শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কর্তব্য

শিক্ষক-ছাত্র ও অভিভাবক মিলেই প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানের ইমারত কথা বলে না। কথা বলেন শিক্ষক। অতএব যোগ্য শিক্ষক ব্যতীত যোগ্য শিক্ষার্থী গড়ে উঠতে পারে না। নরম মাটি যেভাবে কারিগরের হাতে সুন্দর হাড়ি-পাতিলে পরিণত হয়, নরম শিশুগুলি তেমনি সুন্দর ও চরিত্রবান শিক্ষকের হাতে সুন্দর মানুষে পরিণত হয়। তাই যেখানে শিক্ষক সুন্দর, সেখানে শিক্ষার্থীরা সুন্দর রূপে গড়ে ওঠে ও সমাজে প্রশংসিত হয়। সাথে সাথে সেই প্রতিষ্ঠান সুনাম করে। শিক্ষকরা শিক্ষার্থী গড়েন ও নেতারা জাতি গড়েন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন উম্মতে মুহাম্মাদীর শিক্ষক। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলের পরিচয় দিয়ে বলেন,هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِّنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُّبِينٍ- ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি নিরক্ষরদের মধ্যে তাদেরই একজনকে রাসূল হিসাবে পাঠিয়েছেন। যিনি তাদের নিকট তাঁর আয়াত সমূহ পাঠ করেন ও তাদেরকে পবিত্র করেন। আর তাদেরকে কিতাব ও সুন্নাহ শিক্ষা দেন। যদিও তারা ইতিপূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে নিমজ্জিত ছিল’ (জুম‘আহ ৬২/২)। 

তিনি বলেন,وَأَنْزَلَ اللهُ عَلَيْكَ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَعَلَّمَكَ مَا لَمْ تَكُنْ تَعْلَمُ، وَكَانَ فَضْلُ اللهِ عَلَيْكَ عَظِيمًا- ‘আর আল্লাহ তোমার উপর কুরআন ও সুন্নাহ অবতীর্ণ করেছেন এবং তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন যা তুমি জানতে না। বস্ত্ততঃ তোমার উপর আল্লাহর অসীম করুণা রয়েছে’ (নিসা ৪/১১৩)। এতে বুঝা যায় যে, মানুষ মূলতঃ তার দ্বীন ও ভবিষ্যৎ ভাল-মন্দ সম্পর্কে অজ্ঞ। কেবল কুরআন ও সুন্নাহ তাকে সঠিক পথের সন্ধান দেয়।

৬ষ্ঠ নববী বর্ষের শেষে মক্কার নেতারা যখন বহুমূল্য উপঢৌকন সহ ‘আমর ইবনুল ‘আছ ও আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী‘আহকে বাদশাহ নাজাশীর নিকটে দূত হিসাবে প্রেরণ করেন এবং সেখানে আশ্রয় গ্রহণকারী মুসলিমদের মক্কায় ফিরিয়ে আনার জন্য বাদশাহর নিকট আবেদন করেন, তখন বাদশাহ মুসলমানদের কথা শোনার জন্য তাদের একজন প্রতিনিধিকে আহবান করেন। তখন তারা নিজেরা একত্রিত হয়ে আপোষে বলেন,نَقُولُ وَاللهِ مَا عَلَّمَنَا وَمَا أَمَرَنَا بِهِ نَبِيُّنَا - صلى الله عليه وسلم- كَائِنٌ فِى ذَالِكَ مَا هُوَ كَائِنٌ- ‘আল্লাহর কসম! আমরা সেটাই বলব, যেটা আমাদের রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে শিখিয়েছেন এবং আমাদেরকে আদেশ করেছেন। তাতে আমাদের ভাগ্যে ভাল-মন্দ যা-ই ঘটুক না কেন? অতঃপর ভরা মজলিসে তাদের পক্ষ হ’তে জা‘ফর বিন আবু ত্বালেব (রাঃ) বাদশাহকে বলেন, হে বাদশাহ! আমাদের ধর্মের নাম ‘ইসলাম’। আমরা স্রেফ আল্লাহর ইবাদত করি এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করি না। বাদশাহ বললেন, কে তোমাদের এসব কথা শিখিয়েছেন? জা‘ফর বললেন, আমাদের মধ্যেরই একজন ব্যক্তি। ইতিপূর্বে আমরা মূর্তিপূজা ও অশ্লীলতা এবং অন্যায়-অত্যাচারে আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিলাম। আমরা শক্তিশালীরা দুর্বলদের শোষণ করতাম। এমতাবস্থায় আল্লাহ মেহেরবানী করে আমাদের মধ্যে তাঁর শেষনবীকে প্রেরণ করেছেন। যার নাম ‘মুহাম্মাদ’। তিনি আমাদের সামনে বড় হয়েছেন। তাঁর বংশ মর্যাদা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আমানতদারী, সংযমশীলতা, পরোপকারিতা প্রভৃতি গুণাবলী আমরা জানি। নবুঅত লাভের পর তিনি আমাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়েছেন এবং মূর্তিপূজা পরিত্যাগ করে সর্বাবস্থায় এক আল্লাহর ইবাদত করার আহবান জানিয়েছেন। সাথে সাথে যাবতীয় অন্যায়-অপকর্ম হ’তে তওবা করে সৎকর্মশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা তাঁর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং এক আল্লাহর ইবাদত করছি ও হালাল-হারাম মেনে চলছি। এতে আমাদের কওমের নেতারা আমাদের উপর ক্ষিপ্ত হয়েছেন এবং আমাদের উপর প্রচন্ড নির্যাতন চালিয়েছেন...।[1] এতে বুঝা যায় যে, শিক্ষক সর্বদা শিক্ষার্থীকে বিশ্বাস ও কর্মে সর্বাঙ্গ সুন্দর রূপে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকবেন। নিম্নে এ বিষয়ে সংক্ষেপে বর্ণিত হ’ল।-

