দান-ছাদাক্বা : পরকালীন পাথেয় সঞ্চয়ের অনন্য মাধ্যম

প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। এই অমোঘ সত্যকে লঙ্ঘন করার ক্ষমতা মানুষের নেই। ধনী-গরীব, রাজা-বাদশাহ, ছোট-বড় সবার জীবনেই মৃত্যু যেকোন মুহূর্তে চলে আসতে পারে। তার ভয়ংকর থাবায় মিটে যাবে জীবনের স্বাদ। দপ করে নিভে যাবে মানুষের প্রাণ প্রদীপ। নশ্বর পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে চলে যেতে হবে অন্তহীন পরকালের পথে। যেখানে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-প্রিয়জন থেকে মানুষ হবে সম্পূর্ণ একা। পৃথিবীতে ধন-দৌলত, বিত্ত-বৈভব, সুনাম-সুখ্যাতির অধিপতি থাকলেও পরকালে হ’তে হবে নিঃস্ব ও রিক্ত। পৃথিবীর মায়া মরীচিকায় যারা দুনিয়াকে সর্বস্ব জ্ঞান করবে, পরকালে শূন্য খাতা হাতে পেয়ে তাদের সম্বিত ফিরবে। কিন্তু তখন কেবল আফসোস করা ছাড়া কিছুই করার থাকবে না। সেকারণ প্রত্যেক আদম সন্তানকে ইহজীবন সাঙ্গ হওয়ার আগেই পরকালীন পাথেয় সঞ্চয় করা আবশ্যক। যে পাথেয় তাকে জাহান্নামের অগ্নিগহবর থেকে বাঁচাবে।

ছাদাক্বা এমনই এক ইবাদত যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয় এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لِيَقِ أَحَدُكُمْ وَجْهَهُ النَّارَ وَلَوْ بِشِقِّ تَمْرَةٍ ‘তোমরা একটি খেজুরের টুকরা দান করে হ’লেও জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচো’।[1]

ছাদাক্বার কল্যাণকারিতা

(১) ছাদাক্বা গোনাহকে মিটিয়ে দেয় : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الصَّدَقَةُ تُطْفِئُ الخَطِيئَةَ كَمَا يُطْفِئُ المَاءُ النَّارَ، ‘ছাদাক্বা গোনাহকে নিভিয়ে দেয়, যেমন পানি আগুনকে নিভিয়ে দেয়’।[2] তিনি বলেন,إِنَّ الصَّدَقَةَ لَتُطْفِئُ عَنْ أَهْلِهَا حَرَّ الْقُبُورِ، وَإِنَّمَا يَسْتَظِلُّ الْمُؤْمِنُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فِي ظِلِّ صَدَقَتِهِ،...حَتَّى يُقْضَى بَيْنَ النَّاسِ- ‘নিশ্চয় ছাদাক্বা কবরের উত্তাপ নিভিয়ে দেয় এবং ক্বিয়ামতের দিন মুমিন তার ছাদাক্বার ছায়াতলে আশ্রয় পাবে... মানুষের মধ্যে বিচারকার্য শেষ না হওয়া পর্যন্ত’।[3]

(২) ছাদাক্বার নেকী অপরিসীম : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَنْفَقَ نَفَقَةً فِي سَبِيلِ اللهِ كُتِبَتْ لَهُ بِسَبْعِ مِائَةِ ضِعْفٍ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে ব্যয় করে, তার জন্য সাতশ’ গুণ নেকী লেখা হয়’।[4] তিনি বলেন,يَا ابْنَ آدَمَ إِنْ تَبْذُلِ الْفَضْلَ خَيْرٌ لَكَ، وَإِنْ تُمْسِكْهُ شَرٌّ لَكَ، وَلاَ تُلاَمُ عَلَى كَفَافٍ، وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ- ‘হে আদম সন্তান! প্রয়োজনের অতিরিক্ত যে সম্পদ তোমার কাছে আছে তা খরচ করা তোমার জন্য (দুনিয়া ও আখিরাতে) কল্যাণকর। আর তা খরচ না করা হবে অকল্যাণকর। প্রয়োজনীয় পরিমাণ ধন-সম্পদ (জমা করায়) দোষ নেই। তোমার প্রয়োজনের অতিরিক্ত ধন-সম্পদ ব্যয়ের কাজ নিজ পরিবার-পরিজন থেকে শুরু করো’।[5]

হাদীছে কুদসীতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,قَالَ اللهُ تَعَالَى : أَنْفِقْ يَا ابْنَ آدَمَ أُنْفِقْ عَلَيْكَ- ‘আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি দান কর, তোমাকেও দান করা হবে’।[6]

তিনি আসমা (রাঃ)-কে বলেন, أَنْفِقِى وَلاَ تُحْصِى فَيُحْصِىَ اللهُ عَلَيْكِ، وَلاَ تُوعِى فَيُوعِىَ اللهُ عَلَيْكِ- ‘(আল্লাহর পথে) ব্যয় করো, হিসাব করো না। তাহ’লে আল্লাহ তোমার উপর তাঁর রহমতকে হিসাব করবেন। আর হাত গুটিয়ে রেখ না, তাহ’লে আল্লাহও তোমার থেকে হাত গুটিয়ে নিবেন’।[7]

