মানব সৃষ্টির ইতিহাস

আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلاَلَةٍ مِّنْ طِينٍ- ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَّكِينٍ- ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ- ‘নিশ্চয়ই আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি মাটির নির্যাস থেকে’। ‘অতঃপর আমরা তাকে (পিতা-মাতার মিশ্রিত) জনন কোষরূপে (মায়ের গর্ভে) নিরাপদ আধারে সংরক্ষণ করি’। ‘অতঃপর উক্ত জননকোষকে আমরা পরিণত করি জমাট রক্তে। তারপর জমাট রক্তকে পরিণত করি মাংসপিন্ডে। অতঃপর মাংসপিন্ডকে পরিণত করি অস্থিতে। অতঃপর অস্থিসমূহকে ঢেকে দেই মাংস দিয়ে। অতঃপর আমরা ওকে একটি নতুন সৃষ্টিরূপে পয়দা করি। অতএব বরকতময় আল্লাহ কতই না সুন্দর সৃষ্টিকারী!’ (মুমিনূন ২৩/১২-১৪)

উক্ত আয়াতগুলিতে মানব সৃষ্টির সূচনাগত ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে।

প্রথম পর্যায়ে মাটি থেকে সরাসরি আদমকে অতঃপর আদম থেকে তার স্ত্রী হাওয়াকে সৃষ্টি করার পরবর্তী পর্যায়ে আল্লাহ আদম সন্তানদের মাধ্যমে বনু আদমের বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছেন। এখানেও রয়েছে সাতটি স্তর। যেমন : মৃত্তিকার সারাংশ তথা প্রোটোপ্লাজম, বীর্য বা শুক্রকীট, জমাট রক্ত, মাংসপিন্ড, অস্থিমজ্জা, অস্থি পরিবেষ্টনকারী মাংস এবং সবশেষে রূহ সঞ্চারণ।[1] স্বামীর শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে রক্ষিত ডিম্বকোষে প্রবেশ করার পর উভয়ের সংমিশ্রিত বীর্যে সন্তান জন্ম গ্রহণ করে (দাহর ৭৬/২)। উল্লেখ্য যে, পুরুষের একবার নির্গত লম্ফমান বীর্যে লক্ষ-কোটি শুক্রাণু থাকে। আল্লাহর হুকুমে তন্মধ্যকার একটি মাত্র শুক্রকীট স্ত্রীর জরায়ুতে প্রবেশ করে। এই শুক্রকীট পুরুষ ক্রোমোজম Y অথবা স্ত্রী ক্রোমোজম X হয়ে থাকে। এর মধ্যে যেটি স্ত্রীর ডিম্বের X ক্রোমোজমের সাথে মিলিত হয়, সেভাবেই পুত্র বা কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে আল্লাহর হুকুমে।

মাতৃগর্ভের তিন তিনটি গাঢ় অন্ধকার পর্দার অন্তরালে (যুমার ৩৯/৬) দীর্ঘ নয় মাস ধরে বেড়ে ওঠা প্রথমতঃ একটি পূর্ণ জীবন সত্তার সৃষ্টি, অতঃপর একটি জীবন্ত প্রাণবন্ত ও প্রতিভাবান শিশু হিসাবে দুনিয়াতে ভূমিষ্ট হওয়া কতই না বিস্ময়কর ব্যাপার। কোন মানুষের পক্ষে এই অকল্পনীয় সৃষ্টিকর্ম আদৌ সম্ভব কী? ঐ গোপন কুঠরীতে পিতার ২৩টি ক্রোমোজম ও মাতার ২৩টি ক্রোমোজম একত্রিত করে সংমিশ্রিত বীর্য কে প্রস্ত্তত করেন? অতঃপর ১২০ দিন পরে তাতে রূহ সঞ্চার করে তাকে জীবন্ত মানব শিশুতে পরিণত করেন এবং পূর্ণ-পরিণত হওয়ার পরে সেখান থেকে বাইরে ঠেলে দেন (‘আবাসা ৮০/১৮-২০)