শিক্ষকের কর্তব্য

(১) শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার প্রতি আগ্রহী থাকা :

যার মধ্যে শিক্ষকতার মেযাজ নেই ও ছাত্রকে সুন্দর রূপে গড়ে তোলার আগ্রহ নেই, সে ব্যক্তি কখনোই শিক্ষক হ’তে পারে না। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলের গুণ বর্ণনা করে বলেন,لَقَدْ جَآءَكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের নিকট এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, যার নিকট তোমাদের দুঃখ-কষ্ট বড়ই দুঃসহ। তিনি তোমাদের কল্যাণের আকাঙ্খী। তিনি মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়াবান’ (তওবা ৯/১২৮)। অতএব শিক্ষক সর্বদা শিক্ষার্থীর প্রতিটি কথা ও কাজের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন এবং সর্বদা শিক্ষার্থীর প্রতি স্নেহশীল থাকবেন।

(২) শিক্ষক সালাম দিয়ে ক্লাসে প্রবেশ করবেন :

শিক্ষক ক্লাসে সালাম দিয়ে প্রবেশ করবেন। প্রয়োজনে ৩ বার সালাম দিবেন। কেননা রাসূল (ছাঃ) কখনো কখনো এরূপ করতেন (বুখারী হা/৯৫)। সাথে সাথে শিক্ষার্থীদের নিকট থেকে সালামের জবাব নিবেন। এসময় শিক্ষককে অভ্যর্থনা জানিয়ে শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়ে সালামের জবাব দিবে (আবুদাঊদ হা/৫২১৭)। অতঃপর সবার সাথে তিনি কুশল বিনিময় করবেন ও ‘বিসমিল্লাহ’ বলে ক্লাস শুরু করবেন। শিক্ষক বা মেহমান আসার অপেক্ষায় আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকা জায়েয নয় (ছহীহাহ হা/৩৫৭)। শিক্ষক ক্লাসে প্রবেশকালে ও উঠে যাওয়ার সময় সালাম দিবেন।[2]

একইভাবে মজলিসে কথা বলার পূর্বে সালাম দিবে’।[3] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাম দিয়ে শুরু করে না, তাকে অনুমতি দিয়ো না’।[4] এতে বুঝা যায় যে, সভাপতি ব্যতীত সভা হয় না এবং তার অনুমতি ব্যতীত সভায় বক্তব্য রাখা বৈধ নয়। একইভাবে শিক্ষক ব্যতীত শিক্ষা হয় না এবং শিক্ষকের অনুমতি ব্যতীত শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষে বক্তব্য রাখতে পারে না।

(৩) তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত বুঝানো :

শিক্ষক তাঁর শিক্ষার্থীদের নিকট সর্বাগ্রে শিক্ষার লক্ষ্য হিসাবে তাওহীদ, রেসালাত ও আখেরাত বুঝাবেন। অর্থাৎ আল্লাহ আমাদের সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা (ফাতেহা ১/১)। তিনি অহি-র বিধান সমূহ প্রেরণ করেছেন তাঁর সর্বশেষ রাসূল মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম)-এর মাধ্যমে (সাবা ৩৪/২৮; নজম ৫৩/৩-৪)। আর মৃত্যুর পর আমাদেরকে অবশ্যই আখেরাতে আল্লাহর নিকট জবাবদিহি করতে হবে (যুখরুফ ৪৩/৪৪)। অতএব বিচক্ষণ সেই ব্যক্তি, যে মৃত্যুকে সর্বাধিক স্মরণ করে ও আখেরাতের জন্য সর্বাধিক পাথেয় সঞ্চয় করে’ (ইবনু মাজাহ হা/৪২৫৯)

(৪) শিক্ষক যথার্থ ও সারগর্ভ কথা বলবেন :

