জেরুযালেম দখলে ট্রাম্প

১৯৪৮ সালের ১৫ই মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইস্রাঈল রাষ্ট্র জন্মলাভের ঠিক ৭০ বছর পরে ২০১৮ সালের ১৫ই মে তেলআবিব থেকে আমেরিকান দূতাবাস জেরুযালেমে স্থানান্তর করা হ’ল। উদ্বোধন করলেন ট্রাম্প কন্যা ইভাঙ্কা। এরপর আমেরিকার বশংবদ রাষ্ট্রগুলির দূতাবাসও একে একে সেখানে চলে যাবে। পুরা জেরুযালেমের উপরে ইহূদীদের দাবী পূর্ণতা লাভের পথে ইস্রাঈল একধাপ এগিয়ে গেল। এভাবে মুসলমানদের প্রথম ক্বিবলা দখল করার পর তারা মদীনা ও কা‘বা দখলের দিকে এগিয়ে যাবে। ১৯৬৭ সালের ৬ই জুন ইস্রাঈল জেরুযালেমের প্রাচীন নগরী অধিকার করে। তার পরপরই প্রধান পুরোহিতের নেতৃত্বে ইস্রাঈলী প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীবর্গ বিলাপরত প্রাচীরের (Wailing wall) দিকে মার্চ করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দায়ান ঘোষণা করেন, ‘মদীনার রাস্তা এখন আমাদের জন্য খোলা’ (The road to El-Medina is now open)। একই দিনে তারা মসজিদের চার দেওয়ালের মাঝখানে অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে নাচ-গানের মাধ্যমে এর পবিত্রতা বিনষ্ট করে (ইন্নালিল্লাহ...)। আজও দূতাবাস উদ্বোধনের দিন একই দৃশ্য দেখা গেল। অথচ ইস্রাঈলের এই হঠকারিতার পক্ষে সেখানকার ও আমেরিকার সাধারণ ইহূদীরা প্রচন্ড বিক্ষোভ দেখিয়েছে। তারা মার্কিন প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ইস্রাঈলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘শান্তির শত্রু’ বলে আখ্যায়িত করেছে। ৪ বছর আগের এক জরিপে জানা গিয়েছিল যে, মার্কিন ইহূদীদের মাত্র ৩৮ শতাংশ ইস্রাঈলী নীতি সমর্থন করে। বর্তমানে সেই সমর্থন প্রায় তলানিতে নেমে এসেছে। তারা Jewish voice for peace লিখিত ব্যানার নিয়ে আমেরিকার রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করছে। তারা ব্যানারে লিখেছে, Israelis and Palestinians Two people, One future (ইস্রাঈলী ও ফিলিস্তীনী দুই জাতি, এক ভবিষ্যৎ)। ১৯৭৬ সালের ৩০শে মার্চ ইস্রাঈলের দক্ষিণাঞ্চলে নতুনভাবে ইহূদী বসতি নির্মাণ করার প্রতিবাদ বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে ৬জন ফিলিস্তীনীকে হত্যা করা হয়। এরপরের বছর থেকেই ৩০শে মার্চ হ’তে ১৫ই মে পর্যন্ত৬ সপ্তাহকে ‘ভূমি দিবস’ হিসাবে পালন করে আসছে ফিলিস্তীনীরা। এবারের কর্মসূচীতে শেষ দু’দিনে ৬২ জন সহ মোট এক হাযারের অধিক নিহত এবং বারো হাযারের অধিক মুক্তিকামী ফিলিস্তীনী আহত হয়েছে। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন উদারমনা ইহূদী সংগঠন যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় রাস্তায় মিছিল করছে। গত বছর ২০১৭ সালের ৬ই ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুযালেমকে ইস্রাঈলের একক রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেন। এর বিরুদ্ধে বিশ্ব জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এমনকি ইহূদী ধর্মাবলম্বী হলিউড তারকারাও তাতে শামিল হন। যুক্তরাষ্ট্রের একটি ইহূদী সংগঠনের মুখপাত্র এথান মিলার বলেন, ‘আমাদের নাম করে সহিংসতা করা হচ্ছে, হত্যাকান্ড ঘটানো হচ্ছে। তাই আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারিনা। আমরা সংগঠিত প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে জানাতে চাই যে, আমরা কোনভাবেই ফিলিস্তীনী ভূমি দখলদারিত্বের পক্ষে নই। আমরা এর বিরুদ্ধে’। তাদের একটি সংগঠন ওয়াশিংটনের ট্রাম্প টাওয়ার সংলগ্ন রাস্তা আটকে দু’ঘণ্টা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। যেখানে তাদের ফেষ্টুনে লেখা ছিল ‘সহিংসতা বন্ধ কর’। ‘ফিলিস্তীনীদের স্বাধীনতার মধ্যেই ইস্রাঈলের ভবিষ্যৎ নিহিত’। তাদের পরিহিত টি-শার্টে লেখা ছিল ‘আমরা একটি ভালবাসার বিশ্ব গড়তে চাই’। এভাবে জেরুযালেমে যখন আমেরিকান দূতাবাস খোলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইহূদী-নাছারাদের মিলিত আনন্দ-উল্লাস চলছে, তার মাত্র ৪০ মাইল দূরে পৈত্রিক ভূমি হারানো ফিলিস্তীনী মুসলিমদের রক্তে ফিলিস্তীনের মাটি রঞ্জিত হচ্ছে। আমেরিকা ও ইস্রাঈলের ভাষায় এরা হ’ল সন্ত্রাসী। অথচ এরা হ’ল মুক্তিকামী এবং ইহূদীরা হ’ল জবরদখলকারী। শক্তির জোরে এভাবেই চিরকাল সত্যকে মিথ্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার রীতি চলে আসছে।

কে না জানে যে, ইস্রাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্রেফ একটি মিথ (Myth) বা পুরাকথার উপর ভিত্তি করে। হিব্রু বাইবেল ভিত্তিক নানা উপাখ্যানকে সত্য ইতিহাস হিসাবে দাঁড় করানো ছাড়া জায়নবাদীদের পক্ষে ইস্রাঈল রাষ্ট্র গঠনের কোন নৈতিক সমর্থন এবং বিশ্ব স্বীকৃতি আদায় করা খুবই কঠিন ছিল। তাই এসব মিথ্যা ইতিহাস তৈরী ও লালনের কাজটি তারা আজও করে যাচ্ছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় (১৯৩৯-১৯৪৫ খৃ.) জার্মানীর স্বৈরশাসক হিটলারের পরিকল্পনায় হলোকস্টে প্রায় ৬০ লাখ ইহূদীকে হত্যা করা হয়। যা ফিলিস্তীনের মাটিতে ইস্রাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবীকে যোরদার করে। ইউরোপ হলোকস্টের অপরাধ করলেও শাস্তি চাপানো হয় ফিলিস্তীনী আরবদের উপর। ১৯৪৭ সালের ২৯শে নভেম্বর সদ্য গঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অন্যায়ভাবে ফিলিস্তীন ভূখন্ডকে ইহূদী ও আরবদের মধ্যে দুই ভাগে ভাগ করার প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। অতঃপর ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটার সাথে সাথে স্বাধীন ইস্রাঈল রাষ্ট্র ঘোষিত হয়। সীমানা নির্ধারিত হয় জাতিসংঘের প্রস্তাব অনুসারে। যাতে লাখ লাখ ফিলিস্তীনীর উপর নেমে আসে মাতৃভূমি হ’তে বহিষ্কারের মহা বিপর্যয়। হাযার বছর ধরে বসবাসকারী প্রায় ১০ লাখের অধিক আরব মুসলিম বিতাড়িত হয়ে পার্শ্ববর্তী আরব রাষ্ট্র সমূহে স্থায়ীভাবে