আল্লাহ বলেন,إِنَّا خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ نُطْفَةٍ أَمْشَاجٍ نَبْتَلِيهِ فَجَعَلْنَاهُ سَمِيعًا بَصِيرًا- ‘আমরা মানুষকে সৃষ্টি করেছি (পিতা-মাতার) মিশ্রিত জনন কোষ হ’তে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। অতঃপর আমরা তাকে করেছি শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টিশক্তি সম্পন্ন’ (দাহর ৭৬/২)

আধুনিক বিজ্ঞান এ তথ্য জানতে পেরেছে মাত্র ১৮৭৫ সালে ও ১৯১২ সালে। তার পূর্বে এরিস্টটল সহ সকল বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল যে, পুরুষের বীর্যের কোন কার্যকারিতা নেই (সৃষ্টিতত্ত্ব ৪২১ পৃ.; নবীদের কাহিনী ১/২৫ পৃ.)। অথচ রাসূলের হাদীছ এটিকে বাতিল ঘোষণা করেছে।

যেমন উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, ‘একদিন আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলায়েম (রাঃ) এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ সত্য বলায় লজ্জা পান না। নারীদের স্বপ্নদোষ হলে তাদের গোসল আছে কি? তিনি বললেন, হ্যাঁ। যখন সে পানি দেখে। এতে উম্মে সালামাহ লজ্জায় মুখ ঢাকেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, নারীর কি স্বপ্নদোষ হয়? তিনি বললেন, তোমার ডান হাত ধূলি ধূসরিত হৌক! না হ’লে তার সন্তান তার চেহারার সদৃশ কিভাবে হয়?’ ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় বর্ধিতভাবে এসেছে, ‘পুরুষের বীর্য গাঢ় ও সাদা এবং স্ত্রীর বীর্য পাতলা ও হলদে। উভয়ের মধ্যে (আল্লাহর হুকুমে) যেটি জয়ী হয় অথবা গর্ভাশয়ে প্রবেশ করে সন্তান তার সদৃশ হয়’।[2]

আল্লাহ বলেন,لِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ يَخْلُقُ مَا يَشَاءُ يَهَبُ لِمَنْ يَّشَآءُ إِنَاثًا وَّيَهَبُ لِمَنْ يَّشَآءُ الذُّكُورَ- أَوْ يُزَوِّجُهُمْ ذُكْرَانًا وَّإِنَاثًا وَّيَجْعَلُ مَنْ يَّشَآءُ عَقِيمًا إِنَّهُ عَلِيمٌ قَدِيرٌ- ‘আল্লাহর জন্যই রাজত্ব নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের। তিনি যা চান তাই সৃষ্টি করেন। তিনি যাকে চান কন্যা সন্তান দান করেন ও যাকে চান পুত্র সন্তান দান করেন’। ‘অথবা যাকে চান পুত্র ও কন্যা যমজ সন্তান দান করেন এবং যাকে চান বন্ধ্যা করেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান’ (শূরা ৪২/৪৯-৫০)

বীর্য মাতৃগর্ভে ৬ দিন বুদ্বুদ আকারে থাকে। তারপর জরায়ুতে সম্পর্কিত হয়। ৩ মাসের আগে ছেলে বা মেয়ে চিহ্নিত হয় না। ৪ মাস পর তাতে রূহ ফুঁকে দেওয়া হয়। তাতে বাচ্চা নড়েচড়ে ওঠে ও আঙ্গুল চুষতে থাকে। যাতে সে জন্মের পর মায়ের স্তন চুষতে পারে। এ সময় তার কপালে চারটি বস্ত্ত লিখে দেওয়া হয়। আজাল, আমল, রিযিক, ভাগ্যবান বা হতভাগা।[3]

