আলোর পথ

আল্লাহ বলেন,

اللهُ وَلِيُّ الَّذِينَ آمَنُوا يُخْرِجُهُمْ مِنَ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا أَوْلِيَاؤُهُمُ الطَّاغُوتُ يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-

‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে, আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে অন্ধকার হ’তে আলোর দিকে বের করে আনেন। আর যারা অবিশ্বাস করেছে, শয়তান তাদের অভিভাবক। তারা তাদেরকে আলো থেকে বের করে অন্ধকারের দিকে নিয়ে যায়। ওরা হ’ল জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৫৭)

ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, অত্র আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ আমাদের খবর দিচ্ছেন যে, তার সন্তুষ্টির সন্ধানীদের তিনি শান্তির রাস্তাসমূহ দেখাবেন। অতঃপর তিনি বিশ্বাসী বান্দাদেরকে অবিশ্বাস, সন্দেহবাদ ও দ্বিধা-সংকোচের অন্ধকার থেকে বের করে সত্যের স্পষ্ট, উজ্জ্বল, প্রকাশ্য ও উদ্ভাসিত সরল পথের দিকে নিয়ে যাবেন। পক্ষান্তরে অবিশ্বাসীদের অভিভাবক হ’ল শয়তানেরা। যারা মানুষের মূর্খতা ও পথভ্রষ্টতাকে শোভনীয় করে দেখায়। এর মাধ্যমে তারা তাদেরকে সত্যের পথ থেকে বের করে নেয় এবং সেখান থেকে সরিয়ে অবিশ্বাস ও অপবাদের দিকে নিয়ে যায়।

আর সেকারণ এখানে আল্লাহ ‘নূর’ বা আলো-কে এক বচন এবং ‘যুলুমাত’ বা অন্ধকারকে বহু বচনে উল্লেখ করেছেন। কেননা সত্য এক এবং অবিশ্বাসের পথ বহু। যার সবই মিথ্যা। যেমন আল্লাহ বলেছেন,

وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ-

‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)। এভাবে আল্লাহ সর্বত্র সত্যের পথ একটাই এবং মিথ্যর পথ অগণিত বলেছেন (তাফসীর ইবনু কাছীর)

আলোচ্য আয়াতে আল্লাহ তাঁর প্রতিপক্ষ হিসাবে ‘তাগূত’-এর কথা বলেছেন। যা একবচন ও বহুবচন উভয় অর্থে ব্যবহৃত হয় (কুরতুবী)। সেকারণ এখানে ক্রিয়াপদ বহুবচন হয়েছে এবং বলা হয়েছে, يُخْرِجُونَهُمْ مِنَ النُّورِ إِلَى الظُّلُمَاتِ ‘তারা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকার সমূহের দিকে নিয়ে যায়’। অতঃপর পরিণতি হিসাবে বলা হয়েছে যে, তারা সবাই জাহান্নামের অধিবাসী এবং সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’।

এতে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, তাগূত ও তার অনুসারীরা সবাই জাহান্নামের অধিবাসী হবে। আর ‘তাগূত’ হ’ল শয়তান ও তার সাথীরা। যারা আলোর পথের অনুসারী মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে। এরা জিন ও ইনসান দুই জাতি থেকে হয়ে থাকে। জিন শয়তান মনের মধ্যে খটকা সৃষ্টি করে। আর মানুষ শয়তান সরাসরি সামনে এসে পথভ্রষ্ট করে।

الطَّاغُوتُ এসেছে طُغْيَانٌ মাছদার থেকে। যার অর্থ সীমা অতিক্রম করা, অবাধ্যতা করা ইত্যাদি। যেমন আল্লাহ নূহের প্লাবণ সম্পর্কে বলেন,إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ ‘যখন পানি সীমা ছাড়িয়ে গেল, তখন আমরা তোমাদের নৌকায় উঠিয়ে নিলাম’ (হা-ক্কাহ ৬৯/১১)। জাহান্নামীদের দু’টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে আল্লাহ বলেন, فَأَمَّا مَنْ طَغَى- وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا- فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى- ‘অতঃপর যে ব্যক্তি সীমা লংঘন করল’ ‘এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিল’, ‘জাহান্নাম তার ঠিকানা হবে’ (নাযে‘আত ৭৯/৩৭-৩৯)

