অস্ত্র ব্যবসা বনাম মানবিক কূটনীতি

পরাশক্তি নামধারী অস্ত্র ব্যবসায়ী রাষ্ট্রগুলির সৃষ্ট যুদ্ধ, সহিংসতা ও নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে বিশ্বে বাস্ত্তহারা হওয়া লোকের সংখ্যা গত সাত দশকের যেকোন সময়ের চেয়ে এখন বেশী। তাদের কেউ হয় বিদেশে শরণার্থী, নয় আশ্রয়প্রার্থী কিংবা দেশের ভেতরেই বাস্ত্তচ্যুত। গত ১৯শে জুন’১৭ সোমবার জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, ২০১৬ সালের শেষ নাগাদ সারা বিশ্বে বাস্ত্তহারা হ’তে বাধ্য হয়েছে ৬ কোটি ৫৬ লাখ মানুষ। এটা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশী। তার মধ্যে শরণার্থী হ’ল ২ কোটি ২৫ লাখ। স্বদেশের ভেতরে বাস্ত্তহারা ৪ কোটি ৩ লাখ এবং বিভিন্ন দেশে আশ্রয়প্রার্থী ২৮ লাখ। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর গড়ে প্রতি মিনিটে ২০ জন করে লোক (অর্থাৎ প্রতি ৩ সেকেন্ডে একজন) উদ্বাস্ত্ত হ’তে বাধ্য হয়েছে। যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৫০ সালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে সর্বোচ্চ। বাস্ত্তহারা লোকের বিরাট এই সংখ্যা আগের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ আশা করছে, সম্পদশালী দেশগুলো কেবল শরণার্থী গ্রহণই করবে না, বরং এর পাশাপাশি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ ও পুনর্গঠনে বিনিয়োগ করতে মনোযোগী হবে। সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডি বলেন, যেভাবেই দেখা হোক না কেন, উদ্বাস্ত্ত মানুষের এই বিশাল সংখ্যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা আন্তর্জাতিক কূটনীতির একটি হতাশাজনক ব্যর্থতা।

মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর ও বর্বর হত্যাযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এযাবৎ প্রায় সোয়া ৬ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলিম। সেখানে নিহত হয়েছে ৫ হাযারের উপরে। এখনও সেখানে পোড়ামাটি নীতি চলছে। ফলে মানুষের ঢল থেমে থেমে অব্যাহত আছে। এছাড়া পূর্ব থেকেই নির্যাতিত হয়ে এখানে আশ্রিত আছে ৫ লাখের বেশী। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে এখন প্রায় ১১ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর বাস। অন্যান্য দেশে রয়েছে প্রায় ৫ লক্ষ। আরাকানের প্রায় ২২ লক্ষ রোহিঙ্গা মুসলমানের অধিকাংশই এখন বাংলাদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মানবেতর জীবন যাপন করছে। সেই সাথে রয়েছে ভয়াবহ খাদ্য সংকট। কংকালসার মানব সন্তানের বিকট চেহারা দেখলে যেকোন বিবেকবান মানুষের হৃদয় কেঁদে ওঠে। এভাবে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে অস্ত্রবাজদের মাধ্যমে স্বাধীন মানুষকে প্রতি মুহূর্তে সর্বহারায় পরিণত করা হচ্ছে। কেড়ে নেওয়া হচ্ছে তাদের জাতিগত পরিচয়। এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারটুকুও।

