পর্ব ১ । পর্ব ২। পর্ব ৩। পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬। পর্ব ৭ । পর্ব ৮ । পর্ব ৯। শেষ পর্ব।
আত-তাহরীক
জুন ২০১৫, ১৮/৯ সংখ্যায় দরসে হাদীছ কলামে ‘ইসলামী শিক্ষা’ শিরোনামে আলিয়া
মাদ্রাসার সিলেবাস সমূহে ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমলের বিরোধী বক্তব্য
সমূহের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেছিলাম। যার মাধ্যমে সেগুলি সংশোধনের জন্য
সরকারের ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু দেখলাম,
গত চার বছরেও সেগুলির কোন পরিবর্তন হয়নি, বরং আরও ভ্রান্তি বৃদ্ধি পেয়েছে।
আজকের নিবন্ধে মাদ্রাসা শিক্ষা সিলেবাসের সর্বশেষ চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস
পাব।-
মাজারে গিয়ে দোয়া করলে কবুল হয়!
(১) আলিয়া মাদ্রাসায় অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পাঠ্যবইয়ের নাম ‘আকাইদ ও ফিকহ’। এ বইয়ের ৮৯ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম ‘ওলিগণের মাজার শরিফ জেয়ারত’। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘মাজারে গিয়ে দোআ করলে দোআ কবুল হয়। মাজারে বসবাসকারী ফকির-মিসকিনদের সহায়তার জন্য মান্নত করায় কোনো ক্ষতি নেই। এখানে লেখা হয়েছে ‘ওলিগণ যেহেতু দুনিয়া ও আখেরাতে সুসংবাদপ্রাপ্ত, তাই তাদের মাজার শরিফে গিয়ে তাদেরকে ওসিলা করে দোয়া করলে আল্লাহ তায়ালা তার প্রিয়বন্ধুর সম্মানে দোয়া কবুল করেন’।
মন্তব্য : এগুলি সম্পূর্ণ কুরআন-হাদীছ বিরোধী কথা। এমনকি রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারতে গিয়ে নিজের মনস্কামনা পুরনের দো‘আ করা শিরক এবং করলে তা কবুল হবে বলে কোন কথা শরী‘আতে নেই। নেকীর উদ্দেশ্যে তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্যত্র সফর করা নিষিদ্ধ। উক্ত তিনটি মসজিদ হ’ল, বায়তুল্লাহ, বায়তুল আক্বছা ও মসজিদে নববী।[1] এই সফর কোন কবরের উদ্দেশ্যে হবে না।
তাছাড়া কে সত্যিকারের অলি, তা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তাদের অসীলা করে দো‘আ করা শিরক। বরং আল্লাহ ইচ্ছা করলে তার নেককার বান্দাকে তার সৎকর্মের অসীলায় ক্ষমা করতে পারেন।[2] তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সৎকর্ম করে, সে তার নিজের জন্যই সেটা করে। আর যে অসৎ কর্ম করে তার প্রতিফল তার উপরেই বর্তাবে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৬)।
(২) মাদ্রাসার নবম-দশম শ্রেণীর ‘আকাইদ ও ফিকহ’ বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম হ’ল ‘ইসলামে মানতের বিধান’। এখানে লেখা হয়েছে ‘ওলিদের কবর ও মাজারে মান্নতের ব্যাপারে বিভিন্ন মত রয়েছে। শুদ্ধতম কথা হ’ল- ওই সব মান্নত দ্বারা যদি মাজারের আশপাশে বসবাসকারী ফকির-মিসকিনদের প্রতি সহায়তার নিয়ত করা হয়, তবে সে মান্নতে কোনো ক্ষতি নেই’।
মন্তব্য : এটি স্রেফ বাজে কথা। কেননা কবরস্থানে বা নেকীর উদ্দেশ্যে কবর কেন্দ্রিক বসবাসের কোন বিধান ইসলামে নেই। অথচ ৮ম, ৯ম ও ১০ম শ্রেণীতে একই কথা লেখা হয়েছে।
(৩) অষ্টম শ্রেণীর ‘আকাইদ ও ফিকহ’ বইয়ে মাজারে গিয়ে দোআ করার পক্ষে ইমাম শাফেয়ির নাম ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে, ‘আলি ইবনে মায়মুন বলেন, আমি ইমাম শাফেয়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহিকে বলতে শুনেছি, আমি ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির দ্বারা বরকত হাসিল করি। আমি প্রায়ই তার কবর জেয়ারতে যাই। আমার কোনো প্রয়োজন দেখা দিলে আমি দুই রাকাত সালাত আদায় করে আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহির কবরের কাছে এসে দোআ করি। এতে দ্রুত দোআ কবুল হয়’ (তারিখে বাগদাদ, খতিব বাগদাদি ১/২০৩)।
