তুরস্ক-সিরিয়ায় ভূমিকম্প

পৃথিবীর অন্যতম সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণ অঞ্চল তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত ও সিরিয়া সীমান্তবর্তী বিস্তৃত অঞ্চলে গত ৬ই ফেব্রুয়ারী সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪-টা ১৭ মিনিটে প্রচন্ড শীত, তুষারপাত ও বৃষ্টিপাতের মধ্যে ৭.৮ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হানে। প্রথম ভূমিকম্পের কিছু পরে ৭.৫ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এভাবে ৫০টির মত আফটার শক (পরাঘাত) তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, সাইপ্রাস ও সুদূর গ্রীণল্যান্ড পর্যন্ত ৫,৫০০ কি.মি. ব্যাপী বিস্তীর্ণ এলাকাকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল প্রাদেশিক রাজধানী গাজিয়ানতেপ থেকে ৩৩ কিলোমিটার (২০ মাইল) দূরে ১৮ কিলোমিটার (১১ মাইল) গভীরে। ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা ১৬ই ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪২ হাযার ছাড়িয়েছে। আহত ও পঙ্গুর সংখ্যা বেহিসাব। রাস্তা-ঘাট বিপর্যস্ত। ভূমিকম্পে শত শত বহুতল ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রতিটি বহুতল ভবনের ধ্বংসস্তূপ যেন একেকটি গণকবর। ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত তুরস্ক ও সিরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় চার কোটি মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। তুরস্কের ১০টি শহর ও প্রদেশে যরূরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। তুর্কী প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান এ ঘটনাকে বিগত ৮৪ বছরের মধ্যে তুরস্কের সবচেয়ে বড় বিপর্যয় বলে অভিহিত করেছেন। তিনি এই ভূমিকম্পকে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

তুরস্কের গাজিয়ানতেপের বাসিন্দা এরদেম বলেন, ভূমিকম্পের সময় চারপাশ দোলনায় দোলার মতো দুলছিল। তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় আদানা শহরের পাঁচতলা বাড়ির বাসিন্দা নিলুফার আসলান বাঁচবেন না ভেবে পরিবারের সবাইকে ডেকে বলতে থাকেন, ভূমিকম্প হচ্ছে। চল, অন্তত সবাই এক ঘরে একসঙ্গে মরি’। তারপরও ধ্বংসস্তূপের নিচে প্রাণের সন্ধান করা হচ্ছে।

ধ্বংসস্তূপে প্রাণের স্পন্দন :

