জম্মু-কাশ্মীরের রূহ কবয করা হ’ল!

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির দীর্ঘ ৭২ বছর পর জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য তার ‘বিশেষ মর্যাদা’ হারালো। জম্মু-কাশ্মীর থেকে কারগিল ও লাদাঘকে পৃথক করে তৈরী করা হ’ল নতুন দুই কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। এখন থেকে জম্মু-কাশ্মীরের বাইরের রাজ্যের লোকেরা সেখানে স্বাধীনভাবে জমি কেনার ও বসবাস করার অধিকারী হবে। অতঃপর সুপরিকল্পিতভাবে অন্যান্য রাজ্য থেকে লোক এনে কাশ্মীরকে ক্রমে হিন্দু সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজ্যে পরিণত করা হবে। এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের লেবাসধারীরা সেখানে কঠোর হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালের দ্বি-জাতি তত্ত্বের বিরোধীরা এখন কি জবাব দিবেন, সেটাই দেখার বিষয়।

গত ৫ই জুলাই’১৯ সোমবার প্রথমে রাজ্যসভায় ও পরে লোকসভায় সে দেশের নবনিযুক্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বিরোধী দল সমূহের প্রবল আপত্তির মুখে রাষ্ট্রপতির নির্দেশনামা পড়ে শোনান। সাথে সাথে তিনি রাজ্যসভায় ‘জম্মু-কাশ্মীর রাজ্য পুনর্গঠন’ বিল উত্থাপন করেন ও তা পাস হয়ে যায়। এর ফলে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫(ক) ধারা বাতিল হয়। যা ছিল জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত রাজ্য হওয়ার প্রতীক। ব্রুট মেজরিটির স্বৈরাচার এভাবেই গণতন্ত্রের নামে সংখ্যালঘুদের অধিকার হরণ করে থাকে। এর ফলে যে ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে গণতন্ত্রীদের নিরন্তর অভিযোগ সেই ধর্মীয় রাজনীতিরই জয় হ’ল।

সমগ্র কাশ্মীর প্রদেশে ১ কোটি ৪০ লাখ নাগরিকের মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ৮৫%। তন্মধ্যে শুধু কাশ্মীরে মুসলিম জনসংখ্যা ৯৮% ও হিন্দু ২%। জম্মুতে হিন্দু ২২%। এখানে জনসংখ্যার ৬০% হিন্দু, বাকি ৪০% মুসলিম। লাদাঘে ১২%। সেখানে ৩ লাখ নাগরিকের আধাআধি বৌদ্ধ ও মুসলিম। গড়ে পুরো রাজ্যে হিন্দু ৩৬%। বর্তমান বিজেপি সরকার এই অবস্থারই পরিবর্তন ঘটাতে চায় ৩৫(ক) ধারা বাতিল করে। তারা সেখানে বাহির থেকে হিন্দু এনে মুসলিমদের সংখ্যালঘু বানাতে চায়। ৩৭০ ধারা অনুযায়ী প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও পরারাষ্ট্রনীতি ব্যতীত রাষ্ট্র পরিচালনার বাকী বিষয়গুলিতে জম্মু ও কাশ্মীরে কোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে গেলে ভারত সরকারকে রাজ্য আইন সভার সঙ্গে আলাপ করতে হয়। যা এই অঞ্চলের উপর ভারত সরকারের কর্তৃত্ব সীমিত করে। পাশাপাশি ৩৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাশ্মীরের বাসিন্দা নন এমন ভারতীয়দের সেখানে সম্পদের মালিক হওয়া এবং চাকুরী পাওয়ায় বাধা-নিষেধ থাকে’। কাশ্মীরীরা যাতে সার্বভৌমত্বের বোধ নিয়ে সুখী মনোভাবের সঙ্গে ভারত ইউনিয়নে থেকে যায়, সেই লক্ষ্যে নেহেরু সরকারের সুফারিশে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এই অধ্যাদেশটি জারী করেন। বাস্তবে কাশ্মীর ছিল একটি অধিকৃত অঞ্চলের মর্যাদায়। এক সময় এই রাজ্যের আলাদা পতাকা ছিল। ছিলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী । ছিল পৃথক সংবিধান। কালে কালে সব হারিয়ে ‘রাষ্ট্রপতি’ হন ‘রাজ্যপাল’। ‘প্রধানমন্ত্রী’ হন ‘মুখ্যমন্ত্রী’। বিশেষ মর্যাদা হিসাবে যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তা ওই সংবিধানিক ৩৭০ ধারা ও ৩৫(ক) ধারার মতো কিছু বিশেষ ক্ষমতা। এবার সেটিও গেল। সেই সঙ্গে গেল রাজ্যের মর্যাদাও। এই বিল পাস হওয়ার পর ভারতের রাজ্য সংখ্যা ২৯ থেকে কমে ২৮ এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের সংখ্যা ৭ থেকে বেড়ে হবে ৯। পরিবর্তিত নতুন অবস্থায় জম্মু-কাশ্মীর একটি সাধারণ রাজ্যের চাইতেও নীচে চলে যাবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের হাতে কোন ক্ষমতাই থাকবে না। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাঘ শাসন করবেন কেন্দ্রের নিযুক্ত পৃথক দুই লেফটেন্যান্ট গভর্ণর।