মন্তব্য : এখানে ইমাম শাফেঈ ও ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর নামে যা বলা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন ও শরী‘আত বিরোধী বক্তব্য। এটিই যদি হয়, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কবরের কাছে গিয়ে তাঁর অসীলায় দো‘আ করলে সব মুসলমান আখেরাতে মুক্তি পেয়ে যাবে। তাদের আর কোন নেক আমলের প্রয়োজন হবে না। অথচ হযরত ওমর, ওছমান, আলী, হাসান, হোসাইন কেউই শত্রুদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি।
(৪) বইটির ৮৮ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম হ’ল ‘ওলিগণের কারামত’। এখানে লেখা হয়েছে, ওলিগণের কারামতে বিশ্বাস করা ঈমানের অংশ।
মন্তব্য : আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত কারামাতে আউলিয়ায় বিশ্বাসী। এটা আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর কোন নেক বান্দার প্রতি কারামত বা বিশেষ সম্মান প্রদর্শন বৈ কিছু নয়। আল্লাহ কখন কাকে কিভাবে এই মর্যাদা প্রদর্শন করবেন, এটা কেবলমাত্র তিনিই জানেন। এতে বান্দার নিজস্ব কোন গৌরব নেই। কারামতের কারণে কেউ উম্মতের ‘বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত’ ব্যক্তি হিসাবে গণ্য হবেন না। তিনি মানুষের রোগ আরোগ্যকারী, প্রয়োজন পূরণকারী বা ইল্মে গায়েবের অধিকারী হ’তে পারেন না।
অতঃপর প্রশ্ন হ’ল ‘অলি’ বলতে কাদেরকে বুঝায়? তারা কি উম্মতের নির্দিষ্ট কোন একটি শ্রেণীর নাম? আল্লাহ বলেন, ‘মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের অলি (অর্থাৎ বন্ধু)। তারা সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে নিষেধ করে’ (তওবা ৯/৭১)। তিনি বলেন, মনে রেখ আল্লাহর অলিদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না (ইউনুস ১০/৬২)। অতএব এটি কোন শ্রেণীর নাম নয়, বরং প্রত্যেক দ্বীনদার ও সৎকর্মশীল মুমিন নর-নারীই আল্লাহর অলি।
(৫) অষ্টম শ্রেণীর ‘আকাইদ ও ফিকহ’ বইয়ের ৩১ পৃষ্ঠায় একটি শিরোনাম হ’ল, ‘ইবাদতের ক্ষেত্রে ওসিলা গ্রহণ’। এখানে লেখা হয়েছে, ‘হযরত ইমাম আ‘যম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে লক্ষ্য করে বলেছেন, হে আল্লাহর রসূল! আপনিতো সেই মহান ব্যক্তি, আদম আলাইহিস সালাম পদস্খলন থেকে আপনাকে ওসিলা করে সফল হয়েছেন অথচ তিনি আপনার আদি পিতা। আপনার ওসিলা নিয়ে ইব্রাহিম খলিল অগ্নিকুন্ডে পড়ার সাথে সাথে আগুন ঠান্ডা হয়ে যায়, আপনার নূরের তাজাল্লিতে আগুন নিভে যায়’ (কাসিদায়ে নো‘মান)।
মন্তব্য : এখানে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ) সম্পর্কে যে কথা বলা হয়েছে, তা ভিত্তিহীন। একইভাবে ইব্রাহীম (আঃ)-এর অগ্নিকুন্ড মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নূরের তাজাল্লীতে নয়, বরং আল্লাহর হুকুমে ঠান্ডা হয়েছিল (আম্বিয়া ২১/৬৯)। আর মুমিনের সৎকর্মই হ’ল তার জান্নাতের অসীলা (বুঃ মুঃ)। তাছাড়া মুহাম্মাদ (ছাঃ) মানুষ নবী ছিলেন। তিনি নূরের নবী ছিলেন না বা তার কোন তাজাল্লীও ছিলনা।
