শাসন ও অনুশাসন

আল্লাহ আদমকে সৃষ্টি করেছেন এবং সেই সাথে ইবলীসকেও সৃষ্টি করেছেন মানুষকে পরীক্ষা করার জন্য। আর সেজন্য তিনি অন্য প্রাণীর বিপরীতে মানুষকে জ্ঞান ও স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি দান করেছেন। ইবলীস সর্বদা মানুষকে ধোঁকা দিয়ে তার পক্ষে কাজে লাগায়। মানুষের নিজস্ব জ্ঞানশক্তি ইবলীসের খটকার সামনে অধিকাংশ সময় ব্যর্থ হয়। আর তখনই প্রয়োজন হয় শাসন ও অনুশাসনের। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ (গর্ব) ও মাৎসর্য (ঈর্ষা ও পরশ্রীকাতরতা) এই ছয়টি বস্ত্তকে ‘ষড়রিপু’ বলা হয়। প্রত্যেকটিই প্রয়োজনীয় এবং প্রাথমিক ও সহনীয় পর্যায়ে উপকারী। কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে ক্ষতিকর। যেমন কাম অর্থাৎ কামনা দ্বারা মানুষ জীবনে বেঁচে থাকার শক্তি পায়। মানুষ মানুষকে ভালবাসে, ঘর বাঁধে ও সংসারধর্ম পালন করে। কামনা আছে বলেই মানুষ ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগতভাবে বড় বড় মহৎ উদ্দেশ্য গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নের আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এই চাওয়া যখন মন্দের জন্য হয় এবং তা চরম আকার ধারণ করে, তখন সেটি হয় ক্ষতিকর। আর তখনই প্রয়োজন হয় কঠোর শাসনের। যা অন্যের জন্য শিক্ষণীয় হয়। ফলে ব্যক্তি দূষণ থেকে সমাজ দূষণ বারিত হয়। ইসলামী আইন ও বিধান সমূহ উপরোক্ত লক্ষ্যে নির্দেশিত। বস্ত্ততঃ যখন মানুষ আল্লাহর দাসত্ব স্বীকার করে, তখন তার মধ্যে ষড়রিপুর আতিশয্য হ্রাস পায় এবং সে নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করে। আল্লাহভীরুতা ও আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি ব্যতীত মানুষের বিবেক ও মানবিক মূল্যবোধ টেকসই হয়না। 

প্রচলিত দলভিত্তিক গণতান্ত্রিক শাসনে বাংলাদেশের ব্যক্তি ও সমাজ জীবন ক্রমবর্ধমান হারে দূষিত হয়ে চলেছে। যা বর্তমানে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বিএনপি আমলে ‘জিরো থেকে হিরো’ হওয়া প্রধান বন রক্ষক ‘বনের রাজা’ ও ‘বনখেকো’ বলে কুখ্যাত ওছমান গণি (২০০৭), আওয়ামী লীগ আমলে ‘কালো বিড়াল’ খ্যাত রেলখেকো মন্ত্রী (২০১২), চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ও রাজশাহী মেডিকেলে নির্মাণাধীন ভবনে রডের পরিবর্তে বাঁশের চটা ব্যবহার (২০১৬), রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের ‘বালিশ কান্ড’। যেখানে পাঁচটি ২০ তলা ভবনের জন্য বালিশ কিনতে প্রতিটিতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫ হাযার ৯৫৭ টাকা। লেপ বা কম্বলের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত কভারসহ কমফোর্টারের দাম ধরা হয়েছে ১৬ হাযার ৮০০ টাকা (২০১৯), চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভবন নির্মাণের আগেই যন্ত্রপাতি কেনার ‘ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রোফাইল’ (ডিপিপি) তৈরীতে মূল্য দেখানো হয়েছে প্রতিটি বালিশ ২৭ হাযার ৭২০ টাকা, কভার ২৮ হাযার টাকা, সার্জিক্যাল ক্যাপ ও মাস্ক প্রতিটি ৮৪ হাযার টাকা এবং গাউন প্রতিটি ৪৯ হাযার টাকা (২০১৯)। এরপরে রয়েছে সাম্প্রতিক জুয়া ও ক্যাসিনো কান্ড। গত ১৮ই সেপ্টেম্বর’১৯ থেকে যার বিরুদ্ধে পুলিশী অভিযান শুরু হয়েছে। নাম এসেছে, সরকারী দল আওয়ামী লীগ ও তার জোটের ডাকসাইটে মন্ত্রী, হুইপ ও অন্যান্য পদাধিকারী ব্যক্তিদের। যাদের ২৩ জনের ব্যাংক একাউন্টে পাওয়া গেছে ১ হাযার ২৭ কোটি টাকা।  