(১) সিরিয়ার ইদলিব প্রদেশে হারেম শহরের ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া দুই কন্যা শিশুর বড়টি তার ছোট বোনকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে ও উদ্ধারকর্মীদের উদ্দেশ্যে আর্ত আবেদন জানাচ্ছে। বড় বোন মরিয়ম তার ছোট ভাইকে আগলে রেখে আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেন সে মরলেও ভাইটি বাঁচে। (২) মুছতফা যহীর বলেন, আমরা দু’দিন ধরে এই ধ্বংসস্তূপের নিচেই আটকে ছিলাম। চাপাপড়া অবস্থায় তিনি এবং তার পরিবার উচ্চস্বরে কুরআন তেলাওয়াত করছিলেন যেন কেউ না কেউ তাদের আওয়ায শুনতে পান। (৩) মৃত মায়ের পাশে দু’টি বাচ্চা। ছোট বাচ্চাটি ক্ষুধায় কাঁদছে। বড় বাচ্চাটি মায়ের দুধ খাওয়ানোর অনুকরণে নিজের গেঞ্জি খুলে ছোট বাচ্চাটির মুখে ধরছে। দুধ ভেবে সে কিছুক্ষণ চুপ থাকছে। আবার কেঁদে উঠছে। উভয় বাচ্চাই জীবিত উদ্ধার হয়েছে। (৪) বাচ্চা জন্মের পরেই মা মারা গেছেন। এমতাবস্থায় নবজাতকটি জীবিত উদ্ধার হয়েছে। (৫) ২২ ঘণ্টা পর উদ্ধার হয় এক নারী। (৬) ৩৩ ঘণ্টা পর তুরস্কের হাতাই প্রদেশে উদ্ধার হয় এক মা ও তার দুই মেয়ে। (৭) ৪৪ ঘণ্টা পর দু’বছরের এক শিশু ও তার মা। (৮) বিশালাকৃতির কংক্রিটের নিচ থেকে একটি হাত বাইরে বের হয়ে রয়েছে। পাশে একটি কুকুর সেই হাত ধরে টানছে আর চিৎকার করছে। যাতে উদ্ধারকারীরা টের পায়। (৯) ১১৯ ঘণ্টা পর তুরস্কের কাহরামানমারাশ শহরের একটি ধ্বংসাবশেষ থেকে ১৬ বছরের এক কিশোর উদ্ধার হয়। (১০) ১২০ ঘণ্টা পর তিন ভাইকে এবং (১১) ১৮২ ঘণ্টা পর ১৩ বছরের এক কিশোরকে তুরস্কের হাতাই প্রদেশের এক ধ্বংসস্তূপের নিচে থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। (১২) এসময় উদ্ধার পাওয়া ৫ বছরের এক শিশুকে জিজ্ঞেস করা হয়, তুমি কিভাবে এতদিন বেঁচে ছিলে? সে বলল, একজন সাদা পোষাকধারী ব্যক্তি আমাকে রোজ খাবার দিত। (১৩) উদ্ধার পাওয়া এক ব্যক্তির হাতে তিনটা রুটি দেওয়া হয়। লোকটি ধ্বংসস্তূপের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে বলল, এখানে আমার তিনটি বহুতল ভবন ছিল। আজ আমার কিছুই নেই। হাতে তিনটি রুটি। সেটিও অন্যের দেওয়া। (১৪) কাহরামানমারাসে ভূমিকম্পের ১৬২ ঘন্টা পরে রোববার আন্টালিয়া ফায়ার ব্রিগেড ৪৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করেছে। (১৫) উদ্ধার পাওয়া একটি বহুতল ভবনের মালিক ও ভাড়া দিতে না পারায় বহিষ্কৃত তার ভাড়াটিয়া উদ্ধারকর্মীদের একই তাঁবুতে স্থান পেয়েছে। দু’জনে আজ একই কাতারে। (১৬) ১৬৬ ঘণ্টা পর ধ্বংসস্তূপ থেকে ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে (১৭) ১৭৮ ঘণ্টা পর তুরস্কের আদিয়ামানে এক তরুণীকে এবং একই শহরে ৩৫ বছর বয়সী এক মহিলাকে উদ্ধার করা হয়। (১৮) ১৯৮ ঘণ্টা পর একই শহরের একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপ থেকে ‘মুহাম্মাদ’ নামের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণকে, (১৯) ২০০ ঘণ্টা পর তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশের একটি অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের ধ্বংসস্তূপ থেকে দুই ভাইকে, (২০) ২০৭ ঘণ্টা পর তুরস্কের আদিয়ামানের ধ্বংসস্তূপ থেকে ‘রামাযান’ নামের একজনকে, (২১) ২০৯ ঘণ্টা পর দেশটির হাতাই প্রদেশের ধ্বংসস্তূপ থেকে এক পিতা ও তাঁর মেয়েকে, (২২) ২১২ ঘণ্টা পর ৭৭ বছর বয়সী এক নারীকে, (২৩) ১৪ই ফেব্রুয়ারী মঙ্গলবার তুরস্কের কাহরামানমারাস থেকে ১৭ ও ২১ বছর বয়সের দুই ভাইকে, (২৪) হাতাই প্রদেশের এক ধ্বংসস্তূপ থেকে ৭৪ বছরের এক নারীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। (২৫) ভূমিকম্পের ১০ দিন পর গত ১৬ই ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার কাহরামানমারাস থেকে এক কিশোরীকে জীবিত উদ্ধার করা হয়। বাংলাদেশ সহ ৭০টি দেশ থেকে উদ্ধারকর্মী দল প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নিয়ে সেখানে উদ্ধারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে লাশপচা গন্ধ ও ক্ষুধার্তদের হামলার মধ্যে তারা জানবাজি রেখে সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহনশীলতার সাথে মানবতার সেবায় নিজেদেরকে উৎসর্গ করে চলেছেন। আল্লাহ তাদের সর্বোত্তম জাযা দান করুন!

পিছন ফিরে দেখা : ২০০৪ সালের ২৬শে ডিসেম্বর ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা উপকূলে ৯.১৫ মাত্রার ভূমিকম্পে সৃষ্ট সুনামি ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, ভারত ও বাংলাদেশ সহ বিশাল অঞ্চলে অনুভূত হয়। তাতে ২ লাখ ৩০ হাযার মানুষ নিহত এবং অগণিত মানুষ নিখোঁজ হয়। ২০১৫ সালের ২৫শে এপ্রিল নেপালে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে ৯ হাযার মানুষ নিহত ও ৮০ লাখ মানুষ বিপর্যয়ের শিকার হয়। পরে ১২ই মে ১৯ কি.মি. গভীর থেকে আরেকটি ভূমিকম্প হয় এবং ২৪ ঘণ্টায় ৫০ বার থেমে থেমে কম্পন হয়। তাতে হিমালয় পর্বত কিছুটা দেবে যায় এবং রাজধানী কাঠমন্ডু শহর কিছুটা সরে যায়। মার্কিন জিওলজিক্যাল সার্ভে রিপোর্ট অনুযায়ী নেপালের প্রচন্ড ভূমিকম্পের চাইতে ৩২ গুণ তীব্রতা নিয়ে খুব শীঘ্রই আসছে আরেকটি মহা ভূমিকম্প। যাতে পুরা পৃথিবীর মানচিত্র বদলে যাবে। নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল।

