সুখী দেশ

এ বছর জাতিসংঘের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টে ১৪৬টি দেশের তালিকায় ২০১৮ সাল থেকে টানা পঞ্চমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ নির্বাচিত হয়েছে ফিনল্যান্ড। বাংলাদেশ ৯৪, পাকিস্তান ১২১ এবং ভারত রয়েছে ১৩৬ নম্বরে। তালিকা অনুযায়ী শীর্ষ ১০টি সুখী দেশ হ’ল ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, আইসল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, সুইডেন, নরওয়ে, ইসরায়েল ও নিউজিল্যান্ড। অন্যদিকে পরাশক্তিগুলির মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ১২, জার্মানী ১৩, কানাডা ১৪, যুক্তরাজ্য ১৫, যুক্তরাষ্ট্র ১৬, ফ্রান্স ২০, রাশিয়া ৮০, চীন ৮৪। দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে সুখী দেশ হ’ল নেপাল (৮৫)। প্রত্যেক দেশ সুখী হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করছে। বাংলাদেশ গত বছরের ১০১ থেকে ৭ ধাপ এগিয়ে এ বছর ৯৪ হয়েছে। প্রশ্ন হ’ল প্রথম ১০টি সুখী দেশের তালিকায় ৫৭টি মুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে সঊদী আরব, কুয়েত, কাতার, মিসর, তুরস্ক, বাহরায়েন তথা তৈলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলির নাম নেই কেন? অথচ উন্নত দেশগুলি সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সমূহে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি প্রবাসী কর্মরত রয়েছে। 

সুখী দেশের তালিকা করার ক্ষেত্রে মানুষের সুখের নিজস্ব মূল্যায়ন, সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে শূন্য থেকে ১০ সূচকে নম্বর পরিমাপ করা হয়। পাশাপাশি প্রতিটি দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সুস্থতার অনুভূতি, ব্যক্তি স্বাধীনতা, জিডিপি ও দুর্নীতির মাত্রা বিবেচনায় নেওয়া হয়। 

ইউরোপের সর্ব উত্তরের দেশগুলির অন্যতম ফিনল্যান্ড কেন বারবার সুখী দেশ সমূহের তালিকায় ১ম হচ্ছে? অথচ ৫৫ লাখ মানুষের এ দেশটি বছরে ৩৬৫ দিনের মধ্যে ২০০ দিনই থাকে তীব্র শীতের মধ্যে। সেখানের শৈত্য প্রবাহের তীব্রতা কখনো কখনো পৌঁছে যায় মাইনাস ৫০ ডিগ্রীর কাছাকাছি। এছাড়াও বছরের অধিকাংশ সময় সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছে না। ফলে দেশটি প্রায় সর্বদা থাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন। ১৯৯০ সালে বিশ্বের ২য় আত্মহত্যা প্রবণ দেশ ছিল ফিনল্যান্ড। তাহ’লে মাত্র তিন দশকে এই দেশটি কিভাবে সুখী দেশে পরিণত হ’ল? প্রধানতঃ ৫টি বিষয়কে এর মূল কারণ হিসাবে ধরা হয়েছে। (১) শিক্ষাব্যবস্থা (২) সামাজিকতা (৩) বিনয় (৪) সন্তুষ্টি (৫) পর্যাপ্ত উপার্জনের সুবিধা।

২০১৯ সালে নির্বাচিত সেদেশের ৫ দলীয় জোট নেত্রী বর্তমান বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী ৩৪ বছরের সানা মেরিন। যিনি সচরাচর ক্যামেরার সামনে কথা বলেন না। তার মতে, সবুজ প্রযুক্তির বিকাশ ও রফতানী তার দেশের সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। সেদেশের শিক্ষাব্যবস্থা বিশেবর অন্যান্য দেশ থেকে ভিন্ন। যেমন সেখানে ১৮ বছর পর্যন্ত সবার জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক। তাদের একটি শিশু ৭ থেকে ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করে। এ সময়ে তাকে কোন পরীক্ষা দিতে হয়না। এমনকি হোমওয়ার্ক করতে হয়না। ফলে তাদের পূর্ণ মানসিক বিকাশ ঘটে। অতঃপর ১৬ থেকে ১৯ পর্যন্ত তাদের হাইস্কুলে পড়ানো হয়। সেখানেও তাকে কোন হোমওয়ার্ক করতে হয়না। ফলে শিক্ষাস্থান বা শিক্ষাগ্রহণ তাদের কাছে কোন ভয়াবহ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়না। সেখানে সকলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ রয়েছে। যাতে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নিজেরাই গড়ে তুলতে পারে। (২) সামাজিকতা। সেদেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ বন্ধুবৎসল। যেকোন বিপদে পরিবারের বাইরের লোকদের থেকে সাহায্য পাওয়ার ব্যাপারে তারা নিশ্চিন্ত থাকে। (৩) বিনয়। তাদের মধ্যে বিনয় খুব বেশী। নিজেদের সামাজিক ও আর্থিক উচ্চাবস্থান তাদেরকে অহংকারী বানায় না। যা তাদেরকে সুখী হ’তে সাহায্য করে। (৪) সন্তুষ্টি। তারা তাদের ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের মধ্যে ভারসাম্য নিয়ে তৃপ্ত থাকে। (৫) পর্যাপ্ত উপার্জনের সুবিধা। সেদেশে যোগ্যতা অনুযায়ী সকলের কাজ পাওয়ার অধিকার রয়েছে সকলের। তারা ধনী হ’তে চায়না। তবে জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও চিকিৎসা সুবিধা রয়েছে সকলের। তারা ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বড় করে দেখে এবং তারা তাদের সরকারকে বিশ্বাস করে। নরওয়ে ও রাশিয়ার সীমান্তে হওয়া সত্ত্বেও তারা রাশিয়া ও আমেরিকার পুঁজিবাদী লুণ্ঠন থেকে নিজেদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি বর্তমান রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের শরণার্থীদেরকেও তারা স্বাগত জানাতে প্রস্ত্তত আছে। গত ২৪শে ফেব্রুয়ারী থেকে প্রতিবেশী ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলায় ১ মাসে বাস্ত্তচ্যুত হয়েছে ১ কোটি মানুষ। দেশত্যাগী হয়েছে ৩৬ লাখ। এরপরেও বিশ্বে তেমন কোন সাড়া-শব্দ নেই। যেমন সাড়া-শব্দ ছিলনা মিয়ানমারে গণহত্যার শিকার ১১ লাখ বাস্ত্তচ্যুত মুসলমানদের বেলায়। এতে বুঝা যায়, সাম্রাজ্যবাদী লুটেরা পরাশক্তিগুলি না থাকলে এবং কারু উপরে তাদের কোন হস্তক্ষেপ না থাকলে বিশ্বের প্রায় সকল দেশই সুখী দেশে পরিণত হ’ত।        

