প্রশ্ন : আমরা কি চাই?
উত্তর : আমরা আমাদের সার্বিক জীবনে তাওহীদে ইবাদত তথা আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাই।
প্রশ্ন : কেন চাই?
উত্তর : ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির জন্য এটা চাই।
প্রশ্ন : কিভাবে চাই?
উত্তর : পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সংশোধনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে নবীগণের তরীকায় আমরা এটা চাই।
ব্যাখ্যা :
১. পৃথিবীতে মোটামুটি চার ধরনের মানুষ বসবাস করে। (১) আল্লাহকে মানে ও তাঁর বিধানকে মানে। যেমন ছাহাবায়ে কেরাম ও যুগে যুগে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম-এর একনিষ্ঠ অনুসারীবৃন্দ। (২) আল্লাহকে মানে, কিন্তু তার বিধানকে মানে না। যেমন আবু জাহ্ল ও যুগে যুগে তার অনুসারী মুশরিকবৃন্দ। (৩) আল্লাহকে মানে এবং তার বিধানের কিছু মানে, কিছু মানে না। যেমন আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও যুগে যুগে তার অনুসারী মুনাফিক ও ফাসেকবৃন্দ। (৪) আল্লাহকে মানে না। তার বিধানকেও মানে না। যেমন যুগে যুগে কাফের ও নাস্তিক বৃন্দ।
আদমের পৃথিবীতে অবতরণ :
আল্লাহ আদম-হাওয়াকে সৃষ্টি করে পৃথিবীতে নামিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিলেন, যেমন আল্লাহর ভাষায়- قُلْنَا اهْبِطُوا مِنْهَا جَمِيعًا فَإِمَّا يَأْتِيَنَّكُمْ مِنِّي هُدًى فَمَنْ تَبِعَ هُدَايَ فَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ- وَالَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ- ‘আমরা বললাম, তোমরা সবাই জান্নাত থেকে নেমে যাও। অতঃপর যখন আমার নিকট থেকে তোমাদের কাছে কোন হেদায়াত পৌঁছবে, তখন যারা আমার হেদায়াতের অনুসরণ করবে, তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’। ‘পক্ষান্তরে যারা অবিশ্বাস করবে এবং আমাদের আয়াত সমূহে মিথ্যারোপ করবে, তারা হবে জাহান্নামের অধিবাসী এবং তারা সেখানে চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৩৮-৩৯)।
ইবলীসের বিতাড়ন :
ইবলীসকে পৃথিবীতে বিতাড়নের সময় তার প্রার্থনা মোতাবেক আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষকে প্রতারণার মাধ্যমে পথভ্রষ্ট করার অনুমতি দেন এবং বলেন, إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلاَّ مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِينَ ‘নিশ্চয়ই আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। তবে বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে’ (হিজর ১৫/৪২)। তিনি আরও বললেন,قَالَ فَالْحَقُّ وَالْحَقَّ أَقُولُ- لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكَ وَمِمَّنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ أَجْمَعِينَ- ‘তবে এটাই সত্য। আর আমি সত্যই বলে থাকি’। ‘তোমার দ্বারা ও তোমার অনুসারীদের দ্বারা আমি জাহান্নাম পূর্ণ করবই’ (ছোয়াদ ৩৮/৮৪-৮৫)।
বস্ত্ততঃ তখন থেকেই চলছে শয়তানী প্রলোভন থেকে মুক্ত আল্লাহর অনুগত খাঁটি বান্দাদের বাছাই প্রক্রিয়া। সেজন্য যুগে যুগে আল্লাহ তাঁর বাণী ও বিধানসহ নবীগণকে পাঠিয়েছেন মানুষকে আল্লাহর পথে ধরে রাখার জন্য। কিন্তু শয়তান প্রতিনিয়ত মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করতে চায়।
প্রকৃত ঈমানদারগণ সর্বদা শয়তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে টিকে থাকেন ও আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকেন। শয়তানের পাতানো লোভ, ভয় ও প্রতারণার ফাঁদে তারা পা দেন না। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী ও দুর্বল বিশ্বাসী লোকেরা হয় শয়তানের লোভনীয় শিকার। শেষোক্ত তিন প্রকারের লোকেরা সর্বদা প্রথমোক্ত মোখলেছ বান্দাদের দুশমন হয়। এরা সর্বদা সমাজের শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট করে। এরাই হ’ল আল্লাহর ভাষায় কাফের, মুনাফিক ও ফাসেক শ্রেণী বা তাদের অনুগামী। এরাই সমাজের সকল অশান্তি ও ভাঙ্গনের জন্য দায়ী। আল্লাহর দাসত্বের অর্থ ও সারবত্তা এরা বুঝে না। যদিও তারা আল্লাহকে স্বীকার করে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَلَئِن سَأَلْتَهُم مَّنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللهُ قُلِ الْحَمْدُ لِلَّهِ بَلْ أَكْثَرُهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ- ‘যদি তুমি তাদের জিজ্ঞেস কর আসমান ও যমীন কে সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ’। তুমি বল, সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য। কিন্তু তাদের অধিকাংশ এ বিষয়ে অজ্ঞ’ (লোকমান ৩১/২৫)।
অর্থাৎ ওরা আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাকে স্বীকৃতির অর্থ জানেনা। ওরা ‘সৃষ্টিকর্তা’ হিসাবে আল্লাহকে মানে। কিন্তু তাঁর বিধান মানতে চায় না। অথচ আল্লাহকে স্বীকৃতির অর্থই হ’ল তাঁর বিধান সমূহের আনুগত্য করা ও সর্বাবস্থায় তাঁর দাসত্ব করা। দুনিয়াতে মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্যই হ’ল সেটা। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنسَ إِلاَّ لِيَعْبُدُونِ ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবলমাত্র এজন্য যে, তারা আমার দাসত্ব করবে’ (যারিয়াত ৫১/৫৬)। অর্থাৎ সার্বিক জীবনে ‘তাওহীদে ইবাদত’ প্রতিষ্ঠা করবে।
