শান্তি ও সহিষ্ণুতার ধর্ম ইসলাম

শান্তি ও সহিষ্ণুতার ধর্ম ইসলাম

ইসলাম আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ ধর্ম। যা মানবতার সর্বশেষ আশ্রয়। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে মানবতা যখন নিষ্পিষ্ট, ধনী-গরীব, শক্তিমান ও দুর্বলের দ্বন্দ্বে সমাজ যখন বিপর্যস্ত, মানুষের সম্মান যখন সস্তায় বিক্রীত, তখন সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ সৃষ্টি জগতের প্রতি রহমত স্বরূপ প্রেরণ করলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সর্বশেষ কিতাব দিয়ে। যাতে ভূলুণ্ঠিত মানবতা পুনরায় উন্নীত হয়। শয়তানের ধোঁকা থেকে মানুষ মুক্ত হয়। পৃথিবী আবার শান্তিময় হয়। প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াত, বিজ্ঞানপূর্ণ যুক্তি, বাস্তবসম্মত উপদেশ, সর্বোচ্চ মানবিক আচরণ সবকিছুর সর্বোত্তম নমুনা হিসাবে এসেছিলেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। তাঁর কথা, কর্ম ও আচরণ সবই ছিল মানবতার পক্ষে ও পশুত্বের বিপক্ষে। আর সেজন্যেই তো স্বার্থান্ধ সমাজনেতারা তাঁকে মানেনি। তবুও তিনি পরম ধৈর্য্যের সাথে সকলের কথা শুনেছেন। সাধ্যমত দ্বন্দ্ব এড়িয়েছেন। বাধ্য হয়ে অস্ত্রধারণ করেছেন আল্লাহর হুকুমে। কিন্তু তাঁর রিসালাতের মূলনীতিই ছিল ‘দাওয়াত’। উদ্দেশ্য ছিল মানুষের বিশ্বাসের ও কর্মের পরিবর্তন ঘটানো সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে ও সর্বোত্তম পরিচর্যার মাধ্যমে। এজন্য গভীর ধৈর্য্য ও পরমতসহিষ্ণুতা ছিল তাঁর ও তাঁর সাথীদের প্রধান গুণ। মানুষের প্রতি দরদ, তাকে সাক্ষাৎ জাহান্নাম থেকে ফিরিয়ে আনার ব্যাকুল আকুতি তাঁকে করেছিল মহিয়ান। তাইতো দেখি সর্বোচ্চ অলৌকিক ক্ষমতা হাতে পেয়েও তিনি তা প্রয়োগ করেননি তাঁর জানী দুশমন মক্কা ও ত্বায়েফের ধুরন্ধর নেতাদের বিরুদ্ধে। পাহাড় সমূহের নিয়ন্ত্রক ফেরেশতার আবেদনের জবাবে নির্যাতিত রাসূল (ছাঃ) সেদিন বলেছিলেন, ‘ওদের পিষে মেরে ফেলার চাইতে আমি বরং আশা করি আল্লাহ ওদের ঔরসে এমন সন্তান জন্ম দিবেন, যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না’ (বু.মু. মিশকাত হা/৫৮৪৮)। ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধে বিজয়ের পর যুদ্ধবন্দীদের বিষয়ে তিনি ছাহাবীগণকে তাদের সাথে উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দেন। ফলে ছাহাবীগণ নিজেরা খেজুর খেয়ে বন্দীদের রুটি খাওয়ান (ইবনু হিশাম ১/৬৪৫)। ঐ সময় মদীনায় খেজুর ছিল সাধারণ খাদ্য এবং রুটি ছিল মূল্যবান খাদ্য’ (সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)। মক্কা বিজয়ের রাতে ধরা পড়া শত্রুপক্ষের নেতা আবু সুফিয়ানকে তিনি কেবল ক্ষমাই করেননি, বরং তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে বলেন, ‘যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে দিবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’ (মুসলিম, ছহীহাহ হা/৩৩৪১)। অতঃপর মক্কা বিজয় শেষে উপস্থিত কুরায়েশদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘তোমাদের বিরুদ্ধে আজ আর কোন অভিযোগ নেই। যাও তোমরা সবাই মুক্ত’ (সীরাতুর রাসূল (ছাঃ)। অথচ এইসব লোকেরা ছিলেন আজকের পরিভাষায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী। তিনি সেদিন প্রতিশোধ না নিয়ে ক্ষমা করেছিলেন। ফলে তারাই মাত্র ১৯ দিন পরের হোনায়েন যুদ্ধে এবং তারও পরে আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (১১-১৩ হি.) আজনাদায়েন ও ইয়ারমূকের যুদ্ধে ইসলামের পক্ষে অবিস্মরণীয় অবদান রাখেন। এদিকে ইঙ্গিত করেই ইংল্যান্ডের বিখ্যাত আইরিশ দার্শনিক জর্জ বার্নার্ড শ’ (১৮৫৬-১৯৫০) বলেন, ‘আমি যে সর্বদা মুহাম্মাদ-এর ধর্মকে উচ্চ দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করি। তার কারণ হ’ল এ ধর্মের বিস্ময়কর জীবনীশক্তি। আমার নিকট এটাই একমাত্র ধর্ম যা পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা রাখে। ফলে সকল যুগেই সমানভাবে তার আবেদন বজায় রাখতে পারে। আমি তাঁকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছি। একজন বিস্ময়কর মানুষ তিনি এবং আমার মতে তাঁকে এন্টি-ক্রাইস্ট বা যীশু-বিরোধী না বলে অবশ্যই আখ্যায়িত করা উচিৎ ‘সেভিয়ার অব হিউম্যানিটি’ বা ‘মানবতার ত্রাণকর্তা’ হিসাবে। আমি বিশ্বাস করি তাঁর মত একজন মানুষ যদি আধুনিক বিশ্বের একনায়ক শাসক হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করতেন, তাহ’লে তিনি আধুনিক বিশ্বের যাবতীয় সমস্যার সমাধান এমনভাবে করতে সক্ষম হ’তেন, যা সেই অতি কাংখিত সুখ ও শান্তি বয়ে নিয়ে আসত। আমি মুহাম্মাদ-এর ধর্ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করছি যে, এটা আগামীর ইউরোপের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে যেমনিভাবে তা ইতিমধ্যেই বর্তমান ইউরোপে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে শুরু করেছে’। তিনি আরও বলেন, If any religion had the chance of rulling over England, nay Europe within the next hundred years, it could be Islam. ‘যদি কোন ধর্ম আগামী ১০০ বছরের মধ্যে ইংল্যান্ড তথা সমগ্র ইউরোপ শাসন করার সুযোগ পায়, তবে সেটা হ’তে পারে ইসলাম’ (The Genuine Islam Vol. 1, No. 8, 1936)।  