(৬) এখানে আরও লেখা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালার নিয়মই হলো তিনি সরাসরি সবকিছু করার ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও কোনো মাধ্যম ছাড়া কিছু দেন না। তাই নিজেই ওসিলা অন্বেষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। পাঠ্যবইয়ে ওসিলার স্বপক্ষে সূরা মায়েদার ৩৫ নম্বর আয়াতকে ব্যবহার করা হয়েছে। ৩৫ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, ‘হে ঈমানদারগণ, আল্লাহকে ভয় কর এবং তার কাছে ওসিলা তালাশ কর’।
মন্তব্য : উপরোক্ত আয়াতে ‘অসীলা তালাশ কর’ অর্থ ‘আল্লাহর নৈকট্য তালাশ কর’। আর তা হ’ল বিশুদ্ধ আক্বীদা ও আমল (নিসা ৪/১২৪)। অতএব মাযার, মানত, শাফা‘আত ও অসীলা বিষয়ে মাদ্রাসার পাঠ্য বইয়ে যেসব কথা লেখা হয়েছে, সেগুলি পরিষ্কারভাবে শিরক এবং ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদার সম্পূর্ণ বিপরীত। সুতরাং কারু অসীলায় নয়, বরং মুমিনকে সরাসরি আল্লাহর নিকটেই সবকিছু চাইতে হবে ও তাঁর নিকটেই সরাসরি দো‘আ করতে হবে।
উল্লেখ্য যে, দাখিল অষ্টম শ্রেণী ও দাখিল নবম-দশম শ্রেণীর জন্য পাঠ্য আকাইদ ও ফিকহ বই দু’টির রচয়িতা হ’লেন, অধ্যক্ষ ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান, অধ্যক্ষ ড. মাওলানা মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম আল মারুফ, উপাধ্যক্ষ মাওলানা আবুল কাশেম মোহাম্মদ ফজলুল হক। বই দু’টি সম্পাদনা করেছেন মাওলানা রুহুল আমিন খান (সহ-সম্পাদক, দৈনিক ইনকিলাব)। যা বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এনসিটিবি কর্তৃক প্রকাশিত। বই দু’টি প্রথম প্রকাশ করা হয় ২০১৩ সালে। পাঠ্য করা হয় ২০১৪ সালে। ২০১৯ সালের পাঠ্য বইয়েও একইভাবে রয়েছে।
মুহাম্মদ সা: কবরে সশরীরে জীবিত এবং কেয়ামত পর্যন্ত সব কিছু দেখবেন!
(৭) অষ্টম শ্রেণীর আকাইদ ও ফিকহ বইটির চতুর্থ অধ্যায়ের নাম ‘আল ইমান বির রসুল’। এ অধ্যায়ের অধীনে ৫০ পৃষ্ঠায় একটি পাঠ হলো নবি সা. এর আগমনের উদ্দেশ্য। এখানে হজরত মুহাম্মদ সা. সম্পর্কে লেখা হয়েছে, তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সকল সৃষ্টির অবস্থা অবলোকন করবেন এবং আল্লাহর দরবারে সাক্ষ্য দেবেন’।
মৃত্যুর পরপরই তার রূহ মোবারককে আবার দেহ মোবারকে ফেরত দেয়া হয়েছে। যেমন অষ্টম শ্রেণীর জন্য পাঠ্য আকাইদ ও ফিকহ বইয়ের ৫৪ পৃষ্ঠার একটি পাঠের শিরোনাম হ’ল ‘রসুল সা. হায়াতুন্নবি’।
এখানে লেখা হয়েছে, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের জীবন শুরু হয় সৃষ্টির সূচনাতে যখন আল্লাহ ছাড়া কিছুই ছিল না। তিনি প্রকাশ পান ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। ইন্তেকালের পরও তিনি আবার জীবন লাভ করেন। রওজা পাকে সশরীরে তিনি জীবিত আছেন এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকিদা’।
মন্তব্য : এটি মারাত্মক শিরকী আক্বীদা। যা রাসূল (ছাঃ)-কে আল্লাহর স্থানে বসিয়ে দেয়, যিনি চিরঞ্জীব ও সবকিছুর ধারক (আয়াতুল কুরসী)। এটি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা নয়, বরং তার বিপরীত পুরাপুরি পথভ্রষ্টদের আক্বীদা। যা মুসলমানকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়।
(৮) এরপর উক্ত পৃষ্ঠায় আরো লেখা হয়েছে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রওযা মোবারকে দাফন করার পরপরই আল্লাহ তায়ালা তার রুহ মোবারককে ফেরত দেন এবং রুহ মোবারক দেহ মোবারকের মধ্যে কেয়ামত পর্যন্ত সব সময় অবস্থান করতে থাকবে, যাতে তিনি তার প্রতি দরুদ ও সালাম পেশকারি উম্মতের সালামের জবাব দিতে পারেন (সিফাউস সিকাম-আল্লামা সুবকি)।
