যাকাত ও ছাদাক্বার কল্যাণকারিতা

আল্লাহ বলেন,لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوا مِمَّا تُحِبُّونَ، وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ شَيْءٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ- ‘তোমরা কখনোই কল্যাণ লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত থেকে দান করবে। আর তোমরা যা কিছু ব্যয় কর, আল্লাহ তা সবই জানেন’ (আলে ইমরান ৩/৯২)

আল্লাহর নিকট ছওয়াব লাভের দৃঢ় আশায় নিঃস্বার্থভাবে আল্লাহর পথে ব্যয় করাকে ‘ছাদাক্বা’ বলা হয়। তবে পারিভাষিক অর্থে সঞ্চিত ধন ও অন্যান্য সম্পদের ‘নেছাব’ পরিমাণ অংশের বাধ্যতামূলক দানকে ‘যাকাত’ বলা হয়। বাকী সকল প্রকার ঐচ্ছিক দানকে ‘ছাদাক্বা’ বলা হয়।

‘যাকাত’ ও ‘ছাদাক্বা’ বিনিয়োগ হয়। ফলে সমাজে সম্পদ বৃদ্ধি পায় ও তার প্রবাহ ঘটে। পক্ষান্তরে সূদ কেবল শোষণ করে। যা পুনরায় ঋণ দিলে পুনরায় শোষণ করে। এমনকি ঋণের মেয়াদ শেষ হ’লে তার সূদ আসলের সাথে যোগ করে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ বাড়তেই থাকে। যা ঋণ গ্রহীতাকে রক্তহীন করে ফেলে। একসময় ক্রেতার অভাবে উৎপাদকের উৎপন্ন দ্রব্য গুদামজাত হয়ে পড়ে থাকে। ফলে ঋণদাতা নিঃস্ব হয়। অন্যদিকে সূদ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে ঋণগ্রহীতা নিঃস্ব হয়। আর এজন্যই কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ সূদকে নিঃশেষ করেন ও ছাদাক্বায় প্রবৃদ্ধি দান করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘সূদ যতই বৃদ্ধি পাক, এর পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা’।[1]

সূদী প্রথা সারা বিশ্বকে হিংস্র অক্টোপাসের মত গ্রাস করেছে। যা বিশ্ব মানবতাকে আষ্টে-পৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে। এর বিরুদ্ধেই ইসলামের যুগান্তকারী বিধান হ’ল যাকাত ও ছাদাক্বা ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। যা মানবতার রূহ স্বরূপ।

(১) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, যখন উক্ত আয়াত নাযিল হয়, তখন আবুদ্দাহদাহ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ কি আমাদের নিকট ঋণ চাচ্ছেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, ‘তাহ’লে আমার প্রতিপালককে আমি ঋণ দিলাম শ্রেষ্ঠ খেজুর বাগানটি, যাতে ছয়শ’ খেজুর গাছ আছে’। অতঃপর তিনি বাগানে গেলেন। যেখানে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা ছিল। সেখানে গিয়ে তিনি স্ত্রীকে ডেকে বললেন, ‘বেরিয়ে এস। কেননা আমি ছয়শ‘ খেজুর গাছের এই বাগানটি আমার প্রতিপালককে ঋণ দিয়েছি’।[2]

জাবের বিন সামুরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (ছাঃ) আবুদ্দাহদাহ-এর জানাযা করে ফিরে আসার সময় বলেন,كَمْ مِنْ عِذْقٍ مُعَلَّقٍ فِى الْجَنَّةِ لأَبِى الدَّحْدَاحِ- ‘আবুদ্দাহদাহর জন্য জান্নাতে কত খেজুরের কাঁদিই না ঝুলন্ত রয়েছে![3]

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য সাতশ’ গুণ নেকী লেখা হয়’।[4] 

(৩) ছাদাক্বাদাতা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর ছায়াতলে থাকবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘সাত শ্রেণীর লোক যাদেরকে আল্লাহ ছায়া দিবেন নিজের ছায়ায়, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। ...(৭) সেই ব্যক্তি, যে গোপনে দান করে, এমনকি তার বাম হাত জানতে পারেনা, তার ডান হাত কী দান করল’।[5]

(৪) তিনি বলেন,وَالصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النَّارَ، ‘ছাদাক্বা গোনাহকে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়’।[6] অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের ছায়া হবে তার ছাদাক্বা’।[7]