আল্লাহর দাসত্বের পথ কুসুমাস্তীর্ণ নয় :
আল্লাহ বলেন,
شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلاَ تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ- (الشورى ১৩)-
‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ তিনি দিয়েছিলেন নূহকে এবং যা আমরা প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি ও যার আদেশ দিয়েছিলাম আমরা ইবরাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর ও তার মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো না। তুমি মুশরিকদের যে বিষয়ের দিকে আহবান জানিয়ে থাক, তা তাদের কাছে অত্যন্ত কঠিন মনে হয়। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন। আর তিনি পথ প্রদর্শন করেন ঐ ব্যক্তিকে, যে তাঁর দিকে প্রণত হয়’ (শূরা ৪২/১৩)।
নূহ (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকল নবী সার্বিক জীবনে তাওহীদে ইবাদত প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। কিন্তু এটি ছিল মুশরিকদের জন্য সবচেয়ে কঠিন বিষয়। কেননা তাতে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা বিঘ্নিত হয়। আজও সেটি অব্যাহত রয়েছে।
অত্র আয়াতে ‘দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত কর’ অর্থ তাওহীদকে প্রতিষ্ঠিত কর, ‘হুকূমত প্রতিষ্ঠিত কর’ নয়। অর্থাৎ ইক্বামতে দ্বীন অর্থ ইক্বামতে হুকূমত নয়। যেমনটি আধুনিক যুগের কোন কোন মুফাসসির ধারণা করেছেন। ক্ষমতাকেন্দ্রিক ইসলামী চরমপন্থী দলগুলি মূলতঃ এরূপ তাফসীর থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। অথচ কোন নবীই ক্ষমতা লাভের জন্য দাওয়াত দেননি। বরং সকলেই শিরকের স্থলে তাওহীদের আলোকে সমাজ সংশোধনের দাওয়াত দিয়েছেন। বস্ত্ততঃ তাওহীদ এককভাবে নিজ জীবনে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। কিন্তু হুকূমত বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একক ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। অতএব দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সর্বাবস্থায় শর্ত নয়। তবে সেজন্য আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকারের মাধ্যমে জনমত তৈরী করা সর্বাবস্থায় যরূরী। কেননা সার্বিক জীবনে পূর্ণভাবে দ্বীন প্রতিষ্ঠার জন্য রাষ্ট্র ক্ষমতা নিঃসন্দেহে সহায়ক শক্তি। এজন্য মুসলিম রাজনীতিক ও রাষ্ট্রপ্রধানগণ অবশ্যই তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবেন। নইলে আখেরাতে দায়ী হবেন।
আলী (রাঃ)-কে হত্যাকারী খারেজী চরমপন্থীরা বলেছিল,لاَ حُكْمُ إِلاَّ للهِ ‘আল্লাহ ব্যতীত কারু শাসন নেই’। জওয়াবে আলী (রাঃ) বলেছিলেন, كَلِمَةٌ حَقٌّ أُرِيدَ بِهَا بَاطِلٌ، لاَبُدَّ لِلنَّاسِ مِنْ إِمَارَةٍ بِرَّةً كَانَتْ أَوْ فَاجِرَةً.. أَمَّاالْفَاجِرَةُ : فَيُقَامُ بِهَا الْحُدُوْدُ وَتَأْمَنُ بِهَا السُّبُلُ وَيُجَاهَدُ بِهَا العَدُوُّ وَيُقْسَمُ بِهَا الْفَيْءُ-
‘কথা সত্য, কিন্তু বাতিল অর্থ নেওয়া হয়েছে’। ‘অবশ্যই মানুষের জন্য নেতৃত্ব থাকবে, ভাল হৌক বা মন্দ হৌক।.. মন্দ শাসকের মাধ্যমে দন্ডবিধি সমূহ কায়েম করা হয়। রাস্তা সমূহ নিরাপদ করা হয়, শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিতরণ করা হয়’।[1]
বলা বাহুল্য, আধুনিক যুগেও কবীরা গোনাহগার মুসলমানদের কাফের গণ্য করার মাধ্যমে চরমপন্থীরা তাদের রক্তকে হালাল মনে করছে। ফলে মুসলিম সমাজে রক্তাক্ত হানাহানি চলছে। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সকল প্রকার চরমপন্থী আন্দোলন থেকে সর্বদা বিরত থাকে এবং উম্মতকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে।
‘আহদে আলাস্ত্ত :
সৃষ্টির সূচনাতেই আল্লাহ সকল মানুষকে ছোট্ট অবয়ব দিয়ে তাঁর সম্মুখে দাঁড় করিয়ে তাঁর দাসত্বের অঙ্গীকার নিয়ে বলেছিলেন أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই’? তারা বলেছিল, بَلَى شَهِدْنَا ‘হ্যাঁ। আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি’। আল্লাহ এ সাক্ষ্য ও অঙ্গীকার এজন্য নিয়েছিলেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে শিরক করার ব্যাপারে বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে বাঁচতে না পারে কিংবা ক্বিয়ামতের দিন একথা বলতে না পারে যে, আমরা আল্লাহকে স্বীকৃতি দান ও তাঁর দাসত্ব করার বিষয়টি জানতাম না (আ‘রাফ ৭/১৭২-১৭৩)।
বর্তমান পৃথিবীতে যাবতীয় অশান্তির মূলে হ’ল আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করা। তথা শয়তানের দাসত্ব করা। মানুষ নানা ভয়-ভীতি ও প্রলোভনে পড়ে প্রতিনিয়ত আল্লাহর দাসত্ব ছেড়ে শয়তানের দাসত্ব শৃংখলে আবদ্ধ হচ্ছে। সেখান থেকে নিজেকে ও অন্যকে বাঁচানোই হ’ল প্রকৃত মুমিনের কর্তব্য। নবী ও রাসূলগণ সর্বদা সেকাজই করে গেছেন।
শেষনবী মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম ছিলেন সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্বের বাস্তব রূপকার। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সেপথেই মানুষকে পরিচালিত করতে চায় এবং কেবল তাওহীদে রুবূবিয়াত নয়; বরং ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের সকল দিক ও বিভাগে তাওহীদে ইবাদত তথা সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়।
২। কেন চাই?
ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তির জন্যই আমরা এটা চাই। আমরা বলি,رَبَّنَا آتِنَا فِي الدُّنْيَا حَسَنَةً وَفِي الْآخِرَةِ حَسَنَةً وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে দুনিয়ায় মঙ্গল দাও ও আখেরাতে মঙ্গল দাও এবং আমাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে বাঁচাও’ (বাক্বারাহ ২/২০১)। পৃথিবীর সকল ভাষা ও বর্ণের মানুষ একই আদমের সন্তান। ফলে সকলের মৌলিক সমস্যা ও চাহিদা যেমন এক, তেমনি সবকিছুর মৌলিক সমাধান মূলতঃ একই। সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তাই আল্লাহর বিধান সকলের জন্য সমানভাবে কল্যাণকর।
দু’টি দর্শনের সংঘাত :
পৃথিবীতে সর্বযুগে দু’টি দর্শনের সংঘাত চলে এসেছে। এক- মানুষ সর্বদা নিজের মনগড়া বিধান মতে খেয়াল-খুশীমত কাজ করবে। দুই- মানুষ তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর বিধান মতে চলবে ও সে অনুযায়ী কাজ করবে।
প্রত্যেক মানবশিশু ফিৎরাতের উপর অর্থাৎ ‘ইসলামের উপর’(عَلَى فِطْرَةِ الإِسْلاَمِ) জন্মগ্রহণ করে।[2] আল্লাহর দেওয়া স্বভাবধর্ম অনুযায়ী সে তার দৈহিক ও মানসিক পরিবৃদ্ধি লাভ করে। তার আকৃতি, প্রকৃতি, মেধা ও যোগ্যতা সবকিছুই আল্লাহর দেওয়া নে‘মত- একথা সে নিজের অবচেতন মনে স্বীকার করে ও আল্লাহর প্রতি অনুগত হয়। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত শৈশব, কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব ও বাধ্যর্ক্যের স্তরসমূহে তার দেহ বাধ্যগতভাবে আল্লাহর আনুগত্য করে। কিন্তু যতই তার বয়স বাড়তে থাকে ও বিভিন্ন পরিবেশের অভিজ্ঞতা লাভ করে, ততই তার জ্ঞানগত স্বভাবধর্ম বাধাগ্রস্ত হ’তে থাকে।
চারটি বাধা : মোটামুটি ৪টি প্রধান বাধা তাকে তার স্বভাবধর্ম ইসলাম থেকে বিচ্যুত করতে চায়। তার পরিবার, ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র।
প্রথম বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার পরিবার। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, مَا مِنْ مَوْلُودٍ إِلاَّ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ ‘প্রত্যেক মানব সন্তান ফিৎরাতের উপর জন্মগ্রহণ করে। অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইহূদী বানায়, নাছারা বানায় বা অগ্নি উপাসক বানায়’...।[3] ছহীহ মুসলিমের অপর বর্ণনায় এসেছে, وَيُشَرِّكَانِهِ ‘পিতা-মাতা তাকে মুশরিক বানায়’।[4]
এক্ষেত্রে আল্লাহর বিধান হ’ল এই যে, বাপ-মায়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার রাখতে হবে। কিন্তু তাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস ও রীতি-নীতির অনুসরণ করা যাবে না। যেমন আল্লাহ বলেন,وَإِن جَاهَدَاكَ عَلى أَن تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلاَ تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفاً ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহ’লে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাব রেখে বসবাস করবে’ (লোকমান ৩১/১৫)। বস্ত্ততঃ সন্তানের দুনিয়াবী মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি আল্লাহর বিধান মানার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।
পারিবারিক জীবনে তাওহীদে ইবাদত কায়েম করা ভবিষ্যৎ সুসন্তান ও সুনাগরিক সৃষ্টির জন্য একান্তভাবেই যরূরী। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এজন্য নিয়মিত ব্যক্তি প্রশিক্ষণ ছাড়াও ‘সাপ্তাহিক পারিবারিক তা‘লীমের’ কর্মসূচী রেখেছে। যেখানে মা-বোনেরা নিজ গৃহে দ্বীনের তা‘লীম নিতে পারেন। তাছাড়া শৈশবে ‘সোনামণি’ সংগঠনের মাধ্যমে ছোট্টমণিদেরকে শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদের অনুসারী করার জন্য এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আদর্শে জীবন গড়ার জন্য নিয়মিত কর্মসূচীর মাধ্যমে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এভাবে শৈশবে তাওহীদের বীজ বপিত ও রোপিত হ’লে পাথরে খোদাই করার মত ঐ শিশু ভবিষ্যৎ জীবনে আল্লাহর পথে দৃঢ় থাকবে বলে আশা করা যায়। এরপরে যৌবনে তাদেরকে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কর্মসূচী মেনে চলতে হয়।