আলোচ্য আয়াতে ‘তাগূত’ অর্থ হ’ল সীমালংঘনের মাধ্যম آلة الطغيان যাকে দেখে বা পূজা করে বা অনুসরণ করে মানুষ সীমালংঘন করে এবং আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হয়। এগুলি বিভিন্ন হ’তে পারে। যেমন মূর্তি, ছবি, প্রতিমূর্তি, পূজার স্থান বা বেদী, নেতা বা অনুরূপ যেকোন ব্যক্তি বা বস্ত্ত। যা মানুষকে আলোর পথ থেকে অন্ধকারের পথে নিয়ে যায়।

কুরআনে তাগূত (الطَّاغُوتُ) শব্দটি ৮ জায়গায় এসেছে। বাক্বারাহ ২৫৬, ২৫৭; নিসা ৫১, ৬০, ৭৬; মায়েদাহ ৬০; নাহল ৩৬ ও যুমার ১৭। সব স্থানেই তাগূতকে আল্লাহর বিরুদ্ধে পেশ করা হয়েছে। সেই সাথে তাদের পরিচয়ও দেওয়া হয়েছে। যেমন নিসা ৫১ আয়াতেيُؤْمِنُونَ بِالْجِبْتِ وَالطَّاغُوت ‘তারা প্রতিমা ও শয়তানের উপর ঈমান আনে’ বলে উভয়টিকে ‘তাগূত’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। ইহূদী-নাছারা প্রভৃতি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের কাছে ইলাহী কিতাব তাওরাত-ইনজীল থাকা সত্ত্বেও তারা ধর্মের নামে মূর্তিপূজারী হয়েছে। এতবড় পাপ করেও তারা দাবী করত যে তারা মুসলমানদের তুলনায় অধিক সরল পথে রয়েছে (ঐ)। শয়তান তাদেরকে চমৎকার যুক্তি ও আকর্ষণীয় কথাবার্তার মাধ্যমে এমনভাবে হতবুদ্ধি করেছিল যে, বড় বড় ধর্মনেতা ও সমাজ নেতারা অবলীলাক্রমে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের হাতে গড়া প্রাণহীন একটা মূর্তির সামনে গিয়ে প্রণত হ’ত ও তার কাছে প্রার্থনা জানাতো।

এ যুগের মুসলিম ধর্মনেতারা মৃত ব্যক্তির কবরে গিয়ে একইভাবে প্রার্থনা করছে ও সেখানে নযর-নিয়ায পেশ করছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক নেতারা তাদের মূল নেতার কবরে গিয়ে শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাচ্ছে। তাদের ছবি-প্রতিকৃতিতে ফুল দিচ্ছে ও সেখানে গিয়ে নীরবে দু’মিনিট দাঁড়িয়ে থাকছে। মানুষ হত্যা করলেও বিচার নেই। কিন্তু নেতার ছবির অবমাননা করলে বা মূর্তির গায়ে ঢিল মারলে জীবন হারাতে হবে অথবা কারাগারে যাওয়াটা নিশ্চিত। আল্লাহর বিধান মানাটা ঐচ্ছিক। কিন্তু নেতাদের মনগড়া বিধান মান্য করা আবশ্যিক। শয়তানের প্ররোচনায় এরাই পথভ্রষ্ট মানুষের সর্বাধিক ভালবাসা পায়। এমনকি আল্লাহর চাইতে মানুষ তাদেরকেই বেশী ভালবাসে। কারণ জিন ও মানুষ শয়তানেরা তাদের ভক্তদের বুঝিয়েছে যে, এদের খুশীতে আল্লাহ খুশী। এদের অসীলাতেই মুক্তি। এমনকি বিনা চেষ্টায় মামলা খালাস। বিনা লেখায় পরীক্ষায় পাস। কেননা যে আল্লাহর হুকুমে পরীক্ষক একজনকে ১০০-এর মধ্যে ৯০ দেন। সেই আল্লাহর হুকুমে তিনি ‘শূন্য’ পাওয়া ছাত্রকে ১০০ দিতে পারেন। এরূপ নানাবিধ অপযুক্তির মাধ্যমে ধর্মের বেশধারী মানবরূপী শয়তানেরা ঈমানদারগণকে আল্লাহর পথে সংগ্রাম করা ও তাঁর বিধানসমূহ মান্য করা থেকে বিমুখ করে। কর্মস্পৃহ মানুষকে নিষ্কর্মা করে। উদ্যমীকে হতোদ্যম করে। আশান্বিতকে আশাহত করে।