আল্লাহ বলেন, وَمَثَلُ الَّذِينَ يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمُ ابْتِغَآءَ مَرْضَاتِ اللهِ وَتَثْبِيتًا مِّنْ أَنْفُسِهِمْ كَمَثَلِ جَنَّةٍم بِرَبْوَةٍ أَصَابَهَا وَابِلٌ فَآتَتْ أُكُلَهَا ضِعْفَيْنِ، فَإِنْ لَّمْ يُصِبْهَا وَابِلٌ فَطَلٌّ، وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ- ‘আর যারা ধন-সম্পদ ব্যয় করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ ও ছওয়াব লাভের দৃঢ় বিশ্বাসের সাথে, তাদের উদাহরণ সমভূমির ঐ বাগিচার মত, যেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত হ’লে দ্বিগুণ শস্য উৎপাদিত হয়। আর প্রবল বৃষ্টি না হ’লে হাল্কা বৃষ্টিই যথেষ্ট হয়। বস্ত্তত তোমরা যা কিছু কর, আল্লাহ সবই দেখেন’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/২৬৫)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا لَسَرَّنِي أَنْ لاَ يَمُرَّ عَلَيَّ ثَلاَثُ لَيَالٍ وَعِنْدِي مِنْهُ شَيْءٌ إِلاَّ شَيْءٌ أَرْصُدُهُ لِدَيْنٍ- ‘যদি আমার নিকট ওহোদ পাহাড় সমান সোনা থাকত, তাহ’লে আমি এটা পসন্দ করতাম যে, ঋণ পরিশোধের জন্য পরিমাণ মত বাকী রেখে অবশিষ্ট সবটাই তিন দিন অতিবাহিত না হ’তেই আল্লাহর পথে ব্যয় করে ফেলি’।[8]

তিনি বলেন,مَنْ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ ابْتِغَاءَ وَجْهِ اللهِ خُتِمَ لَهُ بِهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর চেহারা কামনায় ছাদাক্বা করল এবং সেটাই যদি তার শেষ আমল হয়, তাহ’লে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’।[9]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلاَّ مَلَكَانِ يَنْزِلاَنِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا، وَيَقُولُ الْآخَرُ: اللَّهُمَّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا- ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করে। তাদের একজন বলে, হে আল্লাহ! দাতাকে তার দানের উত্তম প্রতিদান দিন। অপরজন বলে, হে আল্লাহ! কৃপণকে ধ্বংস করুন’।[10]

(৩) আল্লাহ তা‘আলা ছাদাক্বা নিজ হাতে গ্রহণ করেন : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَصَدَّقَ بِعَدْلِ تَمْرَةٍ مِنْ كَسْبٍ طَيِّبٍ وَلاَ يَقْبَلُ اللهُ إِلاَّ الطَّيِّبَ وَإِنَّ اللهَ يَتَقَبَّلُهَا بِيَمِينِهِ، ثُمَّ يُرَبِّيهَا لِصَاحِبِهِ كَمَا يُرَبِّى أَحَدُكُمْ فَلُوَّهُ حَتَّى تَكُونَ مِثْلَ الْجَبَلِ- ‘যে ব্যক্তি তার হালাল উপার্জন থেকে একটি খেজুরের সমপরিমাণ দান করল, আর আল্লাহ হালাল ব্যতীত কবুল করেন না, আল্লাহ তা নিজ ডান হাতে গ্রহণ করেন। অতঃপর দানকারীর জন্য তা বৃদ্ধি করতে থাকেন, যেভাবে তোমাদের কেউ ঘোড়ার বাচ্চা পালন করে তা বৃদ্ধি করতে থাক, এমনকি তা পাহাড় সমান হয়ে যায়’।[11]

(৪) ছাদাক্বা ব্যক্তিকে পবিত্র করে : ছাদাক্বার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জিত হয়। অন্তরের কৃপণতা দূর হয়। কারো সম্পদের পাহাড় না থাকলেও আল্লাহ তার অন্তরে প্রাচুর্য দান করেন। সেজন্য আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে বলেন,خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا، ‘তুমি তাদের সম্পদ থেকে ছাদাক্বা গ্রহণ কর। যা দ্বারা তুমি তাদের (কৃপণতার কলুষ হ’তে) পবিত্র করবে ও পরিশুদ্ধ করবে’ (তওবা-মাদানী ৯/১০৩)

(৫) ছাদাক্বায় সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটে : আপাত দৃষ্টিতে ছাদাক্বায় সম্পদের পরিমাণ হ্রাস পেলেও মূলত সম্পদ কমে না। আল্লাহ এমন উৎস থেকে বান্দাকে দান করতে থাকেন যে সম্পর্কে বান্দার কোন ধারণাই থাকে না। সেকারণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا نَقَصَتْ صَدَقَةٌ مِّنْ مَّالٍ، ‘ছাদাক্বায় সম্পদ হ্রাস পায় না’।[12] 

অপর একটি হাদীছে এসছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা বলেন, তুমি খরচ কর। আমি তোমাকে দান করব এবং [রাসূল (ছাঃ)] বললেন, আল্লাহ তা‘আলার হাত পরিপূর্ণ। (তোমার) রাতদিন অবিরাম খরচেও তা কমবে না। তিনি বলেন, তোমরা দেখ না, যখন থেকে (আল্লাহ) আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন, তখন থেকে কি পরিমাণ খরচ করেছেন? কিন্তু এত খরচ করার পরও তাঁর হ’তে সম্পদের কোন কমতি হয়নি...। [13]