দ্বিতীয় বাধা হ’ল সমাজ।
সমাজে প্রচলিত রীতি-নীতি ও রসম-রেওয়াজ অনেক সময় ইলাহী বিধানের বিরোধী হয়। সেগুলির বিরোধিতা করে আল্লাহর বিধান মানতে গেলে সামাজিক বাধার সম্মুখীন হ’তে হয়। এমনকি সমাজনেতাদের রোষ ও সামাজিক বয়কটের শিকার হ’তে হয়। নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত সকলকেই এই কঠিন সামাজিক বাধার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে। যখনই তাঁরা তাদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়েছেন, তখনই তারা জওয়াব দিয়েছে, بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءنَا ‘বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি’ (বাক্বারাহ ২/১৭০; লোকমান ৩১/২১)। অতএব এই কঠিন বাধা মোকাবিলা করে আল্লাহর বিধান পালন করা ও তাঁর দাসত্ব করা অনেক সময় অসম্ভব বিবেচিত হয়। তাকে নানাবিধ অপবাদ ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়। শেষনবী (ছাঃ)-কে পর্যন্ত চূড়ান্ত নির্যাতনের সম্মুখীন হ’তে হয়েছে। তাঁকে সমাজে বিভক্তি সৃষ্টির অভিযোগ সহ মক্কায় সর্বমোট ১৫ রকমের অপবাদ দেওয়া হয়েছে। সমাজ তাকে তিন বছর যাবৎ বয়কট করেছে। অবশেষে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছে এবং দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে।
তৃতীয় বাধা হ’ল প্রচলিত ধর্ম বা ধর্মনেতাদের বাধা।
ধর্মনেতারা সর্বদা নিজেদেরকে ধর্মের প্রতিভূ মনে করেন। নিজেদের মধ্যে ধর্ম না থাকলেও ধর্মের বড়াই থাকে তাদের ষোল আনা। আর একারণেই ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতা ধর্মনেতা ‘আযর’ স্বীয় পুত্র ইবরাহীমকে বলেছিলেন, ..أَرَاغِبٌ أَنتَ عَنْ آلِهَتِي يَا إِبْراهِيمُ لَئِن لَّمْ تَنتَهِ لَأَرْجُمَنَّكَ وَاهْجُرْنِي مَلِيًّا- ‘..হে ইবরাহীম! তুমি কি আমার উপাস্যদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ? যদি তুমি (তাদের গালি দেওয়া থেকে) বিরত না হও, তাহ’লে অবশ্যই আমি পাথর মেরে তোমার মাথা চূর্ণ করে দেব। তুমি চিরদিনের মত আমার কাছ থেকে দূর হয়ে যাও’! (মারিয়াম ১৯/৪৬)।
শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে মদীনার ইহূদী ধর্মনেতারা সবচেয়ে বেশী কষ্ট দিয়েছিল। ধর্মের দোহাই দিয়েই তারা তাদের ধার্মিক লোকদের ইসলাম গ্রহণ করা থেকে বিরত রেখেছিল। এমনকি আল্লাহর রাসূলকে নাজরানের খ্রিষ্টান ধর্মনেতাদের সঙ্গে ‘মুবাহালা’র মত কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে হয়েছিল। এইসব পথভ্রষ্ট ধর্মনেতারা তাদের অনুসারীদের ‘রব’-এর আসন দখল করেছিল। ইচ্ছামত বই লিখে তারা বলত, এগুলিই আল্লাহর বিধান। তারা হালালকে হারাম ও হারামকে হালাল করত। ভক্তরা অন্ধভাবে তা মেনে চলত। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) মানুষ কর্তৃক মানুষের প্রতি এই অন্ধ গোলামীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ও জনমত গড়ে তুলেছিলেন। ফলে তারা তাঁর জানী দুশমনে পরিণত হয়। অথচ তারা শেষনবীকে চিনত, যেমন তারা তাদের সন্তানদের চিনত (বাক্বারাহ ২/১৪৬)।
বিখ্যাত খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী ইবনে হাতেম যখন ইসলাম গ্রহণ করার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর দরবারে এলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সূরা তওবার ৩১ আয়াতটি পাঠ করেন,اتَّخَذُواْ أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَاباً مِّن دُونِ اللّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ- ‘ইহূদী-নাছারারা তাদের আলেম ও দরবেশগণকে এবং ঈসা ইবনে মারিয়ামকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’। এটা শুনে ‘আদী বলে উঠলেন إنَّا لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা তাদের ইবাদত করি না’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, أَلَيْسَ يُحَرِّمُونَ مَا أَحَلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونُهُ، ويُحِلُّونَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتَسْتَحِلُّونَهُ؟ ‘তারা কি ঐ বস্ত্তকে হারাম করে না যা আল্লাহ হালাল করেছেন। অতঃপর তোমরাও তা হারাম গণ্য কর এবং তারা কি ঐ বস্ত্তকে হালাল করে না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন। অতঃপর তোমরাও তা হালাল গণ্য কর’। ‘আদী বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[5]