আল্লাহ বলেন,وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللهِ وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ وَلَوْ يَرَى الَّذِينَ ظَلَمُوا إِذْ يَرَوْنَ الْعَذَابَ أَنَّ الْقُوَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا وَأَنَّ اللهَ شَدِيدُ الْعَذَابِ- ‘আর মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে, যারা অন্যকে আল্লাহর সমকক্ষ সাব্যস্ত করে। তারা তাদেরকে ভালোবাসে আল্লাহকে ভালোবাসার ন্যায়। কিন্তু যারা ঈমানদার তারা আল্লাহর জন্য সর্বাধিক ভালোবাসা পোষণ করে থাকে। আর যালেমরা (মুশরিকরা) যদি জানত যখন তারা আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে যে সমস্ত ক্ষমতা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহ কঠোর শাস্তিদাতা (তাহ’লে তারা শিরকের ক্ষতিকারিতা ব্যাখ্যা করে দিত)। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কঠিন শাস্তি দাতা’ (বাক্বারাহ ২/১৬৫)

ইমাম রাযী (৫৪৩-৬০৬ হি.) অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, আল্লাহর সমকক্ষ বা ‘আনদাদ’ কারা সে বিষয়ে বিদ্বানগণ বিভিন্ন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। অধিকাংশ বিদ্বান বলেছেন, এর অর্থ মূর্তি ও প্রতিমা। দ্বিতীয় হ’ল, ধর্ম ও সমাজ নেতারা। মানুষ যাদের অনুসরণ করে এবং হারামকে হালাল করে। এই দলের বিদ্বানগণ পূর্বেরটির উপর এটিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন তিনটি কারণে। (১) ‘তারা তাদেরকে ভালবাসে আল্লাহকে ভালবাসার ন্যায়’ বাক্যে ‘তাদেরকে’ সর্বনামটি প্রাণীর জন্য প্রযোজ্য, প্রাণহীন মূর্তির জন্য নয়। (২) তারা জানে যে, মূর্তি একটি প্রাণহীন বস্ত্ত মাত্র। যা কোন ক্ষতি বা উপকার করতে পারে না। (৩) এই আয়াতের পরেই আল্লাহ বলেছেন, ‘যেদিন অনুসরনীয়রা অনুসারীদের থেকে পৃথক হয়ে যাবে এবং আযাবকে প্রত্যক্ষ করবে’ (বাক্বারাহ ২/১৬৬)। এটাতো কেবল ঐ সময় সম্ভব যখন কাউকে মানুষ আল্লাহর সমকক্ষ হিসাবে গ্রহণ করবে। যাদের প্রতি মানুষ ঐরূপ আনুগত্য ও সম্মান প্রদর্শন করবে, যেরূপ করা উচিত ছিল আল্লাহর প্রতি’।[1]

অন্ধকারের লোকদের আকর্ষণীয় যুক্তিসমূহ

(১) বাপ-দাদাদের বিধান মান্য করা :

যখন তাদের বলা হয়, অহি-র বিধান মেনে চল। তখন তারা বলে, বরং আমরা আমাদের বাপ-দাদার বিধানসমূহ মেনে চলব (বাক্বারাহ ২/১৭০)। এর বাইরে তারা কিছুই শুনতে চায় না। ইমাম রাযী বলেন, এটাই হ’ল তাক্বলীদ। এর মধ্যে কয়েকটি বিষয় রয়েছে। (ক) যদি ঐ মুক্বাল্লিদকে বলা হয় যে, অন্যের তাক্বলীদ তখনই সিদ্ধ, যখন জানা যাবে যে, ঐ ব্যক্তি হক-এর উপর আছে। এক্ষণে যদি তুমি তা না জানো, তাহ’লে কিভাবে তার তাক্বলীদ জায়েয হবে? আর যদি জানো যে, ঐ ব্যক্তি হক-এর উপর আছে, তাহ’লে তোমার তাক্বলীদের প্রয়োজন কি?