শিক্ষক সর্বদা সত্য ও সঠিক কথা বলবেন। কোনরূপ অসত্য ও অনর্থক কথা বলবেন না। কারণ শিক্ষকের প্রতিটি কথাই শিক্ষার্থী সত্য বলে বিশ্বাস করে। সেগুলি তার মনে দাগ কাটে ও সে তার অনুসরণ করে। অতএব যেকোন মূল্যে শিক্ষক সর্বদা সত্য ও সারগর্ভ কথা বলবেন। আর চূড়ান্ত সত্যের উৎস হ’ল কুরআন ও সুন্নাহ। যেমন আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,وَقُلِ الْحَقُّ مِنْ رَّبِّكُمْ فَمَنْ شَآءَ فَلْيُؤْمِنْ وَمَنْ شَآءَ فَلْيَكْفُرْ، إِنَّآ أَعْتَدْنَا لِلظَّالِمِينَ نَارًا، ‘তুমি বলে দাও যে, সত্য এসেছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে। অতএব যে চায় তাতে বিশ্বাস স্থাপন করুক। আর যে চায় তাতে অবিশ্বাস করুক। আমরা সীমালংঘনকারীদের জন্য আগুন প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (কাহ্ফ ১৮/২৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أُوتِيتُ جَوَامِعَ الْكَلِمِ، ‘আমাকে সারগর্ভ কথা বলার ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে’।[5] 

কুতুবে সিত্তাহর অন্যতম প্রসিদ্ধ ইমাম আবুদাঊদ (২০২-২৭৫ হি.) বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-এর বর্ণিত ৫ লক্ষ হাদীছ বাছাই করেছি। তার মধ্য থেকে ৪ হাযার ৮ শত হাদীছ জমা করেছি। তবে আমি মনে করি, একজন মানুষের জন্য দ্বীনের ব্যাপারে চারটি হাদীছই যথেষ্ঠ। এক- ‘সকল আমল নিয়তের উপর নির্ভরশীল’। দুই- ‘সুন্দর ইসলাম হ’ল অনর্থক কথা ও কাজ পরিহার করা’। তিন- ‘মুমিন কখনো প্রকৃত মুমিন হ’তে পারে না, যতক্ষণ না সে অপরের জন্য ঐ বস্ত্ত পসন্দ করে, যা সে নিজের জন্য পসন্দ করে’। চার- ‘হালাল স্পষ্ট ও হারাম স্পষ্ট’ (মুক্বাদ্দামা আবুদাঊদ)। 

(৫) শিক্ষক প্রয়োজনে বারবার বলে বিষয়বস্ত্তকে সহজ করে বুঝিয়ে দিবেন :

এজন্য রাসূল (ছাঃ) কোন কোন বিষয় ৩ বার করে বলতেন (বুখারী হা/৯৫)। তিনি বলেন,إِنَّ اللهَ لَمْ يَبْعَثْنِي مُعَنِّتًا وَلاَ مُتَعَنِّتًا، وَلَكِنْ بَعَثَنِي مُعَلِّمًا مُيَسِّرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ কাউকে কষ্টে ফেলতে বা কারও পদস্খলনকামীরূপে আমাকে প্রেরণ করেননি; বরং তিনি আমাকে প্রেরণ করেছেন শিক্ষা দানকারী ও সহজকারীরূপে’।[6]

(৬) শিক্ষক সর্বদা শিক্ষার্থীকে উৎসাহিত করবেন :

শিক্ষক তার শিক্ষার্থীকে সর্বদা আরও অধিক অগ্রগতির জন্য উৎসাহিত করবেন। কোনভাবেই তাকে হতাশ করবেন না বা মারধর করবেন না। সে অপমান বোধ করে, এমন কোন কথা বা আচরণ তার সাথে করবেন না। বরং প্রশ্নের মাধ্যমে তার মেধাকে জাগিয়ে তুলবেন। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একদিন ছাহাবীদের বললেন, তোমরা আমাকে এমন একটি বৃক্ষ সম্পর্কে বল, যার পাতা পড়ে না এবং অমুক অমুকগুলি পতিত হয় না। যা সর্বদা খাদ্য প্রদান করে?’ তখন কেউ কোন জবাব দিল না। ইবনু ওমর বলেন, আমার মনে হ’ল, এটি খেজুর গাছ হবে। কিন্তু আমি দেখলাম যে, আবুবকর ও ওমর কিছুই বলছেন না। ফলে আমি কিছু বলাটা পসন্দনীয় মনে করলাম না। যখন কেউ কিছু বললেন না, তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, সেটি হ’ল খেজুর গাছ’। অতঃপর যখন আমরা উঠলাম, তখন আমি পিতা ওমরকে বললাম, আববা! আল্লাহর কসম! আমার মনে একথাই উদয় হয়েছিল যে, ওটা খেজুর গাছ। কিন্তু আপনারা কিছু বলছেন না দেখে আমি কিছু বলাটা ঠিক মনে করিনি। তখন পিতা ওমর বললেন, ‘তোমার বলাটা আমার নিকটে অধিক প্রিয় ছিল অমুক অমুক বস্ত্তর চাইতে’।[7]

