মানবাধিকার সবার জন্য সমান

প্রত্যেক মানুষের স্বভাবগত মৌলিক অধিকারকে ‘মানবাধিকার’ বলা হয়। যেমন জান-মাল-ইযযত, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থান, শিক্ষা-চিকিৎসা এবং সর্বোপরি স্বাধীন ও সম্মানজনকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার। মানবাধিকার সর্বদা পরস্পর সম্পর্কিত। তা কখনো এককভাবে অর্জিত হয় না। আর এ কারণেই মানুষ সর্বদা সমাজবদ্ধ থাকতে বাধ্য এবং সে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অপরের অধিকার অর্জনে ও তা সংরক্ষণে সহযোগিতা করে থাকে। মানুষ পরস্পরের অধিকারের প্রতি যত বেশী যত্নবান হবে, সমাজে তত বেশী শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত হবে। এর বিপরীত হ’লে সমাজে অশান্তি ও অধঃপতন ত্বরান্বিত হবে। এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, মানবাধিকার অক্ষুণ্ণ রাখার উপায় কি? জবাব এই যে, ব্যক্তি এমন কাজ করবে না যা সমাজে অশান্তি ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করে। পক্ষান্তরে সমাজ এমন কাজ করবে না, যা ব্যক্তির সম্মান ও স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ করে। প্রশ্ন হ’ল, ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সামঞ্জস্য রক্ষার উপায় কি? এর জবাব দু’ভাবে পাওয়া যায় : মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত জবাব ও সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত জবাব।

(১) আল্লাহর বিধান যেহেতু সবার জন্য সমান, তাই স্বেচ্ছাচারী লোকেরা তা মানতে অস্বীকার করে কিংবা এড়িয়ে চলে। ফলে সুবিধাবাদী মানুষ নিজের মনমত জবাব তৈরী করতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। কারণ মানুষ নিজেই নিজের পরিচয় ও অবস্থান সম্পর্কে অজ্ঞ। সে তার ভবিষ্যৎ জানে না। সে কে? তার পরিচয় কি? তার মর্যাদা কি? তার অধিকার কি? সঠিকভাবে সে কিছুই বলতে পারে না। কেউ বলেন, সে একটি সামাজিক জীব। কেউ বলেন, অর্থনৈতিক জীব। কেউ বলেন, সে একটি যৌন প্রাণী। কেউ বলেন, সে আসলে মানুষই নয়, বরং বানরের বংশধর।

প্রশ্ন হ’ল, মানুষ যদি তার নিজের পরিচয়ই না জানে, তাহ’লে তার অধিকার সে কিভাবে নির্ণয় করবে? বিগত যুগে শক্তিশালী গোত্র ও সমাজনেতারা যেভাবে নিজেরা কিছু বিধান রচনা করে নিজেদের স্বার্থ পাকাপোক্ত করে নিত, এ যুগেও তার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সমাজবিদ বিভিন্ন পথ বাৎলিয়েছেন। যা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যুগে যুগে হাযারো মানুষের জীবন গিয়েছে। কিন্তু মানুষ কোনটাতেই স্থির থাকেনি। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ জীবননদীর এ তীরে ধাক্কা খেয়ে মানুষ অনেক আশা নিয়ে অপর তীরে গিয়েছে। কিন্তু সেখানে ধাক্কা খেয়ে আশাহত অবস্থায় পুনরায় ফিরে মাঝনদীতে হাবুডুবু খেয়েছে। বর্তমানে যার জগাখিচুড়ী দার্শনিক নাম দেওয়া হয়েছে দ্বান্দ্বিক বস্ত্তবাদ। যা থিসিস, এন্টিথিসিস ও সিনথিসিসের সমন্বিত নাম। চমৎকার এই আকর্ষণীয় মোড়কের মধ্যে রয়েছে কেবল বিংশ শতাব্দীর কয়েক কোটি নিহত বনু আদমের শুকনো রক্তের গুঁড়া পাউডার। অতঃপর বর্তমানে বিভিন্ন ইযম ও তন্ত্র-মন্ত্রের নামে মানবাধিকার রক্ষার ধুয়া তুলে নিজ দেশের নিরীহ জনগণের মানবাধিকার প্রতিনিয়ত হরণ করা হচ্ছে। সাথে সাথে অন্য দেশের মাটি ও মানুষের উপর অবিশ্রান্ত ধারায় বোমা ও গোলা-বারুদ নিক্ষেপ করে এবং মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমানের হামলা চালিয়ে বিরামহীনভাবে রক্ত ঝরিয়ে কিংবা নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে ভাটির দেশকে শুকিয়ে ও ডুবিয়ে মেরে অথবা কূটনৈতিক প্রতারণার ফাঁদে ফেলে মানুষের মৌলিক অধিকার হরহামেশা লুণ্ঠন করা হচ্ছে। সেই সাথে কায়েমী স্বার্থবাদীদের অর্থে পুষ্ট শত শত মিডিয়া অহরহ ঐসব রক্তপিপাসুদের বন্দনায় মুখর হচ্ছে। ফলে মানবতা ও মানবাধিকার নীরবে নিভৃতে গুমরে মরছে।