দানের মাধ্যমে যে আল্লাহ সম্পদ বাড়িয়ে দেন সে সম্পর্কে একটি ঘটনা হাদীছে এসেছে। সেটি হ’ল-

আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘জনৈক ব্যক্তি মাঠে কাজ করছিল। এমন সময় সে মেঘের মধ্যে একটা শব্দ শুনতে পেল ‘অমুকের বাগানে বর্ষণ কর’। অতঃপর মেঘটি সে দিকে যেতে লাগল এবং এক প্রস্তরময় স্থানে পানি বর্ষাল। দেখা গেল যে, সেখানকার একটি নালা সমস্ত পানি তার মধ্যে নিয়ে নিল। তখন ঐ ব্যক্তি মেঘটির অনুসরণে সেখানে পৌঁছে দেখল যে, একজন ব্যক্তি তার বাগানে পানি সেঁচ দিচ্ছে। তখন সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তোমার নাম কি? সে বলল, আমার নাম অমুক। যে নাম সে মেঘের মধ্যে শুনেছিল। সে বলল, হে আল্লাহর বান্দা! তুমি কেন আমার নাম জিজ্ঞেস করলে? সে বলল, যে মেঘের এই পানি সেই মেঘের মধ্য থেকে আমি একটি শব্দ শুনেছি, যেখানে তোমার নাম করে বলা হয়েছে যে, অমুকের বাগানে বৃষ্টি বর্ষণ কর! অতএব (হে আল্লাহর বান্দা!) তুমি বল, পানি দিয়ে কি কাজ কর? সে বলল, যখন তুমি তা জিজ্ঞেস করলে তখন শোন, ‘বাগানে যা ফল হয়, তা আমি তিন ভাগ করি। এক ভাগ ছাদাক্বা করি, এক ভাগ আমি ও আমার পরিবার খাই এবং অপর ভাগ জমিতে বীজ হিসাবে লাগাই’।[14]

(৬) ছাদাক্বা আল্লাহর ক্রোধ নিভিয়ে দেয় : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,صَنَائِعُ الْمَعْرُوفِ تَقِي مَصَارِعَ السُّوءِ، وَصَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ، وَصِلَةُ الرَّحِمِ تَزِيدُ فِي الْعُمُرِ- ‘সৎকর্ম সমূহ মন্দ পরিণতি থেকে রক্ষা করে। গোপন ছাদাক্বা আল্লাহর ক্রোধ নিভিয়ে দেয়। আর আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করলে বয়স বৃদ্ধি পায়’।[15]

(৭) ছাদাক্বা রোগ-ব্যধি দূর করে : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,دَاوُوْا مَرْضَاكُمْ بِالصَّدَقَةِ، وَحَصِِّنُوْا أَمْوَالَكُمْ بِالزَّكَاةِ، وَأَعِدُّوْا لِلْبَلاَءِ الدُّعَاءَ- ‘তোমরা তোমাদের পীড়িতদের চিকিৎসা কর ছাদাক্বার মাধ্যমে, তোমরা তোমাদের সম্পদকে সুরক্ষিত কর যাকাত দানের মাধ্যমে এবং বালা-মুছীবত থেকে বাঁচার চেষ্টা কর দো‘আর মাধ্যমে’।[16] বস্ত্তত আল্লাহর সন্তুষ্টি হাছিল ও তাঁর ক্রোধ থেকে বাঁচার মাধ্যম হ’ল ছাদাক্বা।

(৮) মানব কল্যাণের অন্যতম মাধ্যম ছাদাক্বা : একবার জনৈক ব্যক্তি এক মহিলাকে ছাদাক্বা দিল। দেখা গেল যে, সে একজন ব্যভিচারিণী। লোকেরা এটা নিয়ে বলাবলি করতে লাগল। আরেকজন ব্যক্তি অন্য একজনকে ছাদাক্বা দিল। কিন্তু দেখা গেল যে, সে একজন ধনী ব্যক্তি। লোকেরা এটা নিয়ে বলাবলি করতে লাগল। আরেকজন ব্যক্তি একজনকে ছাদাক্বা দিল। দেখা গেল যে, সে একটা চোর। লোকেরা এটা নিয়ে বলাবলি করতে লাগল। তখন বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-কে বলা হ’ল। জবাবে তিনি বললেন,أَمَّا صَدَقَتُكَ فَقَدْ قُبِلَتْ، أَمَّا الزَّانِيَةُ فَلَعَلَّهَا تَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ زِنَاهَا، وَلَعَلَّ الْغَنِيَّ يَعْتَبِرُ فَيُنْفِقُ مِمَّا أَعْطَاهُ اللهُ، وَلَعَلَّ السَّارِقَ يَسْتَعِفُّ بِهَا عَنْ سَرِقَتِهِ- ‘তোমার ছাদাক্বা কবুল হয়ে গেছে। এক্ষণে ছাদাক্বা গ্রহীতা ব্যভিচারিণী; হয়তোবা সে এর কারণে ব্যভিচার পরিত্যাগ করবে। অতঃপর ধনী ব্যক্তি; হয়তোবা সে এর মাধ্যমে উপদেশ হাছিল করবে এবং আল্লাহ তাকে যা দিয়েছেন, তা থেকে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করবে। অতঃপর চোর; সে হয়ত এর ফলে চুরি পরিত্যাগ করবে’।[17]