এর মধ্যে কতগুলি শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে। যেমন (ক) শিক্ষক মাঝে-মধ্যে শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই করবেন। (খ) শিক্ষার্থী উত্তর না দিলে তাকে বকা-ঝকা করবেন না। বরং উৎসাহিত করবেন। (গ) শিক্ষার্থীর জানা থাকলে সঠিক উত্তর দানে লজ্জা করবে না। 

(৭) শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতার মনোভাব সৃষ্টি করা : শিক্ষার্থীকে সর্বদা বৈধ প্রতিযোগিতার কাজে উৎসাহিত করতে হবে। কেননা যেকোন নেকীর কাজে প্রতিযোগিতা করা মুস্তাহাব। যার বিনিময়ে জান্নাত লাভ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,سابِقُوآ إِلى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَبِّكُمْ وَجَنَّةٍ عَرْضُها كَعَرْضِ السَّمآءِ وَالْأَرْضِ، ‘তোমরা প্রতিযোগিতা কর তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে। যার প্রশস্ততা আকাশ ও পৃথিবীর প্রশস্ততার ন্যায়’ (হাদীদ ৫৭/২১)। রাসূল (ছাঃ) বদর যুদ্ধের শুরুতে সারিবদ্ধ ছাহাবীদের নির্দেশ দিয়ে বলেন, قُوْمُوا إلَى جَنَّةٍ عَرْضُهَا السَّمَاوَاتُ وَالْأَرْضُ، ‘তোমরা এগিয়ে চলো জান্নাতের পানে, যার প্রশস্ততা আসমান ও যমীন পরিব্যাপ্ত’।[8] রাসূল (ছাঃ)-এর এই আহবান মুসলমানদের দেহ-মনে ঈমানী বিদ্যুতের চমক এনে দিল।[9] তখন জান্নাত পাগল মুমিন মৃত্যুকে পায়ে দলে শতগুণ শক্তি নিয়ে সম্মুখে আগুয়ান হ’ল ও তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক আনছার ছাহাবী ওমায়ের বিন হোমাম ‘বাখ বাখ’ (بَخْ بَخْ) ‘বেশ বেশ’ বলে উঠলেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে এ কথার কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আমি জান্নাতবাসী হ’তে চাই’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বললেন,فَإِنَّكَ مِنْ أَهْلِهَا ‘নিশ্চয়ই তুমি তার অধিবাসী’। একথা শুনে তিনি থলি হ’তে কিছু খেজুর বের করে খেতে লাগলেন। কিন্তু দ্রুত তিনি বলে উঠলেন,لَئِنْ أَنَا حَيِّيْتُ حَتَّى آكُلَ تَمَرَاتِيْ هَذِهِ إِنَّهَا لَحَيَاةٌ طَوِيْلَةٌ، ‘যদি আমি এই খেজুরগুলি খেয়ে শেষ করা পর্যন্ত বেঁচে থাকি, তবে সেটাতো দীর্ঘ জীবন হয়ে যাবে’ বলেই সমস্ত খেজুর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ও বিপুল বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনি শহীদ হয়ে গেলেন’।[10]

উপরোক্ত ঘটনায় প্রতিযোগিতার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বা সাথীদের উৎসাহিত করার প্রমাণ রয়েছে।

(৮) শিক্ষার্থীদের বুঝের তারতম্য বিচার করে শিক্ষা দান করা :

শিক্ষার্থীদের সামনে এমন কোন বিষয়ের অবতারণা করা ঠিক নয়, যা তারা বুঝবে না। যেমন মানুষকে বানরের বংশধর প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানের নামে ডারউইনের কথিত ‘বিবর্তনবাদে’র নাস্তিক্যবাদী উদ্ভট দর্শন উপস্থাপন করা। অমনিভাবে কোটি কোটি বছর পূর্বে ‘বিগ ব্যাং’ তথা মহা বিস্ফোরণের মাধ্যমে সৃষ্টিজগৎ আপনা-আপনি অস্তিত্ব লাভ করেছে এবং এগুলিকে আল্লাহ সৃষ্টি করেননি বলে মিথ্যা প্রমাণ পেশ করা। একারণে হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন,مَا أَنْتَ بِمُحَدِّثٍ قَوْمًا حَدِيثًا لاَ تَبْلُغُهُ عُقُولُهُمْ إِلاَّ كَانَ لِبَعْضِهِمْ فِتْنَةٌ- ‘তুমি কাউকে এমন কথা বলো না, যা তাদের বোধগম্য হবে না। ফলে এতে তারা ফিৎনায় পড়ে যাবে’ (মুসলিম হা/৫)। যেমন ফেৎনায় পড়েছেন যুগে যুগে অসংখ্য দার্শনিক এবং বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীবৃন্দ। দিনের আলোয় হারিকেন নিয়ে রাস্তা অনুসন্ধানীর ন্যায় তারা জীবনভর মিথ্যা মরীচিকার পিছনে ছুটে চলেছেন (নূর ২৪/৩৯)। ফলে এরা নিজেরা পথভ্রষ্ট হয়েছেন, অন্যদেরও পথভ্রষ্ট করছেন। তরুণ শিক্ষার্থীদের কচি মনে এইসব ভ্রান্ত ব্যক্তিদের অবোধ্য দর্শন উপস্থাপন করা হ’তে আদর্শ শিক্ষকদের দূরে থাকা কর্তব্য।