উল্লেখ্য যে, মাটি থেকে সৃষ্ট হওয়া আদমের নাম হ’ল ‘আদম’ এবং জীবন্ত আদমের পাঁজর হ’তে সৃষ্ট হওয়ায় তাঁর স্ত্রীর নাম হ’ল ‘হাওয়া’ (কুরতুবী)। আর আদম থেকেই আল্লাহ সকল মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। যেমন তিনি বলেন,يَآأَيُّهَا النَّاسُ اتَّقُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَّاحِدَةٍ وَّخَلَقَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَبَثَّ مِنْهُمَا رِجَالاً كَثِيرًا وَّنِسَآءً، وَاتَّقُوا اللهَ الَّذِي تَسَآءَلُونَ بِهِ وَالْأَرْحَامَ إِنَّ اللهَ كَانَ عَلَيْكُمْ رَقِيبًا- ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর। যিনি তোমাদেরকে একজন মানুষ থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঐ জোড়া থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন অগণিত পুরুষ ও নারী। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যার দোহাই দিয়ে তোমরা পরস্পরের নিকট প্রার্থনা করে থাক এবং রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয়তা সম্পর্কে সতর্ক থাক। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের উপর সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষক’ (নিসা ৪/১)। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা নারীদের সাথে উত্তম আচরণ কর। কারণ তাদেরকে পাঁজরের হাড় হ’তে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড়ের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বাঁকা হ’ল উপরের হাড় (সে হাড় থেকে নারীদের সৃষ্টি)। অতএব তুমি যদি তাকে সোজা করতে যাও, তবে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি ছেড়ে দাও, তাহ’লে সবসময় বাঁকাই থাকবে। সুতরাং তোমরা নারীদের সাথে ভাল ব্যবহার কর’।[4]

পৃথিবীতে বিচরণশীল সকল প্রাণী আল্লাহর একেকটি পৃথক সৃষ্টি। যেমন তিনি বলেন,وَمَا مِنْ دَآبَّةٍ فِي الْأَرْضِ وَلاَ طَآئِرٍ يَّطِيرُ بِجَنَاحَيْهِ إِلاَّ أُمَمٌ أَمْثَالُكُمْ، ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল প্রাণীকুল এবং দু’ডানায় ভর করে আকাশে সন্তরণশীল পক্ষীকুল তোমাদের মতই একেকটি সৃষ্টি’ (আন‘আম ৬/৩৮)। অতএব মানুষ ও বানর দু’টিই পৃথক জাতি। মানুষ কখনো বানর ছিল না এবং বানর কখনো মানুষ হয় না। আজও কোন বানর মানুষ হচ্ছে না। 

অতঃপর মায়ের গর্ভে শিশুর আকৃতি গঠন সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,هُوَ الَّذِي يُصَوِّرُكُمْ فِي الْأَرْحَامِ كَيْفَ يَشَآءُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ- ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি মায়ের গর্ভে তোমাদের আকৃতি গঠন করেন যেভাবে তিনি ইচ্ছা করেন। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আলে ইমরান ৩/৬)। তিনি আরও বলেন, خَلَقَكُمْ مِنْ نَفْسٍ وَّاحِدَةٍ، ثُمَّ جَعَلَ مِنْهَا زَوْجَهَا وَأَنْزَلَ لَكُمْ مِنَ الْأَنْعَامِ ثَمَانِيَةَ أَزْوَاجٍ يَخْلُقُكُمْ فِي بُطُونِ أُمَّهَاتِكُمْ خَلْقًا مِّنْ بَعْدِ خَلْقٍ فِي ظُلُمَاتٍ ثَلاَثٍ، ‘তিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি (আদম) হ’তে। অতঃপর তার থেকে তার জোড়া (হাওয়াকে) সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন আট প্রকার গবাদিপশু। তিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে ত্রিবিধ অন্ধকারে একটার পর একটা সৃষ্টির মাধ্যমে’ (যুমার ৩৯/৬)। ঐ তিনটি অন্ধকার হ’ল মায়ের পেট, জরায়ু ও জরায়ু মুখ বা গর্ভাধার। আর সবকিছুই আল্লাহ নিজ হাতে করেছেন। যেমন তিনি বলেন,قَالَ يَآإِبْلِيسُ مَا مَنَعَكَ أَنْ تَسْجُدَ لِمَا خَلَقْتُ بِيَدَيَّ، ‘হে ইবলীস! আমি যাকে আমার দু’হাত দিয়ে সৃষ্টি করেছি, তাকে সিজদা করতে তোমাকে কোন্ বস্ত্ত বাধা দিল?’ (ছোয়াদ ৩৮/৭৫)