ইবনু আববাস ও যাহহাক বলেন,إِنَّهُمْ لَمْ يَأْمُرُوهُمْ أَنْ يَسْجُدُوا لَهُمْ، وَلَكِنْ أَمَرُوهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَأَطَاعُوهُمْ، فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَلِكَ أَرْبَابًا- ‘ইহূদী-নাছারাদের ধর্মনেতা ও সমাজ নেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার জন্য বলেননি। বরং তারা আল্লাহর অবাধ্যতামূলক কাজে লোকদের হুকুম দিত এবং লোকেরা তা মান্য করত। আর সেজন্যই আল্লাহ ঐসব আলেম, সমাজনেতা ও দরবেশগণকে ‘রব’ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন।[6]
বস্ত্ততঃ বর্তমান যুগেও কথিত ধর্মনেতাদের তৈরী করা মাযহাব ও তরীকার সামনে মানুষ অন্ধের মত মাথা নীচু করছে। জায়েয-নাজায়েয, সুন্নাত-বিদ‘আত, শিরক ও তাওহীদ এমনকি অনেক সময় হালাল-হারামও নির্ণীত হচ্ছে এদের নিজস্ব ফৎওয়ার উপর। কখনও বা স্ব স্ব ফৎওয়ার পক্ষে জাল হাদীছ তৈরী করে শুনানো হচ্ছে। কখনও বা কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অপব্যাখ্যা করা হচ্ছে। কখনও বা নিজেদের স্বার্থে কোন হাদীছকে ‘মানসূখ’ (হুকুম রহিত) ঘোষণা করা হচ্ছে। কিন্তু যে কোন মূল্যে নিজের কিংবা স্ব স্ব মাযহাব ও তরীকার গৃহীত ফৎওয়াকে টিকিয়ে রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে। এরা মারা গেলে একদল লোক তাদের কবর পূজা করছে। তাদের অসীলায় পরকালে মুক্তি কামনা করছে। তাদের কবরে নযর-মানত করছে। সেখানে পয়সা দিয়ে বিপদাপদ থেকে মুক্তি চাচ্ছে। সেখানে ওরসের জমজমাট মেলা চালু করছে। তাদের কবরগুলিকে সমাধি সৌধ বানিয়ে সেগুলিকে তীর্থস্থানে পরিণত করছে। এভাবে এই সব ধর্মনেতাগণ জীবিত অবস্থায় এবং মৃত্যুর পরেও তাদের ভক্ত অনুসারীদের নিকট রীতিমত ‘রব’ এর আসনে সমাসীন হয়ে আছেন। এদের রেখে যাওয়া রীতি-নীতি কিংবা তাদের নামে এদের খাদেম ও ভক্তদের চালু করা বেশরা রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধে কথা বলা রীতিমত মানহানিকর এমনকি জীবনহানিকর ব্যাপার হয়ে থাকে। কুরআন-সুন্নাহর নাম নিয়েই এরা এসব শরী‘আত বিরোধী কাজ-কর্ম করে থাকেন। এদের চেহারা-ছূরত ও পোষাক-পরিচ্ছদ এবং ভক্ত বাহিনী যেকোন সৎসাহসী দ্বীনদার মানুষকে ভীত করার জন্য যথেষ্ট। ফলে এদেরকে ডিঙিয়ে ছহীহ হাদীছের উপর আমল করা জীবনের ঝুঁকি নেবার শামিল। যা নেবার মত লোকের সংখ্যা সর্বদাই কম থাকে। অথচ যেকোন মূল্যে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের উপর আমল করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে ইহকালীন মঙ্গল ও পরকালীন মুক্তি।
কেবল ধর্মনেতারা নন, রাজনৈতিক নেতারাও আজকাল পূজিত হচ্ছেন মহা সমারোহে। তাদের কবরগুলি এখন রীতিমত তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। সেখানে যেতে না পারায় এদেশে একজন নির্বাচিত প্রেসিডেন্টের পতন ঘটে গেল চোখের পলকে মাত্র কয়েক বছর আগে। তাদের ছবি ও প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে তাদের রীতিমত পূজা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি অনেক জীবিত রাজনৈতিক নেতা তাদের নামে প্রতিষ্ঠিত স্কুল-কলেজের প্রধান ফটকে নিজেদের প্রতিকৃতি পাথরে খোদাই করে দিচ্ছেন সেখানে শ্রদ্ধাঞ্জলী নিবেদনের জন্য। তাদের ঘরে ও অফিসে তাদের ছবি সমূহ টাঙানো হচ্ছে সম্মান প্রদর্শনের জন্য। দেশের সর্বোচ্চ সেনানিবাসে দেশের প্রেসিডেন্ট ও সেনাপ্রধানগণ নিজেদের বানানো ‘শিখা অনির্বাণ’ বা ‘শিখা চিরন্তন’ নামক সদা জ্বলন্ত আগুনের সম্মুখে মাথা নত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। যা মজূসী-অগ্নি