধিক আলেম-ওলামা ও সুধীদের উপস্থিতিতে ১৯৯৪ সালের ২৩শে সেপ্টেম্বর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ গঠিত হয়। আল্লাহ আমাদের অন্তরের খবর জানেন। আমরা কখনো বিভক্তি চাইনি। কিন্তু একতরফা যিদ ও অহংকারের সামনে আমরা ছিলাম অসহায়। হয়ত এর মধ্যেই মঙ্গল ছিল। যা আল্লাহ ভাল জানতেন এবং যা এখন সবাই দেখছেন। আজও আমরা আহলেহাদীছ জামা‘আতের ঐক্য চাই। যা অবশ্যই হতে হবে আদর্শের ভিত্তিতে। অন্য কিছুর ভিত্তিতে নয়। যাদের মাধ্যমে আল্লাহ কাজ নিচ্ছেন, তাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়াটাই ঈমানের দাবী বলে আমরা মনে করি।
(৯) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : অনেকেই মনে করেন, ড. আব্দুল বারী এবং ড. গালিব একসঙ্গে থাকলে আহলেহাদীছ সমাজের অনেক উন্নতি হত। কিন্তু ১৯৮৯-এর পর থেকে আপনার মাধ্যমে আহলেহাদীছ সমাজ যা পেয়েছে, যখন আপনারা এক সঙ্গে ছিলেন তখন কেন এগুলো করতে পারেননি?
আমীরে জামা‘আত : ১৯৮৪ সাল থেকেই সমাজকল্যাণের কাজ করার মত যথেষ্ট সুযোগ আমাদের হাতে এসেছিল। কিন্তু জমঈয়তের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে সমর্থন পাওয়া তো দূরে থাক আমাদের বাধাগ্রস্ত করা হয়েছিল পদে পদে। তখন আমাদের বলা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে সাভারে ৪৫ বিঘা জমি কেনা হয়েছে বিদেশী অনুদানে। সেখানে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ করা হবে। নবাবপুরে জমঈয়তের বহুতল বিল্ডিং করা হবে। মাওলানা কাফী ছাহেবের রেখে যাওয়া পান্ডলিপিগুলো সব ফুওয়াদ আব্দুল হামীদ আল-খত্বীব ছেপে দিতে চেয়েছেন ইত্যাদি। পরে বুঝেছি এগুলি সব ছিল কেবল অতিকথন। ফুওয়াদ আব্দুল হামীদের আরও প্রস্তাব ছিল ইসলামী ব্যাংক করে দেওয়ার। তিনি ছিলেন জমঈয়ত সভাপতির ছোটবেলার বন্ধু। খুব সহজেই তা হতে পারত। কিন্তু হয়নি কেবল জমঈয়ত সভাপতির নিজস্ব জড়তা ও একগুঁয়েমির কারণে। এসব কারণে মাওলানা আবু তাহের বর্ধমানী শেষ দিকে বংশাল মসজিদে থাকার সময় আমাদের ঐক্য প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা পৃথকভাবে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছেন। আরও এগিয়ে যান। ওনার সঙ্গে থাকলে কোন কাজ করতে পারবেন না’। সর্বোপরি আল্লাহই সবকিছুর ফয়ছালাকারী।
(১০) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আহলেহাদীছ আন্দোলনের সমাজ কল্যাণ সংস্থা ‘তাওহীদ ট্রাস্ট’ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য কি ছিল? কতটুকু সফল হয়েছেন?
আমীরে জামা‘আত : উদ্দেশ্য ছিল নিঃস্বার্থ সমাজসেবা। যতটুকু আল্লাহ চেয়েছেন ততটুকু হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ এখনো কাজ করে যাচ্ছি। আল্লাহ কবুল করুন কেবল এতটুকুই চাই। তবে বলতেই হয়, ট্রাষ্টি নির্বাচনে আমাদের ভুল হয়েছিল। ফলে বহু সম্পত্তি বেহাত হয়ে গেছে। এ বিষয়টি আমাকে সবসময় পীড়া দেয়। এভাবে আল্লাহর মাল যারা নষ্ট করেছে ও করে যাচ্ছে, তাদের বিচারের ভার আল্লাহর উপর রইল। এটুকু বিশ্বাস করি, যে বা যারা যুলুম করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদেরকে তার ফল ভোগ করতেই হবে।
(১১) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : সালাফী আক্বীদা ভিত্তিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা কি অবস্থায় রয়েছে?