মানুষ সৃষ্টির ৩টি পর্যায় নির্ধারণের মধ্যে প্রথমে অবয়ব গঠন ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মধ্যে শক্তির আনুপাতিক হার বণ্টন, পরস্পরের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান ও সবশেষে রূহ সঞ্চার। মৃত্তিকাজাত সকল প্রাণীর জীবনের প্রথম ও মূল একক (Unit) হ’ল ‘প্রোটোপ্লাজম’ (Protoplasm)। যাকে বলা হয় ‘আদি প্রাণসত্তা’। এ থেকেই সকল প্রাণী সৃষ্টি হয়েছে। এজন্য ফরাসী চিকিৎসাবিদ ও বিজ্ঞানী মরিস বুকাইলী (১৯২০-১৯৯৮ খৃ.) একে Bomb shell বলে অভিহিত করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে মাটির সকল প্রকারের রাসায়নিক উপাদান। মানুষের জীবন বীজে প্রচুর পরিমাণে ৪টি উপাদান পাওয়া যায়। অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, কার্বন ও হাইড্রোজেন।

আর ৮টি পাওয়া যায় সাধারণভাবে সমপরিমাণে। সেগুলি হ’ল- ম্যাগনেশিয়াম, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ক্লোরিন, সালফার ও আয়রণ। আরও ৮টি পদার্থ পাওয়া যায় স্বল্প পরিমাণে। সিলিকন, মোলিবডেনাম, ফ্লুরাইন, কোবাল্ট, ম্যাঙ্গানিজ, আয়োডিন, কপার ও যিংক। এই ২০টি উপাদান সংমিশ্রিত করে জীবনের কণা বা Protoplasm তৈরী হয়। জনৈক বিজ্ঞানী ১৫ বছর ধরে উক্ত উপাদানগুলি মিশিয়ে জীবন সৃষ্টির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। জনৈক বিজ্ঞানী দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে এসব মৌল উপাদান সংমিশ্রিত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছেন এবং তাতে কোন জীবনের ‘কণা’ পরিলক্ষিত হয়নি (সৃষ্টিতত্ত্ব ৪০৮ পৃ.)। এই সংমিশ্রণ ও তাতে জীবন সঞ্চার আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। বিজ্ঞান এক্ষেত্রে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে (নবীদের কাহিনী ১/২৪)

কেননা রূহ সৃষ্টির ক্ষমতা কারু নেই। যেমন আল্লাহ বলেন,وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَآ أُوتِيتُمْ مِنَ الْعِلْمِ إِلاَّ قَلِيلاً- ‘আর ওরা তোমাকে প্রশ্ন করছে ‘রূহ’ সম্পর্কে। তুমি বল, রূহ আমার প্রতিপালকের একটি আদেশ মাত্র। আর এ বিষয়ে তোমাদের অতি সামান্যই জ্ঞান দান করা হয়েছে’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৮৫)। তিনি বলেন,إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَآ أَرَادَ شَيْئًا أَنْ يَّقُولَ لَهُ كُنْ فَيَكُونُ- فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَّإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ- ‘যখন তিনি কিছু করতে ইচ্ছা করেন তখন তাকে কেবল বলেন, হও। অতঃপর তা হয়ে যায়’। ‘অতএব (সকল প্রকার শরীক হ’তে) মহা পবিত্র তিনি, যার হাতে রয়েছে সবকিছুর রাজত্ব এবং তাঁর দিকেই তোমরা প্রত্যাবর্তিত হবে’ (ইয়াসীন ৩৬/৮২-৮৩)

সপ্তম শ্রেণীর ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইয়ে লেখা হয়েছে, শিক্ষার্থী ‘নিসর্গ’ বলছে, ‘আমাদের আদি পুরুষেরা নাকি বানর ছিল?’ উত্তরে শিক্ষিকা ‘খুশি আপা’ তাদেরকে ‘লুসি’র গল্প শোনালেন। আর তা এই যে, ১৯৭৪ সালের ২৪শে নভেম্বর ইথিওপিয়ার হাডর এলাকায় বহু পুরানো একটি ফসিল কংকালের কিছু অংশ পাওয়া যায়। গবেষকরা বলছেন, এই কংকাল ছিল ৩২ লক্ষ বছর পূর্বেকার একজন নারীর। যার পায়ের হাড় ছিল প্রায় মানুষের মতোই। অতঃপর ‘খুশি আপা’র নির্দেশ মতে শিক্ষার্থীরা মানুষ ও সমাজ কোথা থেকে এলো’ সেটি বের করার জন্য স্ব স্ব কল্পনা মোতাবেক পরের দিন এ্যসাইনমেন্ট জমা দিল। অতঃপর ‘বিজ্ঞানের চোখ দিয়ে চারপাশ দেখি’ অধ্যায়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করে তারা একটি ‘ফ্লো’ ছক তৈরী করে ফেলল। যেখানে ‘বিভিন্ন সময়ের মানুষ’ শিরোনামে ৪টি ছবি দিয়ে দেখানো হয়েছে যে, বানর থেকে তারা অবশেষে একটি যুবতী নারীতে পরিণত হয়েছে। ‘খুশী আপা’ সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। তাতে সবাই উক্ত পরিকল্পনার প্রশংসা করল।

