শিশু আয়লানের আহবান : বিশ্বনেতারা সাবধান!

তুরস্কের সাগরতীরে কালো হাফপ্যান্ট ও লাল শার্ট পরা তিন বছরের শিশুপুত্র কুর্দী আয়লানের মৃতদেহ পড়ে আছে উপুড় হয়ে। হঠাৎ নযর পড়ল দূর থেকে এক মহিলা চিত্রগ্রাহিকার। বুকটা বেদনায় ককিয়ে উঠল তাঁর। এক দৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন সেদিকে। বুঝলেন, শিশুটি সবার মায়া ছেড়ে চলে গেছে পরপারে। কারু কাছে তার আর কিছুই চাওয়ার নেই। তাই বলে কি সে এভাবেই নীরবে ভূমধ্যসাগরের ঢেউয়ে হারিয়ে যাবে? বিশ্ববাসীর কাছে তার কি কিছুই বলার নেই? হ্যাঁ এবার সক্রিয় হয়ে উঠল হাতের ক্যামেরাটি। ব্যথাভরা মনে নিখুঁতভাবে তুলে নিলেন নিথর দেহের নির্বাক ছবিটি। আহ যেন মনে হয় ও জীবন্ত। বিশ্বনেতাদের ধিক্কার দিয়ে পিঠ উঁচু করা বাচ্চাটি যেন ঝাঁপিয়ে পড়তে চাচ্ছে সামনের উত্তাল পানিরাশিতে। সব হারিয়েছে সে। অথচ কিছুক্ষণ পূর্বে তার সবই ছিল। পরিবারের ১২ জন সদস্যের সাথে সেও তার পিতা-মাতা ভাই-বোনের সঙ্গে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে যাচ্ছিল দূর ইউরোপের কানাডায় স্রেফ একটু নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু না। নৌকাডুবিতে সাগরে ভেসে গেল সবাই। সবশেষে হাত ছাড়িয়ে যাওয়া পিতাকে সে করুণ কণ্ঠে বলেছিল, আববু তুমি মরে যেয়ো না! আল্লাহ তার প্রার্থনা শুনেছিলেন। যুবক পিতা আব্দুল্লাহ ভাসতে ভাসতে তীরে উঠেছিলেন। কিন্তু সন্তানকে তিনি পেলেন মৃত লাশ হিসাবে। সর্বহারা এই মানুষটির হৃদয় তাই বারবার কুরে কুরে খাচ্ছে, শিশু আয়লানের সর্বশেষ আকুতি, ‘আববু তুমি মরে যেয়ো না’...।

আরেকটি ছবি তার কয়েকদিন পরের। আর মাত্র ১০০ মিটার যেতে পারলেই কূলে উঠতে পারবে। হঠাৎ নৌকাটি ডুবতে শুরু করল। বুকে ধরা শিশুপুত্রের চোখ বন্ধ ছবি ও যুবক পিতার বাঁচার আকুতিভরা সেই করুণ চিত্র বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়ে গেল। কিন্তু এগুলি কি বিশ্বনেতাদের হৃদয় টলাতে পেরেছে? হ্যাঁ, মৃত শিশু আয়লানের মর্মন্তুদ ছবি ইউরোপিয় নেতাদের বদ্ধ দুয়ার ক্ষণিকের জন্য খুলে দিয়েছিল। তাতে লাখ খানেক সিরীয় শরণার্থী জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় পেয়েছিল। কিন্তু এখন তারা আবার কঠোরতা আরোপ করছে। অথচ সিরীয় সংকটের মূলে ইউরোপীয়রাই দায়ী। তাদের নেতা আমেরিকা ২০০৩ সালে ইরাকের তৈল লুট করার হীন উদ্দেশ্যে সেখানে হামলা করার অজুহাত সৃষ্টির জন্য মিথ্যা অভিযোগ তোলে যে, ইরাকে জনবিধ্বংসী মারণাস্ত্র লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর ইরাকীদের বিভক্ত করার জন্য সেখানে শী‘আ-সুন্নী দ্বন্দ্ব উস্কে দেয়। অথচ এটা সেখানে কোনদিন কোন ইস্যু ছিল না। সাদ্দামের অনেক ব্যাটালিয়ন শী‘আ যোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত ছিল। যারা ১৯৮০-৮৮ সালে ইরাক-ইরান যুদ্ধ করেছে।

