শান্তির ধর্ম ইসলাম

মানুষের জান-মাল ও ইযযত যখন লুণ্ঠিত হচ্ছিল, আরবের মরু বিয়াবান যখন অশান্তির আগুনে জ্বলছিল, শোষক পূঁজিপতিদের হাতে যখন দীন-হীন মানুষ গরু-ছাগলের মত বিক্রি হচ্ছিল, তখন সেখানে আল্লাহর পক্ষ থেকে অহি-র বিধান নিয়ে আগমন করেন বিশব শান্তির অগ্রদূত বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (ছল্লালল-হু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম)। তিনি সবাইকে দাওয়াত দিলেন ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। ‘তাঁর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান’। তাঁর এই সাম্যের বাণী ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। দাম্ভিক নেতারা বুঝল তাদের প্রভুত্বের দিন শেষ। কিন্তু নির্যাতিত মানবতার হৃদয়ের গভীরে সৃষ্টি হ’ল নতুন চেতনার ঢেউ। যা অতি দ্রুত বাঁধ ভাঙ্গা স্রোতের ন্যায় পৌঁছে গেল সর্বত্র। হাবশার বেলাল, রোমের ছোহায়েব, ইয়াছরিবের আস‘আদ, ইরানের সালমান ছুটে এল চারদিক থেকে। মক্কার নির্যাতিতরা নির্যাতকদের ভয়ে চুপসে থাকলেও বেরিয়ে এল সেখান থেকে নাজদের কর্মকার খাববাব, ইয়ামনের ইয়াসির পরিবার, আফ্রিকার বকরীর রাখাল ‘আমের বিন ফুহায়রা, ক্রীতদাসী যিন্নীরাহ ও নাহদিয়া; যালেম নেতা ওক্ববা বিন আবু মু‘আইতের বকরীর রাখাল আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ, বীর কেশরী হামযা ও ওমর প্রমুখ আপোষহীন মানুষ। চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হ’ল শোষক মহলে। ফলে পরিবেশ তৈরী হয়ে গেল সম্মুখ সংঘাতের। শান্তিবাদী নবীকে আল্লাহ হিজরতের আদেশ দিলেন ইয়াছরিবে। কিন্তু শক্তিমান নেতারা সেখানেও তাঁর পিছু নিল। আল্লাহ চাইলেন সত্য ও মিথ্যার চূড়ান্ত ফায়ছালা করতে। নবী বেরিয়ে এলেন কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা আটকাতে। কিন্তু ঘটে গেল অজানিত ঘটনা। অপ্রস্ত্তত অবস্থায় সম্মুখীন হ’লেন বদরের কূয়ার নিকটে শোষকদের শিখন্ডী আবু জাহলের সুপ্রস্ত্তত ও তিনগুণেরও অধিক সেনাবাহিনীর। যুক্তি বলছিল ফিরে আসার। কিন্তু আল্লাহর হুকুম ছিল এগিয়ে যাওয়ার। ফলে ইসলামের ইতিহাসে সর্বপ্রথম সশস্ত্র যুদ্ধের সম্মুখীন হ’লেন শান্তির নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। ঈমানী তেয ও জান্নাত লাভের উদগ্র বাসনা তাঁর নগণ্য সংখ্যক সাথীদের অজেয় শক্তিতে পরিণত করল। মাটিতে লুটিয়ে পড়ল বিরোধী সেনাপতি আবু জাহল সহ ১১ জন কুরায়েশ নেতার ছিন্ন মস্তক। মোড় পরিবর্তনকারী এই ঘটনার পর তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোমক ও পারসিক সম্রাটদের টনক নড়ল। পরবর্তীকালে তাদেরও দম্ভ চূর্ণ হ’ল এবং বিশব মানবতা শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিল। এভাবে সর্বত্র মানুষের দাসত্বের বদলে আল্লাহর দাসতব প্রতিষ্ঠিত হ’ল। সবাই এক আদমের সন্তান হিসাবে পরস্পরের সহযোগী ভাই ভাইয়ে পরিণত হ’ল।

সেই শান্তির ধর্ম ইসলামের অনুসারী মুসলমান আজ অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। এজন্য দায়ী কে? ইসলাম, না মুসলমান? ঔষধ, না  রোগী? নিশ্চয়ই দোষ ঔষধের নয়, বরং রোগীর। যারা ঔষধ হাতে পেয়েও তা সেবন করেনি। অথবা সঠিক ব্যবহারবিধি শিখেনি। কিংবা অল্প শিখে বাকীটা অনুমান করে নিয়েছে। কিংবা অন্য কিছু মিশিয়ে মনের মত ‘মিকশ্চার’ বানিয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে বর্তমান করুণ পরিণতির জন্য দায়ী হেদায়াতের মূল উৎস পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের মহান শিক্ষা হ’তে দূরে থাকা। আর একারণেই আধুনিক প্রজনম ক্রমেই বিভিন্ন বস্ত্তবাদী কুফরী দর্শনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