(৫) তিনি আরও বলেন,إِنَّ الصَّدَقَةَ لَتُطْفِئُ عَنْ أَهْلِهَا حَرَّ الْقُبُورِ- ‘নিশ্চয় ছাদাক্বা কবরের উত্তাপ নিভিয়ে দেয় এবং ক্বিয়ামতের দিন মুমিন তার ছাদাক্বার ছায়াতলে আশ্রয় পাবে... মানুষের মধ্যে বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত’।[8]

(৬) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আসমা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা)-কে বলেন,أَنْفِقِى وَلاَ تُحْصِى فَيُحْصِىَ اللهُ عَلَيْكِ، ‘(আল্লাহর পথে) ব্যয় করো, হিসাব করো না। তাহ’লে আল্লাহ তোমার উপর তাঁর রহমতকে হিসাব করবেন। আর হাত গুটিয়ে রেখ না, তাহ’লে আল্লাহও তোমার থেকে হাত গুটিয়ে নিবেন’।[9]

(৭) রাসূল (ছাঃ) বলেন, هُمُ الْأَخْسَرُونَ وَرَبِّ الْكَعْبَةِ... ‘কা‘বার রবের কসম! তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। রাবী বলেন আমি বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গীত হৌন! তারা কারা? রাসূল (ছাঃ) বললেন, যাদের ধন-সম্পদ বেশী তারা। কিন্তু যে ব্যক্তি এরূপ করে, এরূপ করে ও এরূপ করে (অর্থাৎ) সামনের দিকে, পিছন দিকে, ডান দিকে ও বাম দিকে (সর্বদা দান করে)। তবে এরূপ লোক খুবই কম’।[10]

(৮) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর চেহারা কামনায় লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলল এবং সেটাই যদি তার শেষ কথা হয়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি আল্লাহর চেহারা কামনায় একদিন ছিয়াম রাখল এবং সেটাই যদি তার শেষ আমল হয়, তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর চেহারা কামনায় ছাদাক্বা করল এবং সেটাই যদি তার শেষ আমল হয়, তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[11] ‘আল্লাহর চেহারা কামনা’ অর্থ জান্নাতে সরাসরি আল্লাহর চেহারা দর্শন (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২২-২৩)

(৯) আল্লাহ বলেন,وَمَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمُ ابْتِغَآءَ مَرْضَاتِ اللهِ وَتَثْبِيتًا مِّنْ أَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍم بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَآتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ، فَإِنْ لَّمْ يُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ، وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ- ‘আর যারা ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও ছওয়াব লাভের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে, তাদের উদাহরণ সমভূমির ঐ বাগিচার মত, যেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত হ’লে দ্বিগুণ শস্য উৎপাদিত হয়। আর প্রবল বৃষ্টি না হ’লে হাল্কা বৃষ্টিই যথেষ্ট হয়। বস্ত্ততঃ তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই দেখেন’ (বাক্বারাহ ২/২৬৫)

(১০) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘হে আদম সন্তান! আমি পীড়িত ছিলাম, কিন্তু তুমি আমার সেবা করোনি। বান্দা বলবে, হে আল্লাহ! কিভাবে আমি আপনাকে সেবা করব? অথচ আপনি জগত- সমূহের প্রতিপালক! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা পীড়িত ছিল? অথচ তুমি তার সেবা করোনি। তুমি কি জানো না যদি তুমি তাকে সেবা করতে, তাহ’লে তুমি আমাকে সেখানে পেতে? হে আদম সন্তান! আমি খাদ্য চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে খাদ্য দাওনি।... হে আদম সন্তান! আমি পানি চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি আমাকে পানি দাওনি।... তুমি কি জানো না যদি তুমি তাকে পানি পান করাতে, তাহ’লে তুমি আমাকে সেখানে পেতে?[12]

(১১) আল্লাহ বলেন,وَأَنْفِقُوا فِي سَبِيلِ اللهِ وَلاَ تُلْقُوا بِأَيْدِيكُمْ إِلَى التَّهْلُكَةِ وَأَحْسِنُوآ إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُحْسِنِينَ- ‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎকর্ম কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ২/১৯৫)। অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয় না করলে তোমরা ধ্বংস হয়ে যাবে।