তাই আমাদের এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, প্রিয়নবি রওযা পাকে সশরীরে জীবিত। তিনি উম্মতের সালামের জবাব দিচ্ছেন’।
মন্তব্য : এটিও চরম ভ্রান্ত শিরকী আক্বীদা। নবীগণ স্ব স্ব কবরে সশরীরে জীবিত। কিন্তু নিঃসন্দেহে তা রক্ত-মাংসে গড়া জড়দেহে নয়। বরং তা হ’ল পরকালের বারযাখী জীবনে। যে বিষয়ে আমাদের বাস্তব কোন জ্ঞান নেই এবং দুনিয়াবী জীবনের সাথে যার কোন সম্পর্ক নেই।
‘মি‘রাজের সফরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দুই সাথী জিব্রাঈল ও মিকাঈল (আঃ) ইতিপূর্বে দেখানো বিষয়গুলির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে বলেন, প্রথম যে ঘরটিতে আপনি প্রবেশ করলেন, ওটা হ’ল আপনার উম্মতের সাধারণ (জান্নাতী) ব্যক্তিদের জন্য। দ্বিতীয় ঘরটি হ’ল শহীদদের জন্য। অতঃপর উপরে মেঘের মত একটা ছায়ার দিকে ইশারা করে বললেন, ওটা আপনার জন্য নির্দিষ্ট। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, আমাকে আমার ঘরে ঢুকতে দাও! তারা বলল, এখনও আপনার জীবনের কিছু অংশ বাকী আছে। ওটা পূর্ণ হ’লেই আপনি এসে পড়বেন (فَلَوِ اسْتَكْمَلْتَ أَتَيْتَ مَنْزِلَكَ)।[3] এ হাদীছ প্রমাণ করে যে, মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বরযখী জীবনে জান্নাতুল ফেরদৌসের সর্বোচ্চ ও প্রশংসিত ‘ওয়াসীলা’ নামক স্থানে, যা আল্লাহর আরশের নীচে অবস্থিত, সেখানে জীবিত অবস্থায় থাকবেন।
তাঁর রূহ মুবারক বা কোন নবী-শহীদ বা নেককার মুমিনের রূহ কখনোই আর দুনিয়াতে ফিরে আসবে না (মুমিনূন ২৩/১০০; মুসলিম হা/১৮৮৭)।
কবরে রাসূল (ছাঃ)-কে জড়দেহে জীবিত প্রমাণ করতে পারলে কবর ব্যবসায়ীরা তাদের ঘোষিত পীর-আউলিয়াদেরকে কবরে জীবিত বলবে ও তাদের সুফারিশে আল্লাহর রহমত হাছিল হবার ধোঁকা দিয়ে নযর-নেয়ায জমা করতে পারবে। অতএব অন্ধভক্তির চোরাগলি দিয়ে ভক্তের পকেট ছাফ করা, আত্মা ও আত্মার মিলনে পরমাত্মার সান্নিধ্য লাভ করার ধোঁকা দিয়ে এমনকি মহিলা মুরীদের ইযযত লুট করা, কাশফ ও কেরামতির প্রতারণার জাল ফেলে মুরীদকে বোকা বানিয়ে চড়া দরের নযর-নেয়ায আদায় করা ইত্যাদি ধর্মের নামে দিনে-দুপুরে এই ডাকাতি করা সহজ হবে। এর দ্বারা তাদের ফানাফিল্লাহ-বাক্বাবিল্লাহ ও যত কল্লা তত আল্লা-র অদ্বৈতবাদী কুফরী আক্বীদার পক্ষে মিথ্যা দলীল পেশ করা হয়েছে মাত্র।
(৯) মাদরাসায় নবম-দশম শ্রেণীর জন্য পাঠ্য আকাইদ ও ফিকহ বইয়ের ২৬ পৃষ্ঠায় তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম হলো ‘ইমান বির রসুল’। এখানে মহানবী সাঃ কবরে সশরীরে জীবিত এ দাবির পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়ে লেখা হয়েছে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তেকালের পর এক বিশেষ ধরনের জীবন রয়েছে, তার শারীরিকভাবে বিদ্যমানতা ও বরযখী জীবন প্রণিধানযোগ্য। অকাট্য দলিলের আলোকেই সকল নবি আপন আপন মাযারে জীবিত আছেন এবং সালাত আদায় করছেন। আল্লাহ পাক শহিদদের প্রসঙ্গে বলেছেন, বরং তারা জীবিত, তাদের প্রভুর কাছ থেকে রিযিকপ্রাপ্ত হচ্ছেন (আল ইমরান ১৬৯)।
মন্তব্য : এগুলির জওয়াব পূর্বে দেওয়া হয়েছে। এগুলি কুরআনের অপব্যাখ্যা মাত্র। নবী-রাসূল ও শহীদগণ সবাই বরযখী জীবনে বেঁচে আছেন। জড়জগতে নয়।
