মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আসন্ন রামাযান

মানুষ আর পশুতে পার্থক্য হ’ল নৈতিক মূল্যবোধ। মানুষ বড়-ছোট হিসাব করে ও মা-বোন তারতম্য করে চলে। পশুরা তা করে না এবং তাদের কোন বিচার হয় না। কিন্তু মানুষ তা পারে না। ফলে যখনই তার নৈতিক মূল্যবোধ হারিয়ে যায় বা শিথিল হয়ে যায়, তখনই তার পশু প্রবণতা জেগে ওঠে। অতঃপর সুযোগ পেলে সে পশুর চাইতে ভয়ংকর হয়ে যায়। গত ২৮শে মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাতে রাজধানীতে বনানীর ‘রেইনট্রি’ হোটেলে দুই ধনীর দুলাল ও তাদের সহযোগীরা পাঁচ জনে মিলে দু’জন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী বন্ধুকে ডেকে নিয়ে রাত ভর যে ধর্ষণ লীলা চালিয়েছে, তাতে হঠাৎ নড়েচড়ে বসেছে প্রশাসন। এর চাইতে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে খুলনা শহরে দু’জন স্বামী-স্ত্রীর উপর। যা সমস্ত নৃশংসতাকে ছাড়িয়ে গেছে। মিডিয়ার বদৌলতে কুম্ভকর্ণরা কেউ কেউ এখন হাই তুলছে। চারদিক মূল্যবোধ নিয়ে কথা উঠছে। প্রশ্ন হ’ল, এটা কি প্রথম ঘটনা? বরং এটাতো দূষিত স্রোতে ভাসমান পঙ্ক সমূহের অংশ। ইতিপূর্বে ১৯৯৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণের সেঞ্চুরী করে প্রকাশ্যে মিষ্টি বিতরণ করেছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সেক্রেটারী জসিম উদ্দীন মানিক। ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলনের মুখে তার কেবল ছাত্রত্ব বাতিল হয়। কিন্তু আর কোন শাস্তি হয়েছিল কি-না জানা যায়নি। এরূপ হাযারো ঘটনা আড়ালে রয়েছে, যার হিসাব কে রাখে?

প্রধান কারণ সমূহ :

(১) ধর্মহীন শিক্ষা ব্যবস্থা (২) নিয়ন্ত্রণহীন পারিবারিক ব্যবস্থা (৩) বিচারহীনতা (৪) প্রচার মাধ্যম (৫) পর্ণোগ্রাফী। প্রথমটি সম্বন্ধে বলা যায় যে, প্রত্যেক দেশ তার নাগরিকদের ধর্ম ও সংস্কৃতির আলোকে শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থা এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ও সংস্কৃতির বিরোধী। সরকার শিক্ষার্থীদের ইসলাম থেকে সরিয়ে সেক্যুলার বানানোর কোশেশ করতে যাওয়ায় তার বিষময় ফল ভোগ করছে দেশ। মানুষের জান-মাল ও ইযযতের নিরাপত্তা যদি না থাকে, তাহ’লে আর কোনকিছুরই প্রয়োজন থাকে না। সেটাই এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এমনকি এখন আর কেউ অভিযোগটুকুও করে না লাজ-লজ্জার ভয়ে। কারণ রক্ষকরাই এদেশে ভক্ষক। ঢাবি-র এক গবেষণা মতে বিগত ৬০-এর দশকের তুলনায় বর্তমানে বিবাহ-পূর্ব ও বিবাহ বহির্ভূত অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার হার তিনগুণ বেশী। এখন প্রতি ১০ জনের ৩ জন অবৈধ সম্পর্কে জড়িত। এরপরেও সরকার সহশিক্ষা অপরিহার্য করে দিতে চাচ্ছে এবং লিঙ্গ বৈষম্য বিলুপ্ত করতে চাচ্ছে। যা মানুষের স্বভাবধর্মের বিরোধী।