যদি একথা সত্য হয়, তাহ’লে প্রশ্ন হয় বর্তমান যুগের মানুষ আর ৩২ লক্ষ বছর পূর্বেকার ‘ফসিলে’র বানর কি একই? ‘ফসিলে’র ঐ বানর কি এ যুগের মানুষের মত কথা বলতে পারত? তাদের কি এ যুগের মানুষের মত মেধা ছিল? এ যুগের কথিত এসব পন্ডিতদের কান্ড দেখে মূসা (আঃ)-এর উম্মতের কথা মনে পড়ে। যখন তিনি ‘তাওরাত’ গ্রহণের জন্য ৪০ দিনের মেয়াদে তূর পাহাড়ে দ্রুত গমন করেন এবং বনু ইস্রাঈলদের তার পিছে পিছে আসতে বলেন। সেই সময় তার অনুপস্থিতিতে মুনাফিক ‘সামেরী’ স্বর্ণালংকার সমূহ পুড়িয়ে একটা গোবৎসের মূর্তি তৈরী করে। যা থেকে এক প্রকার শব্দ বের হ’ত। এতে সামেরী ও তার সঙ্গী-সাথীরা উল্লসিত হয়ে বলে উঠল, هَذَا إِلَهُكُمْ وَإِلَهُ مُوسَى فَنَسِيَ- ‘এটাই হ’ল তোমাদের উপাস্য ও মূসার উপাস্য। যা সে পরে ভুলে গেছে’ (ত্বোয়াহা ২০/৮৮)

মূসা (আঃ)-এর তূর পাহাড়ে গমনকে সে অপব্যাখ্যা দিয়ে বলল, মূসা বিভ্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে কোথাও চলে গিয়েছে। এখন তোমরা সবাই গো-বৎসের পূজা কর’।

মূসার বড় ভাই হারূণ (আঃ) তাদেরকে বললেন, ‘হে আমার কওম! তোমরা এই গো-বৎস দ্বারা পরীক্ষায় পতিত হয়েছ। তোমাদের পালনকর্তা অতীব দয়ালু। অতএব তোমরা আমার অনুসরণ কর এবং আমার আদেশ মেনে চল’। ‘কিন্তু সম্প্রদায়ের লোকেরা বলল, মূসা আমাদের কাছে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা এর পূজায় রত থাকব’ (ত্বোয়াহা ২০/৯০-৯১)

বস্ত্ততঃ গো-বৎসের শব্দ থেকেই তারা ফিতনায় পড়ে গিয়েছিল (কুরতুবী)। অথচ সে কোন কথা বলতে পারত না এবং সে ছিল মুক-বধির ও বোবা। তবুও ইহূদী নেতারা তাকেই উপাস্য ভেবে নিয়ে পূজা শুরু করল। এ যুগেও কথিত ‘ফসিলে’র ধোঁকায় পড়ে জ্ঞানী-গুণী লোকেরা নিজেদের আদি পুরুষ বানর ছিল বলে ধারণা করেছেন। অথচ এরূপ চিন্তা করাটাও মানুষের জন্য অপমানকর।

সেদিন মূসা (আঃ) গো-বৎস পূজায় নেতৃত্ব দানকারীদের মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন (বাক্বারাহ ২/৫৪)। এভাবে তাদের কিছু লোককে হত্যা করা হয়, কিছু লোক ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়।