(১০) ‘আর বলা বাহুল্য যে, নবিগণ শহিদদের তুলনায় উচ্চ মর্যাদার। সে কারণে তাদের বরযখী জীবনের শক্তি শহিদ থেকে আরো বেশি পূর্ণাঙ্গ। রাসূল্লাল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ পাক নবিদের দেহ ভক্ষণ করা জমিনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, নবিগণ জীবিত এবং রিযিক পাচ্ছেন। তিনি আরো বলেন, নবিগণ তাদের নিজ নিজ কবরে জীবিত। সুতরাং বুঝা গেল, সাধারণ ইমানদারদের থেকে ভিন্নতর বৈশিষ্ট্যমন্ডিত এক ধরনের বিশেষ বরযখী জিন্দেগী আছে নবিদের। আমাদের প্রিয়নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বরযখী হায়াত অন্যান্য নবিদের চেয়েও অধিকতর পরিপূর্ণ যা অতীব স্পষ্ট, তিনি আমাদের আমলসমূহ পর্যবেক্ষণ করছেন’।
মন্তব্য : তিনি বারযাখী জীবনে বেঁচে আছেন। যে জীবনের সঙ্গে দুনিয়াবী জীবনের কোন সম্পর্ক নেই। উভয় জীবনের মাঝে পর্দা থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত (মুমিনূন ২৩/১০০)।
‘আমাদের নবী আমাদের আমলসমূহ পর্যবেক্ষণ করছেন’ কথাটি সম্পূর্ণরূপে শিরকী বক্তব্য এবং নিজেদের ভ্রান্ত আক্বীদার পক্ষে কুরআন-সুন্নাহর অপব্যবহার মাত্র। যা ইহূদীদের স্বভাব। যার বিনিময়ে তারা স্বল্পমূল্য অর্জন করে থাকে (বাক্বারাহ ৭৯)। বরং আল্লাহ সবকিছু শোনেন ও দেখেন। তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই (শূরা ৪২/১১)। তাঁর তন্দ্রাও নেই, নিদ্রাও নেই (আয়াতুল কুরসী)। আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে। জান্নাতে মুমিনগণ তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে দেখবেন (ক্বিয়ামাহ ৭৫/২৩)। অবিশ্বাসী ও কপট বিশ্বাসীগণ তাঁর দর্শন থেকে বঞ্চিত হবে (মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৫)।
(১১) নবম-দশম শ্রেণীর পাঠ্যবই আকাইদ ও ফিকহ বইয়ের ১৩৩ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রওজা মুবারক জেয়ারত করা আল্লাহর নৈকট্য লাভের অন্যতম প্রধান উপায়। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা একথা বলে আমাদের নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, আর যদি তারা নিজেদের আত্মার উপর জুলুম করে এবং আপনার কাছে এসে আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং রসুল তাদের জন্য সুপারিশ করেন তবে তারা আল্লাহকে পাবে তওবা কবুলকারি দয়াবান (নিসা ৬৪)।
মন্তব্য : কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্য হ’ল মৃত্যুকে স্মরণ করা।[4] এর বেশী কিছু নয়। এখানে নিসা ৬৪ আয়াতের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেননা বিষয়টি রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনকালের সাথে যুক্ত। এটি তাঁর মৃত্যুর পরের বিষয় নয়।
(১২) এরপর লেখা হয়েছে, এই আয়াত রসুল সা. এর দরবারে যাওয়ার উৎসাহ প্রদান, তার দরবারে গিয়ে ইস্তেগফার করা এবং গুনাহগারের জন্য আল্লাহর দরবারে তার সুপারিশ-চায় তা তার জীবদ্দশায় কিংবা ওফাতের পর- এসব কিছুর উপর নির্দেশ প্রদান করে। রওজা শরীফে এ জন্য যাওয়া উত্তম। কেননা, প্রিয়নবি সশরীরে রওজাপাকে জীবিত। তিনি তার উম্মতের সালামের জওয়াব দেন। নবী করিম সা. হতে বর্ণিত আছে তিনি বলেন, যে আমার রওজা যিয়ারত করবে তার জন্য আমার শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যাবে (বায়হাকি, দারেকুতনি)।
আল্লাহর হাবিব সা. আরো বলেন, যে ব্যক্তি আমার ইন্তেকালের পর আমার রওজা যিয়ারত করবে সে যেন আমার জীবদ্দশায় আমার সাথে সাক্ষাৎ করল (তবারানি, মুজামুল আওসাত)।