(২) নিয়ন্ত্রণহীন পারিবারিক ব্যবস্থা : পরিবার হ’ল জাতির ভিত্তিমূল। এই ভিত্তি যত বেশী আল্লাহভীরু হবে, জাতি তত বেশী দৃঢ় ও অগ্রগতিশীল হবে। অপচয়, ভোগবাদিতা, বেহিসাব খরচ, পর্ণোগ্রাফীর নীল দংশন, অসৎ সঙ্গ, অলসতা, বিলাসিতা প্রভৃতি কুঅভ্যাস পরিবার থেকেই কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যেকোন ছোট-খাট ত্রুটি শিশুকাল থেকেই শুধরে দিতে হবে। বড় হ’লে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, এই চিন্তা ছাড়তে হবে। সন্তানকে পরিবারেই শাসন করতে হবে। সন্তানের দুষ্কর্মে ছাফাই গাওয়া চলবে না। সদা সত্যকথা বল, মিথ্যা বলা মহাপাপ, আল্লাহ আমাদের প্রভু। তিনি আমাদের সবকিছু দেখছেন ও সবকথা শুনছেন। বড়কে সম্মান করা ও ছোটকে স্নেহ করা, যেকোন নেকীর কাজ আল্লাহর জন্য করা, নিজের কাজ নিজে করা, অল্পে তুষ্ট থাকা, সৎকর্মে জান্নাত ও অসৎকর্মে জাহান্নাম। বেগানা নারী-পুরুষে পর্দা করা ফরয। নিজের মা-বোন ছাড়া অন্য নারীর দিকে তাকানো মহাপাপ। খালা-ফুফু-চাচী-মামী মায়ের সমান। পিতা-মাতার পায়ের নীচে সন্তানের জানণাত। এমনকি বড় ভাই পিতার সমান ও বড় ভাবী মায়ের সমান ইত্যাদি নীতিকথা ও সদাচরণ পরিবার থেকেই রপ্ত করাতে হবে। কেননা পারিবারিকভাবে নৈতিকতার চর্চা না থাকলে মানবিক মূল্যবোধ কখনোই জাগ্রত হবে না এবং তার দ্বারা সমাজ গড়বে না। অতএব কেবল ডিগ্রী ও সম্পদ দেখলে হবে না, তার পারিবারিক ঐতিহ্য ও আল্লাহভীরুতা দেখে মূল্যায়ন করতে হবে। নইলে দেশ ধ্বংস করার জন্য উচ্চ শিক্ষিত ভোগবাদীরাই যথেষ্ট হবে।

(৩) বিচারহীনতা : এক্ষেত্রে দু’টি ব্যবস্থা রয়েছে। (ক) মহল্লা ও গ্রাম্য শালিশী ব্যবস্থা। যা সামাজিক ঐক্য ও শৃংখলার প্রধান রক্ষাকবচ। বিগত দিনে গ্রাম্য মুন্সী ও মাতববরগণ ন্যায়বিচার করতেন। ফলে তাদের সম্মান ছিল অতি উচ্চে। বর্তমানে নিরপেক্ষ ও আল্লাহভীরু সমাজনেতাদের মাধ্যমে সামাজিক শালিশী ব্যবস্থাকে উৎসাহিত করলে ও তাদেরকে কিছুটা ক্ষমতা দিলে আদালতের চাইতে ভাল বিচার সেখানেই হ’তে পারত। কেননা প্রতিবেশীরা পরস্পরকে ভালভাবে চিনে ও জানে। যা অন্যদের পক্ষে সম্ভব নয়। (খ) সরকারী আদালত : এখানে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা প্রকারান্তরে বিচারহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাছাড়া এখানে আইনের নানা ফাঁক-ফোকর দিয়ে দুর্ধর্ষ ও শক্তিমানরা পার পেয়ে যায়। নিরীহ-নিরপরাধ লোকেরা কারাভোগ করে। খুনী ও ধর্ষকরা স্বীকারোক্তি দেওয়ার সাথে সাথে শাস্তি কার্যকর হ’লে এর গতি স্তিমিত হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হয় না।

(৪) প্রচার মাধ্যম : এ বিষয়েও একই কথা। মিডিয়া কর্মীরা যদি বস্ত্তবাদী ও নগ্নতাবাদী হন এবং আল্লাহভীরু না হন, তাহ’লে তারাই মূল্যবোধ ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট হয়ে যান। ভুক্তভোগীরা যা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন।

(৫) পর্ণোগ্রাফী : বর্তমান যুগে এটাই মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংসের প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ফেব্রুয়ারী’১৬-এর সম্পাদকীয়তে আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। পরে যেটি হাযার হাযার কপি ফ্রি বিতরণ করেছি। এখনও বিতরণ চলছে। সেখানে নোংরা পর্ণো সাইটগুলি বন্ধ করার ব্যাপারে দাবী জানিয়েছি। কিন্তু এযাবত কোন কার্যকর ভূমিকা দেখতে পাওয়া যায়নি। ফলে বেড়ে চলেছে ইভটিজিং-অপহরণ-ধর্ষণ-খুন। জানিনা আল্লাহর কাছে কি কৈফিয়ত দিবেন সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলগণ!

রামাযানের আহবান :

এ মাসে প্রতি রাতে আল্লাহ ডাক দিয়ে বলেন, ‘হে কল্যাণের অভিযাত্রী এগিয়ে চল! হে অকল্যাণের অভিসারী থেমে যাও! এ মাসে বহু জাহান্নামীকে মুক্ত করা হয়’ (তিরমিযী হা/৬৮২)। রামাযানে কেবল খানাপিনা বন্ধের জন্য ছিয়াম নয়, বরং এটি পুরা মানবসত্তার ছিয়াম। দেহ ও মনকে নিয়ন্ত্রিত করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ছওয়াব অর্জনের নিয়তে ছিয়াম রাখতে হবে। নিজকে মিথ্যা ও অন্যায় থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হ’লে ছিয়ামও ব্যর্থ হবে। নৈতিক মূল্যবোধের উন্নয়নের জন্য মাসব্যাপী রামাযানের ছিয়াম একটি মোক্ষম সুযোগ। অতএব আসুন! সংযম সাধনার এ মাসে আমরা আমাদের নৈতিক মূল্যবোধকে উন্নত করি এবং অনৈতিকতার সকল উৎসমুখ বন্ধ করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)