সত্যের সাক্ষ্য

মিথ্যা ও প্রতারণার গাঢ় তমিশ্রায় নিমজ্জিত এ পৃথিবীতে সত্যের আলো নিয়ে দাঁড়াবার মত মানুষ কদাচিৎ খুঁজে পাওয়া যায়। যদিও সত্য কোনটা মিথ্যা কোনটা তা বাছাই করার যোগ্যতা বা তার আগ্রহ কারু মধ্যে তেমন একটা দেখা যায় না। যে যেটা করেন সেটাই সত্য অথবা অধিকাংশ যা বলেন সেটাই সত্য, এটাই চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এর বিপরীত কিছু শুনলেই মানুষ তাকে প্রত্যাখ্যান করে বা তাকে মিথ্যা বলে। অথচ বাঁধ দিয়ে সাময়িকভাবে স্রোত বন্ধ করা গেলেও বহতা সাগরকে বন্ধ করা যায় না। বাইরের চক্ষুকে ধাঁধাঁনো গেলেও হৃদয়ের চক্ষুকে অন্ধ করা যায় না।

সুদূর লক্ষ্যে নিক্ষিপ্ত একটি কামানের গোলার মূল্য নাকি চল্লিশ লক্ষ ডলার। তাতে মরছে শত শত মানুষ। ধ্বংস হচ্ছে বহুমূল্য স্থাপনা সমূহ। যারা ছুঁড়ছেন তারা মনগড়া তন্ত্রমন্ত্রের অনুসারী ও স্বদেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থনপুষ্ট বলে কথিত। অথচ কোন বিবেকবান মানুষ এটাকে আদৌ সমর্থন করেন না। ভেটো ক্ষমতাধারী পাঁচটি দেশের নির্বাচিত পাঁচজন নেতার যেকোন একজনের ভেটোতে বাকী বিশ্বের মতামত ভূলুণ্ঠিত। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের কোটি কোটি মানুষ আজ দৈত্য-দানবদের পদতলে পিষ্ট। ‘জনগণই সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ এবং ‘অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত’ এই দুই মরীচিকায় ভুলিয়ে অপাংক্তেয়রা এখন মানুষের উপর ‘রব’ হয়ে বসেছে। এদের হাতে আছে অস্ত্র, থলিতে আছে অর্থ, মাথায় আছে ধূর্তামি, কিন্তু ভিতরে নেই হৃদয়। আর হৃদয়হীন মানুষ হিংস্র পশুর চাইতে ভয়ংকর। পুজিত উক্ত দুই মিথ্যা কেবল এদেরকেই নেতৃত্বে বসায়। আর তাদের হাতেই ধ্বংস হয় মানবতা। অথচ ‘আল্লাহ সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস’ এবং সংখ্যা নয়, বরং ‘অহি-র বিধানই সত্য-মিথ্যার মানদন্ড’। যাকে প্রতিষ্ঠা করাই ছিল বিবেকবান মানুষের প্রধান কর্তব্য।

‘দু’টি ক্ষতির মধ্যে কম ক্ষতিটি গ্রহণীয়’ বিষয়টি কোন নতুন আবিষ্কার নয়। ক্ষুধায় খাদ্য না পাওয়া মৃতবৎ ব্যক্তির জন্য শূকরের মাংস হালাল, যা সাধারণ অবস্থায় হারাম। মুসাফির অবস্থায় রামাযানের ফরয ছিয়াম ক্বাযা করা যায়। সফরে চার রাক‘আত ফরয ছালাত, দু’রাক‘আতে ক্বছর করা যায়। দু’ওয়াক্তের ছালাত ক্বছর সহ জমা করা যায় ইত্যাদি বিষয়গুলি চিরন্তন ইলাহী বিধানের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তাই বলে তাওহীদ ছেড়ে শিরককে বরণ করার, ফরয ছেড়ে বিদ‘আতকে গ্রহণ করার এবং সর্বোপরি আল্লাহকে ছেড়ে মানুষকে রব-এর আসনে বসানোর কোন সুযোগ আছে কি? অহি-র বিধান ছেড়ে মানুষের মনগড়া বিধানকে মান্য করার ও তার জন্য জান-মাল, সময় ও শ্রম ব্যয়ের কোন বৈধতা বা যৌক্তিকতা আছে কি? অথচ উপরোক্ত নীতির দোহাই দিয়ে প্রচলিত বহু অন্যায় প্রথাকে বৈধ করা হচ্ছে। যোর করে কোন অবৈধ বস্ত্তকে বৈধ বানাতে যাওয়ার মর্মান্তিক পরিণাম ভোগ করছে আজ গোটা বিশ্ব।

