যেকোন নাগরিকের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করুন!

দেশের প্রত্যেক নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা তাদের মৌলিক মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। অথচ বর্তমানে আমাদের মত অনেকেরই মৌলিক অধিকার ভূলুণ্ঠিত। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে- ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা। ৪১। (১) আইন, জনশৃঙখলা ও নৈতিকতা সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের যে কোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে। (খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রহিয়াছে। (২) কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোন ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হইলে তাঁহাকে কোন ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করিতে হইবে না’। এছাড়া সংবিধানের ২৭, ২৮, ৩১ ও ৪৪ ধারায় সকল নাগরিকের সমানাধিকার বর্ণিত হয়েছে।

উপরোক্ত ধারাগুলি মূলতঃ সংখ্যালঘুদের জন্য নিরাপত্তার গ্যারাণ্টি। কিন্তু তিক্ত বাস্তবতা এই যে, ধারাগুলি দেশের আহলেহাদীছদের ক্ষেত্রে প্রায়ই লংঘিত হচ্ছে। এতদিন এ বিষয়ে আমাদের কোন কথা বলতে হয়নি। কিন্তু এখন বাধ্য হয়ে কথা বলতে হচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে যখনই কোন ভাই শিরক ও বিদ‘আত ছেড়ে ‘আহলেহাদীছ’ হচেছন, তখনই তার বিরুদ্ধে অন্যেরা বিশেষ করে কথিত আলেম সমাজ ও পীর-মাশায়েখরা খড়গহস্ত হয়ে উঠছেন। কখনও তাদেরকে মসজিদ থেকে বা সমাজ থেকে বিতাড়িত করছেন। অতঃপর নানাবিধ নামে ব্যানার নিয়ে হামলে পড়ছেন উগ্র ও হিংসাত্মক শ্লোগান সমূহ নিয়ে। প্রশাসন দেখেও না দেখার ভান করছে। অথবা আপোষ করে দেওয়ার নাম করে আহলেহাদীছদেরকে বলছেন, সবাই যা করে আপনারা তা করেন না কেন? অথবা তাদের মসজিদ-মক্তব-মাদ্রাসা আপাতত বন্ধ রাখার কথা বলছেন। পুলিশের অনুমতি ছাড়া তারা কোন সমাবেশ বা ইসলামী সম্মেলন করতে পারেন না। অথচ একবারও সংখ্যাগুরু পক্ষকে ধমক দিয়ে বলছেন না যে, যার যার ধর্মীয় বিধান পালন ও তা প্রচারের অধিকার রয়েছে। আপনারা বাধা দিবেন না। দিলে আপনাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব’। তাদের এই দুর্বল ভূমিকার কারণে আহলেহাদীছগণ বা শিরক-বিদআত পরিত্যাগ করে বিশুদ্ধ আক্বীদা গ্রহণে ইচ্ছুক ভাইগণ সর্বদা আতংকের মধ্যে বাস করছেন।

বিগত ৫০ বছরের মধ্যে আহলেহাদীছগণ এরূপ বিব্রতকর অবস্থার সম্মুখীন হননি, যত না হয়েছেন দলীয় সরকারগুলির আমলে। ২০০৫ সালে তৎকালীন চার দলীয় জোট সরকারের প্রধান ইসলামী দলটির প্ররোচনায় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীরকে বিনা অপরাধে গভীর রাতে বাসা থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে খুনের মামলা সহ দশ দশটি মিথ্যা মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন পর হাইকোর্টের ডাইরেকশন মতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি যামিনে মুক্তি পান। ৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন পর সকল মামলা থেকে তিনি বেকসুর খালাস পান। তাঁর সাথী অন্যান্যদেরকেও বিভিন্ন মেয়াদে কারা নির্যাতন ও নানাভাবে হয়রানী করা হয়। অদ্যাবধি সেইসব মিথ্যা মামলার রেশ ধরে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিতে তাদের অনেকে সর্বদা নযরদারীতে আছেন। যে এলাকার যে এসপি ভাল, সে এলাকায় তারা প্রোগ্রাম করতে পারেন। আর যে এলাকার এসপি আহলেহাদীছের বিরোধী, সে এলাকায় প্রোগ্রাম করতে পারেন না। এমনকি দুস্থদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণের কার্যক্রমও করতে পারেন না।

‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ একটি সংগঠিত আদর্শবাদী জনশক্তির নাম। আনুমানিক সাড়ে ৩ কোটি আহলেহাদীছের মুখপাত্র রূপে অন্যেরা এই সংগঠনকে গুরুতব দেন। ফলে বিরোধীরা এই সংগঠনকে ধ্বংস করার জন্য মাল ও মর্যাদা লোভীদের নিয়ে সর্বদা অন্তর্ঘাত মূলক অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা ভালভাবেই জানেন যে, এই সংগঠনকে শেষ করতে পারলে বিচ্ছিন্ন আহলেহাদীছদেরকে বিভিন্ন নামধারী ইসলামী সংগঠনে অথবা সেক্যুলার সংগঠনে সহজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে এবং তাদেরকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশে এমন কোন পার্লামেন্ট যায় না, যেখানে আহলেহাদীছ এমপি বা মন্ত্রী  থাকেন না। কিন্তু তাদের অধিকাংশই চেতনাহীন। বরং সোজা কথায় বলতে হয় তারা কদাচিৎ আহলেহাদীছের স্বার্থ দেখেন। যদিও তারা ভোটের আগে দো‘আ চান, কিন্তু ভোটের পর ভুলে যান। বরং অন্যেরা উপকার করলেও তারা এড়িয়ে যেতে চান। এমতাবস্থায় সংখ্যালঘুদের সেফগার্ড হিসাবে সংবিধানের উপরোক্ত ধারাগুলির বাস্তবায়নকারী কারা হবেন? আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাগণ সংখ্যাগুরুদের ভয়ে গভীর রাতে এসে আহলেহাদীছ মসজিদের ইমামকে উঠিয়ে নিয়ে বহু দূরে তার বাড়ীতে রেখে আসেন। হামলাকারী সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে তাদের কার্যকর কোন তৎপরতা দেখা যায় না। অথচ আমাদের রাসূল মুহাম্মাদ (ছাঃ) তার ইহূদী গোলামকে মুসলমান হওয়ার জন্য চাপ দেননি। খলীফা ওমর (রাঃ) বৃদ্ধা খৃষ্টান নারীকেও চাপ দেননি।

আশার কথা এই যে, সম্প্রতি ধর্মপ্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান বিভিন্ন যেলায় সফর করে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও আহলেহাদীছ প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্প্রীতি বৈঠক করছেন। তিনি নিজে জামালপুর-২ আসনের আহলেহাদীছ অধ্যুষিত ইসলামপুর থানার এমপি। আমাদের প্রশ্ন, সারা দেশে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর কর্মসূচীতে যেভাবে বাধা প্রদান করা হচ্ছে, তাতে এরূপ বাধা-বিঘ্নের মধ্যে কিভাবে সরকারের সঙ্গে আহলেহাদীছদের সম্প্রীতির বৈঠক সফল হবে? আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই যে, মিথ্যা পরাজিত হবে এবং সত্যের জয় হবেই। এই সংগঠন সর্বদা সত্যের অনুসারী। মিথ্যার সঙ্গে কোন আপোষ ইতিপূর্বেও ছিল না, আগামীতেও থাকবে না ইনশাআল্লাহ।

অতি সম্প্রতি ভোলায় পুরানো অত্যাচারের নতুন আবির্ভাব ঘটেছে। তথাকথিত ‘ঈমান-আক্বীদা সংরক্ষণ কমিটি’ নামক কথিত পীর-মাশায়েখদের অনুসারী উচ্ছৃংখল কিছু লোক স্থানীয় আহলেহাদীছ মসজিদ ও মক্তবের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করেছে। প্রশাসন তাদের প্রতি নমনীয় থেকে সংখ্যালঘু আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে কঠোরতা প্রদর্শন করছে। ফলে তারা আতংকিত জীবন যাপন করছেন। যদিও গত ২০১৮ সালের ১১ই জুলাই তাদের মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় ২০১৮ সালের ১১০৩৩ নং রিট পিটিশনের বিপরীতে যেলা প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি সংখ্যালঘুদের জান-মাল ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য হাইকোর্টের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। যেমন বলা হয়েছে- Direction upon the respondent Nos. 1-7 to take necessary steps to secure the petitioner's his family members' and his companions' fundamental right to establish, maintain and manage their religious institutions upon restraining the Respondent Nos. 8-31 (The 13th day of March, 2019).

আমরা আশা করব যে, ভোলা সহ দেশের সর্বত্র সরকারী প্রশাসন ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী হাইকোর্টের উপরোক্ত নির্দেশনা মেনে চলবেন এবং সংবিধানের ধারাগুলির প্রতি অনুগত থাকবেন। সর্বোপরি একজন হ’লেও নির্যাতিত যেকোন ব্যক্তির মৌলিক অধিকার রক্ষায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে যাবেন ও প্রতি পদে আল্লাহকে ভয় করবেন। তাতে তারা পরকালে পুরস্কৃত হবেন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন! (স.স.)