(১২) আল্লাহ বলেন,فَاتَّقُوا اللهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ وَاسْمَعُوا وَأَطِيعُوا وَأَنْفِقُوا خَيْرًا لِّأَنْفُسِكُمْ وَمَنْ يُّوقَ شُحَّ نَفْسِهِ فَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ- ‘অতএব তোমরা সাধ্যমত আল্লাহকে ভয় কর। তাঁর কথা শোন ও মান্য কর এবং (আল্লাহর পথে) ব্যয় কর। এটা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। বস্ত্ততঃ যারা তাদের হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’।[13] দান করার সময় এ নিয়ত রাখতে হবে যে, এটা আমি আল্লাহকে ঋণ দিচ্ছি। এর বিনিময়ে তিনি বহুগুণ বেশী দিবেন।

(১৩) জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ যে ব্যবসায়ের কথা বলেছেন, সেখানেও তিনি বলেছেন,يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ- تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ، ذَالِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হ’তে মুক্তি দিবে?’ (১০)। ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে। সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম হবে, যদি তোমরা বুঝ’ (ছফ ৬১/১০-১১)। উক্ত আয়াতে মালের কথা আগে বলা হয়েছে, কারণ জিহাদে প্রথম মালের প্রয়োজন হয় (কুরতুবী)। একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ- ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[14] এখানেও মালের কথা আগে বলা হয়েছে। অতএব মুসলিম জীবনে কৃপণতার কোন অবকাশ নেই।

(১৪) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোন বস্ত্তর একটি জোড়া দান করবে, উক্ত ব্যক্তি জান্নাতের সকল দরজা থেকে আহূত হবে। যেমন মুছল্লী, মুজাহিদ, দানশীল ও ছায়েমদের দরজা। তখন আবুবকর বললেন, সকল দরজা দিয়ে আহবানের প্রয়োজন নেই (একটি দরজাই যথেষ্ট)। তবে আসলে কি কেউ সকল দরজা দিয়ে আহূত হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, نَعَمْ، وَأَرْجُوْ أَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ- ‘হ্যাঁ। আর আমি আশা করি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।[15]

(১৫) ছাদাক্বায় পরকালীন সঞ্চয় : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يَقُوْلُ الْعَبْدُ مَالِىْ مَالِىْ، إِنَّ مَا لَهُ مِنْ مَالِهِ ثَلاَثٌ : مَا أَكَلَ فَأَفْنَى أَوْ لَبِسَ فَأَبْلَى أَوْ أَعْطَى فَاقْتَنَى، وَمَا سِوَى ذَلِكَ فَهُوَ ذَاهِبٌ وَتَارِكُهُ لِلنَّاسِ- ‘বান্দা বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ তার মাল সমূহের মধ্যে তার জন্য মাল হ’ল মাত্র তিনটি : যা সে খায় ও শেষ করে। যা সে পরিধান করে ও জীর্ণ করে এবং যা সে ছাদাক্বা করে ও সঞ্চয় করে। এগুলি ব্যতীত বাকী সবই চলে যায় এবং লোকদের জন্য সে ছেড়ে যায়’।[16]

(১৬) নবী করীম (ছাঃ) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি কি নিজের সম্পদের চাইতে তার উত্তরাধিকারীর সম্পদকে অধিক প্রিয় মনে করে? তারা সবাই বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই, যে তার নিজের সম্পদকে সবচেয়ে অধিক প্রিয় মনে করে না। তখন তিনি বললেন,فَإِنَّ مَالَهُ مَا قَدَّمَ، وَمَالُ وَارِثِهِ مَا أَخَّرَ- ‘নিশ্চয় তার নিজের মাল তা-ই, যা সে (আল্লাহর পথে ব্যয়ের মাধ্যমে) অগ্রিম পাঠায়। আর যা সে পিছনে ফেলে যায়, সেগুলি তার উত্তরাধিকারীর মাল’।[17]

(১৭) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘একটি খেজুরের টুকরা দান করে হ’লেও জাহান্নামের আগুন থেকে তোমাদের চেহারাকে বাঁচানো উচিত। যদি কারু এতটুকু সামর্থ্যও না থাকে, তবে একটি সুন্দর কথা দ্বারা’ (তিরমিযী হা/২৯৫৩)

(১৮) রাসূল (ছাঃ) বলেন,يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ، فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ، يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ، فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ، وَيَبْقَى عَمَلُهُ- ‘মাইয়েতের সঙ্গে তিনজন যায়। তাদের মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন থেকে যায়। তার সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়’।[18]