যেমন নিয়ত গুমরে মরছে অসহায় ফিলিস্তীনীদের মৌলিক মানবাধিকার। যেখানে আমেরিকার পাঠানো প্রাণঘাতি হাযার হাযার টন বোমার মাধ্যমে গত ৭ই অক্টোবর থেকে ৮ই ডিসেম্বর পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ১৭ হাযারের অধিক ও আহতের সংখ্যা ৪৬ হাযার ছাড়িয়ে গেছে। যাদের ৭০ শতাংশ নারী-শিশু। বাস্ত্তচ্যুত হয়েছে ১৫ লাখের অধিক ফিলিস্তীনী। অথচ কথিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের স্বঘোষিত বিশ্ব মোড়ল আমেরিকা এগুলি করে যাচ্ছে নির্বিকার চিত্তে। অর্থ ও অস্ত্রশক্তিতে বলিয়ান হয়ে তারা মানুষকে মানুষ বলেই মনে করে না। অদ্যাবধি তারা সেখানে অস্ত্র ও গোলা-বারুদ সরবরাহ করে যাচ্ছে নির্লজ্জভাবে। বিশ্ব ব্যাপী নিন্দার ঝড় উঠলেও তারা সেগুলি শুনতে পায় না। মুক-বধির ও অন্ধের মত তারা এযুগের ফেরাউন ইস্রাঈলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামীন নেতানিয়াহুকে লালন করে যাচ্ছে। যদিও তার বিরুদ্ধে দেশ ও বিদেশের হাযার হাযার ইস্রাঈলী ধিক্কার ও নিন্দা জানিয়ে মিছিল-মিটিং করছে। 

অবাক করা তাজা খবর হ’ল ইয়েল নোয় নামক জনৈকা ইস্রাঈলী মহিলার পরিচালিত ‘রোড টু রিকভারি’ নামের একটি দাতব্য স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ফিলিস্তীনের পশ্চিম তীর ও গাযার মুমূর্ষু রোগীদের বিশেষ করে শিশুদের খুঁজে বের করে ইস্রাঈলের ভেতরে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। ব্যাপক বোমাবর্ষণ ও রক্তপাতের মধ্যেও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কয়েকজন সঙ্গী সহ একাজ চালিয়ে যাচ্ছেন এই ইস্রাঈলী নারী। সংবাদ মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘আমাদের মত গাযাবাসীও এ সংঘাতের ভুক্ত ভোগী। তাই আমি আগের মতো ফিলিস্তীনীদের সহায়তা করতে শুরু করেছি। কেননা এখনকার পরিস্থিতির জন্য তাদের কোন দায় নেই। তিনি বলেন, তারা আমাদের প্রতিবেশী। তাদের সহায়তা দরকার। আর আমাদেরও তাদের সহায়তা করা প্রয়োজন’ (দৈনিক প্রথম আলো ৯.১২.২৩ পৃ. ১১)। আমরা এই ইস্রাঈলী নারী ও তার দাতব্য সংস্থাকে ধন্যবাদ জানাই।