উপাসকদের অনুকরণ মাত্র। মানুষের যে মস্তক কেবল আল্লাহর কাছে নত হবে, সেই উন্নত মস্তক আজ নত হচ্ছে মৃতদের কবরে এবং ছবি-মূর্তি ও আগুনের সামনে। ঐ জাতির উন্নতি কিভাবে হ’তে পারে, যে জাতির মস্তক যেখানে-সেখানে অবনত হয়? রাজনৈতিক কর্তৃত্ব দেশের অর্থনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। ফলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় প্রচলিত সূদী অর্থনীতির ছোবলে মানুষের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। যথেচ্ছভাবে নেতারা হারামকে হালাল করে যাচ্ছেন। এভাবে ইহূদী-নাছারা নেতাদের উদ্দেশ্যে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ)-এর সেদিনের ভৎর্সনাবাণী আজ মুসলিম নেতাদের হাতেই বাস্তবায়িত হচ্ছে। অথচ জাতির পার্থিব কল্যাণ ও পরকালীন মুক্তি নিহিত রয়েছে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক তথা সার্বিক জীবনে আল্লাহর বিধান সমূহ মেনে চলার মধ্যে।
চতুর্থ বাধা হ’ল রাষ্ট্র।
বিগত যুগে ইবরাহীম (আঃ)-কে বাধা দিয়েছিল নমরূদ। তার লোকেরা বলেছিল, حَرِّقُوهُ وَانْصُرُوا آلِهَتَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ فَاعِلِينَ ‘তোমরা একে পুড়িয়ে মার এবং তোমাদের উপাস্যদের সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও’ (আম্বিয়া ২১/৬৮)। মূসা (আঃ)-কে বাধা দিয়েছিল ফেরাঊন। সে তার জনগণকে বলেছিল, ...وَيَذْهَبَا بِطَرِيقَتِكُمُ الْمُثْلَى ‘(মূসা ও হারূণ) তোমাদের উৎকৃষ্ট জীবন পদ্ধতি রহিত করতে চায়’ (ত্বোয়াহা ২০/৬৩)। সে আরও বলেছিল,مَا أُرِيكُمْ إِلاَّ مَا أَرَى وَمَا أَهْدِيكُمْ إِلاَّ سَبِيلَ الرَّشَادِ ‘আমি যা বুঝি সেদিকেই তোমাদের পথ দেখাই। আর আমি তোমাদেরকে কেবল মঙ্গলের পথই দেখিয়ে থাকি’ (মুমিন/গাফের ৪০/২৯)। যাকারিয়া ও তৎপুত্র ইয়াহইয়া (আঃ) নিহত হয়েছিলেন তৎকালীন সম্রাট কর্তৃক। ইহূদীদের চক্রান্তে ঈসা (আঃ)-কে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করতে চেয়েছিল তাঁর যুগের সম্রাট। অতঃপর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে জন্মস্থান থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং বার বার হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তাঁর যুগের গোত্রনেতারা। তারা রাসূল (ছাঃ)-কে মিথ্যা বলেনি। বরং তারা কুরআনী বিধানকে মানতে চায়নি। যেমন আল্লাহ বলেন,فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُوْنَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ- ‘বস্ত্ততঃ ওরা তোমাকে মিথ্যা বলে না। বরং এইসব যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)। এজন্য তারা বলেছিল, ائْتِ بِقُرْآنٍ غَيْرِ هَذَا أَوْ بَدِّلْهُ ‘এই কুরআন বাদ দিয়ে অন্য কুরআন নিয়ে আস অথবা এটাকে পরিবর্তন করে আনো’। জবাবে রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহ নির্দেশ দেন, قُلْ مَا يَكُونُ لِي أَنْ أُبَدِّلَهُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِي إِنْ أَتَّبِعُ إِلاَّ مَا يُوحَى إِلَيَّ إِنِّي أَخَافُ إِنْ عَصَيْتُ رَبِّي عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ ‘তুমি বল যে, একে নিজের পক্ষ থেকে পরিবর্তন করা আমার কাজ নয়। আমি তো কেবল তারই অনুসরণ করি যা আমার নিকট অহি করা হয়। আমি যদি আমার প্রতিপালকের অবাধ্যতা করি, তাহ’লে আমি এক ভয়ংকর দিবসের শাস্তির ভয় করি’ (ইউনুস ১০/১৫)।
বস্ত্ততঃ যুগে যুগে সত্যসেবীদের বিরুদ্ধে এই নীতিই চলে আসছে। মুসলিম উম্মাহর যুগসংস্কারকগণের মধ্যে কঠিন রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হ’তে হয়েছে অসংখ্য তাবেঈ, তাবে তাবেঈ ছাড়াও ইমাম আবু হানীফা, মালেক, শাফেঈ, আহমাদ বিন হাম্বলকে এবং তাঁদের পরে ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী, ইমাম আহমাদ ইবনু তায়মিয়াহ, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম ও যুগে যুগে তাঁদের অনুসারী যুগসংস্কারক মনীষীগণকে, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।
৩। কিভাবে চাই?