অস্ত্র ব্যবসায়ী পরাশক্তিগুলো তাদের মরণ ব্যবসা প্রসারের স্বার্থে কূটনীতির নামে মানবতা ধ্বংসে কাজ করছে। ভূপৃষ্ঠের মানুষের চাইতে ভূগর্ভের লুক্কায়িত সম্পদ তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। একবিংশ শতকের শুরু থেকে ইরাক, আফগানিস্তান, লিবিয়া, সোমালিয়া, চাদ, নাইজার, নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন, দক্ষিণ সুদান, বুরুন্ডী, সিরিয়া, ইয়ামন, মিয়ানমার প্রভৃতি দেশে তাদের রক্তাক্ত ভূমিকা বিশ্বকে হতাশ করেছে। এরাই এদের হীন স্বার্থে ক্ষমতা লাভের সুঁড়সুড়ি দিয়ে গণতন্ত্রের নামে দেশে দেশে দলাদলি ও বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। একটি মুসলিম দেশকে আরেকটি মুসলিম দেশের বিরুদ্ধে হামলার ভয় দেখিয়ে উভয় দেশকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য করেছে। ইসলামকে বদনাম করার জন্য জিহাদের সুঁড়সুড়ি দিয়ে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করে বিভিন্ন মুসলিম দেশে জঙ্গী গোষ্ঠী সৃষ্টি করেছে। অতঃপর জঙ্গী ও সন্ত্রাস দমনের নামে নিজেদেরকে ত্রাণকর্তা হিসাবে যাহির করে সেখানে তাদের স্বার্থ হাছিল করছে। ফলে ধনী-গরীব সকল রাষ্ট্র এমনকি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলি আধুনিক মারণাস্ত্র সমূহের মালিক হয়েছে। ছোট্ট রাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া প্রতিদিন বৃহৎ পরাশক্তি আমেরিকাকে ভূপৃষ্ঠ থেকে মুছে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। তাই এযুগে সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে কোন দেশকে স্থায়ীভাবে কুক্ষিগত করা সম্ভব নয়। কিন্তু এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নিরীহ লাখ লাখ মানুষ। অথচ মানুষের বসবাসের জন্যই এ পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে। এক্ষণে মানুষের বেঁচে থাকার বৃহত্তর স্বার্থে পরস্পরে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা ছাড়া কোন উপায় নেই। যাকে আধুনিক রাজনৈতিক পরিভাষায় ‘মানবিক কূটনীতি’ বলা হচ্ছে। বাংলাদেশ এই পথ বেছে নিয়েছে। এজন্য আমরা সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। আশা করি এর মাধ্যমে পরাশক্তিগুলিও নরম হবে এবং আল্লাহর বিশেষ রহমতে বিশ্ব বিবেক জেগে উঠবে। কুনূতে নাযেলাহ পাঠের শুভ ফলাফল ইনশাআল্লাহ আমরা পাব।

শরণার্থী বা আশ্রয়প্রার্থী যেকোন মানুষের প্রতি ইসলামের নীতি অতীব মানবিক। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নেকী ও আল্লাহভীরুতার কাজে পরস্পরকে সাহায্য কর’ (মায়েদাহ ২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আল্লাহ বান্দার সাহায্যে অতক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে থাকে’। তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াতে মুমিনের একটি কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিনের কষ্ট সমূহ থেকে একটি কষ্ট দূর করে দিবেন’ (মুসলিম হা/২৬৯৯)। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন না, যে মানুষের প্রতি দয়া করে না’ (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৪৯৪৭)। তিনি বলেন, ‘দয়াশীলদের প্রতি আল্লাহ দয়া করেন। তোমরা যমীনবাসীর প্রতি দয়া কর, আসমানবাসী তোমাদের উপর দয়া করবেন’ (তিরমিযী হা/১৯২৪)। বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি বলেন,  ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা মাত্র একজন। তোমাদের পিতাও মাত্র একজন। মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত’। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিলাম? লোকেরা বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, অতএব উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দেয়’ (ছহীহাহ হা/২৭০০)

রোহিঙ্গা মুসলিম সহ বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মুসলমানরাই সর্বত্র নির্যাতিত হচ্ছে। ইসলামই শত্রুদের প্রধান টার্গেট। দেড় হাযার বছর পূর্বে মুশরিক আরবদের নিকট ইসলাম টার্গেট ছিল। আর তাই শেষনবী ও রহমতের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর সাথীরা চরমভাবে নির্যাতিত হন। অতঃপর জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে কেউ সাগর পেরিয়ে হাবশায় এবং অন্যেরা প্রায় তিনশ’ মাইল মরুপথ পায়ে হেঁটে বা উটে চড়ে ইয়াছরিবে হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেদিন ইয়াছরিবের ভাইয়েরা ইসলাম কবুল করে মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছিলেন ও তাদেরকে নিজেদের পরিবারভুক্ত করে নিয়েছিলেন। যাদের আত্মত্যাগের প্রশংসা করে আল্লাহ বলেন, ‘আর তারা নিজেদের উপর তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়, যদিও তাদেরই রয়েছে অভাব। বস্ত্ততঃ যারা নিজেদেরকে হৃদয়ের কার্পণ্য হ’তে বাঁচাতে পেরেছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (হাশর ৯)। রোহিঙ্গা মুসলমানরা আজ আমাদের নিকট আশ্রয়প্রার্থী। এমতাবস্থায় আমাদের কর্তব্য মদীনার আনছারদের ন্যায় তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা আল্লাহর পথে ব্যয় কর এবং নিজেদেরকে ধ্বংসে নিক্ষেপ করো না। তোমরা সৎকর্ম কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের ভালবাসেন’ (বাক্বারাহ ১৯৫)। আল্লাহ মযলূমদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)