এদিকে গাযায় ইস্রাঈলী বিভীষিকা বন্ধে গত ৮ই ডিসেম্বর শুক্রবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আনীত প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে আমেরিকা। এজন্য জাতিসংঘে ইস্রাঈলের দূত গিলাদ এরদান ইস্রাঈলের পক্ষে ‘অটলভাবে দাঁড়ানো’র জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। উল্লেখ্য যে, ১৫ সদস্যের নিরাপত্তা পরিষদে আমেরিকা ও ইংল্যান্ড উক্ত যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। তাতেই প্রস্তাবটি ভন্ডুল হয়ে যায়। কি চমৎকার গণতন্ত্র!

(২) অতঃপর মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণে এলাহী জবাব এই যে, মানুষ আল্লাহর বিধানমতে চললেই কেবল তার মানবাধিকার নিশ্চিত থাকবে। মানুষ সৃষ্টিকুলের সেরা ও জ্ঞানসম্পন্ন একক প্রাণী। আকাশ, পৃথিবী ও এর মধ্যকার সবকিছু মানুষের সেবায় নিয়োজিত। কিন্তু সে নিজে আল্লাহর কর্তৃত্বের অধীন। আল্লাহর দাসত্বে সকল মানুষ স্বাধীন। আল্লাহর বিধানের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। এখানে উঁচু-নীচু, সাদা-কালো, কিংবা শাসক ও শাসিতের মধ্যে আইনগত কোন ভেদাভেদ নেই। আল্লাহর সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি তথা তাওহীদ বিশ্বাসের মধ্যে মানুষের নৈতিক সমানাধিকার যেমন নিশ্চিত করা হয়েছে, আল্লাহর বিধান সমূহের বাস্তবায়নের মাধ্যমে তার আইনগত সমানাধিকার তেমনি নিশ্চিত করা হয়েছে। এর ফলাফল দাঁড়িয়েছে এই যে, কৃষ্ণকায় ক্রীতদাস বেলাল নিমেষে সকলের ভাই হয়ে গেলেন। এমনকি তার মর্যাদা বেড়ে এতদূর পৌঁছল যে, কা‘বা গৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে আযান দেওয়ার ও পরবর্তীতে মদীনার মসজিদে নববীর স্থায়ী মুওয়াযযিন হওয়ার শ্রেষ্ঠতম গৌরবের অধিকারী হলেন। খেলাফতের বায়‘আত অনুষ্ঠানের ভাষণে ১ম খলীফা আবুবকর (রাঃ) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যকার দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট অধিক শক্তিশালী, যতক্ষণ না আমি তার অধিকার তাকে ফিরিয়ে দিতে পারি। আর তোমাদের মধ্যকার সবল ব্যক্তি আমার নিকটে অধিক দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার নিকট থেকে দুর্বলের প্রাপ্য হক আদায় করতে পারি’ (ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৬/৩০১)। মৃত্যুকালে কপর্দকহীন আবুবকর নিজের কাফনের জন্য কন্যা আয়েশাকে বললেন, আমার পরনের কাপড় দিয়ে আমার কাফনের ব্যবস্থা করো। কেননা জীবিত ব্যক্তিরাই নতুন কাপড়ের অধিক হকদার’ (বুখারী হা/১৩৮৭)। ওমর (রাঃ)-এর যুগে অর্থনৈতিক সাম্য ও সমৃদ্ধি এতদূর পৌঁছেছিল যে, যাকাত নেওয়ার মত কোন হকদার পাওয়া যেত না। খেলাফতে রাশেদাহর ছত্রে ছত্রে এমন অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমনকি পরবর্তীকালে খেলাফতের ক্ষয়িষ্ণু আমলেও এমন বহু নযীর রয়েছে, আধুনিক বিশ্ব যা কল্পনাও করতে পারে না।

