মূল্যবোধের অবক্ষয় ও আমাদের করণীয় (পূর্ব প্রকাশিতের পর)

৫. বেশী বেশী আল্লাহকে স্মরণ করা :

আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُمْ بِذِكْرِ اللهِ أَلاَ بِذِكْرِ اللهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ- ‘যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে এবং আল্লাহকে স্মরণ করলে যাদের অন্তরে প্রশান্তি আসে। মনে রেখ, আল্লাহর স্মরণেই কেবল হৃদয় প্রশান্ত হয়’ (রা‘দ ১৩/২৮)। আল্লাহকে স্মরণ করার শ্রেষ্ঠ ইবাদত হ’ল ছালাত। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘আর তুমি ছালাত কায়েম কর আমাকে স্মরণ করার জন্য’ (ত্বোয়া-হা ২০/১৪)। ছালাতের মধ্যে আল্লাহকে স্মরণ করাই হ’ল প্রধান বস্ত্ত। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তুমি ছালাত কায়েম কর। নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই হ’ল সবচেয়ে বড় বস্ত্ত’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)। আল্লাহর স্মরণ থেকে বিচ্যুৎ হ’লেই মানুষ অশ্লীল ও গর্হিত কর্মে জড়িয়ে পড়ে। অতএব সফলকাম মুমিন তারাই, যারা ছালাতে একাগ্র থাকে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয়ই সফলকাম হবে মুমিনগণ’। ‘যারা তাদের ছালাতে তন্ময়-তদ্গত থাকে’ (মুমিনূন ২৩/১-২)। বস্ত্ততঃ মনোযোগহীন ছালাত প্রাণহীন দেহের ন্যায়। 

হযরত আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, مَثَلُ الَّذِى يَذْكُرُ رَبَّهُ وَالَّذِى لاَ يَذْكُرُ مَثَلُ الْحَىِّ وَالْمَيِّتِ ‘যে ব্যক্তি তার প্রতিপালককে স্মরণ করে এবং যে ব্যক্তি করে না, উভয়ের তুলনা জীবিত ও মৃতের ন্যায়’।[1] যে ব্যক্তি আনন্দে ও বেদনায়, বিপদে ও সম্পদে সর্বাবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং দো‘আ পাঠ করে, সেটি তার হৃদয়ে ঈমান বৃদ্ধি করে এবং জীবন সঞ্চারী ঔষধ হিসাবে কাজ করে। কিন্তু যখন সে আল্লাহকে ভুলে যায় এবং উদাসীন হয়ে পড়ে, তখন তার ঈমান হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। সেকারণ মুমিনের উপরে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়েছে এবং সপ্তাহে একদিন জুম‘আর ছালাতে অংশগ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে নিয়মিত উপদেশ শ্রবণের জন্য এবং আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য। এজন্য জুম‘আর ছালাতকে কুরআনে ‘যিকরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর স্মরণ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘হে বিশ্বাসীগণ! যখন জুম‘আর দিন ছালাতের জন্য আহবান করা হয় (আযান দেওয়া হয়), তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং ব্যবসা ছেড়ে দাও। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জান’ (জুম‘আ ৬২/৯)। এখানে ‘আল্লাহর স্মরণ’ অর্থ ‘জুম‘আর খুৎবা ও ছালাত’। 

এর বিপরীতে আল্লাহর স্মরণ থেকে মুনাফিকদের উদাসীনতার বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় মুনাফিকরা আল্লাহর সাথে প্রতারণা করে। আর তিনিও তাদেরকে ধোঁকায় নিক্ষেপ করেন। যখন তারা ছালাতে দাঁড়ায়, তখন অলসভাবে দাঁড়ায়। তারা লোকদের দেখায় এবং আল্লাহকে খুব কমই স্মরণ করে’ (নিসা ৪/১৪২)।   

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) সূরা নাস ৪ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘মানুষ জন্মগ্রহণ করে এমন অবস্থায় যে, শয়তান তার হৃদয়ের উপর জেঁকে বসে থাকে। যখন সে হুঁশিয়ার হয় ও আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন শয়তান সরে যায়। আর যখন সে উদাসীন হয়, তখন শয়তান আবার তার অন্তরে খটকা সৃষ্টি করতে থাকে’।[2]

আব্দুল্লাহ বিন বুস্র (রাঃ) বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ইসলামের বিধি-বিধান অনেক। আপনি আমাকে সংক্ষেপে কিছু বলে দিন। যা আমি সবসময় ধরে রাখতে পারি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন,لاَ يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللهِ- ‘তোমার জিহবা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকরে সিক্ত থাকে’।[3] সেকারণ দিনে-রাতে, দুঃখে-আনন্দে সর্বাবস্থায় পাঠের জন্য বিভিন্ন দো‘আ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যেগুলো সর্বদা মনে রাখা উচিৎ।[4] সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় বাক্য হ’ল চারটি : সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার’।[5]

আবু মালেক আল-আশ‘আরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ নেক আমলের পাল্লা ভরে দেয়। সুবহানাল্লাহ এবং আলহামদুলিল্লাহ আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী সবকিছুকে নেকী দ্বারা পূর্ণ করে দেয়’।[6] অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার আসমান ও যমীনের মধ্যবর্তী সবকিছুকে নেকী দ্বারা পূর্ণ করে দেয়’ (দারেমী হা/৬৫৩, সনদ ছহীহ)

হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,أَفْضَلُ الذِّكْرِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَفْضَلُ الدُّعَاءِ الْحَمْدُ لِلَّهِ ‘শ্রেষ্ঠ যিকর হ’ল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ এবং শ্রেষ্ঠ দো‘আ হ’ল আলহামদুলিল্লাহ’।[7] বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে যেমন মৃত যমীন পুনর্জীবিত হয়, দো‘আর মাধ্যমে তেমনি শুষ্ক অন্তর সজীব হয়ে ওঠে। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,

الذِّكْرُ لِلْقَلْبِ مِثْلَ الْمَاءِ لِلسَّمَكِ فَكَيْفَ يَكُونُ حَالُ السَّمَكِ إذَا فَارَقَ الْمَاءَ؟

‘মাছের জন্য পানি যেমন, হৃদয়ের জন্য যিকর তেমন। মাছ যখন পানি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তখন তার অবস্থা কেমন হয়?’[8] একই অবস্থা হয়ে থাকে মুমিনের। দুনিয়াবী দুঃখ-কষ্টের খরতাপে যখনই তার হৃদয় শক্ত হয়ে যায় অথবা আনন্দে-উচ্ছ্বাসে উদ্বেলিত হয়, তখনই সে দো‘আর মাধ্যমে আল্লাহকে স্মরণ করে। আর তাতেই তার হৃদয় প্রসন্ন হয়ে ওঠে এবং প্রশান্ত হৃদয়ে সে সবকিছুকে আল্লাহর ইচ্ছা হিসাবে হাসিমুখে বরণ করে নেয়। আবার যখন সে কোন নেকীর কাজে ধাবিত হয় এবং আল্লাহর উপরে একান্তভাবে ভরসা করে, তখন সে অদম্য ও সৎসাহসী হয়। কোন ভয় ও বাধা তাকে দমিয়ে রাখতে পারে না।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি আমার বান্দার ধারণার নিকটে অবস্থান করি, যেরূপ সে আমাকে ধারণা করে (অর্থাৎ আমার নিকট থেকে সে যেরূপ ব্যবহার আশা করে, আমি তার সাথে সেরূপই ব্যবহার করি)। যদি সে আমাকে তার অন্তরে স্মরণ করে, আমি তাকে আমার অন্তরে স্মরণ করি। যদি সে আমাকে মজলিসে স্মরণ করে, তাহ’লে আমি তাকে সেই মজলিসে স্মরণ করি, যা তাদের চাইতে উত্তম। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই। যদি সে এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার দিকে দু’হাত এগিয়ে যাই। যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দেŠড়ে যাই। যদি সে পাত্র ভর্তি পাপ নিয়ে আমার সাথে সাক্ষাৎ করে, অথচ শিরক না করে, তাহ’লে আমি তার নিকট অনুরূপ ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাৎ করব’।[9]

এভাবে তওবাকারী ও সর্বদা আল্লাহকে স্মরণকারীদের পুরস্কার ঘোষণা করে আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় মুসলিম পুরুষ ও নারী, মুমিন পুরুষ ও নারী, অনুগত পুরুষ ও নারী, সত্যবাদী পুরুষ ও নারী, ধৈর্যশীল পুরুষ ও নারী, বিনীত পুরুষ ও নারী, দানশীল পুরুষ ও নারী, ছিয়াম পালনকারী পুরুষ ও নারী, যৌনাঙ্গ হেফাযতকারী পুরুষ ও নারী, ‘আল্লাহকে অধিকহারে স্মরণকারী পুরুষ ও নারী; এদের জন্য আল্লাহ প্রস্ত্তত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার’ (আহযাব ৩৩/৩৫)।    

অতএব জীবনের প্রতি পদক্ষেপে সর্বদা কুরআন-হাদীছে বর্ণিত দো‘আ সমূহ দ্বারা আল্লাহর স্মরণ তথা যিকর করা কর্তব্য। এজন্য লোকদের আবিষ্কৃত হালক্বায়ে যিকরের মজলিসে বসার কোন প্রয়োজন নেই।