মন্তব্য : ‘তাঁর জীবদ্দশায় কিংবা ওফাতের পর’ সূরা নিসা ৬৪ আয়াতের হুকুম প্রযোজ্য বলে যে কথা বলা হয়েছে, তা স্রেফ অপব্যাখ্যা। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের কোন মুফাসসির এরূপ ধোঁকাপূর্ণ ব্যাখ্যা দেননি। বরং এটি কেবল তাঁর জীবদ্দশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
অতঃপর রাসূল (ছাঃ)-এর ‘রওজা যিয়ারত’ সম্পর্কে
উপরে যে দু’টি হাদীছ বলা হয়েছে, সে দু’টি সহ উক্ত মর্মে যেসব হাদীছ বলা হয়ে
থাকে, সবগুলিই জাল ও বাজে(كُلُّهَا وَاهِيَةٌ)।[5]
‘প্রিয়নবি সশরীরে রওজাপাকে জীবিত’ কথাটি দ্বারা যদি কবরে তিনি দুনিয়াবী দেহে জীবিত ধারণা করা হয়, তবে সেটি হবে পুরোপুরি শিরকী আক্বীদা। দ্বিতীয়তঃ কবরকে ‘রওজাপাক’ বলাটা চরম ধৃষ্টতাপূর্ণ কথা। কারণ রাসূল (ছাঃ) নিজের কবরকে ‘কবর’ বলেছেন[6] ‘রওজাপাক’ বলেননি ।
(১৩) ১৩৫ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, রসুলের দরবারে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা দেয়া মুনাফিকদের অভ্যাস এবং তাঁর দরবারে একনিষ্ঠ হয়ে থাকা আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের পাথেয়। রসুলের দরবার বলতে এখানে রসুলের রওজা বোঝানো হয়েছে’।
মন্তব্য : বরং আল্লাহর ঘর যিয়ারতে বাধাদানকারীদের পবিত্র কুরআনে ‘সবচেয়ে বড় যালেম’ বলা হয়েছে (বাক্বারাহ ১১৪)। আর রাসূল (ছাঃ)-এর কবরকে যারা তীর্থস্থানে পরিণত করতে চায়, তাদেরকে তিনি লা‘নত করেছেন।[7]
রাসূল (ছাঃ)-এর কবরকে কোথাও রওজা বলা হয়নি, বরং তিনি বলেছেন, আমার গৃহ ও
আমার মিম্বরের মধ্যবর্তী স্থানটি হ’ল, জান্নাতের বাগিচা সমূহের অন্যতম
বাগিচা (রওযা)’।[8] তিনি মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে আল্লাহর নিকট প্রার্থনা
করে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ো না, যাকে পূজা করা
হয়। ঐ কওমের উপরে আল্লাহর প্রচন্ড ক্রোধ রয়েছে, যারা নবীগণের কবরসমূহকে
সিজদার স্থানে পরিণত করে’।[9] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমি
তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’। দেখো, আমি কি তোমাদেরকে পৌঁছে দিলাম’
(৩ বার)? হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’ (৩ বার)।[10]
উপরোক্ত হাদীছ সমূহের আলোকে এটাই পরিষ্কার যে, রাসূল (ছাঃ)-এর কবর যিয়ারত ব্যতীত বাকী সবই মুনাফিকদের কাজ। আর তা থেকে বাধা দেওয়াই হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর আদেশের যথার্থ অনুসরণ। যেটি বর্তমানে সঊদী সরকার করে যাচ্ছেন এবং রীতিমত পুলিশী প্রহরা দিয়ে কথিত দরবার ও রওজাপূজারী বিদ‘আতীদের সীমালঙ্ঘন থেকে রাসূল (ছাঃ)-এর কবরকে রক্ষা করছেন। দুর্ভাগ্য, এইসব শিরকী ও বিদ‘আতী আলেমদের দিয়েই মাদ্রাসা বোর্ডের আক্বায়েদ-ফিক্বহের মত গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্য বইসমূহ লেখানো হচ্ছে এবং কোমলমতি শিশুদের বিশুদ্ধ তাওহীদী আক্বীদার বদলে ভ্রান্ত আক্বীদা শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।
রসুলের সা: রওজা জিয়ারত করলেই শাফায়াত ওয়াজিব
(১৪) ‘কবিরা গুনাহকারী এবং পাপের কারণে যাদের শাস্তি অবধারিত হয়ে গেছে তাদের জন্য হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শাফায়াত অবধারিত। রসুলের রওজা মুবারক জিয়ারত করলে তার জন্য রসুলের শাফায়াত ওয়াজিব হয়ে যায়’।
মন্তব্য : এগুলি কবরপূজারীদের ধোঁকা মাত্র। এবিষয়ে ১২ নং মন্তব্যের আলোচনা দ্রষ্টব্য।
বড়দের সম্মানে পায়ে চুমু খাওয়া সুন্নত!