প্রশ্ন হ’ল, মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার এই অভূতপূর্ব প্রেরণার মূল উৎস কি ছিল? জওয়াব একটাই। আর সেটা হ’ল, বিশ্বাসের পরিবর্তন। আগে মানুষ নিজেকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী মনে করত। ফলে সে স্বেচ্ছাচারী ছিল। এখন সে আল্লাহকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী মনে করে। আগে সে নিজের রচিত বিধানকে চূড়ান্ত ভাবত। এখন সে আল্লাহর বিধানকে চূড়ান্ত সত্যের অভ্রান্ত মানদন্ড বলে বিশ্বাস করে। আগে সে দুনিয়াকেই সবকিছু মনে করত। এখন সে আখেরাতকে সবকিছু মনে করে। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ও আখেরাতে মুক্তিলাভের উদগ্র বাসনা তাকে অন্যের অধিকার রক্ষায় সচেতন ও ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। ১৫ হিজরীর রজব মাসে অনুষ্ঠিত ফিলিস্তীনের নিকটবর্তী ইয়ারমূক যুদ্ধের ময়দানে আহত মৃত্যুপথযাত্রী তৃষ্ণার্ত মুসলিম সৈনিক কাতরকণ্ঠে ‘পানি’ ‘পানি’ বলে কাতরাচ্ছে। পানি আনা হ’লে পাশ থেকে একই শব্দ ভেসে এল তার কানে। তাই নিজে না খেয়ে ইঙ্গিত করলেন, ঐ ওকে দাও! সেখানে গেলে পাশ থেকে একই শব্দ ভেসে এল। তখন তিনি নিজে না খেয়ে ইঙ্গিত করলেন, ঐ ওকে দাও! সেখানে গেলে দেখা গেল তিনি শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে আখেরাতে পাড়ি জমিয়েছেন। দ্রুত ফিরে এসে দ্বিতীয় জন, অতঃপর প্রথম জন, কাউকে আর জীবিত পাওয়া গেল না। পানি হাতে দাঁড়িয়ে রইলেন নির্বাক সাক্বী! (আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৭/১১)। এ দৃশ্য কি পৃথিবী অন্য কারো কাছে দেখেছে?

কেবল মানবাধিকার নয়, একটা নিকৃষ্ট প্রাণী কুকুরের তৃষ্ণা মেটানোর অধিকার রক্ষার জন্য মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে একজন বেশ্যা নারী মরুভূমির গভীর কূয়ায় নেমে নিজের চামড়ার মোযা ভরে পানি এনে তাকে খাইয়ে বাঁচালো এবং একারণে সে আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রাপ্ত হ’ল। (এ কথা শুনে) ছাহাবীগণ আরয করলেন, পশু-পাখির সাথে উত্তম আচরণের মধ্যেও কি আমাদের জন্য ছওয়াব রয়েছে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ। প্রত্যেক তাজা প্রাণের সাথে উত্তম আচরণের বিনিময়ে ছওয়াব রয়েছে’ (বুখারী হা/৩৩২১; মিশকাত হা/১৯০২)। এ অভাবনীয় দৃশ্যও মানুষ দেখেছে। একটাই বিশ্বাস সেখানে কাজ করেছে। আর তা হ’ল তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাস। সে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী দুনিয়াকে সুন্দরভাবে আবাদ করে আখেরাতে মুক্তির জন্য। সে দুনিয়াপূজারী নয়, আখেরাতই তার লক্ষ্য। উক্ত বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে ধারণ ও তা যথার্থভাবে বাস্তবায়ন ব্যতীত মানবাধিকার রক্ষার সত্যিকারের কোন উপায় আছে কি? আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)