মুসলমানদের মধ্যে বর্তমানে চার ধরণের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। (১) একদল বিশব রাজনীতির দোহাই দিয়ে সবকিছুতেই আপোষ করে চলতে চান। তারা ভিতরে ঘা রেখে উপরে মলম দিতে ভালবাসেন। ব্যক্তিগত জীবনে ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ ইত্যাদি পালনেই তাদের ধর্ম-কর্ম সীমাবদ্ধ। কথিত বিশবনেতারা সর্বদা এদেরকেই পসন্দ করেন ও এদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায় বসান। এরা নিজেদেরকে ‘সেক্যুলার’ বলেন। যদিও তারা পুরাপুরি সেক্যুলার নন। তবে ইসলামী বিধান জারি করতে উদ্যোগী না হবার কারণেই পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে তারা সেক্যুলার। (২) আরেক দল আছেন যারা ইসলামী হুকূমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই রাজনীতি করেন। কিন্তু প্রচলিত অনৈসলামী রাজনীতির মাধ্যমেই সেটা করতে চান। ফলে লক্ষ্য ইসলাম হ’লেও পথ যেহেতু ভিন্ন, তাই তাদের রাজনীতি ও সেক্যুলারদের রাজনীতির মধ্যে শ্লোগানের পার্থক্য ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা ক্ষমতায় যাবার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পর সে আচরণই করেন, যেটা সেক্যুলাররা করে থাকেন। বরং কিছুটা বেশীই করেন। ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ বলাই তাদের নীতি। ফলে সংস্কারের গুরু দায়িতব পালনে তারা অপারগ। কূয়াতে পচা বিড়াল রেখে উপরের পানি সেচাতেই তারা অভ্যস্ত। (৩) তৃতীয় আরেক দল আছেন যারা ইসলাম বলতে তাদের শিরক ও বিদ‘আতের জঞ্জালে ভরা তরীকাকে বুঝেন। ছূফীবাদের অনুসারী হবার দাবী করে এরা দুনিয়াত্যাগী হিসাবে পরিচিত হ’তে ভালবাসেন। যদিও ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য এখন তারা নির্বাচনে প্রার্থী হচেছন। এদের কাছাকাছি আরেকটি দল আছেন, যারা নিজেদের দাওয়াতকে ‘নবীওয়ালা দাওয়াত’ বলেন এবং সর্বদা ‘রাসূলের তরীকায় শান্তি’ বলে থাকেন। অথচ মিথ্যা ফাযায়েলের মোহ ছড়িয়ে স্বচ্ছ মাসায়েল থেকে মানুষকে দূরে রাখেন। সবাইকে খুশী করতে গিয়ে সমাজ সংস্কারের গুরু দায়িতব পালন থেকে এরা অনেক দূরে। যদিও ধর্মের বাহ্যিক রূপ এদের মধ্যেই বেশী। (৪) চতুর্থ দলটি হ’লেন তারাই যারা তাদের সার্বিক জীবনে তাওহীদে ইবাদত প্রতিষ্ঠা করতে চান। জীবনের সকল দিক ও বিভাগে আল্লাহর দাসতব করতে চান। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী নিজেদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে ঢেলে সাজাতে চান। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ তাদেরই প্রিয় সংগঠন।

রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা তাদের মূল লক্ষ্য নয়। বরং সমাজের সার্বিক সংস্কার সাধনই তাদের প্রধান লক্ষ্য। সমাজ পরিবর্তনের কঠিন দায়িতব পালনে তারা শরী‘আতের নির্দেশ অনুযায়ী আমীরের প্রতি পূর্ণ আনুগত্যের মাধ্যমে নেকীর উদ্দেশ্যে ও আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে জামা‘আতবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে থাকেন। ছহীহ হাদীছের আলোকে তারা নিজেদের ত্রুটিসমূহ সংশোধন করেন এবং অন্যকে সংশোধনে উদ্বুদ্ধ করেন। তারা সরকারকে সুপরামর্শ দেন এবং সরকারের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন না। ধর্মঘট ও ভাঙচুর করেন না। সমাজের শান্তি ও শৃংখলা বিরোধী কোন কাজ করেন না। তারা ক্ষমতা লাভের জন্য দল গঠন করেন না বা ক্ষমতার জন্য লড়াই করেন না। কারণ নেতৃত্ব বা ক্ষমতা চেয়ে নেওয়া শরী‘আতে নিষিদ্ধ। এটি আল্লাহর দান। তিনি যাকে খুশী এটা দান করে থাকেন।

সেক্যুলার, পপুলার ও ছূফী মুসলমানরা বৃটিশের রেখে যাওয়া কুফরী নীতি ও পদ্ধতির প্রতি আপোষমুখী হওয়ায় তারাই পাশ্চাত্যের সবচাইতে নিকটের। ইসলামের প্রতি আপোষহীন থাকার কারণেই সম্ভবতঃ আমাদের সংগঠনের উপর সরকারী যুলুম নেমে এসেছিল ২০০৫ সালে। বর্তমান সরকারের আমলে পুনরায় তার নমুনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সত্যিকারের আদর্শনিষ্ঠ ঈমানদার কর্মীরা কোন অবস্থাতেই আদর্শচ্যুত হবেন না এবং দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত বিক্রি করবেন না। বরং সর্বদা তাক্বদীরে বিশ্বাস রেখে ও আল্লাহর উপর ভরসা করে সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসতব প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় জামা‘আতবদ্ধভাবে এগিয়ে যাবেন, এটাই কাম্য। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন -আমীন! (স.স.)