(৯) কোন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে যাওয়া : এর দ্বারা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে মহববত বৃদ্ধি পায় ও সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়। রাসূল (ছাঃ) তাঁর খাদেম অসুস্থ ইহূদী বালককে তার বাড়ীতে দেখতে যান। অতঃপর যখন দেখেন যে, বালকটি মৃত্যুপথযাত্রী, তখন তিনি তাকে বলেন, তুমি ইসলাম কবুল কর। তখন বালকটি তার পিতার দিকে তাকাল। ইহূদী পিতা বলল,أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ، ‘তুমি আবুল কাসেমের কথা মেনে নাও! অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বললেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي أَنْقَذَهُ بِي مِنَ النَّارِ- ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি আমার মাধ্যমে ছেলেটিকে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচালেন’।[11] এর মধ্যে রোগীর সেবা ও তাকে জান্নাত লাভের সঠিক পথ প্রদর্শনের দলীল রয়েছে। অতএব শিক্ষকের কর্তব্য হবে তার স্নেহের শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে দেখতে যাওয়া এবং সদুপদেশ দেওয়া।

(১০) সকল শিক্ষার্থীর সাথে ন্যায়বিচার করা :

শিক্ষার্থীদের সবাইকে সমান নযরে দেখা এবং সর্বদা তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা (মুসলিম হা/১৮২৭; মিশকাত হা/৩৬৯০)। বিশেষ করে পরীক্ষায় কারু প্রতি পক্ষপাতিত্ব না করা এবং ফলাফল দানের সময় যার যা পাওনা, তা সঠিকভাবে প্রদান করা। কারণ এর পরিণতিতে তিনি আল্লাহর কঠিন পাকড়াওয়ের শিকার হবেন (নিসা ৪/৮৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْمُقْسِطِينَ عِنْدَ اللهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُورٍ، عَنْ يَّمِينِ الرَّحْمَنِ عَزَّ وَجَلَّ، وَكِلْتَا يَدَيْهِ يَمِينٌ، الَّذِينَ يَعْدِلُونَ فِي حُكْمِهِمْ وَأَهْلِيهِمْ وَمَا وَلُوا- ‘ন্যায়বিচারকগণ (ক্বিয়ামতের দিন) মহিমান্বিত ও দয়ালু আল্লাহর ডানপাশে নূরের মিম্বর সমূহে বসবেন। আর আল্লাহর উভয় হাতই ডান হাত। তারা হ’লেন ঐসব ব্যক্তি, যারা তাদের শাসনে, পরিবারে এবং তাদের অধিনস্তদের মধ্যে ন্যায়বিচার করে’ (মুসলিম হা/১৮২৭; মিশকাত হা/৩৬৯০)

(১১) শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বদা স্নেহশীল ও কল্যাণকামী থাকা :

শিক্ষক সর্বদা শিক্ষার্থীর প্রতি স্নেহশীল ও কল্যাণকামী থাকবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَّمْ يَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ شَرَفَ كَبِيرِنَا- ‘ঐ ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে ছোটকে সেণহ করে না ও বড়দের মর্যাদা বুঝে না’।[12] হাদীছটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজের জন্য একটি চিরন্তন দিগদর্শন। আর এই দিগদর্শন কেবল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে নয়, বরং একই আদর্শের অনুসারীদের মধ্যে যদি কারু সাথে কোনদিন সাক্ষাৎ না-ও হয়, তথাপি তাদের পরস্পরের মহববতের সম্পর্ক ক্বিয়ামত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। যেমন রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কি বলেন, যে একদল লোককে ভালবাসে, কিন্তু তাদের সাথে কখনো সাক্ষাৎ হয়নি? জবাবে তিনি বললেন,الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ- ‘মানুষ তার সঙ্গেই থাকবে, যাকে সে ভালবাসে’।[13] অতএব শিক্ষক-শিক্ষার্থী সশরীরে হোক বা অদৃশ্যভাবে হোক, অ্যাকচুয়াল হোক বা ভার্চুয়াল হোক, দেশে হোক বা বিদেশে হোক, বিশুদ্ধ দ্বীনের আদর্শিক অনুসারী যিনিই হবেন, তিনিই ক্বিয়ামতের দিন পরস্পরে একত্রে থাকবেন। আর আল্লাহ যাকে কবুল করেন, জিব্রীলের মাধ্যমে জগদ্বাসীর অন্তরে তিনি সেটি নিক্ষেপ করে দেন । যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন তিনি জিব্রীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ভালবাসি, তুমিও তাকে ভালবাস। ...অতঃপর তিনি আল্লাহর হুকুমে আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ভালবাসেন। অতএব তোমরাও তাকে ভালবাসো। তখন আসমানবাসীরা তাকে ভালবাসতে থাকেন। অতঃপর পৃথিবীতেও তাকে গ্রহণযোগ্য করে দেওয়া হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ঘৃণা করেন, তখন তিনি জিব্রীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুককে ঘৃণা করি, অতএব তুমিও তাকে ঘৃণা কর। ...অতঃপর তিনি আল্লাহর হুকুমে আসমানবাসীদের মধ্যে ঘোষণা করে দেন যে, আল্লাহ অমুক বান্দাকে ঘৃণা করেন। অতএব তোমরাও তাকে ঘৃণা কর। তখন আসমানবাসীরা তাকে ঘৃণা করতে থাকেন। অতঃপর পৃথিবীতেও তাকে ঘৃণার পাত্র করে দেওয়া হয়’।[14]