যদি তুমি বল যে, ওসব আমার জানার বিষয় নয়। তাহ’লে তুমি স্বীকার করে নিলে যে, মিথ্যার অনুসরণ করা সিদ্ধ। এটির প্রতিবাদেই আয়াতের শেষে আল্লাহ বলেছেন, ‘তারা আল্লাহর বিধান ছেড়ে তাদের বাপ-দাদাদের রীতি-নীতি অনুসরণ করে। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই বুঝেনা বা হেদায়াতের উপর থাকেনা’। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘যদিও শয়তান তাদেরকে জাহান্নামের শাস্তির দিকে আহবান করে’ (লোকমান ৩১/২১)

এখানে পথভ্রষ্ট বাপ-দাদাকে আল্লাহ সরাসরি শয়তান বলেছেন। অতএব অহি-র বিধানের বাইরে সবকিছুই শয়তাদের পথ। অত্র আয়াতে দলীলের অনুসরণের প্রতি তীব্র তাকীদ রয়েছে। যেন তারা বে-দলীল কোন কথা না মানে’।[2]

(২) ধর্মনেতাদের মনগড়া বিধান মান্য করা :

আল্লাহ বলেন,اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلاَّ لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لاَ إِلَهَ إِلاَّ هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ- (التوبة 31)- ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদত করবে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি সে সব থেকে পবিত্র’ (তওবা ৯/৩১)

‘আদী বিন হাতেম বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে এলাম, তখন আমার গলায় স্বর্ণ (বা রৌপ্যের) ক্রুশ ঝুলানো ছিল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, ‘তোমার গলা থেকে ঐ মূর্তিটা ফেলে দাও। এ সময় তিনি সূরা তওবাহর ৩১ আয়াতটি পাঠ করছিলেন। যেখানে বলা হয়েছে,اتَّخَذُوْا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ ‘ইহূদী-নাছারাগণ আল্লাহকে ছেড়ে তাদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে’। তখন আমি বললাম, لَسْنَا نَعْبُدُهُمْ ‘আমরা ওদের ইবাদত করি না’। রাসূল (ছাঃ) বললেন,أَلَيْسَ يُحَرِّمُوْنَ مَا أَحلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّونَ مَا حرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّونَهُ؟ ‘তোমরা কি ঐসব বস্ত্তকে হারাম করো না, যা আল্লাহ হালাল করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হারাম করে? তোমরা কি ঐসব বস্ত্ত হালাল করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন? অতঃপর লোকেরাও তা হালাল করে? ‘আদী বললেন, হ্যাঁ। রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[3]

উক্ত হাদীছের ও কুরআনী আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) ও যাহহাক বলেন,لَمْ يَأْمُرُوهُمْ أَنْ يَسْجُدُوا لَهُمْ، وَلَكِنْ أَمَرُوهُمْ بِمَعْصِيَةِ اللهِ، فَأَطَاعُوهُمْ، فَسَمَّاهُمُ اللهُ بِذَلِكَ أَرْبَابًا. ‘ইহূদী-নাছারাদের সমাজনেতা ও ধর্মনেতাগণ তাদেরকে সিজদা করার আদেশ দেননি। বরং তারা তাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার কাজে নির্দেশ দিতেন এবং তারা তা মান্য করত। সেকারণ আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[4]

রবী‘ বলেন, আমি আবুল ‘আলিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, বনু ইস্রাঈলের মধ্যে রুবূবিয়াত কিভাবে প্রবেশ করল? তিনি বললেন, তারা যখন আল্লাহর কিতাবে তাদের ধর্মনেতাদের ফৎওয়া বিরোধী কিছু পেত, সেগুলিকে তারা প্রত্যাখ্যান করত। রাযী বলেন, আমাদের শায়েখ ও উস্তাদ বলেছেন, আমি একদল মুক্বাল্লিদকে দেখেছি, যখন তাদের সামনে আমি আল্লাহর কিতাব থেকে কোন আয়াত তেলাওয়াত করেছি যা তাদের মাযহাবের বিরোধী, সেগুলি তারা কবুল করেনি। বরং বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, কিভাবে এইসব আয়াতের উপর আমল করা সম্ভব? অথচ আমাদের পূর্ববর্তীদের থেকে এর বিপরীত ফৎওয়া চলে আসছে? হে পাঠক! তুমি যদি গভীরভাবে দেখ, তবে দেখতে পাবে যে, এই ব্যাধি বিশ্ববাসীদের অধিকাংশের মধ্যে রয়েছে।