৬. আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের ভালবাসাকে নিজের উপরে স্থান দেওয়া :

আল্লাহ বলেন,فَلاَ وَرَبِّكَ لاَ يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لَا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجًا مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيمًا- ‘অতএব তোমার পালনকর্তার শপথ! তারা কখনো (পূর্ণ) মুমিন হ’তে পারবে না, যতক্ষণ না তারা তাদের বিবাদীয় বিষয়ে তোমাকে ফায়ছালা দানকারী হিসাবে মেনে নিবে। অতঃপর তোমার দেওয়া ফায়ছালার ব্যাপারে তাদের অন্তরে কোনরূপ দ্বিধা-সংকোচ না রাখবে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নিবে’ (নিসা ৪/৬৫)

আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রাঃ) বলেন, একদা আমরা নবী করীম (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম। যখন তিনি ওমর-এর হাত ধরা অবস্থায় ছিলেন। এসময় ওমর তাঁকে বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই আপনি আমার নিকট সকল বস্ত্তর চাইতে সর্বাধিক প্রিয়, আমার নিজের জীবন ব্যতীত। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, যাঁর হাতে আমার জীবন, তাঁর কসম করে বলছি, যতক্ষণ না আমি তোমার নিকট প্রিয়তর হব তোমার জীবনের চাইতে। তখন ওমর তাঁকে বললেন, এখন আল্লাহর কসম! অবশ্যই আপনি আমার নিকট আমার জীবনের চাইতে প্রিয়তর। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, হ্যাঁ, এখন হে ওমর!’[10]   

এখানে নিজের জীবনের কথা বলা হয়েছে, মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা থেকে। কিন্তু পরকালীন সফলতার দৃষ্টিতে দ্বীন ও আদর্শের স্থান দুনিয়ার সবকিছুর উপরে। সেটা বুঝতে পেরেই ওমর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ভালবাসাকে নিজের জীবনের চাইতে উচ্চে স্থান দেন। আর তখনই রাসূল (ছাঃ) তার ঈমানের পূর্ণতার স্বীকৃতি দেন। নিঃসন্দেহে এই ভালবাসার বাস্তব প্রমাণ হ’ল তাঁর নিখাদ আনুগত্য ও পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বল, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তবে আমার অনুসরণ কর। তাহ’লে আল্লাহ তোমাদের ভালবাসবেন ও তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (আলে ইমরান ৩/৩১)। আল্লাহ অন্যত্র বলেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দিলে কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর সে বিষয়ে নিজস্ব কোন ফায়ছালা দেওয়ার এখতিয়ার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে ব্যক্তি স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)

এতে পরিষ্কার যে, কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর জন্য আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের সিদ্ধান্তের বাইরে মানুষের মনগড়া সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার কোন সুযোগ নেই। সেটা করলে অবশ্যই সে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিক্ষিপ্ত হবে। সে অবস্থায় মানুষ আল্লাহকে ছেড়ে নিজের প্রবৃত্তিকে উপাস্যের আসনে বসাবে। যাকে ধিক্কার দিয়ে আল্লাহ বলেন,أَرَأَيْتَ مَنِ اتَّخَذَ إِلَهَهُ هَوَاهُ أَفَأَنْتَ تَكُونُ عَلَيْهِ وَكِيلاَ؟ ‘তুমি কি তাকে দেখেছ, যে তার প্রবৃত্তিকে উপাস্যরূপে গ্রহণ করেছে? তুমি কি তার যিম্মাদার হবে?’ (ফুরক্বান ২৫/৪৩)

হযরত আনাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যার মধ্যে তিনটি বস্ত্ত রয়েছে, সে ঈমানের স্বাদ পেয়েছে।  যার নিকটে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সবকিছুর চাইতে প্রিয়তর। যে ব্যক্তি কাউকে স্রেফ আল্লাহর জন্য ভালোবাসে এবং যে ব্যক্তি কুফরীতে ফিরে যাওয়াকে এমন অপসন্দ করে- যা থেকে আল্লাহ তাকে মুক্তি দিয়েছেন, যেমনভাবে সে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপসন্দ করে’।[11]

হযরত আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) বলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,مَنْ أَحَبَّ لِلَّهِ وَأَبْغَضَ لِلَّهِ وَأَعْطَى لِلَّهِ وَمَنَعَ لِلَّهِ فَقَدِ اسْتَكْمَلَ الإِيمَانَ-  ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য (কাউকে) ভালবাসে ও আল্লাহর জন্য শত্রুতা করে এবং আল্লাহর জন্য কাউকে দান করে ও আল্লাহর জন্যই দান করা হ’তে বিরত থাকে, সে ব্যক্তি তার ঈমানকে পূর্ণ করল’।[12] এভাবে সর্বদা আল্লাহকে খুশী করার উদ্দেশ্যে সৎকর্ম সাধনের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কেননা রাসূলগণকে পাঠানোই হয়েছে তাঁদের আনুগত্য করার জন্য।

যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ  ‘আমরা রাসূল পাঠিয়েছি কেবল এই উদ্দেশ্যে যে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তার আনুগত্য করা হবে’ (নিসা ৪/৬৪)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্য হ’ল, সে আল্লাহর অবাধ্য হ’ল। মুহাম্মাদ হ’লেন মানুষের মধ্যে (ঈমান ও কুফরের) পার্থক্যকারী’।[13]

৭. যিকরের মজলিস সমূহে বসা ও তার প্রতি আকৃষ্ট থাকা :

আল্লাহ বলেন,وَاصْبِرْ نَفْسَكَ مَعَ الَّذِينَ يَدْعُونَ رَبَّهُمْ بِالْغَدَاةِ وَالْعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجْهَهُ وَلاَ تَعْدُ عَيْنَاكَ عَنْهُمْ تُرِيدُ زِينَةَ الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا- ‘আর তুমি নিজেকে ধরে রাখো তাদের সাথে, যারা সকালে ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে আহবান করে তাঁর চেহারার কামনায় এবং তুমি তাদের থেকে তোমার দু’চোখ ফিরিয়ে নিয়ো না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায়। আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য করো না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ অত্রিক্রম করে গেছে’ (কাহফ ১৮/২৮)

অত্র আয়াতে ঈমানের হ্রাস-বৃদ্ধি দু’টিরই কারণ বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর যিকরের মজলিস সমূহে অবস্থান করলে ঈমান বৃদ্ধি পায়। পক্ষান্তরে আল্লাহ থেকে উদাসীন ব্যক্তিদের মজলিসে অবস্থান করলে ঈমান হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ঠিক যেমন মসজিদে ও গানের মজলিসে অবস্থান করা।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِى بَيْتٍ مِنْ بُيُوتِ اللهِ يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ وَيَتَدَارَسُونَهُ بَيْنَهُمْ إِلاَّ نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ وَغَشِيَتْهُمُ الرَّحْمَةُ وَحَفَّتْهُمُ الْمَلاَئِكَةُ وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ وَمَنْ بَطَّأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ- ‘যখন একদল বান্দা আল্লাহর গৃহ সমূহের কোন একটি গৃহে সমবেত হয় এবং আল্লাহর কিতাব পাঠ করে ও নিজেদের মধ্যে তা পর্যালোচনা করে, তখন (আল্লাহর পক্ষ হ’তে) তাদের উপরে বিশেষ প্রশান্তি নাযিল হয়। আল্লাহর রহমত তাদেরকে ঢেকে ফেলে, ফেরেশতাগণ তাদের ঘিরে রাখে এবং আল্লাহ তাদের কথা আলোচনা করেন তাদের মধ্যে, যারা তাঁর নিকটে থাকে (অর্থাৎ নৈকট্যশীল ফেরেশতামন্ডলীর কাছে)। আর যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার উচ্চবংশ তাকে এগিয়ে দিতে পারে না’।[14]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর অন্যতম অহি লেখক হানযালা বিন রবী‘ আল-উসাইয়েদী (রাঃ) বলেন, ‘আবুবকর আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন। অতঃপর বললেন, হে হানযালা! তুমি কেমন আছ? আমি বললাম, হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে। তিনি বললেন, সুবহানাল্লাহ! সেটা কি? আমি বললাম, আমরা যখন আল্লাহর রাসূলের নিকট থাকি এবং তিনি আমাদের সামনে জাহান্নাম ও জান্নাতের আলোচনা করেন, তখন আমরা যেন সেগুলি চোখের সামনে দেখি। কিন্তু যখন আমরা তাঁর নিকট থেকে বেরিয়ে যাই এবং স্ত্রী-সন্তানাদি ও পেশাগত কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়ি, তখন আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই। আবুবকর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর কসম! আমারও এমন অবস্থা হয়। তখন আবুবকর ও আমি রওয়ানা হয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট হাযির হ’লাম। আমি তাকে বললাম, আল্লাহর কসম! হে আল্লাহর রাসূল! হানযালা মুনাফিক হয়ে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, সেটা কিভাবে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা যখন আপনার কাছে থাকি এবং আপনি আমাদের নিকট জাহান্নাম ও জান্নাতের আলোচনা করেন, তখন আমরা যেন সেগুলি চোখের সামনে দেখি। কিন্তু যখন আমরা আপনার নিকট থেকে বেরিয়ে যাই এবং স্ত্রী-সন্তানাদি ও পেশাগত কাজ-কর্মে জড়িয়ে পড়ি, তখন আমরা অনেক কিছু ভুলে যাই। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, যদি তোমরা সর্বদা ঐরূপ থাকতে, যেরূপ আমার নিকটে থাক এবং সর্বদা যিকরের মধ্যে থাকতে, তাহ’লে নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের বিছানায় ও তোমাদের রাস্তায় করমর্দন করত। কিন্তু হে হানযালা! একটি অবস্থা অন্য অবস্থার কাফফারা মাত্র। কথাটি তিনি তিনবার বলেন’।[15] অর্থাৎ কখনো স্মরণ করায় ও কখনো ভুলে যাওয়ায় তুমি মুনাফিক হবে না। বরং এই আল্লাহভীরুতাই তোমার মুমিন হওয়ার বড় নিদর্শন। এতে বুঝা গেল যে, সর্বদা ঈমান বৃদ্ধির মজলিসে থাকার চেষ্টা করতে হবে। নইলে ঈমান হ্রাসপ্রাপ্ত হবে।