রাসূল (ছাঃ) বলেন,الأَرْوَاحُ جُنُودٌ مُّجَنَّدَةٌ، فَمَا تَعَارَفَ مِنْهَا ائْتَلَفَ، وَمَا تَنَاكَرَ مِنْهَا اخْتَلَفَ- ‘রূহ সমূহ (আত্মার জগতে) ভাল-মন্দ মিলিত সেনাবাহিনীর ন্যায় একত্রিত ছিল। সেখানে যে সব রূহ যাদের পসন্দ করত, দুনিয়াতেও তাদের সাথে পরিচিত হ’লে তারা পরস্পরে বন্ধু হবে। আর সেখানে যে সব রূহ যাদের অপসন্দ করত, দুনিয়াতেও তারা তাদের সাথে পরিচিত হ’লে তাদের সাথে মতভেদ করবে’।[15] অর্থাৎ আখেরাতের ন্যায় দুনিয়াতেও তারা ‘হিযবুল্লাহ’ (আল্লাহর বাহিনী) ও ‘হিযবুশ শায়ত্বান’ (শয়তানের বাহিনী) হবে (মুজাদালাহ ৫৭/১৯, ২২; মিরক্বাত)

হাদীছে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,وَجَبَتْ مَحَبَّتي لِلْمُتَحَابِّيْنَ فِيَّ، وَالْمُتَجَالِسيْنَ فِيَّ، وَالْمُتَزَاوِرِيْنَ فِيَّ، وَالْمُتَبَاذِلِيْنَ فِيَّ- ‘আমার ভালোবাসা ওয়াজিব হয়ে যায় তাদের জন্য, যারা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য পরস্পরকে ভালোবাসে, পরস্পরে বৈঠক করে, পরস্পরে সাক্ষাৎ করে এবং পরস্পরে ব্যয় করে’।[16]

অতএব শিক্ষকের কর্তব্য হবে তার শিক্ষার্থীকে আল্লাহর প্রিয় বান্দারূপে গড়ে তোলা এবং শিক্ষার্থীদের প্রতি সর্বদা স্নেহশীল থাকা।

শিক্ষার্থীর কর্তব্য :

শিক্ষার্থী মূলতঃ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে দ্বীনী ইলম শিক্ষা করবেন। ফলে সে জীবনের যে অবস্থানেই থাকুক না কেন, সর্বদা সে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাজ করবে। কোন অবস্থাতেই সে দ্বীনকে হাতছাড়া করবে না এবং আখেরাত বিক্রি করে দুনিয়া হাছিল করবে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيقًا إِلَى الْجَنَّةِ- ‘যে ব্যক্তি ইল্ম শিক্ষার জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের একটি পথ সহজ করে দেন’।[17] এখানে ‘ইল্ম’ অর্থ ‘দ্বীনী ইল্ম’ (মিরক্বাত)। যা জান্নাতের পথ দেখায়।