রুবূবিয়াতের দ্বিতীয় ব্যাখ্যা হ’ল এই যে, কিছু জাহিল ও বাজে লোক তাদের শায়েখদের ও নেতাদের প্রতি সম্মানে বাড়াবাড়ি করে। ফলে তারা হুলূল ও ইত্তিহাদের ধারণায় বিশ্বাসী হয়ে পড়ে। হুলূল অর্থ স্বয়ং আল্লাহ তার দেহে প্রবেশ করেন এবং ইত্তিহাদ হ’ল আল্লাহ ও বান্দা এক হয়ে যাওয়া। তখন ঐ শায়েখ যদি দুনিয়াদার হয় ও দ্বীন থেকে দূরের হয়, তখন সে তার শাগরিদ ও ভক্তদের তার প্রতি সিজদার আহবান জানায়। হুলূল ও ইত্তিহাদের ধোঁকায় ফেলে সে অনেক সময় নিজেকে ইলাহ দাবী করে। যদি এটা এই উম্মতের পক্ষে সম্ভব হয়, তাহ’লে পূর্বের উম্মতগুলির পক্ষে কেন সম্ভব হবে না? বরং পূর্বের উম্মতের ব্যাধিগুলির সবই এই উম্মতের মধ্যে আছে’।[5]

ইমাম শাওকানী (১১৭৩-১২৫০ হি.) ও ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালী (১২৪৮-১৩০৭ হি.) বলেন, কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিরোধিতা সত্ত্বেও এই উম্মতের মুক্বাল্লিদ লোকেরা ইহূদী-নাছারাদের মত আচরণ করে। উভয়ের পারস্পরিক সামঞ্জস্য যেমন ডিমের সাথে ডিমের, খেজুরের সাথে খেজুরের ও পানির সাথে পানির।

অতএব হে আল্লাহর বান্দারা! হে মুহাম্মাদ ইবনে আব্দুল্লাহর অনুসারীরা! তোমাদের কি হ’ল যে, তোমরা কিতাব ও সুন্নাহকে একপাশে রেখে দিলে। আর তোমাদেরই মত মানুষের দিকে রুজূ হ’লে? তোমরা তাদের মনগড়া বিধানসমূহের অনুসারী হ’লে? কিতাব ও সুন্নাতে যার ভিত্তি নেই এমনসব  কাজ তোমরা করছ। আর তাদের তোমরা ডাকছ সর্বোচ্চ ভক্তির সাথে?[6] নূহ (আঃ)-এর সময়কার প্রধান প্রধান ধর্মনেতা অদ, সুওয়া‘, ইয়াগূছ, ইয়া‘ঊক্ব ও নাসরের কথা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে’ (নূহ ৭১/২৩)

(৩) সমাজ নেতা :

সচেতন ও যোগ্য লোকেরাই সাধারণতঃ সমাজনেতা হয়ে থাকেন। সমাজ পরিচালনার জন্য এটা আল্লাহরই প্রদত্ত্ব সৃষ্টিগত বিধান। পশু-পক্ষীর মধ্যেও এমনকি পানিতে ও জঙ্গলে সর্বত্র সকল প্রাণীর মধ্যে আল্লাহর এ বিধান কার্যকর রয়েছে। এরা স্বভাবধর্ম অনুযায়ী আল্লাহর বিধান মতে চললে সমাজ সুন্দর ভাবে চলে। আর বিপথে গেলে সমাজ বিপথে যায়। পৃথিবীর এই সুন্দর ব্যবস্থাপনাকে বিশৃংখল ও বিনষ্ট করার জন্য শয়তান এদের পিছনে কাজ করে থাকে। এরা পার্থিব লোভ-লালসা ও মন ভুলানো যুক্তি সমূহের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। প্রত্যেক নবীর যুগে এরাই ছিল অহি-র বিধানের সবচেয়ে বড় বিরোধী। যেমন আল্লাহ বলেন, وَكَذَلِكَ جَعَلْنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوًّا شَيَاطِينَ الْإِنْسِ وَالْجِنِّ يُوحِي بَعْضُهُمْ إِلَى بَعْضٍ زُخْرُفَ الْقَوْلِ غُرُورًا وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ مَا فَعَلُوهُ فَذَرْهُمْ وَمَا يَفْتَرُونَ ‘এভাবে আমরা প্রত্যেক নবীর জন্য মানুষ ও জিনের মধ্য থেকে বহু শয়তানকে শত্রুরূপে নিযুক্ত করেছি। তারা প্রতারণার উদ্দেশ্যে একে অপরকে চাকচিক্যপূর্ণ কথা দ্বারা প্ররোচনা দেয়। যদি তোমার প্রভু চাইতেন, তাহ’লে তারা এটা করতে পারতো না। অতএব তুমি ওদেরকে ও ওদের মিথ্যা অপবাদসমূহকে ছেড়ে চল’ (আন‘আম ৬/১১২)