(১৫) বড়দের হাতে ও পায়ে মহববতে, সম্মান প্রদর্শনের জন্য চুমু খাওয়া সুন্নত। কদমবুছি মুস্তাহাব আমল। আলেম, বুজুর্গ ও ওস্তাদের নেক নজর পাওয়ার অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে কদমবুছি।
আলিয়া মাদরাসার ষষ্ঠ শ্রেণীর জন্য পাঠ্যবই ‘আকাইদ ও ফিকহ’ বইয়ে এ কথা লেখা হয়েছে। এ বইয়ের ১১৩ পৃষ্ঠার একটি পাঠের নাম ‘কদমবুছি’। এখানে লেখা হয়েছে, ‘বড়দের প্রতি সম্মান ছোটদের প্রতি মায়া-মমতা ইসলামের অন্যতম শিক্ষা।... হাত ও পায়ে মুহববতে, সম্মান প্রদর্শনের জন্য চুমু খাওয়া সুন্নত। হযরত সোহাইব রা. বর্ণনা করেন, আমি হযরত আলী রা. কে হযরত আববাস রা. এর হাত এবং পায়ে চুম্বন করতে দেখেছি’ (আল আদাবুল মুফরাদ, ২৩৮)।
এছাড়া ওজজা ইবনে আমের বলেন, আমরা রসুলুল্লাহ সা:-এর খেদমতে হাজির হলাম। আমাদের বলা হলো ইনি রসুল সা:। আমরা তার দুই হাত ও দুই পায়ে ধরেছি এবং চুমু খেয়েছি (আল আদাবুল মুফরাদ, ২৩৮)।
মন্তব্য : হাত-পায়ে চুমু খাওয়া সুন্নাত নয়, বরং বিদ‘আত। সুন্নাত হ’ল স্রেফ সালাম করা ও মুছাফাহা করা।[11] হাত-পায়ে চুমু খাওয়া সম্পর্কে উপরে যে দু’টি হাদীছ বলা হয়েছে, তা যঈফ। এছাড়া প্রথমটি আলী ও তাঁর চাচা আববাস-এর বিষয়। দ্বিতীয়টি বহিরাগত জনৈক ব্যক্তির প্রথাগত আচরণ। যা নবীর সুন্নাত নয় এবং যার প্রচলন ছাহাবায়ে কেরামের মধ্যে ছিল না। আর ঐ ব্যক্তির নাম ওজজা নয়, বরং ওয়াযে‘ বিন ‘আমের। যিনি বনু আব্দিল ক্বায়েস গোত্রের প্রতিনিধি দলের সাথে মদীনায় এসেছিলেন ইসলাম কবুল করার জন্য (আল-ইছাবাহ)।
শবেবরাতের পক্ষে কুরআনের আয়াতের ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক
(১৬) দাখিল অষ্টম শ্রেণীর আকাইদ ও ফিকহ বইয়ের ২১১ পৃষ্ঠায় শবেবরাত বিষয়ে লেখা হয়েছে, ‘শবেবরাতকে কুরআন মজিদে লাইলাতুল মুবারাকান বা বরকতময় রাত হিসেবে আখ্যা দেয়া হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি এ কুরআনকে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে’ (সূরা দোখান : ২)।
মন্তব্য : উক্ত আয়াতে বর্ণিত বরকতময় রাত্রির অর্থ ‘লায়লাতুল ক্বদর’। যা সূরা ক্বদরে আল্লাহ বলে দিয়েছেন। তাছাড়া সূরা বাক্বারাহ ১৮৫ আয়াতে স্পষ্টভাবে আল্লাহ বলেছেন, রামাযান মাস, যার মধ্যে কুরআন নাযিল হয়েছে’। অতএব শবেবরাতে কুরআন নাযিল হয়েছে বলে যে কথা বোর্ডের বইয়ে লেখা হয়েছে, তা সম্পূর্ণরূপে বানোয়াট ও উদ্দেশ্যপূর্ণ। শবেবরাতের বিদ‘আতী প্রথাকে টিকিয়ে রাখার জন্য বিদ‘আতী আলেমদের এটি অন্যতম অপকৌশল মাত্র। যা সিলেবাসের মাধ্যমে ছোট থেকেই কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রসুলের শান ও মানকে বুলন্দ করার জন্য এ সৃষ্টিজগৎ!
(১৭) দাখিল অষ্টম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে একটি পাঠের নাম ‘রসুল-এর শান ও মানকে হেয় করার পরিণাম’। এখানে হজরত মুহাম্মদ সা: সম্পর্কে লেখা হয়েছে ‘সৃষ্টির সূচনা ও কেন্দ্রবিন্দু যিনি। যার শান ও মানকে বুলন্দ করার জন্য এ সৃষ্টিজগৎ’। হজরত মুহাম্মদ সা: -কে না বানালে কিছুই সৃষ্টি করা হতো না। তার নূরকেই সর্বপ্রথম সৃষ্টি করা হয়েছে এবং পরে তার নূর থেকে অন্যসব সৃষ্টি। হজরত আদমের সৃষ্টির আগে হজরত মুহাম্মদ সা: আকাশে তারকা রূপে বিদ্যমান ছিলেন’।
উপরোক্ত মর্মে যেসব কথা বিদ‘আতী আলেমদের মাধ্যমে সমাজে প্রচারিত হয়েছে, সবই বানোয়াট ও বাজে কথা মাত্র। অতীতে ঈসা (আঃ)-কে নিয়ে বাড়াবাড়ি করে খৃষ্টানরা তাঁকে আল্লাহর পুত্র এমনকি তিন ইলাহের অন্যতম ইলাহ বলেছে (মায়েদাহ ৫/৭৩)। বিদ‘আতী আলেমরা একইভাবে শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) সম্পর্কে বাড়াবাড়ি করে তাঁকে ‘নূরের নবী’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