চুরি ও ব্যভিচার কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে অন্যতম। তবু্ও চোর ও ব্যভিচারীকে দেয়া ছাদাক্বা রাসূল (ছাঃ) অনুমোদন করেছেন শুধুমাত্র তাদেরকে কল্যাণের পথে আকৃষ্ট করার জন্য।

(৯) ছাদাক্বা দাতা ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়াতলে থাকবে : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,سَبْعَةٌ يُّظِلُّهُمُ اللهُ فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ...وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، ‘সাত শ্রেণীর লোক যাদেরকে আল্লাহ ছায়া দিবেন নিজের ছায়ায়, যেদিন তাঁর ছায়া ব্যতীত কোন ছায়া থাকবে না। ...সেই ব্যক্তি, যে গোপনে দান করে, এমনকি তার বাম হাত জানতে পারে না, তার ডান হাত কি দান করল’।[18] তিনি বলেন, إِنَّ ظِلَّ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَدَقَتُهُ- ‘ক্বিয়ামতের দিন মুমিনের ছায়া হবে তার ছাদাক্বা’।[19]

(১০) ছাদাক্বার মাধ্যমে জাহান্নাম থেকে মুক্তি মেলে : জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহ যে ব্যবসার কথা বলেছেন, সেখানেও তিনি বলেছেন,يَآأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا هَلْ أَدُلُّكُمْ عَلَى تِجَارَةٍ تُنْجِيكُمْ مِنْ عَذَابٍ أَلِيمٍ- تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَرَسُولِهِ وَتُجَاهِدُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ، ذَالِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! আমি কি তোমাদের এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দিব, যা তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হ’তে মুক্তি দিবে?’। ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবে তোমাদের মাল ও জান দিয়ে। সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম হবে, যদি তোমরা বুঝ’ (ছফ-মাদানী ৬১/১০-১১)

উক্ত আয়াতে মালের কথা আগে বলা হয়েছে, কারণ জিহাদে প্রথম মালের প্রয়োজন হয় (কুরতুবী)। একইভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,جَاهِدُوا الْمُشْرِكِينَ بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ وَأَلْسِنَتِكُمْ- ‘তোমরা জিহাদ কর মুশরিকদের বিরুদ্ধে তোমাদের মাল দ্বারা, জান দ্বারা ও যবান দ্বারা’।[20] এখানেও মালের কথা আগে বলা হয়েছে। অতএব মুসলিম জীবনে কৃপণতার কোন অবকাশ নেই।

(১১) দানকারী জান্নাতের সকল দরজা থেকে আহূত হবে : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,

مَنْ أَنْفَقَ زَوْجَيْنِ مِنْ شَيْءٍ مِنَ الْأَشْيَاءِ فِي سَبِيلِ اللهِ دُعِيَ مِنْ أَبْوَابِ الْجَنَّةِ، وَلِلْجَنَّةِ أَبْوَابٌ، فَمَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الصَّلاَةِ دُعِيَ مِنْ بَابِ الصَّلاَةِ وَمَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الْجِهَادِ دُعِيَ مِنْ بَابِ الْجِهَادِ وَمَنْ كَانَ مَنْ أَهْلِ الصَّدَقَةِ دُعِيَ مِنْ بَابِ الصَّدَقَةِ وَمَنْ كَانَ مِنْ أَهْلِ الصِّيَامِ دُعِيَ مِنْ بَابِ الرَّيَّانِ، فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: مَا عَلَى مَنْ دُعِيَ مِنْ تِلْكَ الْأَبْوَابِ مِنْ ضَرُورَةٍ، فَهَلْ يُدْعَى أَحَدٌ مِنْ تِلْكَ الْأَبْوَابِ كُلِّهَا؟ قَالَ: نَعَمْ وَأَرْجُو أَنْ تَكُونَ مِنْهُمْ-

‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোন বস্ত্তর একটি জোড়া দান করবে, উক্ত ব্যক্তি জান্নাতের সকল দরজা থেকে আহূত হবে (যেমন মুছল্লী, মুজাহিদ, দানশীল ও ছায়েমদের দরজা)। তখন আবুবকর বললেন, সকল দরজা দিয়ে আহবানের প্রয়োজন নেই (একটি দরজাই যথেষ্ট)। তবে আসলে কি কেউ সকল দরজা দিয়ে আহূত হবে? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, نَعَمْ، وَأَرْجُوْ أَنْ تَكُوْنَ مِنْهُمْ- ‘হ্যাঁ। আর আমি আশা করি তুমি তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে’।[21] ‘জোড়া’ বলতে দুই দিরহাম, দুই দীনার বা জামা-পায়জামা, শাড়ি-লুঙ্গী ইত্যাদি যে কোন বস্ত্ত দু’টি করে দান করা (মিরক্বাত)