উল্লেখ্য যে, অতি পরহেযগারিতার খটকা লাগিয়ে শয়তান বহু দ্বীনদার মানুষকে পথভ্রষ্ট করে। ফলে তারা সংসার-ধর্ম ছেড়ে দ্বীনের নামে অগ্রহণযোগ্য কর্ম সমূহে লিপ্ত হয়। এমনকি তারা সমস্ত আমল ছেড়ে দিয়ে কেবল যিকরে লিপ্ত থাকে (মিরক্বাত)

অত্র হাদীছে বুঝা গেল যে, সৎকর্ম সমূহের মধ্যেই আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। আর সেটাই হ’ল ঈমান বৃদ্ধির নিদর্শন। কর্মহীন ধর্মের কোন মূল্য নেই। আবার ধর্মহীন কর্মেরও কোন মূল্য নেই। কর্মের মধ্যে যত বেশী আল্লাহকে স্মরণ করা হবে, তত বেশী ঈমান বৃদ্ধি পাবে ও কর্ম সুন্দর হবে। আর সে আল্লাহর রহমত লাভে ধন্য হবে।

মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) একদিন তার সাথী আসওয়াদ বিন  হেলালকে বললেন, اجْلِسْ بِنَا نُؤْمِنْ سَاعَةً ‘তুমি আমাদের সাথে বস। কিছুক্ষণ আমরা ঈমানের আলোচনা করি’। অতঃপর তাঁরা উভয়ে বসলেন এবং আল্লাহকে স্মরণ করলেন ও প্রশংসা করলেন’ (ফাৎহুল বারী ‘ঈমান’ অধ্যায় ১/৪৮)। 

আত্বা বিন ইয়াসার (মদীনা : ২৯-১০৩ হি.) বলেন, ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাঃ) একদিন তাঁর এক সাথীকে বললেন, تَعَالَ حَتَّى نُؤْمِنَ سَاعَةً ‘এসো আমরা কিছুক্ষণ ঈমানের আলোচনা করি’। সাথীটি বলল, أَوَلَسْنَا بِمُؤْمِنَيْنِ؟ ‘আমরা দু’জন কি মুমিন নই?’ তিনি বললেন, بَلَى، وَلَكِنَّا نَذْكُرُ اللهَ فَنَزْدَادُ إِيمَانًا ‘হ্যাঁ, তবে আমরা কিছুক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করব, তাতে আমরা ঈমান বৃদ্ধি করে নিব’ (বায়হাক্বী, শো‘আব হা/৫০)

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘ছাহাবীগণ কখনো কখনো একত্রে জমা হ’তেন। তাঁরা তাঁদের একজনকে আদেশ করতেন কুরআন পাঠের জন্য এবং বাকীরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলতেন, হে আবু মূসা! তুমি আমাদের প্রতিপালককে স্মরণ করিয়ে দাও। তখন তিনি কুরআন পাঠ করতেন এবং লোকেরা তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। ছাহাবীদের মধ্যে এমন অনেকে ছিলেন, যিনি বলতেন, আমাদের সঙ্গে বস, কিছুক্ষণ ঈমানের আলোচনা করি। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জামা‘আতের সাথে ছালাত আদায়ের পর আহলে ছুফফাহর ছাহাবীদের সঙ্গে গিয়ে বসতেন। তাদের মধ্যে একজন কুরআন পাঠ করতেন এবং তিনি বসে তা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। এইভাবে কুরআন শ্রবণ করা ও আল্লাহকে শরী‘আত সম্মতভাবে স্মরণ করার মাধ্যমে হৃদয়ে যে ভয়ের সঞ্চার হয়, চক্ষু দিয়ে অশ্রু প্রবাহিত হয় এবং আতংকে শরীরে যে কাঁটা দিয়ে ওঠে, এটাই হ’ল ঈমানের শ্রেষ্ঠ অবস্থা (حال), যে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহ বর্ণনা করেছে’ (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ২২/৫২১-২২)। এর দ্বারা বুঝানো হয়েছে যে, ছূফীদের আবিষ্কৃত তথাকথিত ‘হাল’ (حال) সমূহের কোন শারঈ ভিত্তি নেই। বরং মুমিন বান্দা যখনই কুরআন-হাদীছের বাণী শুনবে, তখনই তার হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহভীতির সঞ্চার হবে এবং তা ঈমান বৃদ্ধি করবে।

৮. আখেরাত পিয়াসী সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকা :

সর্বদা সৎকর্মশীল উত্তম ব্যক্তিদের সাথে উঠা-বসা করা ঈমান বৃদ্ধির অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপায়। যারা সর্বদা আখেরাতে মুক্তির সন্ধানে থাকেন ও সে মতে সমাজ সংস্কারে রত থাকেন, তারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হন। তিনি তাদেরকে গায়েবী মদদ করে থাকেন। আল্লাহ বলেন,مَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الْآخِرَةِ نَزِدْ لَهُ فِي حَرْثِهِ وَمَنْ كَانَ يُرِيدُ حَرْثَ الدُّنْيَا نُؤْتِهِ مِنْهَا وَمَا لَهُ فِي الْآخِرَةِ مِنْ نَصِيبٍ ‘যে ব্যক্তি আখেরাতের ফসল কামনা করে আমরা তার জন্য তার ফসল বাড়িয়ে দেই। আর যে ব্যক্তি দুনিয়ার ফসল কামনা করে, আমরা তাকে তা থেকে কিছু দিয়ে থাকি। কিন্তু আখেরাতে তার জন্য কোন অংশ থাকবে না’ (শূরা ৪২/২০)। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাদেরকে ভালবাসেন, যারা তাঁর পথে লড়াই করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)। তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবাহ ৯/১১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يَدُ اللهِ عَلَى الْجَمَاعَةِ وَإِنَّ الشَّيْطَانَ مَعَ مَنْ فَارَقَ الْجَمَاعَةَ، ‘জামা‘আতের উপর আল্লাহর হাত থাকে। আর শয়তান তার সাথে থাকে যে জামা‘আত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।[16]

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَنْ أَرَادَ بُحْبُوحَةَ الْجَنَّةِ فَلْيَلْزَمِ الْجَمَاعَةَ ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের মধ্যস্থলে থাকতে চায়, সে যেন জামা‘আতকে অপরিহার্য করে নেয়’।[17] হযরত উম্মুল হুছায়েন (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে এরশাদ করেন,إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ تَعَالَى فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর একজন নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামকেও আমীর নিযুক্ত করা হয়, যদি তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তাহ’লে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর’।[18] এর মধ্যে জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপন ও আমীরের আনুগত্যের অপরিহার্যতা বর্ণিত হয়েছে।

এভাবে আখেরাত পিয়াসী নেককার লোকদের সংগঠনে থাকার মধ্যে সর্বদা তার ঈমান বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ- ‘মানুষ তার বন্ধুর আদর্শে গড়ে ওঠে। অতএব তোমাদের প্রত্যেকের লক্ষ্য রাখা উচিৎ, সে কাকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করছে’।[19] তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘সৎ লোকের সাহচর্য ও অসৎ লোকের সাহচর্যের দৃষ্টান্ত, কস্ত্তরী বিক্রেতা ও কামারের হাপরে ফুঁক দানকারীর ন্যায়। কস্ত্তরী বিক্রেতা হয়তো তোমাকে এমনিতেই কিছু দিয়ে দিবে অথবা তুমি তার নিকট থেকে কিছু কিনবে অথবা তার সুঘ্রাণ তুমি পাবে। পক্ষান্তরে কামারের হাপরের আগুনের ফুলকি তোমার কাপড় জ্বালিয়ে দিবে অথবা তার দুর্গন্ধ তুমি পাবে’।[20] এমনকি সামনা-সামনি সাক্ষাৎ না হ’লেও দূরে থেকে পরস্পরে একই আদর্শের অনুসারী হ’লে তারা ক্বিয়ামতের দিন এক সাথে থাকবে। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, ‘জনৈক ব্যক্তি এসে জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে আপনি কি বলেন, যে ব্যক্তি একটি কওমকে ভালবাসে, কিন্তু তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ ‘ব্যক্তি (ক্বিয়ামতের দিন) তার সঙ্গে থাকবে, যাকে সে ভালবাসত’।[21]