উদ্বাস্ত্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে যা ৫০ লাখের উপরে দাঁড়িয়েছে। বিগত ৭০ বছর ধরে চলছে এই বিপর্যয়। ইস্রাঈলের ৭০তম বার্ষিকী উপলক্ষে সেখানকার প্রভাবশালী দৈনিক হারেজ (Haaretz) পত্রিকা ১৮ই এপ্রিল’১৮ সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেছে, ৫০ বছর ধরে সামরিক শক্তি দিয়ে ইস্রাঈল লাখ লাখ মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে তাদের অধিকারহীন করে। এটি তাদের ভূমি কেড়ে নিয়েছে। ভূমির মালিকদের বাস্ত্তচ্যুত করেছে। আর সেখানে গড়ে তুলেছে বসতির পর বসতি। যেখানে বসবাস করছে হাযার হাযার ইস্রাঈলী।... ৭০তম বার্ষিকীর উদযাপন দ্রুতই শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু দখলদারীর অভিশাপ ঘোচানোর কোন আভাসই নেই।... ইস্রাঈল সত্যিকারের স্বাধীনতা কেবল তখনই উদযাপন করতে পারবে, যখন তার প্রতিবেশী ফিলিস্তীন রাষ্ট্রও নিজের স্বাধীনতা উদযাপন করতে পারবে’। আজ ইস্রাঈলের ও আমেরিকার সাধারণ ইহূদীদের উচ্চারিত দাবীর মধ্য দিয়ে সেটাই প্রকাশ পাচ্ছে।

মধ্যপ্রাচ্যের তৈল লুট করা ও সেখানকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলির উপর ছড়ি ঘুরানোর কপট উদ্দেশ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চক্রান্তে ও আন্তর্জাতিক ইসলাম বৈরী শক্তিগুলির যৌথ ষড়যন্ত্রে ১৯৪৮ সালের ১৫ই মে মধ্যপ্রাচ্যের বুকে ইস্রাঈল রাষ্ট্রের জন্ম দেওয়া হয়। সাধারণ ইহূদীদেরকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য উপরোক্ত মিথ-কে কাজে লাগানো হয়। যার পিছনে কোন সত্য নেই। মিথটি হ’ল এই যে, ফিলিস্তীন হ’ল ‘ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি’ বা Promised land। অথচ তাদের নবী মূসা (আঃ) যখন তাদেরকে সেখানে প্রবেশ করতে বলেছিলেন, তখন তারা অস্বীকার করে বলেছিল, ‘তুমি ও তোমার প্রভু (আল্লাহ) যাও ও যুদ্ধ কর গে। আমরা এখানে বসে রইলাম’ (মায়েদাহ ৫/২৪)। বিগত যুগে সেখানে বসবাসরত ইহূদীরা সম্রাট বুখতানছরের দ্বারা ও পরে অন্যান্যদের দ্বারা কয়েকবার উৎখাতের শিকার হয়েছে। সবশেষে খ্রিষ্টান দখলদারদের হাতেই তারা সবচেয়ে বেশী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। ইহূদীদের রক্তের উপরে দাঁড়িয়ে সেদিন খ্রিষ্টান সেনারা উল্লাস করেছে। মুসলিম সেনাপতি ছালাহুদ্দীন আইয়ূবী (৫৩২-৫৮৯ হি./১১৩৮-১১৯৩ খৃ.)-এর মাধ্যমে খ্রিষ্টানদের হাত থেকে ফিলিস্তীন পুনরুদ্ধার হ’লেই কেবল ইহূদীরা তাদের হৃত মানবাধিকার ফিরে পায়। অথচ আজ সেই খ্রিষ্টানদের হাতের পুতুল হিসাবে কথিত ইস্রাঈল রাষ্ট্রের নেতারা উল্লাস করছেন। কে না জানে যে, ‘আমেরিকা যার বন্ধু হয়, তার আর কোন শত্রু লাগে না’। সম্প্রতি ২৯ জাতি ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড টুস্ক জেরুযালেমে দূতাবাস স্থানান্তরে প্রেসিডেণ্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মত বন্ধু থাকলে তার অন্য কোন শত্রুর প্রয়োজন আছে কি?