সম্প্রতি গত ১৩ই জানুয়ারী সোমবার সকালে ধরা পড়েছে দুই ভাই এনামুল ও রূপন। রাজধানীর গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুল হক এনু ও তার ছোট ভাই দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক রূপন ভূঁইয়ার বস্তা বস্তা টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধার করেছে র‌্যাব। পুরান ঢাকার তিনটি বাসায় অভিযান চালিয়ে দুই ভাইয়ের প্রায় ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা, ৭৩০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। টাকা রাখলে বেশী জায়গা লাগে তাই স্বর্ণ কিনে সেগুলো তারা ভল্টে ভরে রাখতেন। গত ৬-৭ বছরে পুরান ঢাকায় বাড়ী কিনেছেন কমপক্ষে ১২টি। ফ্ল্যাট কিনেছেন ৬টি। যাদের মূল পেশা হ’ল জুয়া এবং নেশা হ’ল বাড়ী কেনা।

এ ঘটনায় গেন্ডারিয়া, সূত্রাপুর ও ওয়ারী থানায় সাতটি মামলা হলেও এনু-রূপন এবং তাদের দুই সহযোগী হারূণুর রশীদ ও আবুল কালাম গা ঢাকা দেন। অবশেষে কেরাণীগঞ্জের শুভাঢ্যার ‘শ্যামল ছায়া কমপ্লেক্স’ নামের ১০ তলা ভবনের ৫ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। সিআইডি জানায়, ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন দুই ভাই। রাতে ঘুমাতেন টয়লেটের ফল্স ছাদে। দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে স্বেচ্ছাবন্দী থাকা অবস্থায় একবারের জন্যও তারা বাইরে আসেননি। তবু শেষ রক্ষা হয়নি। এনু ও রূপন ঘরের মধ্যেই চুল-দাড়ি কাটতেন। বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল তাদের বিশ্বস্ত পুরনো কর্মচারী শেখ সানি মোস্তফা। তাকেও পাকড়াও করা হয়েছে। বাসায় সানির মাধ্যমে নাপিত আনা হ’ত। গোয়েন্দারা প্রথমে সানিকে অনুসরণ করে। পরে ওই কর্মচারীর বাসায় সোর্স নিয়োগ করা হয়। অতঃপর বাইরে থেকে নাপিতের আসা-যাওয়ার পথ ধরে গোয়েন্দারা পৌঁছে যায় উক্ত ফ্লল্যাটে। এরপর টয়লেটের ফল্স ছাদ থেকে তাদের নামিয়ে আনে গোয়েন্দারা। এসময় নগদ ৪০ লাখ টাকা, ১২টি মোবাইল ফোন, বাড়ির দলিলপত্র এবং ব্যাংকের কাগজপত্র জব্দ করা হয়। এ দুই ভাই এখন ‘ক্যাসিনো ব্রাদার্স’ নামে কুখ্যাত হয়েছে। এত টাকা আয় করে ফলাফল কি হ’ল? বেচারারা একটু শান্তির সাথে ঘুমাতেও পারেনি। বউ-বাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্তে কোথাও থাকতেও পারেনি। তাহ’লে দুনিয়াতে কি পেল? এরপরে আখেরাতে তো রয়েছে জাহান্নামের জ্বলন্ত হুতাশন।...

প্রশ্ন হ’ল মন্ত্রী, হুইপ, দলনেতা সবার মধ্যে এই অধঃপতন কেন? এর উত্তর হ’ল, এখানে শাসন ও অনুশাসন দু’টিরই অভাব। মানুষকে তার অসৎকর্ম থেকে বিরত রাখার জন্যই সৃষ্টি হয়েছে পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসন এবং রাষ্ট্রীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থা। সেই সাথে রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন ব্যবস্থা। কোনটাই কোনরূপ ফল দেয়না, যদি তার যথাযথ প্রয়োগ না থাকে। অধিক পাওয়ার আকাংখা ও সম্পদের লোভ মানুষকে ধ্বংস করে। অথচ সংশ্লিষ্ট বস্ত্তবাদী সংগঠন ও রাজনৈতিক প্রশাসন নিজেদের স্বার্থে এইসব ব্যক্তিদের অবাধ সুযোগ করে দিয়ে থাকে। ফলে প্রশাসন তাদের উপর অর্পিত আমানতের হক যথাযথভাবে আদায়ে ব্যর্থ হয়। আল্লাহ বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের সাথে খেয়ানত করো না এবং জেনে-শুনে তোমাদের পরস্পরের আমানত সমূহে খেয়ানত করো না’। ‘জেনে রাখ, তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি পরীক্ষার বস্ত্ত মাত্র। এর চাইতে মহা পুরস্কার রয়েছে আল্লাহর নিকট’। ‘হে ঈমানদারগণ! যদি তোমরা আল্লাহভীরু হও, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার পথ বের করে দিবেন এবং এর ফলে তোমাদের পাপসমূহ মোচন করবেন ও তোমাদের ক্ষমা করে দিবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল’ (আনফাল ৮/২৭-২৯)। প্রত্যেক মুমিন ও দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ আল্লাহর নিকটে কৈফিয়ত দেওয়ার ভয়ে ভীত হবেন কি? (স.স.)।