মু‘আল্লাক্বা খ্যাত জাহেলী কবি ত্বরাফাহ ইবনুল ‘আব্দ আল-বিকরী (৫৪৩-৫৬৯ খৃ.) বলেন,

عنِ المرْءِ لا تَسألْ وسَلْ عن قَرينه  

فكُلُّ قَرينٍ بالمُقَارِنِ يَقْتَدي

‘মানুষকে জিজ্ঞেস করো না। জিজ্ঞেস কর তার সাথীকে। কেননা প্রত্যেক সাথী তার সাথীর অনুসরণ করে থাকে’ (দীওয়ানু ত্বরাফাহ)। আরবী প্রবাদ রয়েছে, الصُّحْبَةُ مُتَأثِّرَةٌ ‘সাহচর্য গভীর প্রভাব বিস্তারকারী’। ফারসী কবি জালালুদ্দীন রূমী (৬০৪-৬৭২ হি./১২০৭-১২৭৩ খৃ.) বলেন,

صحبت صالح  ترا  صالح  كند + صحبت  طالح  ترا  طالح  كند

همجنس  با  همجنس  كند  برواز + كبوتر  با كبوتر ،  باز  با  باز

‘সৎসঙ্গ তোমাকে সৎ বানাবে এবং অসৎসঙ্গ তোমাকে অসৎ বানাবে’। ‘একই জাতের পাখি একই জাতের সাথে উড়ে থাকে। কবুতর কবুতরের সাথে, বায বাযের সাথে’। বাংলায় প্রবাদ রয়েছে, ‘সৎসঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’।

৯. পাপ হ’তে দূরে থাকা ও তওবা-ইস্তেগফার করা :

আল্লাহ বলেন,قُلْ لِلْمُؤْمِنِينَ يَغُضُّوا مِنْ أَبْصَارِهِمْ وَيَحْفَظُوا فُرُوجَهُمْ ذَلِكَ أَزْكَى لَهُمْ إِنَّ اللهَ خَبِيرٌ بِمَا يَصْنَعُونَ- ‘তুমি মুমিন পুরুষদের বলে দাও, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হেফাযত করে। এটা তাদের জন্য পবিত্রতর। নিশ্চয়ই তারা যা করে সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবহিত’ (নূর ২৪/৩০)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ‘আদম সন্তানের জন্য যেনার অংশ নির্ধারিত রয়েছে, যাতে সে অপরিহার্যভাবে পতিত হয়। যেমন তার চোখের যেনা হ’ল দেখা, কানের যেনা হ’ল মনোযোগ দিয়ে শোনা, যবানের যেনা হ’ল কথা বলা, হাতের যেনা হ’ল ধরা, পায়ের যেনা হ’ল সেদিকে ধাবিত হওয়া, অন্তরের যেনা হ’ল সেটা কামনা করা ও তার আকাংখা করা। অতঃপর গুপ্তাঙ্গ সেটাকে সত্য অথবা মিথ্যায় পরিণত করে’।[22] হাদীছটির শুরুতে ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, আমি ছোট গোনাহের তুলনার জন্য আবু হুরায়রা বর্ণিত মরফূ‘ হাদীছটির চাইতে অন্য কিছুকে পাইনি। এরপর থেকে উপরের মরফূ‘ হাদীছটি বর্ণিত হয়েছে। অত্র হাদীছে আসক্তির সাথে পরনারীর প্রতি দৃষ্টিপাত ও অন্য বিষয়গুলিকে ‘যেনার অংশ’ বলা হয়েছে এ কারণে যে, এগুলি যেনা সংঘটনে প্ররোচিত করে।

আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ يَجْتَنِبُونَ كَبَائِرَ الْإِثْمِ وَالْفَوَاحِشَ إِلاَّ اللَّمَمَ إِنَّ رَبَّكَ وَاسِعُ الْمَغْفِرَةِ ‘যারা বড় বড় পাপ ও অশ্লীল কর্ম সমূহ হ’তে বেঁচে থাকে ছোট-খাট পাপ ব্যতীত, (সে সকল তওবাকারীর জন্য) তোমার প্রতিপালক প্রশস্ত ক্ষমার অধিকারী...’ (নজম ৫৩/৩২)। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّهُ لَيُغَانُ عَلَى قَلْبِي، وَإِنِّي لَأَسْتَغْفِرُ اللهَ فِي الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ ‘আমার ক্বলবের উপর আবরণ পড়ে। আর সেজন্য আমি দৈনিক ১০০ বার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি। অর্থাৎ তওবা-ইস্তেগফার করি’।[23] অন্য বর্ণনায় এসেছে ‘৭০-এর অধিক বার’।[24] এর অর্থ বহু বার হ’তে পারে। অথবা ৭০ থেকে ১০০ বার হ’তে পারে (ফাৎহুল বারী)। কেননা আরবী বাকরীতিতে অধিক সংখ্যক বুঝানোর জন্য ৭০ বা তার উর্ধ্ব সংখ্যা দ্বারা ব্যক্ত করা হয়। যাঁর আগে-পিছে সকল গোনাহ মাফ, তিনি যদি দৈনিক এত বেশী তওবা করেন, তাহ’লে আমাদের অবস্থা কেমন হওয়া উচিৎ, চিন্তা করা আবশ্যক।

 তিনি বলতেন, যে ব্যক্তি পাঠ করবে, أَسْتَغْفِرُ اللهَ الَّذِيْ لآ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ الْحَيُّ الْقَيُّوْمُ وَأَتُوْبُ إِلَيْهِ ‘আমি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। যিনি চিরঞ্জীব ও বিশ্বচরাচরের ধারক এবং আমি তাঁর দিকেই ফিরে যাচ্ছি (বা তওবা করছি), তাকে ক্ষমা করা হবে, যদিও সে জিহাদের ময়দান হ’তে পলাতক আসামী হয়’।[25] অতএব ‘ক্বলব ছাফ’ করার নামে পৃথকভাবে কোন কসরৎ করার দরকার নেই। যেভাবে কিছু লোক করে থাকেন।

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ‘মানুষের মনে ফিৎনা সমূহ এমনভাবে পেশ করা হয়, যেমনভাবে খেজুরের পাটি বুনতে একটা একটা করে পাতা পেশ করা হয়। যে হৃদয় ঐ ফিৎনা কবুল করে, তাতে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। আর যে হৃদয় তা প্রত্যাখ্যান করে, তাতে একটা সাদা দাগ পড়ে। এভাবে হৃদয়গুলো দু’ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক- মসৃণ পাথরের মত স্বচ্ছ হৃদয়, যাতে আসমান ও যমীন বিদ্যমান থাকা অবধি কোন ফিৎনা কোনরূপ ক্ষতি করতে পারে না। দুই- কয়লার ন্যায় কালো হৃদয়, যা উপুড় করা পাত্রের মত। না সে কোন ন্যায়কে স্বীকার করে, না কোন অন্যায়ের প্রতিবাদ করে। তবে যতটুকু তার প্রবৃত্তি কবুল করে’।[26] অর্থাৎ মন যা চায়, তাই করে। 

একইভাবে মুমিন যতক্ষণ ফিৎনা ও পাপসমূহ হ’তে দূরে থাকে, ততক্ষণ তার হৃদয় পরিচ্ছন্ন থাকে এবং ঈমান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু যখনই সে পাপসমূহকে তুচ্ছ মনে করে এবং ফিৎনা সমূহের সম্মুখীন হয়, তখন তার ঈমান হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, ‘দৃষ্টিকে অবনত রাখার মধ্যে তিনটি উপকারিতা রয়েছে। (১) ঈমানের স্বাদ আস্বাদন করা (২) হৃদয়ের জ্যোতি ও দূরদর্শিতা বৃদ্ধি পাওয়া (৩) হৃদয়ের শক্তি, দৃঢ়তা ও বীরত্ব বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওয়া’ (মাজমূ‘ ফাতাওয়া ১৫/৪২০-২৬)

খ্যাতনামা তাবেঈ আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক (১১৮-১৮১ হি.) বলেন,

رَأَيْتُ الذُّنُوبَ تُمِيْتُ الْقُلُوبَ + وقَدْ يُوْرِثُ الذُّلَّ إِدْمَانُهَا

وتَرْكُ الذُّنُوبِ حَيَاةُ القُلُوْبِ + وخَيْرٌ لِنَفْسِكَ عِصْيَانُهَا

وَهَلْ أَفْسَدَ الدِّيْنَ إِلاَّ الْمُلُوْكُ + وَأَحْبَارُ سُوْءٍ وَرُهْبَانُهَا؟