উল্লেখ্য যে, শাসক দল বিজেপি ৩টি বিষয় থেকে কখনো সরেনি। (১) সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল (২) সারাদেশে অভিন্ন দেওয়ানী বিধির প্রচলন এবং (৩) অযোধ্যায় বাবরী মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণ। ৩০শে মে ২০১৯ বৃহস্পতিবার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে ২ মাস ৫ দিন পর ৫ই আগস্ট তারা প্রথমটি করে ফেলল এবং কাশ্মীরকে পুরোপুরি কব্জায় নিল। অতঃপর ৬ই আগষ্ট মঙ্গলবার থেকে অযোধ্যা মামলার শুনানি সুপ্রিম কোর্টে শুরু হবে। বিজেপির বিশ্বাস অতি দ্রুত উক্ত শুনানি শেষ হবে এবং অযোধ্যায় রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার সব বাধা দূর হবে। বাকী থাকবে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি। তা করার আগে মুসলমানদের ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে তারা ‘তিন তালাক বিল’ পাস করেছে। সবকিছুই হচ্ছে অত্যন্ত তড়িঘড়ি করে যেন হাতে আর সময় নেই। এর পূর্বে ‘ইউএপিএ’ বিল পাস করা হয়েছে, যাতে প্রতিবাদকারী কোন ব্যক্তিকে সরকার খুশী মত সন্ত্রাসবাদীর তকমা দিয়ে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখতে পারে। অতঃপর ‘আরটিআই’ নামে আরেকটি বিল পাস করা হয়েছে, যাতে সরকারের মর্যীমাফিক চলা ছাড়া তথ্য কমিশনারদের কোন উপায় থাকবে না।

জম্মু-কাশ্মীর সম্পর্কিত যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নেওয়ার আগে তারা কোন দলের সঙ্গে আলোচনা করেনি বা সর্বদলীয় বৈঠক ডাকেনি। এক সপ্তাহ পূর্বে কাশ্মীরে পূর্বেকার ৬ লাখ সেনার উপরে বাড়তি ১০,০০০ সেনা প্রেরণ করা হয়। সকল পর্যটককে উপত্যকা ছেড়ে যেতে বলা হয়। মোবাইল-ইন্টারনেট পরিসেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গৃহবন্দী করা হয়। এভাবে ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টির পর সবাইকে অন্ধকারে রেখে হঠাৎ এরূপ হঠকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। 

উক্ত ঘোষণার পর কাশ্মীরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় বর্ষীয়ান নেতা সৈয়দ আলী শাহ গীলানী (৯০) এক টুইটার বার্তায় বিশ্ববাসীর নিকটে তাদের রক্ষার আর্তি জানিয়ে লিখেছেন যে, আপনারা এই বার্তাকে ‘এস ও এস’ হিসাবে গণ্য করুন! তবে পাকিস্তান, তুরস্ক ও মালয়েশিয়া ব্যতীত কেউ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোও ঐক্যবদ্ধ কোন অবস্থান নিতে পারেনি এবং পারবে বলেও মনে হয় না। কারণ কংগ্রেস অদ্যাবধি নেতাহীন। সাথে সাথে আযাদ কাশ্মীর ও আকসাই চীন ভারতের অংশ বলে দাবী করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এ ব্যাপারে পরদিন ৬ই আগষ্ট মঙ্গলবার লোকসভায় বিল পাস করেছে বিজেপি।

উক্ত বিলের প্রতিবাদে কংগ্রেস নেতা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম বলেন, সরকার যা করেছে তা দেশ ও গণতন্ত্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক। এই সিদ্ধান্ত দেশকে টুকরো টুকরো করে ফেলার প্রথম পদক্ষেপ’। রাজ্যসভায় কংগ্রেসের বিরোধী দলনেতা গোলাম নবী আযাদ বলেন, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিকভাবে কাশ্মীরের যে অনন্য চরিত্র, কলমের এক খোঁচায় বিজেপি সেটাই বরবাদ করে দিতে চাইছে’। কাশ্মীরের শেষ অধিপতি মহারাজা হরি সিং-এর পুত্র ও লোকসভার কংগ্রেস সদস্য ডঃ করণ সিং এই বিলের বিরোধিতা করে বলেন, বিজেপি কাশ্মীর নিয়ে যে পন্থাই গ্রহণ করুক তাতে বৈপ্লবিক কিছু ঘটবে না। তিনি বলেন, যেদিন আমার বাবা সেই চুক্তিতে সই করেন সেদিন ২৭শে অক্টোবর আমি নিজেও সেখানে উপস্থিত ছিলাম। মনে রাখতে হবে, মহারাজা সেদিন কেবল প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্কটুকুতেই ভারতভুক্তি স্বীকার করেছিলেন, নিজের রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে দেননি। যে শর্তে বাবা সেদিন নিজের রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, দিল্লী তার মর্যাদা রাখেনি’।

পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত আযাদ কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী রাজা ফারূক হায়দার খান বলেন, ‘ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে কাশ্মীরকে হারালো। আমরা কখনোই ভারতের অংশ ছিলাম না। কিন্তু ভারত আজ জম্মু সহ লাদাঘ উপত্যকাও হারালো’। ভারতীয় কংগ্রেসের এমপি অধীর চৌধুরী বলেন, ‘নিয়ম ভেঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর ভাগ করা হচ্ছে। সিমলা চুক্তি ও লাহোর চুক্তি সত্ত্বেও কিভাবে এটা আভ্যন্তরীণ বিষয় হ’ল? কাশ্মীরকে আপনারা কয়েদখানা বানিয়ে দিলেন’। কংগ্রেস নেতা মনিস তেওয়ারী বলেন, ‘ভারতীয় সংবিধানে  কেবল ৩৭০ ধারা নেই। বরং সেখানে ৩৭১-এ থেকে আই পর্যন্ত রয়েছে। যেগুলি নাগাল্যান্ড, আসাম, মণিপুর, অন্ধ্র প্রদেশ, সিকিম প্রভৃতি রাজ্যে ‘বিশেষ অধিকার’ প্রদান করে। আজ যখন সরকার ৩৭০ ধারা বাতিল করছে, তখন এর মাধ্যমে ঐসব রাজ্যের জন্য কি বার্তা পাঠানো হচ্ছে?’ মিজোরামের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা লালথান হাওলা ৩৭০ ধারা বাতিলের প্রেক্ষিতে বলেন, ‘এ ঘটনা মিজোরাম, মেঘালয়, নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশের মত রাজ্যের জন্য আতংকের’। তারা বলেন, ৩৭১-এ ধারায় হাত পড়লে রুখে দাঁড়াবে মিজোরা’। একই ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন অন্যান্য রাজ্যগুলির নেতারা। হ্যাঁ, ১৫ই আগষ্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে উক্ত ৫টি রাজ্যে পৃথক পতাকা উড়িয়ে মিছিল করা হয়েছে। যা তাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতা আন্দোলনের ইঙ্গিত বহন করে। এদিকে পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রদেশ কংগ্রেস। দার্জিলিং ও কুচবিহার পশ্চিমবঙ্গের অংশ থাকবে কি না সেটা নিয়ে তাদের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে। কাশ্মীর নিয়ে সরকারের এই হঠকারী সিদ্ধান্তে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ৭ই সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে বাম রাজনৈতিক সংগঠনগুলো। ইতিমধ্যে গত ১৭ই আগষ্ট শনিবার পাকিস্তান ও চীনের অনুরোধে কয়েক দশক পরে এই প্রথম কাশ্মীর নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক বসে। কিন্তু ভেটো ক্ষমতার অধিকারী রাশিয়া ভারতের পক্ষে এবং চীন পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় তাতে কোন ফলাফল আসেনি। তবে জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি বলেছেন, এ বৈঠকই পাকিস্তানের শেষ পদক্ষেপ নয়। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের এই বৈঠক কাশ্মীর সমস্যাকে আন্তর্জাতিক ইস্যু হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে’।

উল্লেখ্য যে, ১৯৪৮ সালে গৃহীত নিরাপত্তা পরিষদের ৪৭ নং প্রস্তাবে কাশ্মীরের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার স্বীকার করে বলা হয়েছিল যে, গণভোটের মাধ্যমে কাশ্মীরীরা তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে’। কিন্তু ভারত এ প্রস্তাব অদ্যাবধি মানেনি। বরং তারা সর্বদা এটিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবী করেছে। যদিও শুরু থেকেই এটি ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা ছিল এবং আজও আছে। এটা নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দু’বার যুদ্ধও হয়েছে।

আমরা মনে করি, এভাবে একটার পর একটা অন্যায় সিদ্ধান্ত ভারতকে সোভিয়েত ইউনিয়নের ন্যায় ছিন্নভিন্ন করে ফেলবে। মুসলমানদের ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ন্যায্য অধিকার আল্লাহর পক্ষ থেকেই ফিরে আসবে। আল্লাহ যালেমদের ধ্বংস করুন ও মযলূমদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)

বর্ষশেষের নিবেদন : ২২তম বর্ষ শেষে ২৩তম বর্ষের প্রাক্কালে আমরা আমাদের সকল পাঠক-পাঠিকা, লেখক-লেখিকা, এজেন্ট ও গ্রাহক এবং দেশী ও প্রবাসী সকল শুভানুধ্যায়ীকে আন্তরিক মুবারকবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ দ্বীনদার ভাই-বোনদের হৃদয় সমূহকে এ মহান আন্দোলনের প্রতি রুজূ করে দিন- আমীন! [সম্পাদক]