ধ্বংসের কারণ ও ইতিহাস : মানুষের নানা ধরনের পাপ বৃদ্ধির ফলে ইতিপূর্বে বহু জাতি ধ্বংস হয়েছে। এভাবে আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর আদি ৬টি জাতি হ’ল, কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, লূত, মাদিয়ান ও কওমে ফেরাঊন। কওমে নূহ ও কওমে ফেরাউনকে আল্লাহ ধ্বংস করেছেন মহাপ্লাবনে ডুবিয়ে। কওমে ‘আদ-এর নেতারা দম্ভ করে বলেছিল, আমাদের চাইতে শক্তিশালী পৃথিবীতে আর কে আছে? (হা-মীম সাজদাহ ১৫)। তারা তাদের নবী হূদ (আঃ)-এর অবাধ্যতা করেছিল। তারা (ক) প্রতিটি উঁচু স্থানে অযথা নিদর্শন নির্মাণ করত। (খ) বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করত। (গ) নিষ্ঠুর যালেমের মত মানুষকে মারত। ফলে তাদের উপর নেমে আসে প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু। যা ৭ রাত ও ৮ দিন অবিরতভাবে চলে এবং সবাই নিজ নিজ গৃহে মরে পড়ে থাকে (হা-ক্কাহ ৬-৮)

কওমে ছামূদ ধবংস হওয়ার কারণ ছিল তাদের ৯ জন নেতার চূড়ান্ত হঠকারিতা। তাদের নবী ছালেহ (আঃ)-এর অবাধ্যতা করেছিল। ফলে আল্লাহ তাদেরকে ৩ দিন সময় দেন। এতেও তারা ঠাট্টা করে। ফলে প্রথম দিন তাদের চেহারা হলুদ হয়, পরের দিন লাল এবং তৃতীয় দিন ঘোর কৃষ্ণ রূপ ধারণ করে। নবী তাদের ছেড়ে চলে যান। তখন তাদের দম্ভ চূর্ণ করার জন্য নেমে আসে বজ্র নিনাদ ও ভূমিকম্প। এতে তারা সবাই একত্রে ধ্বংস হয় (আ‘রাফ ৭৮; শাম্স ১১-১৫)কওমে লূত সমকামিতায় লিপ্ত হয়েছিল। তারা নবী লূত (আঃ)-এর অবাধ্যতা করে। তারা প্রকাশ্যে কুকর্ম এবং লুটপাট ও রাহাযানিতে দেশে চূড়ান্ত বিপর্যয় সৃষ্টি করে। ফলে প্রধান শহর ‘সাদূম’ সহ পাঁচটি শহরকে আল্লাহ একত্রে আকাশে উঠিয়ে উল্টা ফেলে ধ্বংস করে দেন (হূদ ৮২-৮৩)। ফিলিস্তীন ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী ৭৭ কি.মি. দৈর্ঘ ও ১২ কি.মি. প্রস্থ এবং ৪০০ মিটার গভীরতা সহ বিশাল অঞ্চল জুড়ে অদ্যাবধি যা নদীর রূপ ধারণ করে আছে। যেখানে মাছ, ব্যাঙ কোন প্রাণীই জন্মায় না। কওমে শো‘আয়েব ধ্বংস হয়েছিল ওযন ও মাপে কম দেওয়া, রাহাযানি ও লুটপাট করা এবং সমাজে অনর্থ সৃষ্টির কারণে। তারা তাদের নবীর উপদেশকে বিদ্রুপ করে বলে, আপনি আপনার ছালাত নিয়ে থাকুন। আমাদের আয়-উপার্জনের হালাল-হারাম নিয়ে কথা বলবেন না। সমস্ত সংস্কার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার ফলে শো‘আয়েব (আঃ) আল্লাহর নিকট ফায়ছালা কামনা করেন। তখন নেমে আসে চূড়ান্ত গযব (আ‘রাফ ৮৯-৯১)। প্রথমে ৭ দিন প্রচন্ড গরম। পরে ঘনকালো মেঘ ও শীতল বায়ু। তখন অতিষ্ঠ মানুষ সব মেঘের নীচে গিয়ে আশ্রয় নেয়। অতঃপর মেঘ থেকে নেমে আসে অগ্নিবৃষ্টি এবং সাথে সাথে ভূমিকম্প। নিমেষে ধ্বংস হয়ে যায় পুরা জাতি।

উম্মতে মুহাম্মাদীকে তাই সতর্ক করে আল্লাহ বলেন, ‘তারা কি তাহ’লে আল্লাহর পাকড়াওয়ের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে? বস্ত্ততঃ আল্লাহর পাকড়াও থেকে নিশ্চিন্ত হয় কেবল ক্ষতিগ্রস্ত সম্প্রদায়’ (আ‘রাফ ৯৯)। পৃথিবীর অন্যতম ভূমিকম্প-প্রবণ বলয়ে অবস্থিত বাংলাদেশের মানুষ কি সাবধান হবে না? আল্লাহ আমাদের হেফাযত করুন- আমীন! (স.স.)