‘পাপ সমূহকে আমি দেখি হৃদয়গুলিকে মেরে ফেলে। এটি স্থায়ী হ’লে তা লাঞ্ছনাকে ডেকে আনে’। ‘পাপ পরিত্যাগ করা হৃদয় সমূহের জীবন। তোমার জন্য উত্তম হ’ল সেগুলির অবাধ্যতা করা’। ‘আর অত্যাচারী শাসকবর্গ, দুষ্টমতি আলেমগণ ও ছূফী পীর-মাশায়েখগণ ব্যতীত কেউ দ্বীনকে ধ্বংস করে কি?’ (দীওয়ান আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক)

মরিচা যেমন লোহাকে খেয়ে শেষ করে দেয়, কুফর, নিফাক ও ফাসেকীর কলুষ-কালিমা তেমনি এদের ঈমান গ্রহণের সহজাত যোগ্যতাকে অকেজো করে দেয়। কুরআন নাযিলের সময়কাল হ’তে এযাবত এর ব্যত্যয় ঘটেনি।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘বান্দা যখন কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে একটা কালো দাগ পড়ে যায়। অতঃপর যখন সে পাপ থেকে নিজেকে ছিনিয়ে নেয় ও আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে ও তওবা করে, তখন অন্তরের মরিচা ছাফ হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে পাপের পুনরাবৃত্তি করে, তাহ’লে মরিচা বৃদ্ধি পায়। এমনকি মরিচা তার অন্তরের উপরে জয়লাভ করে (অর্থাৎ সে আর তওবা করে ফিরে আসে না)। এটাই হ’ল সেই মরিচা যে বিষয়ে আল্লাহ বর্ণনা করেছেন’।[27] 

আল্লাহ বলেন, كَلاَّ بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ- ‘কখনই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,

ــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــــْئَتُهُ فَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ-  

‘হ্যাঁ যে ব্যক্তি পাপ অর্জন করেছে এবং তার পাপ তাকে বেষ্টন করে ফেলেছে, তারাই হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮১)। এটাই হ’ল অন্তরের মরিচা। অর্থাৎ মরিচা যেমন লোহার উপরে বৃদ্ধি পেয়ে লোহার শক্তি ও ঔজ্জ্বল্যকে বিনষ্ট করে। তেমনিভাবে পাপের কালিমা বৃদ্ধি পেয়ে অন্তরের মধ্যকার ঈমানের জ্যোতিকে ঢেকে ফেলে। যা মুমিনের ভিতর ও বাইরের শক্তি ও সৌন্দর্য বিনষ্ট করে।

এর বিপরীতে বান্দা যখনই আল্লাহকে স্মরণ করে, তখনই তার হৃদয়ের কালিমা দূর হয়ে যায় এবং সে সৎকর্ম সম্পাদন করে। তখন সে জান্নাতের অধিবাসী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ- ‘পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মাদি সম্পাদন করেছে, তারা হ’ল জান্নাতের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮২)

উপরের আলোচনায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, মানুষের অন্তরে হর-হামেশা আবরণ পড়ছে। অতএব হৃদয়কে আবরণ মুক্ত ও স্বচ্ছ রাখার জন্য সর্বদা প্রচেষ্টা চালাতে হবে। আর তার সর্বোত্তম পন্থা হ’ল ফরয ও নফল ইবাদত সমূহ আদায় করা ছাড়াও সর্বদা বেশী বেশী তওবা-ইস্তেগফার করা এবং সাধ্যমত পাপ দৃশ্য দেখা ও পাপ চিন্তা হ’তে বিরত থাকা। কেননা চোখে দেখার মাধ্যমেই হৃদয়ে কল্পনার সৃষ্ট হয়। চোখ ও কান হ’ল হৃদয়ের বাহ্যিক দরজা। এই দু’টি দরজা পাপ হ’তে বন্ধ করতে পারলে হৃদয় অনেক গোনাহ থেকে বেঁচে যাবে ও ঈমান বৃদ্ধি পাবে। আর এদু’টি দরজাকে সৎকর্মে অভ্যস্ত করতে পারলে হৃদয় সর্বদা সৎচিন্তা ও সৎকর্মের জ্যোতি দ্বারা আলোকিত থাকবে। সেখান থেকে পাপচিন্তার বুদ্বুদ সাথে সাথে উবে যাবে। 

১০. বেশী বেশী নফল ইবাদত ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করা :

ফরয ইবাদতের বাইরে সবকিছুকে নফল ইবাদত বলা হয়। নফল ইবাদতের মাধ্যমে বাড়তি নেকী সমূহ পাওয়া যায়। যা মুমিনের ঈমানী সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং তিনি দুনিয়া ও আখেরাতে সম্মানিত হন। এমনকি ক্বিয়ামতের দিন নেক আমল সমূহের ওযনের সময় ফরয ইবাদতের নেকীতে সংকুলান না হ’লে নফল ইবাদতের নেকী দ্বারা মীযানের পাল্লা ভারী করা হয়। যেমন হোরায়েছ বিন ক্বাবীছাহ বলেন, আমি মদীনায় এলাম। অতঃপর আল্লাহর নিকটে বলতে থাকলাম, হে আল্লাহ! আমাকে একজন সৎকর্মশীল সাথী পাওয়াকে সহজ করে দাও। তারপর আমি আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বৈঠকে বসে পড়লাম। অতঃপর তাঁকে আমি বললাম, আমাকে এমন একটি হাদীছ শুনান, যা আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট থেকে শুনেছেন। সম্ভবতঃ এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে উপকৃত করবেন। তখন তিনি বললেন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন,إِنَّ أَوَّلَ مَا يُحَاسَبُ بِهِ الْعَبْدُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ بِصَلاَتِهِ فَإِنْ صَلَحَتْ فَقَدْ أَفْلَحَ وَأَنْجَحَ وَإِنْ فَسَدَتْ فَقَدْ خَابَ وَخَسِرَ... فَإِنِ انْتَقَصَ مِنْ فَرِيضَتِهِ شَىْءٌ قَالَ انْظُرُوا هَلْ لِعَبْدِى مِنْ تَطَوُّعٍ فَيُكَمَّلُ بِهِ مَا نَقَصَ مِنَ الْفَرِيضَةِ ثُمَّ يَكُونُ سَائِرُ عَمَلِهِ عَلَى نَحْوِ ذَلِكَ- ‘ক্বিয়ামতের দিন বান্দার প্রথম হিসাব নেওয়া হবে তার ছালাতের। যদি ছালাতের হিসাব সঠিক হয়, তাহ’লে সে সফলকাম হবে ও কৃতকার্য হবে। আর যদি ছালাতের হিসাব বেঠিক হয়, তাহ’লে সে নিরাশ হবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। যদি তার ফরয ইবাদতের ছওয়াবে ঘাটতি পড়ে যায়, তাহ’লে আল্লাহ বলবেন, দেখ আমার এ বান্দার কোন নফল ইবাদত আছে কি-না? অতঃপর সেটি দিয়ে তার ফরয ইবাদত সমূহের ঘাটতি পূরণ করা হবে। অতঃপর অন্যান্য সকল আমলের বিষয়ে এইরূপ করা হবে’।[28]

নফল ইবাদত সমূহের মধ্যে সুন্নাত ও নফল ছালাত সমূহ অন্তর্ভুক্ত। আর নফল ছালাত সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’ল রাত্রির নফল ছালাত। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ- ‘ফরয ছালাতের পরে সর্বোত্তম ছালাত হ’ল রাত্রির (নফল) ছালাত’।[29]

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَتَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِينَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الآخِرُ يَقُولُ : مَنْ يَدْعُونِى فَأَسْتَجِيبَ لَهُ، مَنْ يَسْأَلُنِى فَأُعْطِيَهُ، مَنْ يَسْتَغْفِرُنِى فَأَغْفِرَ لَهُ- رَوَاهُ الْبُخَارِىُّ- وَفِى رِوَايَةِ لِمُسْلِمٍ عَنْهُ :  فَلاَ يَزَالُ كَذَلِكَ حَتَّى يُضِىءَ الْفَجْرُ- ‘আমাদের মহান প্রতিপালক প্রতি রাতের তৃতীয় প্রহরে দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন, আছ কি কেউ প্রার্থনাকারী আমি তার প্রার্থনা কবুল করব। আছ কি কেউ যাচ্ঞাকারী, আমি তাকে তা প্রদান করব। আছ কি কেউ ক্ষমাপ্রার্থী, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব?’ (বুখারী হা/১১৪৫)। একই রাবী হ’তে ছহীহ মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, ‘যতক্ষণ না ফজর প্রকাশিত হয়’ (মুসলিম হা/৭৫৮)

এর দ্বারা স্পষ্ট বুঝা গেল যে, আল্লাহ প্রতি রাতের শেষ প্রহরে দুনিয়ার আকাশে নেমে আসেন, কেবলমাত্র কথিত শবেবরাতের রাতে নয়। আর সেজন্য ঐ বিশেষ রাতে ইবাদত করা এবং ঐ দিনে ছিয়াম রাখার প্রচলিত প্রথার কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি নেই।[30]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর খাদেম রবী‘আহ বিন কা‘ব বলেন, ‘আমি রাতের বেলা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জন্য ওযূর পানি নিয়ে গেলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, তুমি আমার কাছে কিছু চাও। আমি বললাম, আমি জান্নাতে আপনার সাথে থাকতে চাই। তিনি বললেন, এটি ব্যতীত অন্য কিছু? আমি বললাম, এটাই যথেষ্ট। অতঃপর তিনি বললেন, فَأَعِنِّى عَلَى نَفْسِكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ ‘তাহ’লে তুমি তোমার জন্য আমাকে অধিক সিজদা দ্বারা সাহায্য কর’।[31] এর অর্থ অধিক নফল ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য হাছিল করা।