সবশেষে প্রশ্ন হ’ল, জাতির এই সার্বিক ভাঙ্গন দশা প্রতিরোধ আমরা কিভাবে চাই। বিভিন্ন পন্ডিত ও তাদের অনুসারী দলসমূহ স্ব স্ব দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী এর জবাব দিয়ে থাকেন এবং সে অনুযায়ী তারা কাজ করে থাকেন। পৃথিবীর মানুষ রাজনৈতিক মতবাদ হিসাবে রাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, সাম্যবাদ, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ এবং অর্থনৈতিক মতবাদ হিসাবে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের পরীক্ষা নিয়েছে। লাখ-কোটি মানুষের জান-মাল ও ইযযতের বিনিময়ে এইসব মানব রচিত মতবাদ সমূহ পৃথিবীর বিভিন্ন জনপদে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। প্রত্যেক মতবাদের অনুসারীরা পৃথিবীর অন্যান্য জনপদেও এগুলি প্রতিষ্ঠার জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। উপরোক্ত সকল মতবাদের সার-নির্যাস হ’ল, মানুষের নিজস্ব চিন্তা ও কল্পনা অনুযায়ী সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনা করা।
মানুষের জ্ঞান সীমিত এবং তার চিন্তাধারা কখনোই নিরাবেগ নয়। ফলে পানি ভেবে মরীচিকার পিছনে ছোটা তার জন্য খুবই স্বাভাবিক। সেকারণ উক্ত মতবাদ সমূহের কোনটাই মানুষের স্বভাবধর্মের কাছাকাছি যেতে পারেনি। ফলে সবগুলিই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তবুও জেঁকে বসে আছে ছলে-বলে-কৌশলে। সেকারণ আমরা মানব রচিত কোন বিধানের অনুসরণ না করে আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত বিধানের আনুগত্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং নবীগণের তরীকায় দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে তথা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ সংশোধনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টার মাধ্যমে মানবতার বিপর্যয় রোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কেননা আমাদের রাসূল (ছাঃ) এভাবেই চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
যেমন আল্লাহ বলেন,هُوَ الَّذِي بَعَثَ فِي الْأُمِّيِّينَ رَسُولاً مِنْهُمْ يَتْلُو عَلَيْهِمْ آيَاتِهِ وَيُزَكِّيهِمْ وَيُعَلِّمُهُمُ الْكِتَابَ وَالْحِكْمَةَ وَإِنْ كَانُوا مِنْ قَبْلُ لَفِي ضَلاَلٍ مُبِينٍ ‘তিনিই সেই মহান সত্তা, যিনি নিরক্ষরদের মধ্য হ’তে একজন রাসূলকে প্রেরণ করেছেন। যিনি তাদের কাছে পাঠ করেন তাঁর আয়াতসমূহ ও তাদেরকে পবিত্র করেন এবং শিক্ষা দেন কিতাব ও সুন্নাহ। যদিও ইতিপূর্বে তারা স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে ছিল ’ (জুম‘আহ ৬২/২)।
আমরা আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার উৎস মনে করি এবং তাঁর প্রেরিত বিধান সমূহকে চির সত্য ও সকল যুগের জন্য পালনযোগ্য ও অপরিবর্তনীয় বলে বিশ্বাস করি। আল্লাহ প্রেরিত প্রতিটি বিধানই সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তার পরিবর্তনকারী কেউ নেই। ইসলাম মানব জাতির জন্য আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জীবনের সকল দিক ও বিভাগে এর পূর্ণ অনুসরণ ও অনুশীলনের মধ্যেই মানবতার মুক্তি নিহিত। এর বাইরে যা কিছুই বলা হবে, তা স্রেফ ধারণা ও কল্পনা এবং অন্তঃসারশূন্য যিদ ও হঠকারিতা মাত্র।
মুসলিম-অমুসলিম মনীষীবৃন্দ সর্বদা ইসলামের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু ইসলামী বিধান পালন ও প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অনেকের মধ্যেই রয়েছে সীমাহীন অজ্ঞতা, দুর্বলতা ও ঝুঁকি নেওয়ার মত সৎসাহসের অভাব। ইসলামের সত্যতা ও শ্রেষ্ঠত্ব সুপ্রমাণিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত। তাই ইসলামী বিধান সমূহ ভাল কি মন্দ তা প্রমাণ করার জন্য জনমতের কোন প্রয়োজন নেই। দেশের শাসনব্যবস্থা, অর্থব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী চলবে, না মানুষের মনগড়া বিধান অনুযায়ী চলবে? রোগাক্রান্ত মানুষ আল্লাহ প্রেরিত খাঁটি ঔষধ খাবে, না মানুষের তৈরী ভেজাল ঔষধ খাবে? কেবল এ বিষয়েই জনমত যাচাই করা আবশ্যক। কেননা রোগীকে জোর করে ঔষধ খাওয়াতে গেলে সে বমি করে দিবে। তাতে হিতে বিপরীত হবে। আমরা বিশ্বাস করি, পৃথিবীর মানুষ যতদিন আল্লাহ্ প্রেরিত বিধান অনুযায়ী নিজেদের সার্বিক জীবন পরিচালনা না করবে, ততদিন বিশ্বের বর্তমান অশান্ত অবস্থার কোনই পরিবর্তন হবে না। বরং অশান্তি দিন দিন বাড়তেই থাকবে।