সমাজে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার কারণে তার দোহাই দিয়ে এরা নবীদের আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চাইত। সেকারণ উক্ত আয়াতের পরপরই আল্লাহ স্বীয় শেষনবীকে সাবধান করে দিয়ে বলেন,وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ ‘যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)

অতঃপর অহি-র বিধান যে চূড়ান্ত সত্য ও ন্যায়ের উৎস, সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকার জন্য আল্লাহ স্বীয় নবীকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়ে দিয়ে বলেন,وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلاًّ لاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ ‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর বাণীর পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)।  

বিশ্বের প্রথম রাসূল নূহ (আঃ)-কে আল্লাহর সত্যবাণী প্রচারের অপরাধে (?) ইবলীসের শিখন্ডী এইসব সমাজ নেতারাই নির্যাতন করত। এরাই লোকদের বলেছিল,لاَ تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ ‘তোমরা তোমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করো না’ (নূহ ৭১/২৩)। এভাবে তারা বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছিল (নূহ ৭১/২৪)। এমনকি অতুলনীয় রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী নবী ইউসুফ, দাঊদ ও সুলায়মান (আঃ)-এর বিরুদ্ধে এরাই মিথ্যা ও নোংরা অপবাদ সমূহ আরোপ করেছিল। যাতে মানুষ নবীদের অনুসরণ না করে এইসব দুনিয়া সর্বস্ব সমাজ নেতাদের অনুসারী হয়। আজও দেশে দেশে অহি-র বিধান পালনে এরাই সমাজ জীবনে সবচেয়ে বড় বাধা। যদিও তারা মুখে বলে প্রত্যেকের ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখা হবে। এটা তারা অন্যের ক্ষেত্রে উৎসাহের সাথে প্রদর্শন করে থাকে। এমনকি ইসলামের নামে বিভিন্ন শিরকী ও বিদ‘আতী পর্বে ও অনুষ্ঠানে এদের বিশেষ উৎসাহ দেখা যায়। কিন্তু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকৃত ইসলামের বিরুদ্ধে এরা সদা খড়গহস্ত।

(৪) রাষ্ট্রনেতা :

অন্ধকার জগতের সবচেয়ে বড় নায়ক হলেন দুনিয়াদার রাষ্ট্রনেতারা। সেকারণ দরসে উল্লেখিত আয়াতের পরেই আল্লাহ ইরাকের সম্রাট নমরূদের সাথে ইবরাহীম (আঃ)-এর বাদানুবাদের ঘটনা উল্লেখ করেছেন (বাক্বারাহ ২/২৫৮)

রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারীরা সাধারণতঃ অহংকারী হয়ে থাকে। তারা মনে করে ‘আমাদের চাইতে ক্ষমতাশালী আর কে আছে? (হামীম সাজদাহ ৪১/১৫)। যখন তাদের বলা হয় আল্লাহকে ভয় কর, তখন পদমর্যাদার অহংকার তাদেরকে পাপে স্ফীত করে (বাক্বারাহ ২/২০৬)। এই ক্ষমতাকে আল্লাহ বিরোধী পথে লাগানোর জন্য শয়তান তার যাবতীয় ক্রিয়া-কৌশল প্রয়োগ করে। নমরূদ ও ফেরাঊনের সভাসদরা যেমন সেযুগে দুষ্কর্ম করেছে, এযুগেও তেমনি আল্লাহবিরোধী রাষ্ট্রনেতারা তাদের সভাসদগণের মাধ্যমে দুষ্কর্মসমূহ করে থাকে। তারা নিজেদের মনগড়া বিধান অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করে। আল্লাহর বিপক্ষে কাজে লাগানোর জন্য শয়তান এদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বেছে নেয়। দেশের সর্বত্র এদের মাধ্যমে খুব সহজে কুফর ও জাহেলিয়াত ছড়িয়ে দেওয়া হয়। আর কিছু বুদ্ধিজীবী ও কথিত সুশীল লোক এদের সহযোগী হিসাবে মিথ্যাকে সত্য করার মিশন নিয়ে ময়দানে কাজ করে। এরা অনেক সময় ইসলামের দোহাই দিয়ে যুক্তিসমূহ উপস্থাপন করে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক রয়েছে, পার্থিব জীবনে যার কথা-বার্তা তোমাকে চমৎকৃত করে এবং তার অন্তরের কথাগুলির ব্যাপারে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে। অথচ সে ভীষণ ঝগড়াটে ব্যক্তি’ (বাক্বারাহ ২/২০৪)। এরাই দেশে সমস্ত অশান্তি ও বিশৃংখলার মূল নায়ক। কিন্তু মুখে তারা শান্তির ফেরিওয়ালা হয়ে থাকে। এদের মুখোশ খুলে দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ لاَ تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ قَالُوا إِنَّمَا نَحْنُ مُصْلِحُونَ- أَلاَ إِنَّهُمْ هُمُ الْمُفْسِدُونَ وَلَكِنْ لاَ يَشْعُرُونَ- ‘যখন তাদের বলা হয়, পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করো না, তখন তারা বলে আমরা তো সংশোধনকামী’। ‘সাবধান! ওরাই হ’ল অশান্তি সৃষ্টিকারী। কিন্তু ওরা তা উপলব্ধি করে না’ (বাক্বারাহ ২/১১-১২)। আজকের অশান্ত বিশ্ব কি এদেরই সৃষ্ট নয়?

(৫) অসৎ বন্ধু ও সংগঠন :

মানুষ মানুষ ছাড়া চলতে পারে না। তাই তাকে সর্বদা বন্ধু তালাশ করতে হয়। বন্ধু যদি সৎ হয়, তাহ’লে সে সৎ হয়। আর বন্ধু অসৎ হ’লে সে অসৎ হয়। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَكُونُوا مَعَ الصَّادِقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক’ (তওবা ৯/১১৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ ‘মানুষ তার বন্ধুর রীতির উপর হয়ে থাকে। অতএব দেখ সে কার সাথে বন্ধুত্ব করছে’।[7] তিনি বলেন, الْمَرْءُ مَعَ مَنْ أَحَبَّ ‘(ক্বিয়ামতের দিন) প্রত্যেক ব্যক্তি তার বন্ধুর সাথে থাকবে’।[8] আল্লাহ বলেন,وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ ‘মুমিন নর-নারীগণ পরস্পরের বন্ধু। তারা পরস্পরকে সৎ কাজের আদেশ দেয় এবং অসৎ কাজে নিষেধ করে’ (তওবা ৯/৭১)। পক্ষান্তরে কপট বিশ্বাসীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,الْمُنَافِقُونَ وَالْمُنَافِقَاتُ بَعْضُهُمْ مِنْ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمُنْكَرِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمَعْرُوفِ وَيَقْبِضُونَ أَيْدِيَهُمْ ‘মুনাফিক পুরুষ ও নারী পরস্পরে সমান। তারা অসৎ কাজের আদেশ দেয় ও সৎকাজে নিষেধ করে এবং তাদের হাত সমূহ বন্ধ রাখে (অর্থাৎ আল্লাহর পথে ব্যয় থেকে কৃপণতা করে) (তওবা ৯/৬৭)। তিনি আরও বলেন,الَّذِينَ آمَنُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ اللهِ وَالَّذِينَ كَفَرُوا يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِ الطَّاغُوتِ فَقَاتِلُوا أَوْلِيَاءَ الشَّيْطَانِ إِنَّ كَيْدَ الشَّيْطَانِ كَانَ ضَعِيفًا ‘যারা ঈমানদার তারা লড়াই করে আল্লাহর পথে। আর যারা কাফের তারা লড়াই করে ত্বাগূতের পথে। অতএব তোমরা লড়াই কর শয়তানের বন্ধুদের বিরুদ্ধে। নিশ্চয়ই শয়তানের কৌশল অতীব দুর্বল’ (নিসা ৪/৭৬)। তিনি বলেন,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন ঐসব লোকদের যারা তাঁর পথে লড়াই করে সারিবদ্ধভাবে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছফ ৬১/৪)। অতএব অসৎ বন্ধুর নিদর্শন হ’ল, সে সর্বদা শোভনীয় কথাবার্তা ও লোভনীয় প্রস্তাবসমূহের মাধ্যমে তার বন্ধুকে আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে রাখে এবং মন্দ কর্মে প্রলুব্ধ করে।