(১২) ছাদাক্বাই প্রকৃতপরকালীন সঞ্চয় : বিশুদ্ধ নিয়তে হালাল সম্পদ যতটুকু ছাদাক্বা করা হবে, ততটুকুই আমাদের পরকালীন পাথেয় হিসাবে সঞ্চিত থাকবে। তাই যার ছাদাক্বা যত বেশী, তার সঞ্চয় তত বেশী। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, يَقُوْلُ الْعَبْدُ مَالِىْ مَالِىْ، وَإِنَّ مَا لَهُ مِنْ مَالِهِ ثَلاَثٌ : مَا أَكَلَ فَأَفْنَى أَوْ لَبِسَ فَأَبْلَى أَوْ أَعْطَى فَاقْتَنَى، وَمَا سِوَى ذَلِكَ فَهُوَ ذَاهِبٌ وَتَارِكُهُ لِلنَّاسِ- ‘বান্দা বলে আমার মাল, আমার মাল। অথচ তার মাল সমূহের মধ্যে তার জন্য মাল হ’ল মাত্র তিনটি : (ক) যা সে খায় ও শেষ করে। (খ) যা সে পরিধান করে ও জীর্ণ করে এবং (গ) যা সে ছাদাক্বা করে ও সঞ্চয় করে। এগুলি ব্যতীত বাকী সবই চলে যায় এবং লোকদের জন্য সে ছেড়ে যায়’।[22]

নবী করীম (ছাঃ) লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কোন ব্যক্তি নিজের সম্পদের চাইতে তার উত্তরাধিকারীর সম্পদকে অধিক প্রিয় মনে করে? তারা সবাই জবাব দিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে এমন কেউ নেই যে তার নিজের সম্পদকে সবচেয়ে অধিক প্রিয় মনে করে না। তখন তিনি বললেন, فَإِنَّ مَالَهُ مَا قَدَّمَ، وَمَالُ وَارِثِهِ مَا أَخَّرَ- ‘নিশ্চয়ই মানুষের নিজের সম্পদ তা-ই, যা সে (আল্লাহর পথে ব্যয়ের মাধ্যমে) অগ্রিম পাঠায়। আর যা সে পিছনে ছেড়ে যাবে, তা তার ওয়ারিছদের মাল’।[23]

তিনি আরো বলেন, يَتْبَعُ الْمَيِّتَ ثَلاَثَةٌ، فَيَرْجِعُ اثْنَانِ وَيَبْقَى مَعَهُ وَاحِدٌ، يَتْبَعُهُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ وَعَمَلُهُ، فَيَرْجِعُ أَهْلُهُ وَمَالُهُ، وَيَبْقَى عَمَلُهُ- ‘মাইয়েতের সাথে তিনজন যায়। তার মধ্যে দু’জন ফিরে আসে ও একজন থেকে যায়। মাইয়েতের সঙ্গে যায় তার পরিবার, তার মাল ও তার আমল। অতঃপর তার পরিবার ও মাল ফিরে আসে এবং আমল তার সাথে থেকে যায়’।[24]

(১৩) কৃপণ ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘কা‘বার রবের কসম! তারাই ক্ষতিগ্রস্ত। রাবী বলেন, আমি বললাম, আমার পিতা-মাতা আপনার প্রতি উৎসর্গীত হৌন! তারা কারা? রাসূল (ছাঃ) বললেন, هُمُ الْأَكْثَرُونَ أَمْوَالاً، إِلاَّ مَنْ قَالَ هَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا مِنْ بَيْنَ يَدَيْهِ وَمِنْ خَلْفِهِ وَعَنْ يَّمِينِهِ وَعَنْ شِمَالِهِ وَقَلِيلٌ مَّا هُمْ- যাদের ধন-সম্পদ বেশী তারা। কিন্তু যে ব্যক্তি এরূপ করে, এরূপ করে ও এরূপ করে (অর্থাৎ) সামনের দিকে, পিছন দিকে, ডান দিকে ও বাম দিকে (সর্বদা দান করে)। তবে এরূপ লোক খুবই কম’।[25]

অন্যত্র তিনি বলেন,فَوَاللهِ لاَ الْفَقْرُ أَخْشَى عَلَيْكُمْ، وَلَكِنْ أَخْشَى عَلَيْكُمْ أَنْ تُبْسَطَ عَلَيْكُمُ الدُّنْيَا كَمَا بُسِطَتْ عَلَى مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ، فَتَنَافَسُوهَا كَمَا تَنَافَسُوهَا، وَتُهْلِكُكُمْ كَمَا أَهْلَكَتْهُمْ- ‘আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের সম্পর্কে দরিদ্রতার ভয় করি না; কিন্তু আমি ভয় করি যে, তোমাদের উপর দুনিয়াকে প্রশস্ত করে দেওয়া হবে যেমন প্রশস্ত করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। আর তোমরা তা লাভ করার জন্য ঐরূপ প্রতিযোগিতা করবে যেরূপ তারা প্রতিযোগিতা করেছিল। ফলে তা তোমাদেরকে ধ্বংস করবে যেরূপ তাদেরকে ধ্বংস করেছিল।[26]

কৃপণ ব্যক্তিকে মন্দ লোক অভিহিত করে অপর এক হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِشَرِّ النَّاسِ مَنْزِلاً؟ قِيلَ : نَعَمْ، قَالَ الَّذِي يُسْأَلُ بِاللهِ وَلاَ يُعْطِي بِهِ- ‘আমি কি তোমাদের সর্বাপেক্ষা মন্দস্তরের ব্যক্তি সম্পর্কে বলব না? বলা হ’ল, হ্যাঁ বলুন। তখন তিনি বললেন, যে ব্যক্তির নিকট আল্লাহর নামে কিছু চাওয়া হয়, অথচ সে তাঁর নামে কিছু দেয় না’।[27]