এভাবে ‘নূরে মুহাম্মাদী’র আক্বীদা সম্পূর্ণরূপে শিরকী আক্বীদা এবং পবিত্র কুরআনের বিরোধী এবং অবাস্তব। আল্লাহ বলেন, আদমকে আমরা সৃষ্টি করেছি মাটি থেকে (ছোয়াদ ৩৮/৭১-৭২)। আর মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন আদম সন্তান। অতএব তিনিও মাটির মানুষ। যাঁর সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘তুমি বল, নিশ্চয় আমি তোমাদেরই মত একজন মানুষ ব্যতীত নই’ (কাহফ ১৮/১১০)। অথচ বিদ‘আতী আলেমদের বক্তব্য সম্পূর্ণ তার বিপরীত। এরপরেও এরা দাবী করেন, আমরা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত। একারণেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘যখন তুমি নির্লজ্জ হবে, তখন তুমি যা খুশী তাই কর’।[12] কে না জানে যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর স্ত্রী-সন্তানাদি ছিল। অথচ তিনি নূর হ’লে তো এসব হতোনা।
ফেরেশতাদের আকৃতি নিয়ে দুই রকমের বক্তব্য
(১৮) ইবতেদায়ি পঞ্চম শ্রেণীর ‘আকাইদ ও ফিকহ’ বইয়ের ১৯ পৃষ্ঠায় ফেরেশতাদের পরিচয় সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘তাদের নির্ধারিত কোনো আকৃতি নেই’। অপর দিকে দাখিল অষ্টম শ্রেণীর ‘আকাইদ ও ফিকহ’ বইয়ের ৪০ পৃষ্ঠায় ফেরেশতাদের পরিচয় সম্পর্কে লেখা হয়েছে, ‘তাদের নিজস্ব আকৃতি রয়েছে’।
মন্তব্য : ‘ফেরেশতাদের কোন আকৃতি নেই’ কথাটি ভুল। বরং তাদের নিজস্ব আকৃতি আছে। যেমন ফেরেশতাদের সর্দার জিব্রীল (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘সে মহা শক্তিধর। অতঃপর সে নিজ আকৃতিতে প্রকাশ পেল’। ‘তখন সে সর্বোচ্চ দিগন্তে ছিল’ (নাজম ৫৩/৬-৭)।
জিব্রীলকে
তার ছয়শো ডানা বিশিষ্ট নিজ আকৃতিতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মোট দু’বার দেখেছেন।
প্রথমবার হেরা গুহায় নুযূলে অহীর পর সাময়িক বিরতি শেষে এবং দ্বিতীয়বার
মি‘রাজের সফরে সিদরাতুল মুনতাহায়। সূরা নাজমে মে‘রাজের সময়ের কথাটিই বলা
হয়েছে।[13]
এ ছাড়া সূরা ফাতিরের প্রথম আয়াতেও ফেরেশতাদের আকৃতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের সৃষ্টিকর্তা। যিনি ফেরেশতাগণকে করেছেন বার্তাবাহক। যারা দুই দুই, তিন তিন ও চার চার ডানা বিশিষ্ট। তিনি সৃষ্টিতে যা খুশী বৃদ্ধি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাশালী’ (ফাত্বির ৩৫/১)। কেবল ফেরেশতা নয়, বরং অন্যান্য সৃষ্টিকেও তিনি এভাবে করেছেন। তিনি বলেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক জীবকে সৃষ্টি করেছেন পানি থেকে। তাদের কেউ বুকে ভর দিয়ে চলে। কেউ দু’পায়ে ভর দিয়ে চলে এবং কেউ চারপায়ে ভর দিয়ে চলে। আল্লাহ যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে সর্বশক্তিমান’ (নূর ২৪/৪৫)।
বাংলাদেশ মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক প্রণীত ২০১৪ সাল থেকে মাদ্রাসার পাঠ্য পঞ্চম শ্রেণীর আকাইদ ও ফিকহ বইটি রচনা করেছেন আবু সালেহ মো: কুতবুল আলম, আবু জাফর মুহাম্মদ নুমান ও মোহাম্মদ নজমুল হুদা খান। বইটি সম্পাদনা করেছেন অধ্যক্ষ হাফেজ কাজী মোঃ আব্দুল আলীম।
ফেরেশতাদের প্রিয় নবীর নূর থেকে সৃষ্টি কথাটি বাদ দেয়া হয়েছে :
দাখিল অষ্টম শ্রেণীর আকাইদ ও ফিকহ বইটি ২০১৪ সাল থেকে পাঠ্যবই হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ২০১৪ সালে এ বইটির ৪২ পৃষ্ঠায় ফেরেশতাদের সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ফেরেশতাগণ প্রিয় নবীর নূর বা জ্যোতি থেকে সৃষ্টি। তারা অত্যন্ত জ্যোতির্ময়, সুঠাম দেহের অধিকারী’।
বেশ কয়েক বছর পর্যন্ত ফেরেশতাদের সৃষ্টি সম্পর্কে এ ভ্রান্ত কথাটি বহাল রাখা হয় পাঠ্যবইয়ে। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে ২০১৭ সালের সংস্করণে এ কথাটি বাদ দেয়া হয় এবং ২০১৮ সালে বইটি পরিমার্জন করা হয়।
(ক্রমশঃ)