অন্ধকার থেকে আলোর পথে :

অন্ধকারের পথসমূহ না চিনলে মানুষ তা ছেড়ে আলোর পথে আসতে পারে না। উপরের আলোচনায় সে পথগুলি চিহ্নিত করা হয়েছে। যেগুলির একমাত্র পরিণাম দুনিয়াতে ব্যর্থতা ও আখেরাতে জাহান্নাম। এক্ষণে ঐসব পথ থেকে ফিরে আসার জন্য  প্রয়োজন  কেবল  দু’টি  বস্ত্ত :  (১)  বর্জন :  অর্থাৎ অন্ধকারের পথ বুঝতে পারার সাথে সাথে তীব্র ঘৃণাসহ তা বর্জন করা এবং শয়তানকে বামে তিনবার থুক মেরে আলোর পথে ফিরে আসা। (২) গ্রহণ : অর্থাৎ পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের সুস্পষ্ট জান্নাতী পথের সন্ধান পাওয়ার সাথে সাথে তা গ্রহণ করা এবং পরিপূর্ণ রূপে আল্লাহর উপর নিজেকে সোপর্দ করা। কেননা তিনিই বান্দার হায়াত-মউত এবং রুটি-রূযী ও মান-সম্মান সবকিছুর একচ্ছত্র মালিক।

আল্লাহর উপর ভরসা করার অপার্থিব তৃপ্তি যখন সত্যসেবী মুমিন উপলব্ধি করে, দুনিয়ার ভোগবিলাস তার কাছে তুচ্ছ মনে হয়। আর তখনই সে আলোর পথে পুরোপুরি চলে আসে এবং তার দিশারী হয়ে ওঠে। আর এটাই স্বাভাবিক যে আলোর পথের অভিসারী কখনই তার অপর ভাইকে জাহান্নামের আগুনে জীবন্ত পোড়ার মর্মান্তিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারে না। ফলে সে পাগলপারা হয়ে উঠবে নিজেকে ও অন্যকে জাহান্নাম থেকে বাঁচানোর জন্য। সে তার সকল আরামকে হারাম করে ছুটবে প্রত্যেক আদম সন্তানের কাছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে সে সংগ্রাম করবে নবীগণের দেখানো পথে একাকী ও সংঘবদ্ধভাবে (তওবা ৯/৪১) সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় (ছফ ৬১/৪)। এর বিপরীত করলে পৃথিবী বিশৃংখলায় ভরে যাবে ও অগ্নিগর্ভ হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,الَّذِينَ كَفَرُوا وَصَدُّوا عَنْ سَبِيلِ اللهِ زِدْنَاهُمْ عَذَابًا فَوْقَ الْعَذَابِ بِمَا كَانُوا يُفْسِدُونَ ‘যারা (দুনিয়াতে) কুফরী করেছিল এবং আল্লাহর পথে বাধা দান করেছিল, আমরা তাদের শাস্তির উপর শাস্তি বাড়িয়ে দেব। কারণ তারা (পৃথিবীতে) অশান্তি সৃষ্টি করত’ (নহল ১৬/৮৮)

অতএব হে মানুষ! অন্ধকারের পথ ছেড়ে ফিরে এসো আলোর পথে। শয়তানের দেখানো চাকচিক্য সর্বস্ব লোভনীয় পথ ছেড়ে ফিরে এস আল্লাহর দেখানো ছিরাতে মুস্তাক্বীমের কনকোজ্জ্বল রাজপথে। আল্লাহ আমাদের হেদায়াত দান করুন- আমীন!