আর কুরআন-সুন্নাহর ইল্ম হ’ল ‘আল্লাহর অহি’। যা সত্য ও শাশ্বত এবং যার মধ্যে দুনিয়া ও আখেরাতের কল্যাণ রয়েছে (বাক্বারাহ ২/২০১)। পক্ষান্তরে দুনিয়াবী ইল্ম দুনিয়ার তাকীদে মুমিন-কাফের সবাই শেখে। আর উক্ত ইলম হ’ল ধারণা নির্ভর। যেখানে শাশ্বত সত্য বলে কিছু নেই (ইউনুস ১০/৩৬)। যেমন একই বিজ্ঞান একেক সময় একেক তথ্য প্রকাশ করছে। ফলে আজকে যা সত্য, কাল তা মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে। যেমন সূর্য ঘোরে, না পৃথিবী ঘোরে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক সময় ছিল বিস্তর মতভেদ। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী পিথাগোরাস (খৃ. পূ. ৫৭০-৪৯৫) বলেন, পৃথিবী ঘোরে, সূর্য স্থির। তার প্রায় সাতশ’ বছর পর মিসরীয় বিজ্ঞানী টলেমী (৯০-১৬৮ খৃ.) বলেন, সূর্য ঘোরে পৃথিবী স্থির। তার প্রায় চৌদ্দশ’ বছর পর পোলিশ বিজ্ঞানী কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খৃ.) বলেন, টলেমীর ধারণা ভুল। বরং পৃথিবীই ঘোরে, সূর্য স্থির। কিন্তু এখন সবাই বলছেন, আকাশে সবকিছুই ঘোরে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাযার বছর পূর্বে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে কুরআন ঘোষণা করেছে,كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَّسْبَحُوْنَ- ‘নভোমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই সন্তরণশীল’ (আম্বিয়া ২১/৩৩; ইয়াসীন ৩৬/৪০)

কারণ মনুষ্য বিজ্ঞানের উৎস হ’ল ‘অনুমিতি’। যা যেকোন সময় ভুল প্রমাণিত হ’তে পারে। তাই বিজ্ঞানীরা বলেন, Science gives us but a partial knowledge of reality ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়’।[18]

মানুষ যতবড় জ্ঞানীই হৌক সে তার ভবিষ্যৎ জানেনা। এক মিনিট পরে তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে, সে বলতে পারে না। পৃথিবীতে বসবাস ও তা পরিচালনার জন্য যাকে যতটুকু জ্ঞান দেওয়ার প্রয়োজন, আল্লাহ তাকে ততটুকু দান করেছেন এবং প্রকৃত জ্ঞানের ভান্ডার নিজ হাতে রেখেছেন। সীমিত জ্ঞানের মানুষ চিরকাল নিজেদের মধ্যে হৈ চৈ করেছে স্রেফ আন্দাজ-অনুমানের উপর ভিত্তি করে। এমনকি শত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও বিজ্ঞান মানুষকে এযাবৎ কেবল ‘আংশিক সত্য’ (Partial truth) উপহার দিতে পেরেছে, ‘চূড়ান্ত সত্য’ (Absolute truth) নয়।

রাসূল (ছাঃ) বলেন, ...দ্বীনী ইলম শিক্ষার্থীর জন্য ফেরেশতারা তাদের ডানা সমূহ বিছিয়ে দেয় এবং আসমান ও যমীনে যা কিছু আছে, সবাই উক্ত শিক্ষার্থীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। এমনকি পানির মধ্যেকার মাছ পর্যন্ত। আর আলেমের মর্যাদা আবেদের উপর যেমন পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা নক্ষত্ররাজির উপর। নিশ্চয়ই আলেমগণ নবীগণের ওয়ারিছ। আর নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম রেখে যান না কেবল ইল্ম ব্যতীত। যে ব্যক্তি সেটি গ্রহণ করল, সে পূর্ণমাত্রায় সেটি পেয়ে গেল’।[19]

তিনি আরও বলেন,فَضْلُ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِي عَلَى أَدْنَاكُمْ، ثُمَّ قَالَ رَسُولُ اللهِ -صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- إِنَّ اللهَ وَمَلاَئِكَتَهُ وَأَهْلَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ حَتَّى النَّمْلَةَ فِي جُحْرِهَا وَحَتَّى الْحُوتَ لَيُصَلُّونَ عَلَى مُعَلِّمِ النَّاسَ الْخَيْرَ- ‘আবেদের উপর আলেমের মর্যাদা, যেমন তোমাদের উপর আমার মর্যাদা। অতঃপর তিনি বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর

ফেরেশতামন্ডলী এবং নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে বসবাসকারী এমনকি গর্তের পিঁপড়া ও পানির মাছ পর্যন্ত দো‘আ করে মানুষকে উত্তম শিক্ষা দানকারী ব্যক্তির উপর’।[20] অত্র হাদীছে জাহিল আবেদের উপরে জ্ঞানী আলেমের উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। সাথে সাথে তারা যাতে নিজেদের উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে সর্বদা সজাগ থাকেন, সে বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে।

মানুষের জ্ঞানের দরজা খুলে দেওয়া বা না দেওয়াটা আল্লাহর রহমতের উপর নির্ভরশীল। তিনি কাউকে তা বেশী দেন। কাউকে কম দেন। কাউকে যৎসামান্য দেন। এজন্য সর্বদা দো‘আ করতে বলা হয়েছে,رَبِّ زِدْنِي عِلْمًا- ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও!’ (ত্বোয়াহা ২০/১১৪)। অতঃপর শিক্ষার্থীরা নিম্নোক্ত বিষয়গুলি স্মরণ রাখবে।-