মানব রচিত এযাবত কালের সকল মতবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এবং এ সবের চূড়ান্ত ব্যর্থতার পর মানুষ এখন উন্মুখ হয়ে আছে মুক্তি ও শান্তির জন্য। জর্জ বার্নার্ডশ’, বার্ট্রান্ড রাসেল, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, মিঃ গান্ধী প্রমুখ বিশ্বখ্যাত অমুসলিম দার্শনিক ও রাজনীতিক গণ ইসলামকেই পৃথিবীর মানুষের কল্যাণের জন্য একমাত্র বিকল্প হিসাবে তাদের মতামত ব্যক্ত করে গেছেন। কিন্তু আমরা যারা ইসলামের অনুসারী, যাদের দায়িত্ব ছিল জগদ্বাসীর কাছে ইসলামের সৌন্দর্য তুলে ধরার, সেই আমরাই আজ চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছি।
স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্ব মুসলিমের জন্য আল্লাহর একটি অনন্য নে‘মত। এখানকার অধিকাংশ মানুষ আল্লাহর বিধান মেনে চলার জন্য জন্ম থেকেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু কীভাবে সেটা মানবে, তা জানে না। এদেশে বিগত আড়াই শতাধিক বছর ধরে বৃটিশদের অমানবিক শাসননীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি ও বিচার ব্যবস্থা চলছে। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ চলে যাবার পর থেকে বিগত ৬৮ বছর কেবল নেতার বদল হয়েছে। কিন্তু নীতির বদল হয়নি। ফলে আমরা যে তিমিরে ছিলাম, সেই তিমিরেই আছি। সাধারণ মানুষ এথেকে পরিত্রাণ চায়। কিন্তু কীভাবে পরিত্রাণ পাবে? এক্ষেত্রে চারটি মতের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়।-
চার ধরনের প্রচেষ্টা :
(১) একদল বিশ্ব রাজনীতির দোহাই দিয়ে সবকিছুতেই আপোষ করে চলতে চান। তারা ভিতরে ঘা রেখে উপরে মলম দিতে ভালবাসেন। ব্যক্তিগত জীবনে ছালাত-ছিয়াম, হজ্জ ইত্যাদি পালনেই তাদের ধর্ম-কর্ম সীমাবদ্ধ। কথিত বিশ্বনেতারা সর্বদা এদেরকেই পসন্দ করেন ও এদেরকে সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতায় বসান। এরা নিজেদেরকে সেক্যুলার বলেন। যদিও তারা পুরাপুরি সেক্যুলার নন। তবে ইসলামী বিধান জারি করতে উদ্যোগী না হবার কারণেই পাশ্চাত্যের দৃষ্টিতে তারা সেক্যুলার।
(২) আরেক দল আছেন যারা ইসলামী হুকূমত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই রাজনীতি করেন। কিন্তু প্রচলিত অনৈসলামী রাজনীতির অনুসরণেই সেটা করেন। ফলে লক্ষ্য ইসলাম হ’লেও পথ যেহেতু ইসলামের বিপরীত, সেকারণ তাদের রাজনীতি ও সেক্যুলারদের রাজনীতির মধ্যে শ্লোগানের পার্থক্য ছাড়া আর কিছুই নেই। তারা ক্ষমতায় যাবার জন্য এবং ক্ষমতায় যাওয়ার পর সে আচরণই করেন, যেটা সেক্যুলাররা করে থাকেন। বরং কিছুটা বেশীই করেন। ভোটপ্রার্থী হওয়ার কারণে ‘এটাও ঠিক ওটাও ঠিক’ বলাই তাদের নীতি। ফলে সংস্কারের গুরু দায়িত্ব পালনে তারা অপারগ। কূয়াতে পচা বিড়াল রেখে উপরের পানি সেচাতেই তারা অভ্যস্ত। এরা ইতিমধ্যে পাশ্চাত্যের কাছ থেকে ‘মডারেট’ বা পপুলার লকব পেয়ে গেছেন। যদিও সেক্যুলারদের হাতেই তারা পর্যুদস্ত হচ্ছেন। আদর্শচ্যুত হয়ে দু’কুল হারিয়েছেন।
(৩) তৃতীয় আরেক দল আছেন যারা ইসলাম বলতে তাদের শিরক ও বিদ‘আতের জঞ্জালে ভরা তরীকাকে বুঝেন। মীলাদ-ক্বিয়াম, শবেবরাত, কবর-ওরস এগুলিই তাদের প্রধান উপজীব্য বিষয়। ছূফীবাদের অনুসারী হবার দাবী করে এরা দুনিয়াত্যাগী হিসাবে পরিচিত হতে ভালবাসেন। যদিও ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য এখন তারা কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন ও নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। এদের কাছাকাছি মতবাদের আরেকটি দল আছে, যারা নিজেদের দাওয়াতকে ‘নবীওয়ালা দাওয়াত’ বলেন এবং সর্বদা ‘রাসূলের তরীকায় শান্তি’ বলে থাকেন। কিন্তু সবাইকে খুশী করতে গিয়ে সমাজ সংস্কারের গুরু দায়িত্ব পালন থেকে এরা অনেক দূরে। এমনকি তাদের মুখে এখন প্রায়ই শোনা যায়, হাদীছ সবই রাসূলের। এর মধ্যে আবার ছহীহ-যঈফ আছে নাকি? এদের হামলার প্রধান শিকার হলেন ইমাম বুখারী, শায়খ নাছেরুদ্দীন আলবানী প্রমুখ যুগশ্রেষ্ঠ হাদীছ বেত্তাগণ। কারণ তাদের আচরিত দ্বীনের বেশীর ভাগই ছহীহ হাদীছের আলোকে শুদ্ধ নয়। যদিও ধর্মের বাহ্যিক রূপ এদের মধ্যেই বেশী।