সুতরাং আমাদের আমলের মধ্যে অবশ্যই দান-ছাদাক্বার পরিমাণ বেশী হওয়া উচিত।

ছাদাক্বা কবুলের শর্ত

(১) রিয়া ও শ্রুতিমুক্ত হওয়া : দান-ছাদাক্বা একটি মহৎ ইবাদত। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনায় বহু মানুষ লোক দেখানো দান-ছাদাক্বা করে থাকে। আর কোন ব্যক্তি যে আমলই করুক না কেন, তার উদ্দেশ্য হ’তে হবে কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। কেননা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য ব্যতীত কোন ইবাদতের ছওয়াব লাভ করা যাবে না। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِيْنَ يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ رِئَـآءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُوْنَ بِاللهِ وَلاَ بِالْيَوْمِ الآخِرِ، وَمَنْ يَّكُنِ الشَّيْطَانُ لَهُ قَرِيْناً فَسَآءَ قِرِيْناً- ‘আর যারা লোক দেখানোর উদ্দেশ্যে নিজেদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে এবং আল্লাহর প্রতি ও বিচার দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে না। বস্ত্তত শয়তান যার সঙ্গী হয়েছে, সে নিকৃষ্ট সঙ্গীই বটে!’ (নিসা-মাদানী ৪/৩৮)

রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ سَمَّعَ سَمَّعَ اللهُ بِهِ، وَمَنْ يُرَائِى يُرَائِى اللهُ بِهِ- ‘যে ব্যক্তি খ্যাতি অর্জনের জন্য কোন কাজ করে, আল্লাহ তার দোষ প্রকাশ করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি লোক দেখানোর জন্য কোন কাজ করে, আল্লাহ তার সাথে লোক দেখানোর আচরণ করবেন’।[28] 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন (রিয়াকারদের মধ্যে) প্রথমে যে ব্যক্তির বিচার হবে, সে হবে শহীদ। ...দ্বিতীয় ব্যক্তি হ’ল আলেম। ...আর তৃতীয় ব্যক্তি হবে সম্পদশালী ব্যক্তি। আল্লাহ যার রিযিক প্রশস্ত করে দিয়েছিলেন এবং তাকে দান করেছিলেন সব ধরনের সম্পদ। তাকে আল্লাহর দরবারে হাযির করা হবে। অতঃপর আল্লাহ তাকে দেওয়া তাঁর নে‘মত সমূহের কথা স্মরণ করিয়ে দিবেন এবং সেও তা স্বীকার করবে। অতঃপর তিনি তাকে বলবেন, তুমি এসবের বিনিময়ে কি করেছ? সে বলবে, তুমি খুশী হবে এমন কোন রাস্তায় দান করতে আমি বাকী রাখিনি। তখন আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। বরং তুমি এ উদ্দেশ্যে দান করেছিলে যাতে বলা হয় যে, তুমি একজন ‘দানবীর’। আর তা বলাও হয়েছে। অতঃপর তার বিষয়ে আদেশ দেওয়া হবে এবং তাকে উপুড় করে টানতে টানতে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে’।[29]

(২) খোটা না দেওয়া : দুনিয়াবী কোন প্রতিদানের আশা ছাড়াই নিঃশর্তভাবে দান করতে হয়। দান করে খোটা দেয়া একটি গর্হিত কাজ। খোটা তারাই দেয় যারা দুনিয়াবী কল্যাণ কামনা করে। যারা নিঃশর্তভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য পরকালীন মুক্তির আশায় দান করে তারা কখনো খোটা দেয়ার মত অন্যায় আচরণ করে না।

আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تُبْطِلُوا صَدَقَاتِكُمْ بِالْمَنِّ وَالْأَذَى كَالَّذِي يُنْفِقُ مَالَهُ رِئَاءَ النَّاسِ وَلاَ يُؤْمِنُ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ فَمَثَلُهُ كَمَثَلِ صَفْوَانٍ عَلَيْهِ تُرَابٌ فَأَصَابَهُ وَابِلٌ فَتَرَكَهُ صَلْدًا لاَ يَقْدِرُونَ عَلَى شَيْءٍ مِمَّا كَسَبُوا وَاللهُ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الْكَافِرِينَ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা খোটা দিয়ে ও কষ্ট দিয়ে তোমাদের দানগুলিকে বিনষ্ট করো না। সেই ব্যক্তির মত, যে তার ধন-সম্পদ ব্যয় করে লোক দেখানোর জন্য এবং সে আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাস করে না। ঐ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত একটি মসৃণ প্রস্তরখন্ডের মত, যার উপরে কিছু মাটি জমে ছিল। অতঃপর সেখানে প্রবল বৃষ্টিপাত হ’ল ও তাকে ধুয়ে ছাফ করে রেখে গেল। এভাবে তারা যা কিছু উপার্জন করে, সেখান থেকে কোনই সুফল তারা পায় না। বস্ত্তত আল্লাহ অবিশ্বাসী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (বাক্বারাহ-মাদানী ২/২৬৪)। 

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,ثَلاَثَةٌ لاَّ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ الْمَنَّانُ الَّذِى لاَ يُعْطِى شَيْئًا إِلاَّ مَنَّهُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْفَاجِرِ وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ-­ ‘তিন ব্যক্তির সাথে আল্লাহ ক্বিয়ামতের দিন কথা বলবেন না। যে ব্যক্তি দান করে খোটা দেয়, যে ব্যক্তি মিথ্যা শপথের মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করে এবং যে ব্যক্তি পায়ের গিঁটের নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরে’।[30]

কোন সময়ের ছাদাক্বা উত্তম?

