অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উৎস হৌক যাকাত ও ছাদাক্বা

আল্লাহর নিকট ছওয়াব লাভের দৃঢ় আশায় আল্লাহর পথে মুমিনের সকল প্রকার ঐচ্ছিক দানকে ‘ছাদাক্বা’ বলে এবং নিজের সঞ্চিত ধন ও অন্যান্য সম্পদের ‘নেছাব’ পরিমাণ অংশের বাধ্যতামূলক দানকে ‘যাকাত’ বলে। দু’টিই মুমিনের মালকে পরিশুদ্ধ করে এবং দু’টিরই লক্ষ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। হাদীছে ছাদাক্বাকে ‘বুরহান’ বলা হয়েছে (মুসলিম হা/২২৩)। অর্থাৎ এটি মুমিনের বিশুদ্ধ ঈমানের প্রমাণ (মির‘আত)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘একজন বান্দার হৃদয়ে কৃপণতা ও ঈমান কখনো একত্রিত হ’তে পারেনা’ (নাসাঈ, মিশকাত হা/৩৮২৮)। আল্লাহ বলেন, ‘যারা হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে মুক্ত, তারাই সফলকাম’ (তাগাবুন ৬৪/১৬)। যাকাত ও ছাদাক্বা হ’ল সামাজিক সাম্য ও দারিদ্র্য বিমোচনের পূর্বশর্ত। উৎপাদকগণ তাদের লভ্যাংশ থেকে যাকাত দেন। হকদারগণ সেটি গ্রহণ করেন। অতঃপর তা দিয়ে তারা উৎপাদিত পণ্য খরীদ করেন। ফলে যাকাতের অর্থ পুনরায় উৎপাদকদের ঘরেই ফিরে যায়। এভাবে যাকাত ও ছাদাক্বার মাধ্যমে সম্পদের প্রবাহ সচল থাকে এবং সমাজে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে।

এর বিপরীত হ’ল সূদ, যা কোন সম্পদ নয়। বরং ঋণের আর্থিক বিনিময় মাত্র। যা শোষণ করে। পুনরায় ঋণ দিলে পুনরায় শোষণ করে। এমনকি ঋণের মেয়াদ শেষ হ’লে তার সূদ আসলের সঙ্গে যোগ হয়ে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ বাড়তেই থাকে। যা ঋণ গ্রহীতাকে রক্তহীন করে ফেলে। একসময় ক্রেতার অভাবে উৎপাদকের উৎপন্ন দ্রব্য গুদামজাত হয়ে পড়ে থাকে। ফলে ঋণদাতা ও ঋণগ্রহীতা উভয়ে নিঃস্ব হয়। এভাবে আর্থিক প্রবাহ বন্ধ হয়ে সমাজদেহ রক্তশূন্য হয়ে পড়ে। ফলে দেহে রক্ত প্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয়। যেভাবে উচ্চ রক্তচাপে মানুষের মৃত্যু ঘটে, তেমনি অর্থনীতির চাকা বন্ধ হলে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সমাজ অচল হয়ে পড়ে। আর সেজন্যেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘সূদ যতই বৃদ্ধি পাক, এর পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা’ (ছহীহুল জামে‘ হা/৫৫১৮; মিশকাত হা/২৮২৭)। আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ সূদকে নিঃশেষ করেন ও ছাদাক্বায় প্রবৃদ্ধি দান করেন’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)।

পৃথিবীর তাবৎ সূদী কারবার ঋণের বিনিময়ে লাভের ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। সে যুগের ‘কাবুলীওয়ালা’ ও ‘দাদন ব্যবসায়ী’দের স্থলে এযুগে সূদভিত্তিক ব্যাংক ব্যবস্থা চালু হয়েছে। শতভাগ সূদবিহীন কোন ব্যাংক পৃথিবীতে নেই। এর বিরুদ্ধেই ইসলামের যুগান্তকারী বিধান হ’ল যাকাত ও ছাদাক্বা ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা। যা মানবতার রক্ষা কবচ। খলীফা ওমর (রাঃ)-এর ১০ বছরের খেলাফতকালে (১৩-২৩ হি.) যাকাতের বিধান পূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হওয়ায় সমাজে যাকাত নেওয়ার মত কোন হকদার খুঁজে পাওয়া যেত না (ইরওয়া হা/৮৫৬-এর আলোচনা)। জাহেলী আরবের ফেলে আসা গাছতলা ও পাঁচতলার রক্তচোষা পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিরুদ্ধে সেদিন আল্লাহ প্রেরিত ইসলামী অর্থনীতির বরকত পেয়ে যেমন বুভুক্ষু মানবতা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল, আজও সেটি সম্ভব, যদি মুসলিম রাষ্ট্রগুলি আন্তরিক হয়।