উপরের বিষয়গুলি একত্রিত করলে যেটা দাঁড়ায় তা এই যে, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ব্যক্তি স্বাধীনতা প্রভৃতি মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি সহজে সম্পন্ন হ’লে মানুষ তৃপ্তিবোধ করে। এগুলি যেদেশে যত বেশী সুলভ, সেদেশ তত বেশী সুখী। তার অর্থ এটা নয়, যেমন ফিনল্যান্ডে উদার সমাজ ব্যবস্থার নামে বিবাহহীন জীবন ও সমকামিতাকে অনুমোদন দেওয়া হয়। মহিলা প্রধানমন্ত্রী সানা মেরিন নিজেও বিবাহ ছাড়াই এক সন্তানের মা। এটি স্পষ্টভাবে পশু স্বভাব এবং মানুষের স্বভাব বিরুদ্ধ। কাছাকাছি সুখী দেশ কানাডায় (১৪) রাস্তা-ঘাটে কোন ছবি-মূর্তি দেখা যায় না। সেদেশের প্রধানমন্ত্রীর ছবির বিলবোর্ড চোখে পড়েনা। এগুলিকে তারা অপচয় মনে করে। কারণ মানুষ বেঁচে থাকে তার কর্মে। মূর্তি-ভাষ্কর্যে বা মিনার-বেদীতে নয়। আর ইসলাম মানুষের স্বভাবধর্ম। যেখানে আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। মানুষের আয়ুষ্কাল, কর্মকান্ড, রিযিক এবং তাক্বদীরের ভাল-মন্দ আল্লাহ কর্তৃক পূর্ব নির্ধারিত। ইসলামী সমাজে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের স্থান নেই। রয়েছে অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার। রয়েছে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন। রয়েছে আল্লাহর উপর নির্ভশীলতার সুদৃঢ় হাতল। রয়েছে তাক্বদীরে বিশ্বাসের সীমাহীন তৃপ্তি। ফেলে আসা স্বর্ণযুগের ইসলামী খেলাফত বিশ্ব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় দলীল। সুখী হওয়ার উপায় তাই মাত্র দু’টি : তাক্বদীর ও তাওয়াক্কুল।

ইসলামের রয়েছে কর্মদর্শন। সে সৎকর্ম করলে ইহকালে ও পরকালে পুরস্কৃত হবে। অসৎকর্ম করলে নিন্দিত ও শাস্তিপ্রাপ্ত হবে। এই দর্শন তাকে সুখী সমাজ গঠনে সাহায্য করে। এই দর্শনের আলোকে যে আল্লাহভীরু রাজনৈতিক প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তা তাকে সুখী হ’তে নিশ্চয়তা দেয়। যেকোন বিপদে সমাজ ও রাষ্ট্র তার সাহায্যে এগিয়ে আসে। সে কখনো নিজেকে একাকী মনে করেনা। একাকীত্বের হতাশা তাকে গ্রাস করেনা। সর্বাবস্থায় আল্লাহর উপরে ভরসা তাকে সাহসী করে। সে দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে, ‘আল্লাহ আমাদের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন, তা ব্যতীত কিছুই আমাদের নিকট পৌঁছবে না। তিনিই আমাদের অভিভাবক। আর আল্লাহর উপরেই মুমিনদের ভরসা করা উচিত’ (তওবা ৯/৫১)। কঠিন বিপদে সে কেবল আল্লাহর কাছেই সাহায্য চায়। বিগত যুগে গুহায় আটকে পড়া ৩ জন যুবকের স্ব স্ব সৎকর্মের বিনিময়ে আল্লাহর হুকুমে অলৌকিকভাবে মুক্তির ইতিহাস তাদেরকে অনুপ্রাণিত করে (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৪৯৩৮)। আল্লাহ আমাদের এই প্রিয় দেশকে আল্লাহভীরু, সৎকর্মশীল ও সর্বাবস্থায় তাঁর উপরে ভরসাকারী সুখী দেশ হিসাবে কবুল করুন- আমীন! (স.স.)।