সাধারণত যেকোন সময় ছাদাক্বা করা যায়। তবে ছাদাক্বার একটি উত্তম সময় আছে। এ সম্পর্কে হাদীছে এসেছে, জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করল হে আল্লাহর রাসূল! কোন ছাদাক্বা ছওয়াবের দিক দিয়ে উত্তম? তিনি বললেন,أَنْ تَصَدَّقَ وَأَنْتَ صَحِيحٌ شَحِيحٌ تَخْشَى الْفَقْرَ وَتَأْمُلُ الْغِنَى وَلاَ تُمْهِلَ حَتَّى إِذَا بَلَغَتِ الْحُلْقُومَ قُلْتَ : لِفُلاَنٍ كَذَا وَلِفُلاَنٍ كَذَا وَقَدْ كَانَ لِفُلاَنٍ- ‘যখন তুমি সুস্থ থাক, মালের প্রতি লোভ কর, দরিদ্রতার ভয় কর এবং ধনী হওয়ার আশা রাখ, সে সময়ের দান। সুতরাং প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়া পর্যন্ত তুমি দান করতে বিলম্ব কারো না। যখন তুমি বলবে যে, এ মাল অমুকের জন্য, আর এ মাল অমুকের জন্য। অথচ তখন মাল অমুকের হয়ে গেছে’।[31]

সুস্থতা মানুষকে আত্মভোলা করে। মালের প্রতি লোভ ব্যক্তিকে সম্পদ পুঞ্জীভূত করতে উদ্বুদ্ধ করে। দরিদ্রতার ভয় ব্যক্তির কার্পণ্য সত্তাকে জাগ্রত করে। আর ধনী হওয়ার প্রবণতা ব্যক্তিকে আয়েশী ও দুনিয়ামুখী বানায়। সেকারণে উক্ত হাদীছে বর্ণিত অবস্থাগুলোতে বেশী বেশী দানের প্রতি তাকীদ দেয়া হয়েছে।

রামাযান মাসে ছাদাক্বা

যাকাত ও ছাদাক্বা আদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সময় হচ্ছে রামাযান মাস। কেননা এ মাসে রয়েছে বহুবিধ ফযীলত। এটি বরকতপূর্ণ এক মহিমান্বিত মাস। সেজন্য রাসূল (ছাঃ) রামাযান মাসে বেশী বেশী ছাদাক্বা করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,كَانَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَ سَلَّمَ أَجْوَدَ النَّاسِ وَكَانَ أَجْوَدَ مَا يَكُوْنُ فِىْ رَمَضَانَ حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ وَكَانَ جِبْرِيْلُ يَلْقَاهُ فِىْ كُلِّ لَيْلَةٍ مِّنْ رَمَضَانَ فَيُدَارِسُهُ الْقُرْآنَ فَلَرَسُوْلُ اللهِ-صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- حِيْنَ يَلْقَاهُ جِبْرِيْلُ أَجْوَدُ بِالْخَيْرِ مِنَ الرِّيْحِ الْمُرْسَلَةِ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন লোকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী দানশীল। বিশেষ করে রামাযান মাসে তাঁর দানশীলতা আরও বেড়ে যেত, যখন জিব্রীল তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। আর জিব্রীল রামাযানের প্রতি রাতেই তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন এবং কুরআন শেখাতেন। জিব্রীল যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করতেন তখন তাঁর দানশীলতা প্রবাহিত বায়ুর চাইতেও বেশী হ’ত’।[32] অপর এক বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, لَوْ كَانَ لِي مِثْلُ أُحُدٍ ذَهَبًا لَسَرَّنِي أَنْ لاَّ يَمُرَّ عَلَيَّ ثَلاَثُ لَيَالٍ وَعِنْدِي مِنْهُ شَيْءٌ إِلاَّ شَيْءٌ أَرْصُدُهُ لِدَيْنٍ- ‘যদি আমার নিকট ওহোদ পাহাড় সমপরিমাণ স্বর্ণও থাকে, তবে আমি তখনই সমুতষ্ট হব, যখন তিন দিন অতিবাহিত না হ’তেই তা নিঃশেষ হয়ে যায়; তার সামান্য পরিমাণ ব্যতীত যা আমি আমার ঋণ পরিশোধের জন্য রাখি’।[33]

এ হাদীছ থেকে বোঝা যায় রাসূল (ছাঃ) ধনী ছিলেন না কিন্তু তাঁর অন্তর প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। এখান থেকে ধনীরা কোন

উপদেশ গ্রহণ করবে কি?