(১৯) রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর কসম! আখেরাতের মোকাবিলায় দুনিয়ার তুলনা সাগরের পানিতে আঙ্গুল ডুবানোর ন্যায়। অতঃপর সে দেখুক! কতটুকু নিয়ে তা ফিরে আসে’।[19] তিনি বলেন,مَوْضِعُ سَوْطٍ فِي الْجَنَّةِ خَيْرٌ مِنَ الدُّنْيَا وَمَا فِيهَا- ‘জান্নাতের একটি চাবুক রাখার স্থান দুনিয়া ও তার মধ্যেকার সবকিছুর চাইতে উত্তম’।[20] তিনি জান্নাতবাসীদের পুরস্কার সম্পর্কে বলেন,قَالَ اللهُ تَعَالَى: أَعْدَدْتُ لِعِبَادِيَ الصَّالِحِينَ مَا لاَ عَيْنٌ رَأَتْ وَلاَ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلاَ خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بشر، واقْرَؤوا إِنْ شِئْتُمْ : فَلاَ تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّآ أُخْفِيَ لَهُمْ مِنْ قُرَّة أَعْيُنٍ جَزَآءً بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- ‘আল্লাহ বলেছেন, আমি আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছি এমন সব সুখ-সম্ভার, যা কোন চোখ কখনো দেখেনি, কান কখনো শুনেনি, হৃদয় কখনো কল্পনা করেনি। রাবী বলেন, তোমরা চাইলে পড়তে পার, ‘অতঃপর কেউ জানেনা তাদের জন্য চক্ষু শীতলকারী কি কি বস্ত্ত লুক্কায়িত রয়েছে তাদের কৃতকর্মের পুরস্কার হিসাবে’।[21]

(২০) হযরত জাবের (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূল (ছাঃ) বাজারের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। এমন সময় রাস্তার পাশে একটি মরা কানকাটা বকরীর বাচ্চা পড়ে থাকতে দেখে তিনি বললেন, তোমরা এটি কত দিরহাম মূল্যে কিনতে চাও? তারা বলল, আমরা এটা আদৌ কিনতে চাইনা। তখন তিনি বললেন,فَوَاللهِ لَلدُّنْيَا أَهْوَنُ عَلَى اللهِ مِنْ هَذَا عَلَيْكُمْ- ‘আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই দুনিয়া আল্লাহর নিকট এই মৃত বকরীর চাইতেও নিকৃষ্ট’।[22]

(২১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মু‘আযকে ইয়ামনের গভর্ণর করে পাঠান। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) মারা যান। পরবর্তীতে হযরত ওমরের সময় তিনি সেখানকার এক তৃতীয়াংশ ছাদাক্বার মাল মদীনায় পাঠান। কিন্তু ওমর (রাঃ) তা নিতে অস্বীকার করে বলেন, আমি তোমাকে সেখানে কর আদায়কারীরূপে পাঠাইনি। বরং তোমাকে পাঠিয়েছি সেখানকার ধনীদের নিকট থেকে ছাদাক্বা নিয়ে সেখানকার হকদারদের মধ্যে তা বিতরণ করার জন্য। জবাবে মু‘আয বললেন,مَا بَعَثْتُ إِلَيْكَ بِشَىْء وَأَنَا أَجِدُ أَحَدًا يَأْخُذُه مِنِّى! ‘আমি আপনার নিকটে কিছু পাঠাতাম না, যদি আমি আমার নিকট থেকে যাকাত নেওয়ার মত কাউকে পেতাম! পরের বছর তিনি সেখান থেকে ছাদাক্বার অর্ধাংশ প্রেরণ করেন। তৃতীয় বছর পুরোটাই প্রেরণ করেন। প্রতিবারেই ওমর (রাঃ) আপত্তি করেন এবং প্রতিবারেই মু‘আয (রাঃ) একই জবাব দেন’।[23] এ ঘটনায় ইসলামী অর্থনীতির বরকত প্রমাণিত হয়। মুসলিম রাষ্ট্রগুলি এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে কি?