খলীফা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (১৩-২৩ হি.)-এর সময়ে বায়তুল মুক্বাদ্দাস বিজয়ের প্রাক্কালে খ্রিষ্টান নেতারা শর্ত দিল যে, খলীফাকে রাজধানী ছেড়ে এখানে আসতে হবে। তখন খলীফা ওমর হযরত ওছমানের সাথে পরামর্শ করলেন। তিনি বললেন, এটা হীনকর শর্ত। অতএব তাদের উপর অবরোধ আরোপ করুন। যাতে তারা সন্ধিতে বাধ্য হয়। অতঃপর তিনি আলী (রাঃ)-এর নিকট পরামর্শ নিলেন। তিনি বললেন, অবরোধে সময় ক্ষেপণ ও লোকক্ষয়ের সম্ভাবনা বেশী। তার চেয়ে আপনার যাওয়াটাই উত্তম হবে। খলীফা শেষোক্ত পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং আলী (রাঃ)-কে খেলাফতের দায়িত্ব দিয়ে তিনি যেরুযালেম যাত্রা করলেন। অতঃপর একটি পানির ঘাটে, যেখানে খ্রিষ্টান নেতারা অপেক্ষা করছিলেন, সেখানে পৌঁছে তিনি উট থেকে নেমে পায়ের মোযা খুলে ঘাড়ে রেখে উটের লাগাম ধরে হাঁটতে শুরু করেন। এটা দেখে সেনাপতি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) এতে আপত্তি করেন। জবাবে খলীফা বলেন, ‘আমরা ছিলাম নিকৃষ্ট জাতি। অতঃপর আল্লাহ আমাদেরকে ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। অতএব যে কারণে আল্লাহ আমাদের মর্যাদা দান করেছেন, তা ছেড়ে অন্য কিছুর মাধ্যমে সম্মান তালাশ করলে আল্লাহ আমাদেরকে লাঞ্ছিত করবেন’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘আমরা সেই জাতি যাদেরকে আল্লাহ ইসলামের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এর বাইরে অন্য কিছুর মাধ্যমে আমরা সম্মান চাই না’ (হাকেম হা/২০৮; ছহীহাহ হা/৫১; আল-বিদায়াহ ৭/৫৫ পৃ.)। আমেরিকান কুটনীতিবিদ ও ইতিহাসবিদ ওয়াশিংটন ইরভিং (১৭৮৩-১৮৫৯) বলেন, If he aimed at a universal dominion, it was the dominion of faith ‘মুহাম্মাদ যদি বিশ্বজনীন আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নির্ধারণ করে থাকেন, তবে সেটা ছিল বিশ্বাসের আধিপত্য’ (Washington Irving, 'Mahomet and His Successors', New York, 1920)। আজও ইসলাম বিশ্ব জয় করতে পারে, দৃঢ় ঈমানী শক্তির জোরে, কেবল অস্ত্র শক্তির জোরে নয়। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)