অতঃপর তিনি উক্ত শিরকের প্রচলনকারী সামেরীর শাস্তি ঘোষণা করেছিলেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘মূসা বলল, দূর হও। তোর জন্য সারা জীবন এ শান্তিই রইল যে, তুই বলবি, ‘আমাকে স্পর্শ করো না’। আর তোর জন্য রইল একটি নির্দিষ্ট সময়কাল। যার ব্যতিক্রম হবে না। তুই তোর সেই উপাস্যের প্রতি লক্ষ্য কর যাকে নিয়ে তুই থাকতিস। আমরা সেটিকে (গো-বৎসটিকে) জ্বালিয়ে দেবই। অতঃপর ওটাকে বিক্ষিপ্ত করে সাগরে ছড়িয়ে দেবই’ (ত্বোয়াহা ২০/৯৫-৯৭)

অর্থাৎ মূসা (আঃ) সামেরীর জন্য পার্থিব জীবনে এই শাস্তি নির্ধারণ করেন যে, সবাই তাকে বর্জন করবে এবং কেউ তার কাছে ঘেঁষবে না। তিনি তাকেও নির্দেশ দেন যে, সে কারও গায়ে হাত লাগাবে না। সারা জীবন এভাবেই সে বন্য জন্তুর ন্যায় সবার কাছ থেকে আলাদা থাকবে। এটাও সম্ভবপর যে, পার্থিব আইনগত শাস্তির ঊর্ধ্বে খোদ তার সত্তায় আল্লাহর হুকুমে এমন বিষয় সৃষ্টি হয়েছিল, যদ্দরুন সে নিজেও অন্যকে স্পর্শ করতে পারত না এবং অন্যেরাও তাকে স্পর্শ করতে পারত না।

যেমন এক বর্ণনায় এসেছে যে, মূসা (আঃ)-এর বদদো‘আয় তার মধ্যে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, সে কাউকে হাত লাগালে বা কেউ তাকে হাত লাগালে উভয়েই জ্বরাক্রান্ত হয়ে যেত’ (কুরতুবী, ত্বোয়াহা ২০/৯৫)। এই ভয়ে সে সবার কাছ থেকে আলাদা হয়ে উদ্ভ্রান্তের মত ঘুরত। কাউকে নিকটে আসতে দেখলেই সে চীৎকার করে বলে উঠতো لامِسَاسَ ‘আমাকে কেউ স্পর্শ করো না’। বস্ত্ততঃ মৃত্যুদন্ডের চাইতে এটিই ছিল কঠিন শাস্তি। যা দেখে অপরের শিক্ষা হয়।

প্রশ্ন হ’ল, বর্তমান যুগের এসব বানরবাদীদের শাস্তি কে দিবে? অথচ দেশের বানরগুলির একটিও মানুষ না হ’লেও মানুষের বাচ্চাগুলি সর্বত্র বাঁদরামী করছে। ইভটিজিং, খুন-ধর্ষণ, কিশোর গ্যাং, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, মাদক সেবন ব্যাপকহারে বেড়ে গেছে। প্রশাসন তাদেরকে ঠেকাতে ব্যর্থ হচ্ছে। সমাজ এদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে। এরপরেও সরকারী শিক্ষা সিলেবাসের মাধ্যমে কিশোর-কিশোরীদের যৌন সুড়সুড়ি দেওয়া হচ্ছে। যাতে সমাজের অধঃপতন ত্বরান্বিত হচ্ছে। কি কৈফিয়ত দিবেন প্রশাসন ক্বিয়ামতের দিন?


[1]. মুমিনূন ২৩/১২-১৪; মুমিন ৪০/৬৭; ফুরক্বান ২৫/৪৪; তারেক্ব ৮৬/৫-৭।

[2]. বুখারী হা/১৩০; মুসলিম হা/৩১৩; মিশকাত হা/৪৩৩-৩৪ ‘গোসল’ অনুচ্ছেদ

[3]. বুখারী হা/৭৪৫৪; মুসলিম হা/২৬৪৩; মিশকাত হা/৮২ ‘তাক্বদীরে বিশ্বাস’ অনুচ্ছেদ।

[4]. নিসা ৪/১; বুখারী হা/৩৩৩১; মুসলিম হা/১৪৬৮; মিশকাত হা/৩২৩৮ ‘বিবাহ’ অধ্যায়।