(১) ইখলাছ : প্রথমেই শিক্ষার্থীকে দ্বীনী ইল্ম শিখার নিয়তে একনিষ্ঠ হ’তে হবে। কেননা লক্ষ্যে একনিষ্ঠ ও অবিচল থাকা ব্যতীত দুনিয়াতে কিছুই অর্জন করা সম্ভব নয়। আল্লাহ বলেন,أَلاَ لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ، ‘মনে রেখ, একনিষ্ঠ আনুগত্য স্রেফ আল্লাহরই প্রাপ্য’ (যুমার ৩৯/৩)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، ‘সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[21] অতএব দ্বীনী বা দুনিয়াবী যে ইলম হাছিল করুক না কেন, লক্ষ্য থাকতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন এবং আখেরাতে আল্লাহর চেহারা দর্শন। ভবিষ্যতে বড় কোন পেশাজীবী বা পদাধিকারী ব্যক্তি হ’লে সেখানেও যেন একই দ্বীনী লক্ষ্য থাকে।

(২) লেখাপড়ায় সর্বদা অগ্রবর্তী থাকার প্রচেষ্টা চালানো : কেননা ইসলাম হ’ল লেখাপড়ার দ্বীন। যার প্রথম অহি হ’ল ‘ইক্বরা’ ‘পড় তুমি তোমার প্রতিপালকের নামে’ (‘আলাক্ব ৯৬/১)। ঐ লেখাপড়া যা শিক্ষার্থীকে তার প্রতিপালকের সন্ধান দেয়। যিনি তাকে লেখাপড়ার মেধা, যোগ্যতা ও পরিবেশ দান করেছেন।                                                                                                                                                                                              (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)


[1]. আহমাদ হা/১৭৪০; সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ‘নাজাশীর দরবারে কুরায়েশ প্রতিনিধি দল’ অনুচ্ছেদ ১৫৮ পৃ.।

[2]. তিরমিযী হা/২৭০৬; আবুদাঊদ হা/৫২০৮; মিশকাত হা/৪৬৬০।

[3]. তিরমিযী হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/৪৬৫৩; ছহীহাহ হা/৮১৬।

[4]. বায়হাক্বী শো‘আব হা/৮৮১৬; মিশকাত হা/৪৬৭৬; ছহীহাহ হা/৮১৭।

[5]. আহমাদ হা/৭৩৯৭ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[6]. মুসলিম হা/১৪৭৮; মিশকাত হা/৩২৪৯ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।

[7]. বুখারী হা/৪৬৯৮; মুসলিম হা/২৮১১ রাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)।

[8]. মুসলিম হা/১৯০১; মিশকাত হা/৩৮১০ রাবী আনাস (রাঃ)।

[9]. দ্র. লেখক প্রণীত সীরাতুর রাসূল (ছাঃ), ৩য় মুদ্রণ ‘যুদ্ধ শুরু’ অনুচ্ছেদ ২৯৭ পৃ.।

[10]. মুসলিম হা/১৯০১; মিশকাত হা/৩৮১০ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, রাবী আনাস (রাঃ); সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ২৯৯ পৃ.।

[11]. আবুদাঊদ হা/৩০৯৫; বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪।

[12]. তিরমিযী হা/১৯২০ রাবী আমর বিন শো‘আয়েব তাঁর পিতা ও দাদা হ’তে; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪৪৪।

[13]. বুখারী হা/৬১৭০; মুসলিম হা/২৬৪০; মিশকাত হা/৫০০৮; মিরক্বাত।

[14]. মুসলিম হা/২৬৩৭; মিশকাত হা/৫০০৫ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায় ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ; বুখারী হা/৬০৪০ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[15]. বুখারী হা/৩৩৩৬; মিশকাত হা/৫০০৩ রাবী আয়েশা (রাঃ)।

[16]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৫০৭; তিরমিযী হা/২৩৯০; মিশকাত হা/৫০১১ ‘শিষ্টাচার সমূহ’ অধ্যায়-২৫ ‘সালাম’ অনুচ্ছেদ-১ রাবী মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ); আলবানী, ছহীহুত তারগীব হা/২৫৮১।

[17]. মুসলিম হা/২৬৯৯; মিশকাত হা/২০৪ রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[18]. মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী ৫ম প্রকাশ ১৪১৯ হি./১৯৯৮ খৃ.) ৬১ পৃ.; দ্র. সীরাতুর রাসূল (ছাঃ) ৩য় মুদ্রণ ‘কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ’ অধ্যায় ৭৯১ পৃ.।

[19]. তিরমিযী হা/২৬৮২; মিশকাত হা/২১২ রাবী আবুদ্দারদা (রাঃ)।

[20]. তিরমিযী হা/২৬৮৫; মিশকাত হা/২১৩ রাবী আবু উমামা বাহেলী (রাঃ)।

[21]. বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭; মিশকাত হা/১ রাবী ওমর (রাঃ)।