একই ডিভাইড এন্ড রুল (বিভক্ত কর ও শাসন কর) পলিসি তারা সিরিয়াতেও শুরু করে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী সাড়া জাগানো ‘উইকিলিক্সে’ ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী ২০০৬ সালে দামেষ্কে কর্মরত মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম রোবাকের তারবার্তা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমেরিকা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য সরকারের ভিতরে ক্যু সৃষ্টির চেষ্টা চালায় এবং বাইরে জনগণের মধ্যে শী‘আ-সুন্নী বিভেদকে উত্তেজিত করে। যাতে শান্ত দেশটিতে অশান্তির আগুন জ্বলে ওঠে। আর যাতে এজন্য ইরানকে এবং সঊদী আরব ও মিসরকে দায়ী করা যায়। পরবর্তীতে সেটাই হয়। ২০১১ সালে কথিত আরব বসন্তের সময় থেকে সঊদী আরব ও কাতার এমনকি তুরষ্ক সুন্নী সন্ত্রাসীদের এবং ইরান শী‘আ সন্ত্রাসীদের অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে লালন করতে থাকে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বাশার সরকারের বিরুদ্ধে এবং রাশিয়া বাশারের পক্ষে মাঠে নামে। সেই সাথে আইএস নামক এক ভয়ংকর দৈত্য সৃষ্টি করে তাদের নৃশংসতম কর্মকান্ডগুলি ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রচার করে বিশ্বব্যাপী ‘ইসলামী সন্ত্রাস’ নামের জুজুর ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে নো ফ্লাই জোন সৃষ্টি করে একচেটিয়াভাবে টন কে টন বোমা ফেলে লিবিয়ার ন্যায় ইরাক ও সিরিয়া সহ পুরা মধ্যপ্রাচ্যকে ধ্বংস অথবা বগলদাবা করা যায়। ২০১১ সাল থেকে সৃষ্ট সিরীয় সংকটে সেদেশের ২ কোটি ৩০ লক্ষ অধিবাসীর মধ্যে ইতিমধ্যে প্রায় পৌনে এক কোটির বেশী মানুষ হতাহত ও দেশছাড়া হয়েছে। বাকীরা মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সবকিছু হারিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমাচ্ছে। পথিমধ্যে ভূমধ্যসাগরে প্রতিদিন বহু শরণার্থীর সলিল সমাধি ঘটছে।

সঊদী আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরায়েন, আরব আমিরাত প্রভৃতি ধনকুবের মুসলিম রাষ্ট্রগুলি নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করছে। অথচ  আগামী ২০২২ সালে বিশ্ব অলিম্পিকের ভেন্যু তৈরীর জন্য কাতার শত শত কোটি ডলার ব্যয় করছে। অন্যদিকে ইরান তার লালিত হাউছী সন্ত্রাসীদের মাধ্যমে ইয়ামনে সুন্নীদের হত্যা করছে। তার বিরুদ্ধে গত মার্চ থেকে সঊদী জোটের বিমান হামলায় প্রতিদিন সেখানে গড়ে ৪টি শিশু নিহত ও ৫টি শিশু পঙ্গু হচ্ছে। ফলে দলে দলে মানুষ দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। সাগরতীরে পড়ে থাকা মৃত শিশু আয়লান কি সেই নিহত শিশুদের প্রতিনিধি নয়?

লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যায় যখন দেখি সংকটের রাজনৈতিক সমাধান বাদ দিয়ে হোয়াইট হাউসে মার্কিন প্রেসিডেন্টের পাশে বসে আছেন হারামাইন শরীফাইনের খাদেম বাদশাহ সালমান দু’টি ফ্রিগেট খরিদ করার জন্য। মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা ভুলে গেছেন যে, কিছুদিন আগেও তারা ছিলেন মিসকীন। শুষ্ক মরুর বুক থেকে আল্লাহর রহমতের ফল্গুধারা তৈল বিক্রয়লব্ধ পয়সা আল্লাহর শত্রুদের হাতে তুলে দিয়ে তারা আজ তাদের কাছ থেকে খরিদ করছেন নিজেদের জন্য মারণাস্ত্র। নিজের ভাল পাগলেও বুঝে। সিরিয়া ও ইয়ামনে যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা না করে সঊদী বাদশাহ এখন জার্মানীতে আশ্রয় নেওয়া সিরীয় মুসলমানদের জন্য সেদেশে ২০০ মসজিদ তৈরীর প্রস্তাব দিয়েছেন। এটা কি তাদের সাথে মসকরা নয়? এখন তারা সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ইউরোপীয়দের প্রতি আহবান জানাচ্ছেন। এটাই কি তাহ’লে সমাধান? অথচ সিরীয়রা ইতিপূর্বে কখনো উদ্বাস্ত্ত হয়নি। যেখানে বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট উরুগুয়ের নেতা হোসে মুজিকা সিরীয় ইয়াতীম শিশুদের জন্য তাঁর বাড়ী ছেড়ে দিচ্ছেন, সেখানে সঊদীআরবের অনাবাদী বিশাল ভূখন্ড এবং রাজ পরিবারের শত শত প্রাসাদ কোন্ কাজে লাগছে? সম্প্রতি হারাম শরীফে অসময়ে প্রচন্ড ধূলিঝড় ও বজ্রপাত ও তাতে ক্রেন ভেঙ্গে কয়েকশ’ হাজীর হতাহত হওয়া কি আল্লাহর গযব নয়? ঐ গযব হারামের পাশে সঊদী বাদশাহর প্রাসাদে পড়া আদৌ অসম্ভব ছিল না। কিন্তু পড়েনি কেবল হুঁশিয়ার করার জন্য। অতএব হে ইরান! হে সালমান! তোমরা সাবধান হও! ইহূদী-নাছারা চক্রান্তের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে এসো। অস্ত্র ফেলে দাও। আল্লাহর উপর পূর্ণভাবে ভরসা কর। শী‘আ-সুন্নী বিদ্বেষ ভুলে যাও। আদর্শকে আদর্শ দিয়ে মোকাবিলা কর। হে আল্লাহ! তুমি বিপন্ন মানবতাকে রক্ষা কর- আমীন! (স.স.)