ইহূদীদের বিষয়ে আল্লাহ বলেন, ‘যেখানেই তারা থাকুক না কেন তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেওয়া হবে, কেবলমাত্র আল্লাহর অঙ্গীকার ও মানুষের অঙ্গীকার ব্যতীত। তারা আল্লাহর ক্রোধ অপরিহার্য করে নিয়েছে এবং তাদের উপর পরমুখাপেক্ষিতা আপতিত হয়েছে। এটা এজন্যে যে, তারা আল্লাহর আয়াতসমূহকে অস্বীকার করেছে এবং নবীগণকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। কারণ ওরা অবাধ্য হয়েছে ও সীমা লংঘন করেছে’ (আলে ইমরান ৩/১১২)। ‘আল্লাহর অঙ্গীকার’ যেমন মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সহযোগিতা করে না এমন বৃদ্ধ, ধর্মযাজক, নারী ও শিশু প্রভৃতি। ‘মানুষের অঙ্গীকার’ যেমন মুসলমানদের সাথে বা অন্যের সাথে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে বিপদমুক্ত হওয়া প্রভৃতি। বর্তমান ‘ইস্রাঈল’ রাষ্ট্র পাশ্চাত্য বলয়ের সাথে চুক্তির মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে এবং টিকে রয়েছে। নইলে একদিনও তারা স্বাধীনভাবে পৃথিবীতে টিকতে পারবে না। এরপরেও তারা সারা পৃথিবীতে লাঞ্ছিত হয়েই আছে। মুসলিম-অমুসলিম প্রায় সকল রাষ্ট্র তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখে। কারণ ওরা আল্লাহর অভিশাপগ্রস্ত। একইভাবে পাশ্চাত্যের খ্রিষ্টান জগত সূদী অর্থনীতিতে ফুলে-ফেঁপে উঠলেও এবং মারণাস্ত্রের জোরে পরাশক্তির দাবীদার হ’লেও তারা সারা পৃথিবীর মানুষের ঘৃণার পাত্র। কারণ ওরা পথভ্রষ্ট। ওরা শেষনবীকে পেয়েও তাঁকে মানেনি এবং ইসলাম কবুল করেনি। প্রতি রাক‘আত ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহ প্রতিদিন ওদেরকে ‘অভিশপ্ত’ ও ‘পথভ্রষ্ট’ বলে এবং ওদের পথে না যাওয়ার জন্য আল্লাহর নিকটে ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের হেদায়াত প্রার্থনা করে থাকে। ইহূদী-নাছারা উভয় জাতি সম্পর্কে স্বীয় রাসূলকে সাবধান করে আল্লাহ বলেন, ‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)। মুসলিম রাষ্ট্রগুলির নেতারা আল্লাহর উক্ত সাবধান বাণী মেনে চলেন কি?

ইঙ্গ-মার্কিন ও পাশ্চাত্য বলয়ের সমর্থন ছাড়া ইস্রাঈল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব একদিনের জন্যেও রক্ষা পাবে না। যদি না সেখানকার স্থানীয় আরব মুসলমানরা এবং মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম রাষ্ট্রগুলি তাদের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। ট্রাম্প দৈত্য আজ ইস্রাঈলের ঘাড়ে সওয়ার হয়েছে, কাল তার মুসলিম লেজুড় রাষ্ট্রগুলির ঘাড়ে যে সওয়ার হবে না, তার নিশ্চয়তা কোথায়? অতএব মুসলিম উম্মাহ সাবধান হও! হারামায়েন শরীফায়েনকে আল্লাহ তুমি রক্ষা কর- আমীন! (স.স.)