উপসংহার :

ছাদাক্বা ধনী-গরীবের সামাজিক ভারসাম্য রক্ষার মাধ্যম। এতে সমাজে সম্পদের প্রবাহ সচল থাকে এবং ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ে উপকৃত হয়। সবচেয়ে বড় কথা হ’ল, পরকালের চিরস্থায়ী জীবনে ছাদাক্বার সঞ্চয় চূড়ান্ত মুক্তির জন্য বড় ভূমিকা পালন করবে। সেকারণে সকলের ছাদাক্বার হাত দীর্ঘ হওয়া উচিত। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

 

[1]. তিরমিযী হা/২৯৫৩, রাবী ‘আদী বিন হাতেম (রাঃ); ছহীহুল জামে‘ হা/৮১৪৭।

[2]. আহমাদ হা/১৫৩১৯; তিরমিযী হা/৬১৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২১০; মিশকাত হা/২৯, রাবী মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ); ছহীহাহ হা/১১২২।

[3]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭৮৮, রাবী ওক্ববা বিন ‘আমের (রাঃ); ছহীহ ইবনু হিববান হা/৩৩১০; ছহীহাহ হা/৩৪৮৪।

[4]. তিরমিযী হা/১৬২৫; নাসাঈ হা/৩১৮৬; মিশকাত হা/৩৮২৬, রাবী খুরাইম বিন ফাতেক (রাঃ)।

[5]. মুসলিম হা/১০৩৬; মিশকাত হা/১৮৬৩, রাবী আবু উমামাহ (রাঃ)।

[6]. বুখারী হা/৫৩৫২; মুসলিম হা/৯৯৩; মিশকাত হা/১৮৬২।

[7]. বুখারী হা/২৫৯০; মুসলিম হা/১০৯২; মিশকাত হা/১৮৬১, রাবী আসমা বিনতে আবুবকর (রাঃ)।

[8]. বুখারী হা/৬৪৪৫; মিশকাত হা/১৮৫৯, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[9]. আহমাদ হা/২৩৩৭২, রাবী হোযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ); ছহীহুত তারগীব হা/৯৮৫।

[10]. বুখারী হা/১৪৪২; মুসলিম হা/১০১০; মিশকাত হা/১৮৬০, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[11]. বুখারী হা/১৪১০; মুসলিম হা/১০১৪; মিশকাত হা/১৮৮৮; ‘যাকাত’ অধ্যায় ‘দানের মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[12]. মুসলিম হা/২৫৮৮; মিশকাত হা/১৮৮৯ ‘যাকাত’ অধ্যায়, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[13]. বুখারী হা/৪৬৮৪; মুসলিম হা/২৩৫৬; রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[14]. মুসলিম হা/২৯৮৪; মিশকাত হা/১৮৭৭; আহমাদ হা/৭৮৮১।

[15]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/৮০১৪, রাবী আবু উমামা বাহেলী (রাঃ); ছহীহুত তারগীব হা/৮৮৯।

[16]. বায়হাক্বী ৩/৩৮২ পৃ., হা/৬৮৩২, রাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ); ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৫৮, সনদ হাসান। 

[17]. বুখারী হা/১৪২১; মুসলিম হা/১০২২; মিশকাত হা/১৮৭৬, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[18]. বুখারী হা/৬৬০; মুসলিম হা/১০৩১; মিশকাত হা/৭০১, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[19]. আহমাদ হা/১৮০৭২, ছহীহ-আরনাঊত্ব; মিশকাত হা/১৯২৫, রাবী তাবেঈ মারছাদ বিন আব্দুল্লাহ (রহঃ)।

[20]. আবুদাঊদ হা/২৫০৪; নাসাঈ হা/৩০৯৬; দারেমী হা/২৪৭৫; মিশকাত হা/৩৮২১, রাবী আনাস (রাঃ); ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৯০।

[21]. বুখারী হা/৩৬৬৬, মুসলিম হা/১০২৭; মিশকাত হা/১৮৯০ ‘যাকাত’ অধ্যায়-৬, ‘দানের মাহাত্ম্য’ অনুচ্ছেদ, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[22]. মুসলিম হা/২৯৫৯; মিশকাত হা/৫১৬৬ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[23]. বুখারী হা/৬৪৪২; মিশকাত হা/৫১৬৮, রাবী আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ)।

[24]. বুখারী হা/৬৫১৪; মুসলিম হ/২৯৬০; মিশকাত হা/৫১৬৭, রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ)।

[25]. মুসলিম হা/৯৯০; মিশকাত হা/১৮৬৮, রাবী আবু যার গিফারী (রাঃ)।

[26]. বুখারী হা/৬৪২৫; মুসলিম হা/২৯৬১; মিশকাত হা/৫১৬৩ ‘রিক্বাক্ব’ অধ্যায়, রাবী আমর বিন ‘আওফ (রাঃ)।

[27]. আহমাদ হা/২৯২০, হাদীছ ছহীহ-আরনাঊত্ব; মিশকাত হা/১৮৮১।

[28]. বুখারী হা/৬৪৯৯; মুসলিম হা/২৯৮৬; মিশকাত হা/৫৩১৬, রাবী জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ)।

[29]. মুসলিম হা/১৯০৫; মিশকাত হা/২০৫ ‘ইলম’ অধ্যায়, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[30]. মুসলিম হা/১০৬; নাসাঈ হা/৫৩৩৩, রাবী আবু যার গিফারী (রাঃ)।

[31]. বুখারী হা/১৪১৯; মুসলিম হা/১০৩২; মিশকাত হা/১৮৬৭, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।

[32]. বুখারী হা/১৯০২; মুসলিম হা/২৩০৮; মিশকাত হা/২০৯৮, রাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)।

[33]. বুখারী হা/২৩৮৯; মিশকাত হা/১৮৫৯, রাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)।