আমীরে জামা‘আত : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্লান-এস্টিমেট এমনকি ভিত কাটার সূতা করাও হয়ে গিয়েছিল নওদাপাড়ায়। কিন্তু সবকিছু ভন্ডুল হয়েছে ষড়যন্ত্রকারীদের চক্রান্তে। তারপরও পরিকল্পনা থেকে পিছিয়ে আসিনি। আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে একদিন অবশ্যই ‘দারুলহাদীছ বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ।
(১২) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : ২০০৫ সালে কথিত ‘ইসলামী মূল্যবোধের সরকার’ জঙ্গী অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করেছিল এবং দীর্ঘ তিন বছর ছয় মাস ছয় দিন আটকে রেখেছিল। উক্ত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু গ্রেফতারের মৌলিক কারণ কী ছিল?
আমীরে জামা‘আত : বহিষ্কৃত জনৈক ট্রাষ্টী ও তার সাথীদের ষড়যন্ত্র এবং তৎকালীন জোট সরকারের পার্টনার একটি নামধারী ইসলামী রাজনৈতিক দলের হীন স্বার্থ উদ্ধারের মিশন।
(১৩) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : কারারুদ্ধ থাকাকালে রাজনৈতিক দল খোলার অনুমতি দিয়েছিলেন বলে কর্মীদের মাঝে ছড়ানো হয়েছিল। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?
আমীরে জামা‘আত : এটাও ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের পাতানো খেলা। বর্তমানে দুইজন ট্রাষ্টীকে দিয়ে ‘আহলেহাদীছ’ নামে যে দুটো দলের সাইনবোর্ড খাড়া করা হয়েছে, সেটার পিছনেও একই ষড়যন্ত্রীদের কালো হাত থাকা বিচিত্র নয়। তবে যতদিন ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর নেতাকর্মীদের মধ্যে আদর্শচেতনা অক্ষুণ্ণ থাকবে এবং পরকালীন মুক্তির চেতনা জীবন্ত থাকবে, ততদিন ঐসব দুনিয়াসর্বস্ব চক্রান্তকারীরা কোনই ক্ষতি করতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।
(১৪) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আপনার পাশে বর্তমানে মুরববীদের কেউ নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। এর কারণ কী?
আমীরে জামা‘আত : নিঃস্বার্থ দ্বীনদার মুরববীরা সর্বক্ষণ আমাদের সাথে ছিলেন ও আছেন। স্বার্থপররা কখনো মুরববী হতে পারে না। বিশেষ করে দ্বীনী সংগঠনে দ্বীনদার মানুষ প্রয়োজন। দুনিয়াদার মানুষ সর্বদা অবিশ্বস্ত ও ক্ষতিকর প্রাণী।
(১৫) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : বিভক্ত আহলেহাদীছ সমাজের ঐক্য নিয়ে কিছু বলবেন কী? আপনার কোন প্রস্তাবনা আছে কি?
আমীরে জামা‘আত : প্রকৃত আহলেহাদীছরা কখনই দলে দলে বিভক্ত হতে পারে না। আমরা সর্বদা আদর্শিক ঐক্য কামনা করি। নির্ভেজাল তাওহীদ প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ময়দানে কাজ করে যাচ্ছে। অতএব দ্বীনদার ভাই বোনদের প্রতি আবেদন থাকবে, প্রকৃতঅর্থে ‘আহলেহাদীছ’ হৌন এবং এ আন্দোলনকে আরোও গতিশীল করার জন্য একক ইমারতের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হৌন।
(১৬) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আগামী দিনে আপনার লক্ষ্য কী?
আমীরে জামা‘আত : আহলেহাদীছ-এর সঠিক দাওয়াত প্রসারের জন্য একদল হকপন্থী নেতা, মুত্তাকী আলেম, গবেষক, লেখক, বাগ্মী ও সংগঠক তৈরী করা। এজন্য প্রয়োজনীয় ভৌতকাঠামো, আর্থিক সংগতি ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সংস্থানের জন্য দ্বীনদার সচেতন ভাইদের সহযোগিতা কামনা করি এবং সর্বোপরি আল্লাহর রহমত প্রার্থনা করি।
(১৭) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আপনার জীবনের সবচেয়ে বেদনাময় স্মৃতি কী?
আমীরে জামা‘আত : দু’টির কথা বিশেষভাবে বলা যায়, আমাদের সরলতার প্রতি জমঈয়ত নেতাদের অবিশ্বাস এবং আমার ও যুবসংঘের বিরুদ্ধে তাঁর দুঃখজনক অপপ্রচার ও মর্মান্তিক আচরণসমূহ। দ্বিতীয়টি, ষড়যন্ত্রের শিকার বন্ধুবর আব্দুল মতীন সালাফীর সপরিবারে বিদায়ের করুণ স্মৃতি।
(১৮) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা কী?
আমীরে জামা‘আত : ট্রাষ্টীদের বিশ্বাসঘাতকতা।
(১৯) আহলেহাদীছ যুবসংঘ : সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি কী?
আমীরে জামা‘আত : কারা জীবনের স্মৃতি।