অনুরূপ একটি প্রশ্নে আরেক খাদেম ছাওবানকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,عَلَيْكَ بِكَثْرَةِ السُّجُودِ لِلَّهِ فَإِنَّكَ لاَ تَسْجُدُ لِلَّهِ سَجْدَةً إِلاَّ رَفَعَكَ اللهُ بِهَا دَرَجَةً وَحَطَّ عَنْكَ بِهَا خَطِيئَةً- ‘তুমি অধিকহারে সিজদা কর। কেননা আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রতিটি সিজদার মাধ্যমে আল্লাহ তোমার সম্মানের স্তর একটি করে বৃদ্ধি করবেন ও তোমার থেকে একটি করে গোনাহ দূর করে দিবেন’।[32]

আল্লাহ পাক স্বীয় রাসূলকে নির্দেশ দিয়ে বলেন,وَاسْجُدْ وَاقْتَرِبْ ‘তুমি সিজদা কর ও আল্লাহর নৈকট্য হাছিল কর’ (‘আলাক্ব ৯৬/১৯)। তিনি আরও বলেন,وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌ أُجِيبُ دَعْوَةَ الدَّاعِ إِذَا دَعَانِ فَلْيَسْتَجِيبُوا لِي وَلْيُؤْمِنُوا بِي لَعَلَّهُمْ يَرْشُدُونَ- ‘আর যখন আমার বান্দারা তোমাকে আমার সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করে, (তখন তাদের বল যে,) আমি অতীব নিকটবর্তী। আমি আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেই যখন সে আমাকে আহবান করে। অতএব তারা যেন আমাকে আহবান করে এবং আমার উপরে নিশ্চিন্ত বিশ্বাস রাখে। যাতে তারা সুপথপ্রাপ্ত হয়’ (বাক্বারাহ ২/১৮৬)। এজন্য সর্বদা আল্লাহর নিকট বেশী বেশী দো‘আ করা কর্তব্য। তাতে সর্বদা ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করে।

অনুরূপভাবে রামাযানের এক মাস ফরয ছিয়াম-এর বাইরে সারা বছরের নফল ছিয়াম সমূহ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। যেমন রামাযানের পরপরই ৬টি শাওয়ালের ছিয়াম, সপ্তাহের প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবারের ছিয়াম, প্রতি মাসে আইয়ামে বীয-এর ৩টি ছিয়াম, আশূরার ২টি ছিয়াম, ‘আরাফাহর ছিয়াম এবং একদিন অন্তর একদিন ছিয়াম, যাকে ‘ছওমে দাঊদী’ বলা হয় প্রভৃতি। অমনিভাবে ফরয যাকাত, ওশর ও ছাদাক্বাতুল ফিৎরের বাইরে সর্বদা নফল ছাদাক্বা সমূহ। যা ক্বিয়ামতের দিন আমলের পাল্লা ভারী করণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে ইনশাআল্লাহ। 

এভাবে কেবল ছালাত-ছিয়াম নয়, বরং আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ বড় ও ছোট সকল সৎকর্মই নফল ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, كُلُّ مَعْرُوفٍ صَدَقَةٌ ‘প্রত্যেক সৎকর্মই ছাদাক্বা’।[33] রাস্তার কাঁটা সরানো বা ছোট-খাট বাধা দূর করাকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ‘ঈমানের সর্বনিম্ন শাখা’ হিসাবে গণ্য করেছেন।[34] অন্য বর্ণনায় এটিকে অন্যতম ‘ছাদাক্বা’ বলা হয়েছে।[35] প্রতিটি তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল, প্রতিটি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ এক একটি ছাদাক্বা।[36] কারু সঙ্গে হাসি মুখে সুন্দরভাবে কথা বলাটাও একটি ছাদাক্বা।[37] এমনকি স্ত্রী-সন্তানদের গালে এক লোক্বমা খাদ্য তুলে দেওয়াটাও ছাদাক্বা।[38] এমনি করে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের ছোট-খাট সদাচরণও ছাদাক্বা হবে, যদি তা আল্লাহকে খুশী করার জন্য হয়।[39] বান্দা যখন এইভাবে নফল ইবাদত সমূহে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন আল্লাহ তার সকল সৎকর্মে বরকত দান করেন এবং তাকে সর্বক্ষণ নিজ তত্ত্বাবধানে রাখেন। যেমন হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,وَمَا يَزَالُ عَبْدِى يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِى يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِى يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِى يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِى يَمْشِى بِهَا، وَإِنْ سَأَلَنِى لأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِى لأُعِيذَنَّهُ- ‘বান্দা নফল ইবাদত সমূহের মাধ্যমে সর্বদা আমার নৈকট্য হাছিলের চেষ্টায় থাকে, যতক্ষণ না আমি তাকে ভালবাসি। অতঃপর যখন আমি তাকে ভালবাসি, তখন আমিই তার কান হয়ে যাই যা দিয়ে সে শোনে, চোখ হয়ে যাই যা দিয়ে সে দেখে, হাত হয়ে যাই যা দিয়ে সে ধরে, পা হয়ে যাই যা দিয়ে সে চলাফেরা করে। তখন সে যদি আমার কাছে কিছু চায়, তখন অবশ্যই আমি তাকে দান করি। যদি সে আমার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করে, আমি তাকে অবশ্যই আশ্রয় প্রদান করি’।[40]

উল্লেখ্য যে, ভ্রান্ত লোকেরা এই হাদীছের অপব্যাখ্যা করে তাদের পূজিত ব্যক্তিদেরকে ‘আউলিয়া’ বা ‘আল্লাহর অলি’ বলে থাকেন। যা ইহূদী-নাছারাদের অনুকরণ মাত্র। যারা তাদের পোপ-পাদ্রীদের নিষ্পাপ মনে করে থাকে। মনে রাখা আবশ্যক যে, ‘কারামাতে আউলিয়া’ শরী‘আতের কোন দলীল নয়। এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বীয় নেক বান্দার প্রতি সম্মান প্রদর্শন মাত্র। যা অনেক সময় বান্দার জন্য পরীক্ষা হয়ে থাকে। যে ফিৎনায় পড়ে গেছেন বহু দ্বীনদার মানুষ।

১১. সর্বদা ঈমান তাযা করা :

হযরত আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ الْإِيمَانَ لَيَخْلَقُ فِي جَوْفِ أَحَدِكُمْ كَمَا يَخْلَقُ الثَّوْبُ الْخَلِقُ، فَاسْأَلُوا اللهَ أَنْ يُجَدِّدَ الْإِيمَانَ فِي قُلُوبِكُمْ- ‘নিশ্চয় ঈমান তোমাদের হৃদয়ে জীর্ণ হয়ে যায়, যেমন তোমাদের পোষাক জীর্ণ হয়ে যায়। সেকারণ তোমরা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা কর, যেন তিনি তোমাদের হৃদয় সমূহে ঈমানকে তাযা করে দেন’।[41] আব্দুল্লাহ বিন ‘উকায়েম বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাঃ)-কে দো‘আ করতে শুনেছি, اللَّهُمَّ زِدْنَا إِيمَانًا وَيَقِينًا وَفِقْهًا ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ঈমান, ইয়াক্বীন ও দ্বীনের বুঝ বৃদ্ধি করে দাও’।[42] আবুদ্দারদা (রাঃ) বলতেন,إِنَّ مِنْ فِقْهِ الْعَبْدِ أَنْ يَعْلَمَ نَزَعَاتِ الشَّيْطَانِ أَنَّى تَأْتِيهِ- ‘বান্দার দ্বীনী বুঝের অন্যতম প্রমাণ হ’ল এই যে, সে মনের মধ্যে শয়তানের খটকা এলে জানতে পারে’। তিনি আরও বলতেন, مِنْ فِقْهِ الْعَبْدِ أَنْ يَعْلَمَ أَمُزْدَادٌ هُوَ أَوْ مُنْتَقِصٌ؟ ‘বান্দার দ্বীনী বুঝের অন্যতম প্রমাণ হ’ল এই যে, সে জানতে পারে সে তার ঈমানকে বৃদ্ধি করছে, না কমিয়ে দিচ্ছে?’[43]

হাদীছে জিব্রীলের শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,هَلْ تَدْرُونَ مَنْ هَذَا؟ هَذَا جِبْرِيلُ جَاءَكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ-  ‘তোমরা কি জান কে এই ব্যক্তি? ইনি হ’লেন জিব্রীল। এসেছিলেন তোমাদেরকে দ্বীনের প্রশিক্ষণ দিতে’।[44] অথচ ঐ মজলিসে হযরত ওমর সহ বড় বড় ছাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। যারা আগে থেকেই এগুলি জানতেন। এতে বুঝা যায় যে, সর্বদা দ্বীনের চর্চা ও পরিচর্যার মাধ্যমে দ্বীনকে তাযা রাখা আবশ্যক।