মনে রাখা আবশ্যক যে, সম্পদ আল্লাহর দান। বান্দা তার ব্যবহারকারী মাত্র। অতএব তাঁর দেওয়া সম্পদ তাঁর বিধান মতেই ব্যয় করতে হবে। তাঁরই নির্দেশ হ’ল, ‘তাদের সম্পদে প্রার্থী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে’ (যারিয়াত ৫১/১৯)। আল্লাহ বলেন, ‘যারা কৃপণতা করে ও লোকদের কৃপণতার নির্দেশ দেয় এবং আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের যা সম্পদ দিয়েছেন, তা গোপন করে। বস্ত্তত আমরা অকৃতজ্ঞদের জন্য হীনকর শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (নিসা ৪/৩৭)

দানের ক্ষেত্রে সর্বদা দৃষ্টি রাখা আবশ্যক, যাতে এটি বিশুদ্ধ ইসলামের প্রচার ও প্রসারে সহায়ক হয় এবং শিরক ও বিদ‘আতের সহায়ক না হয়। এমনকি মসজিদ-মাদ্রাসায় দান করতে গেলেও দেখা উচিৎ সেগুলির পরিচালনা কমিটি ও ইমাম-খতীব শিরক ও বিদ‘আতের অনুসারী কি-না। নইলে এইসব দান বাতিলের সহায়ক হবে। জেনে-শুনে এরূপ স্থানে দান করলে নেকীর বদলে গোনাহ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী থাকবে (মায়েদাহ ২)। দ্বিতীয়ত হীলা-র ফাঁদে ফেলে ইসলামী অর্থনীতিকে যেন পঙ্গু করা না হয় এবং বিশুদ্ধ ইসলামী অর্থনীতিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করা হয় (দ্র. লেখকের ‘যাকাত ও ছাদাক্বা’ বই ১০৬-১১০)

অমুসলিম ধনিক শ্রেণী দেশে বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল করেছে। তারা দুনিয়ায় প্রশংসা পাবে। কিন্তু আখেরাতে কিছুই পাবে না। মুসলিম ধনিক শ্রেণী যারা অনেক সময় হারামের সঙ্গে আপোষ করতে বাধ্য হন, তারা তাদের হালাল-হারাম মিশ্রিত মালের পাপ থেকে বাঁচার জন্য হারাম মালের সমপরিমাণ বা তার চেয়ে বেশী সম্পদ নেকীর উদ্দেশ্য ছাড়াই বিশুদ্ধ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল ইত্যাদি জনসেবা মূলক কাজে ব্যয় করতে পারেন এবং আল্লাহর নিকট বিনীতভাবে তওবার মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করতে পারেন (তওবা ৯/১০২-০৩)

‘প্রত্যেক ঋণ যা লাভ আনে, সেটাই সূদ’ (ইরওয়া হা/১৩৯৭; বায়হাক্বী হা/১০৯৩৩)। এর বিপরীতে আখেরাতে বহুগুণ নেকী লাভের আশায় দুনিয়াবী লাভহীন ঋণকে ‘কর্যে হাসানাহ’ বলা হয়। যা ইসলামে অনুমোদিত। মাক্কী ও মাদানী উভয় জীবনে একই ভাষায় আল্লাহ বলেছেন, ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর ও যাকাত আদায় কর। আর তোমরা নিজেদের জন্য যেসব সৎকর্ম অগ্রিম প্রেরণ কর, তা তোমরা আল্লাহর নিকটে পাবে’ (মুয্যাম্মিল-মাক্কী ৭৩/২০; বাক্বারাহ-মাদানী ২/১১০)

সবচেয়ে বড় কথা হ’ল, পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে ‘সূদ গ্রহীতা ও সূদ দাতা উভয়ে জাহান্নামে রক্তের নদীতে ভাসবে। কিনারে আসতে চাইলেই পাথর মেরে তার মস্তক চূর্ণ করা হবে। আবার জোড়া লাগানো হবে। এভাবে চলতে থাকবে চিরদিন। কিন্তু সে কিনারে উঠতে পারবে না’ (বুখারী হা/২০৮৫; মিশকাত হা/৪৬২১)। তাহ’লে আধুনিক যুগের রকমারি গণতন্ত্রের জয়জয়কারের মধ্যে দেশে দেশে কঙ্কালসার মানুষের ভিড় কেন? কেন সর্বত্র ভুখা-মিছিল ও নেতাদের কাঙ্গালী ভোজের প্রদর্শনী। কেন কথিত ন্যায্যমূল্যের দোকানে ও ট্রাকের পিছনে মানুষের দীর্ঘ সারি? কেন মুষ্টিমেয় ধনীর যাকাত নেওয়ার ভিড়ে পদতলে পিষ্ট হয়ে মানুষ মরছে?

পরিশেষে আমরা চাই আমাদের প্রিয় জন্মভূমির মানুষ দারিদ্র্যমুক্ত হৌক এবং যাকাত ও ছাদাক্বার বরকতে দেশে ইসলামী ন্যায়বিচার ভিত্তিক অর্থব্যবস্থা পূর্ণরূপে চালু হৌক! সাথে সাথে দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও ইসলামী বিচার ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে মানবতা নিরাপদ হৌক! আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)