বস্ত্ততঃ যাকাত ও ছাদাক্বা হ’ল সামাজিক সাম্য ও দারিদ্র্য বিমোচনের পূর্বশর্ত। উৎপাদক তার লভ্যাংশ থেকে যাকাত দেন। হকদারগণ সেটা গ্রহণ করেন। অতঃপর তা দিয়ে তারা উৎপাদিত পণ্য খরীদ করেন। ফলে যাকাতের অর্থ পুনরায় উৎপাদকের ঘরেই ফিরে যায়। এভাবে যাকাত ও ছাদাক্বার মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ অব্যাহত থাকে এবং সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে।

খলীফা ওমর (রাঃ)-এর ১০ বছরের খেলাফতকালে যদি যাকাত নেওয়ার মত কোন লোক খুঁজে না পাওয়া যায় তাহ’লে আধুনিক যুগের রকমারি গণতন্ত্রের জয়জয়কারের মধ্যে দেশে দেশে কঙ্কালসার মানুষের ভিড় কেন? কেন সর্বত্র ভুখা-মিছিল ও নেতাদের কাঙ্গালী ভোজের প্রদর্শনী। কেন কথিত ন্যাযমূল্যের দোকান ও ট্রাকের পিছনে মানুষের দীর্ঘ লাইন? কেন মুষ্টিমেয় ধনীর যাকাত নেওয়ার ভিড়ে পদতলে পিষ্ট হয়ে মানুষ মরছে দৈনন্দিন? জাহেলী আরবের ফেলে আসা গাছতলা ও পাঁচতলার রক্তচোষা পূজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে সেদিন আল্লাহ প্রেরিত ইসলামী অর্থনীতির বরকত পেয়ে যেমন বুভুক্ষু মানবতা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল, আজও সেটি সম্ভব, যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলি স্ব স্ব দেশে ইসলামী অর্থনীতি এবং ইসলামী শাসন ও বিচার ব্যবস্থা চালু করেন। যার মাধ্যমে মানবতা নিরাপদ ও সুরক্ষিত হবে।

সবচেয়ে বড় কথা হ’ল, পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে ‘সূদ গ্রহীতা ও সূদ দাতা উভয়ে জাহান্নামে রক্তের নদীতে ভাসবে। কিনারে আসতে চাইলেই তাকে পাথর মেরে মস্তক চূর্ণ করে দেওয়া হবে। আবার জোড়া লাগানো হবে। এভাবে চলতে থাকবে চিরদিন। কিন্তু সে কিনারে উঠতে পারবে না’।[24] সূদী অর্থনীতির অনুসারীরা সেদিন বাঁচতে পারবেন কি? আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!


[1]. ইবনু মাজাহ হা/২২৭৯

[2]. মুসনাদে বায্যার হা/২০৩৩

[3]. মুসলিম হা/৯৬৫

[4]. তিরমিযী হা/১৬২৫; মিশকাত হা/৩৮২৬

[5]. বুখারনী মুসলিম মিশকাত হা/৭০১

[6]. আহমাদ হা/১৫৩১৯; মিশকাত হা/২৯

[7]. আহমাদ হা/১৮০৭২; মিশকাত হা/১৯২৫

[8]. ছহীহাহ হা/৩৪৮৪

[9]. বুখারনী মুসলিম মিশকাত হা/১৮৬১

[10]. মুসলিম হা/৯৯০; মিশকাত হা/১৮৬৮

[11]. ছহীহুত তারগীব হা/৯৮৫

[12]. মুসলিম হা/২৫৬৯; মিশকাত হা/১৫২৮

[13]. তাগাবুন ৬৪/১৬; হাশর ৫৯/৯

[14]. আবুদাঊদ হা/২৫০৪; মিশকাত হা/৩৮২১

[15]. বুখারনী মুসলিম মিশকাত হা/১৮৯০

[16]. মুসলিম হা/২৯৫৯; মিশকাত হা/৫১৬৬

[17]. বুখারী হা/৬৪৪২; মিশকাত হা/৫১৬৮

[18]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫১৬৭

[19]. মুসলিম হা/২৮৫৮; মিশকাত হা/৫১৫৬

[20]. বুখারী হা/৩২৫০; মিশকাত হা/৫৬১৩

[21]. সাজদাহ ৩১/১৭; বুখারনী মুসলিম মিশকাত হা/৫৬১২

[22]. মুসলিম হা/২৯৫৭; মিশকাত হা/৫১৫৭

[23]. ইরওয়া হা/৮৫৬-এর আলোচনা

[24]. বুখারী হা/২০৮৫; মিশকাত হা/৪৬২১