অথচ ভ্রান্ত ফিরক্বা মুরজিয়াদের আক্বীদা হ’ল ঈমানের কোন হ্রাস-বৃদ্ধি নেই। তাদের নিকট আবুবকর (রাঃ)-এর ঈমান ও সাধারণ লোকদের ঈমান সমান। যুগে যুগে শৈথিল্যবাদী ফাসেক মুসলমানরা এই ভ্রান্ত দলের অন্তর্ভুক্ত।

এর বিপরীতে হোদায়বিয়ার সফরে সূরা ফাৎহ নাযিল করে আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ ‘তিনিই মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন যেন তারা নিজেদের ঈমানের সাথে ঈমানকে আরও বাড়িয়ে নেয়’ (ফাৎহ ৪৮/৪)। বিগত যুগে ৩০৯ বছর ঘুমিয়ে থাকা গুহাবাসী যুবকদের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আল্লাহ বলেন, إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى ‘তারা ছিল কয়েকজন যুবক। যারা তাদের প্রতিপালকের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমরা তাদের হেদায়াত (অর্থাৎ আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকার শক্তি) বৃদ্ধি করে দিয়েছিলাম’ (কাহফ ১৮/১৩)। ঈমানদারগণের ঈমান বৃদ্ধি করা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَيَزِيدُ اللهُ الَّذِينَ اهْتَدَوْا هُدًى ‘যারা সৎপথে থাকে, আল্লাহ তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দেন’ (মারিয়াম ১৯/৭৬)। ৫ম হিজরীতে সংঘটিত খন্দক যুদ্ধে মদীনা অবরোধকারী দশ হাযার সৈন্যের সম্মিলিত আরব বাহিনীকে দেখে মুসলমানদের ঈমানী তেয বৃদ্ধি পাওয়া সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيمَانًا وَتَسْلِيمًا ‘এটি তাদের ঈমান ও আনুগত্যকে আরও বৃদ্ধি করল’ (আহযাব ৩৩/২২)

উপরোক্ত দলীল সমূহের মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, জীবনের বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতে ও বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রকৃত মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। আর এগুলির মাধ্যমে আল্লাহ মুমিনদের ঈমানকে বারবার তাযা করেন। 

১২. সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ করা :

এটি ঈমান বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। এই অভ্যাস সৃষ্টি হ’লে নিজের মধ্যে আপনা থেকেই ঈমান বৃদ্ধি পায়। কারণ কাউকে কোন উপদেশ দিতে গেলে আগে নিজের মধ্যে তার চেতনা সৃষ্টি হয়। সমাজে ও পরিবারে এই অভ্যাস জারী থাকলে সমাজ দ্রুত সংশোধিত হবে এবং সর্বত্র ঈমানী পরিবেশ সৃষ্টি হবে। সেজন্যেই এটি মুসলিম উম্মাহর শ্রেষ্ঠত্বের কারণ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরাই হ’লে শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে ইমরান ৩/১১০)

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন,وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لَتَأْمُرُنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلَتَنْهَوُنَّ عَنِ الْمُنْكَرِ أَوْ لَيُوشِكَنَّ اللهُ أَنْ يَبْعَثَ عَلَيْكُمْ عِقَابًا مِنْهُ ثُمَّ تَدْعُونَهُ فَلاَ يُسْتَجَابُ لَكُمْ- ‘যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, অবশ্যই তোমরা সৎকাজের আদেশ করবে ও অসৎকাজে নিষেধ করবে। নইলে সত্বর আল্লাহ তার পক্ষ হ’তে তোমাদের উপর শাস্তি প্রেরণ করবেন। অতঃপর তোমরা দো‘আ করবে। কিন্তু তা আর কবুল করা হবে না’।[45]

সৎকাজের আদেশ দানের সময় কাজটি ছোট না বড় সেটি দেখা সর্বদা যরূরী নয়। বরং কোন বস্ত্তকে ছোট-খাট বলে এড়িয়ে যাওয়া বা তার প্রতি উদাসীন হওয়াটাই ক্ষতির কারণ। যেমন মুমিনের চুল, দাঁড়ি, পোষাকাদি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য শিষ্টাচার মূলক বিষয় সমূহ। এগুলো পরিত্যাগ করলে কেউ ‘কাফের’ হবে না। কিন্তু এর ফলে কেউ উন্নত ঈমানদারও হবে না। আল্লাহর নিকট তার সম্মানও বৃদ্ধি পাবে না। বরং এটি তার প্রতি মানুষের ঘৃণা সৃষ্টি করবে। অনেকে ফরয ও সুন্নাতের তারতম্য করতে গিয়ে সুন্নাত ও নফল সমূহের প্রতি উদাসীনতা দেখান। যা অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

সব মানুষ সব ব্যাপারে সমানভাবে সতর্ক হয় না, সেজন্য সর্বদা সতর্ককারী ব্যক্তির প্রয়োজন হয়। শিশুকালে পিতা-মাতা, বয়সকালে গুরুজন ও শিক্ষকমন্ডলী এবং সর্বোপরি বিশুদ্ধ ইসলামী সংগঠনের ‘আমীর’ এই দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আর এই দায়িত্ব সাময়িক নয়, বরং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রত্যেককে পালন করে যেতে হবে।

যত ছোটই হৌক প্রত্যেক মুমিনকে পরস্পরের প্রতি সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজে নিষেধ-এর এই মৌলিক দায়িত্ব পালন করে যেতে হবে। কেউ মেনে নিলে আদেশকারী মান্যকারীর সমান নেকী পাবেন। না মানলে আদেশকারী তার নেকী পুরোপুরি পাবেন। কাজটি যত ছোটই হৌক তা কখনোই নেকী থেকে খালি হবে না। ঠিক অমনি করে অসৎকাজের নির্দেশ দিলে তা যত ছোটই হৌক, তার গোনাহ থেকে কেউ বাঁচতে পারবে না। এ বিষয়ে আল্লাহর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা হ’ল,أَنِّي لاَ أُضِيعُ عَمَلَ عَامِلٍ مِنْكُمْ مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى ‘পুরুষ হৌক নারী হৌক আমি তোমাদের কোন কর্মীর কর্মফল বিনষ্ট করব না’ (আলে ইমরান ৩/১৯৫)। তিনি বলেন,فَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ خَيْرًا يَرَهُ- وَمَنْ يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ- ‘অতঃপর কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলে তা সে দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৯/৭-৮)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এ দু’টি আয়াতকে একত্রে الآيَةُ الْفَاذَّةُ الْجَامِعَةُ ‘অনন্য ও সারগর্ভ আয়াত’ বলে অভিহিত করেছেন।[46] অন্ততঃ এই একটি আয়াত মনে রাখলেই মানুষের জন্য যথেষ্ট হবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলতেন, يَا عَائِشَةُ إِيَّاكِ وَمُحَقِّرَاتِ الذُّنُوبِ فَإِنَّ لَهَا مِنَ اللهِ طَالِباً ‘হে আয়েশা! তুচ্ছ গোনাহ হ’তেও বেঁচে থাকো। কেননা উক্ত বিষয়েও আল্লাহর পক্ষ হ’তে কৈফিয়ত তলব করা হবে’।[47] ছাহাবায়ে কেরাম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর প্রতিটি ছোট ও বড় আদেশ ও নিষেধ জান-মালের কুরবানী দিয়ে হ’লেও সাথে সাথে তা করার চেষ্টা করতেন। তাঁরাই আমাদের আদর্শ এবং অনুসরণীয়।

১৩. কবর যিয়ারত করা :

কবর যিয়ারত করলে বা জানাযায় অংশগ্রহণ করলে মানুষের মধ্যে মৃত্যুর চিন্তা ও পরকালীন জবাবদিহিতার অনুভূতি জাগ্রত হয়। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ...فَزُورُوا الْقُبُورَ فَإِنَّهَا تُذَكِّرُ الْمَوْتَ ‘... অতএব তোমরা কবর যিয়ারত কর। কেননা এটি মৃত্যুকে স্মরণ করিয়ে দেয়’।[48] তাই অন্যের জানাযায় অংশগ্রহণ করে নিজের জানাযার কথা স্মরণ করা উচিৎ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَكْثِرُوا ذِكْرَ هَاذِمِ اللَّذَّاتِ، يَعْنِى الْمَوْتَ- ‘তোমরা স্বাদ বিনষ্টকারী বস্ত্তটিকে অর্থাৎ মৃত্যুকে বেশী বেশী স্মরণ কর’।[49]

কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় অবশ্যই তাদের উদ্দেশ্যে কবর যেয়ারতের দো‘আ পাঠ করবে। তাতে ঈমান বৃদ্ধি পাবে।