পৃথিবীর সেরা মানুষ নবী-রাসূলগণ মানুষকে কোন্ দিকে আহবান করেছেন? নিঃসন্দেহে সেটি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী সৃষ্টিকে পরিচালনা করার দিকে। যেখানে রয়েছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার। কিন্তু ‘রব’ হওয়ার খাহেশ যাদের, তারা এটা মানতে চায়নি। তাই ছলে-বলে-কৌশলে তারা সর্বদা অহি-র বিধানের বিরোধিতা করেছে। আর মানুষকে তাদের দাসত্ব করতে বাধ্য করছে। যুগে যুগে নমরূদ, ফেরাঊন ও কারূণদের আবির্ভাব ঘটেছে। যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার ইলাহী নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপ্রিয় জনগণকে পরস্পরে ভোট যুদ্ধে লেলিয়ে দিয়ে কিভাবে সমাজে শান্তি আশা করা যায়? কিভাবে ক্ষমতার লড়াইয়ে ক্ষত-বিক্ষত জনগণের মাঝে ঐক্য ও সংহতির কল্পনা করা যায়? পরস্পরে ছিদ্রান্বেষী ও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার নিকৃষ্ট মানসিকতার অধিকারী মানুষদের মধ্যে কিভাবে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার কাঙ্ক্ষিত সুখ এনে দেওয়া যায়? দু’ধারী কাঁচির মাঝখানে আঙ্গুল দিলে তা যেকোন সময় কাটতে বাধ্য। একইভাবে প্রচলিত নির্বাচনী কাঁচির ফাঁদে পা দিলে তা অবশ্যই সমাজকে ধ্বংস করবে। যার বাস্তব প্রমাণ, বিশ্বব্যাপী হানাহানি। ইসলামের স্বার্থেই নাকি একদল পোষাকধারী মানুষ এই দু’ধারী কাঁচির মাঝখানে প্রবেশ করাকে ‘ওয়াজিব’ বলছেন, কেউ এটাকে ‘জিহাদ’ বলে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছেন। তারা ‘দু’টি ক্ষতির মধ্যে কম ক্ষতিটি গ্রহণীয়’ বলে সত্যসেবীদের বোকা বানানোর কোশেশ করছেন।

১৯৪৭ সালে বৃটিশ চলে যাওয়ার পর থেকে দু’দু’বার দেশ স্বাধীন হয়েছে। ইসলামের নামধারীরা সরাসরি অথবা জোটবদ্ধভাবে সর্বদা ক্ষমতাসীন হয়েছেন। নানা মতের লোক সংসদে গিয়ে কেবল মারামারি করেছেন এবং সমাজকে অগ্নিগর্ভ করেছেন। আরেকদল বুলেটের মাধ্যমে দ্বীন কায়েম করতে চেয়েছেন। কিন্তু তাতে ইসলামের কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন মানুষ ইসলামের নাম নিতেই ভয় পাচ্ছে। ইসলামের কোন বিধানই বিগত ৭১ বছরে দেশে কায়েম হয়নি। যদিও রাস্তা-ঘাট, ব্রীজ-ক্যালভার্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ এগুলি কাফের-মুশরিকরাও করে থাকে। এসবের জন্য ইসলামী নেতাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। মাস্টার্সের মান নেওয়ার জন্য ও তার মাধ্যমে কিছু চাকরী-বাকরী ও বেতন-ভাতা বৃদ্ধির রঙিন আশায় ১০ লক্ষ আলেম রাজধানীতে সমবেত হ’তে পারেন, কিন্তু সূদী অর্থনীতি ও কুফরী রাজনীতি বন্ধের দাবীতে তাদের কন্ঠে কোন আওয়ায শোনা যায় না। উল্টা তাদের বয়ান ও লেখনী বাতিলের পক্ষে সরব। তাই বলে কি, সত্যকে সত্য বলার ও মিথ্যাকে মিথ্যা বলার মত সাহসী মানুষ পৃথিবীতে কেউ থাকবে না? নবীদের তরীকায় জামা‘আতবদ্ধভাবে পরিশুদ্ধি ও পরিচর্যার মাধ্যমে যখন সমাজ কুসংস্কারমুক্ত হবে এবং দল ও প্রার্থীবিহীনভাবে নেতৃত্ব নির্বাচন হবে, তখনই কেবল মানুষ স্বাধীনভাবে তার মত প্রকাশ করতে পারবে। তখন শাসন ক্ষমতায় যিনিই থাকুন, তিনি অবশ্যই দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের প্রতি নিরপেক্ষ থাকবেন। কিন্তু যদি আমরা কুসংস্কারের সাথে আপোষ করি, তাহ’লে কিভাবে দেশে বিশুদ্ধ ইসলামী সমাজ কায়েম হবে?

আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে সত্য সাক্ষ্য দানে অবিচল থাক এবং কোন সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ যেন তোমাদেরকে সুবিচার বর্জনে প্ররোচিত না করে’ (মায়েদাহ ৫/৮)। তাই ঈমানদারগণের কর্তব্য হবে পরস্পরকে হক-এর পথে দাওয়াত দেওয়া ও এ পথে দৃঢ় থাকা (আছর ১০৩/৩)। আল্লাহর হাতেই সকল ক্ষমতার চাবিকাঠি। অতএব যারা ক্ষমতায় থাকবেন বা বাইরে থাকবেন, সকলের প্রতি আবেদন, আসুন! আমরা সবাই সত্যের সাক্ষ্যদাতা হই। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন- আমীন! (স.স.)