হযরত ওছমান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত আছে যে, তিনি যখন কোন কবরের নিকটে দাঁড়াতেন, তখন কেঁদে ফেলতেন, যাতে তাঁর দাড়ি ভিজে যেত। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করা হ’ল যে, আপনি জান্নাত ও জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদেন না, অথচ কবর দেখলে কাঁদেন। উত্তরে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, আখেরাতের মনযিলসমূহের প্রথম মনযিল হ’ল ‘কবর’। যদি কেউ এখানে মুক্তি পায়, তাহ’লে পরবর্তী মনযিলগুলি তার জন্য সহজ হয়ে যায়। আর যদি এখানে মুক্তি না পায়, তাহ’লে পরের মনযিলগুলি তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। অতঃপর তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন ‘আমি এমন কোন দৃশ্য কখনো দেখিনি যে, কবর সেগুলির চেয়ে অধিক ভীতিকর নয়’।[50]

অতএব মৃত্যুকে নিশ্চিত জেনে এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনকে চির শান্তিময় করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করলে সর্বদা ঈমান বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। সাময়িকভাবে পদস্খলন ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা ও আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যমে ঈমানকে তাযা করা সম্ভব।

১৪. বিগত নবীগণের জীবনেতিহাস পাঠ করা : 

আদম (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত মানব জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ প্রেরিত ১ লক্ষ ২৪ হাযার নবী-রাসূলের মধ্যে ২৫ জন নবীর কাহিনী পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে বিগত ২৪ জন নবীর জীবনে আল্লাহর গযবে ধ্বংসপ্রাপ্ত ৬টি জাতির ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। উক্ত ৬টি জাতি হ’ল- কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, কওমে লূত, মাদইয়ান ও কওমে ফেরাঊন। যা থেকে মানব জাতি বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহ শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে। যে বিষয়ে আল্লাহ পাক বলেন, ‘বহু রাসূল সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা তোমাকে বলেছি এবং অনেক রাসূল সম্পর্কে বলিনি। আর আল্লাহ মূসার সঙ্গে সরাসরি কথোপকথন করেছেন’। ‘আমরা রাসূলগণকে জান্নাতের সুসংবাদ দানকারী ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করেছি। যাতে রাসূলগণের পরে লোকদের জন্য আল্লাহর বিরুদ্ধে কোনরূপ অজুহাত দাঁড় করানোর সুযোগ না থাকে। আর আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (নিসা ৪/১৬৪-৬৫)।[51]

বস্ত্ততঃ কুরআন যদি বিগত দিনের এসব কাহিনী আমাদের না শুনাতো, তাহ’লে তা থেকে মানবজাতি চিরকাল অন্ধকারে থাকত।

১৫. রাসূল চরিত বেশী বেশী পাঠ করা :

নবীদের সিলসিলা শেষ হয়েছে মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর মাধ্যমে। তিনি ছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী। তাঁর আনীত ‘কুরআন’ হ’ল সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ এলাহী কিতাব। তাঁর মাধ্যমে প্রেরিত ‘ইসলাম’ হ’ল মানব জাতির জন্য আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন। তাই তাঁর ২৩ বছরের নবুঅতী জীবন সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রত্যেক মানব দরদী  সমাজ সংস্কারকের জন্য অপরিহার্য।

আল্লাহ বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيرًا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)

সেকারণ মতভেদকারী মানব সন্তানদের প্রতি সিদ্ধান্তকারী নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘আমার রাসূল তোমাদের নিকটে যা নিয়ে আসেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা হ’তে বিরত থাক’ (হাশর ৫৯/৭)

সেই সাথে তাঁর জীবন সংগ্রামের সাথী ছাহাবায়ে কেরামের জীবনী, বিশেষ করে খুলাফায়ে রাশেদীনের জীবনেতিহাস জানা অত্যন্ত যরূরী। তাঁদের পরে তাঁদের শিষ্য তাবেঈন, তাবে তাবেঈন ও সালাফে ছালেহীনের জীবনী পাঠ করা আবশ্যক। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِى، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ الَّذِينَ يَلُونَهُمْ، ثُمَّ يَجِىءُ أَقْوَامٌ تَسْبِقُ شَهَادَةُ أَحَدِهِمْ يَمِينَهُ، وَيَمِينُهُ شَهَادَتَهُ- ‘মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম যুগ হ’ল আমার যুগ (অর্থাৎ ছাহাবীগণের যুগ)। অতঃপর তাদের পরবর্তী (তাবেঈদের) যুগ। অতঃপর তাদের পরবর্তী (তাবে তাবেঈদের) যুগ। এরপর এমন লোকেরা আসবে, যাদের সাক্ষ্য তাদের শপথের আগে হবে এবং তাদের শপথ তাদের সাক্ষ্যের আগে হবে’।[52] অর্থাৎ তারা এত দ্রুত সাক্ষ্য দিবে যে, শপথ ও সাক্ষ্য কোনটি আগে বা কোনটি পরে হবে, সেটা তারা নির্ণয় করতে পারবে না। তারা সাক্ষ্যকে শপথ দ্বারা এবং শপথকে সাক্ষ্য দ্বারা দৃঢ় করবে। এ সময় সাক্ষ্যদাতা ও শপথকারীর মধ্যে কোন সদগুণ অবশিষ্ট থাকবে না।

এর দ্বারা ভ্রষ্টতা যুগের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে। আমরা সে যুগেই বসবাস করছি। আল্লাহ আমাদেরকে ভ্রষ্টতা হ’তে রক্ষা করুন!

ইবনুল জাওযী (৫০৮-৫৯৭ হি.) বলেন,

وأصْلُ الأُصُولِ الْعِلْمِ وأنْفَعُ العُلُومِ النَّظْرُ في سِيَرِ الرَّسولِ صلى الله عليه وسلم وأَصْحابِهِ: {أُولَئِكَ الَّذِينَ هَدَى اللهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ} ‘জ্ঞানের সূত্র সমূহের মূল উৎস এবং সবচেয়ে উপকারী জ্ঞান হ’ল রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবীগণের জীবনী অনুধাবন করা। আল্লাহ বলেছেন, ‘এরাই হল ঐসব মানুষ যাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেছেন। অতএব তুমি তাদের অনুসরণ কর’ (আন‘আম ৬/৯০)।[53] অত্র আয়াতে বিগত নবীগণের কথা বলা হ’লেও শেষনবী ও তাঁর সাথীগণ এর মধ্যে শামিল হবেন। কারণ তাঁরাই উম্মতের সেরা ব্যক্তি।

শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনী ছেড়ে যারা অন্যদের জীবনী থেকে উপদেশ গ্রহণ করতে চাইবে, তারা বিভ্রান্ত হবে। ওমর ফারূক (রাঃ) তাওরাত থেকে কিছু অংশ লিখে নিতে চাইলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে কঠোরভাবে ধমক দেন এবং বলেন, আজ মূসা বেঁচে থাকলেও তাকে আমার অনুসরণ করা ছাড়া উপায় থাকত না’।[54] এমনকি ক্বিয়ামতের পূর্বে ঈসা (আঃ) অবতরণ করলে তিনি মুহাম্মাদী শরী‘আত মেনে চলবেন।[55] যদি কেউ অন্যদের বিধান ও প্রথা মেনে চলে, তাহ’লে সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে। যেমন রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি যে কওমের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে, সে ব্যক্তি তাদের মধ্যে গণ্য হবে’।[56]

শয়তান প্রতিনিয়ত মানুষের মানবিক মূল্যবোধ বিনষ্ট করার চক্রান্তে লিপ্ত। চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি ও প্রতারণাপূর্ণ কথামালার মাধ্যমে সে ঈমানদারগণকে চুম্বকের মত সর্বদা তার দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এক্ষণে তার থেকে বাঁচতে গেলে এবং জান্নাতের পথ পেতে গেলে আমাদেরকে সবদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বিশুদ্ধ জীবনী বারবার পাঠ করতে হবে এবং সেখান থেকে ঈমানের সঞ্জীবনী সুধা পান করতে হবে।[57]

পরিশেষে আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করে বলব, যেমনটি বলেছিলেন নির্যাতিত নবী ইউসুফ (আঃ),فَاطِرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ أَنْتَ وَلِيِّي فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ تَوَفَّنِي مُسْلِمًا وَأَلْحِقْنِي بِالصَّالِحِينَ ‘নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের হে সৃষ্টিকর্তা! দুনিয়া ও আখেরাতে তুমিই আমার অভিভাবক। তুমি আমাকে ‘মুসলিম’ হিসাবে মৃত্যু দান কর এবং আমাকে সৎকর্মশীলদের সাথে মিলিত কর’ (ইউসুফ ১২/১০১)। প্রার্থনা করেছিলেন সম্রাট নবী সুলায়মান (আঃ),رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَدْخِلْنِيْ بِرَحْمَتِكَ فِيْ عِبَادِكَ الصَّالِحِيْنَ- ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে দান করেছ। আর যাতে আমি এমন সৎকর্ম করতে পারি, যা তুমি পসন্দ কর এবং আমাকে তোমার অনুগ্রহে তোমার সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত কর’ (নমল ২৭/১৯)

হে আল্লাহ! তুমি আমাদের ঈমান বৃদ্ধি কর, সমাজকে শান্তিময় কর এবং ঈমানী হালতে আমাদের মৃত্যু দান কর- আমীন!