উন্মত্ত হিংসার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ

গত ১৬ই ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানের পেশোয়ার শহরে সেনাবাহিনী পরিচালিত স্কুলে ‘তাহরীকে তালেবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) হামলায় বার্ষিক পরীক্ষারত ১৩২ জন শিশু-কিশোর শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক-অভিভাবক ও কর্মকর্তা মিলে ১৪৫ জনের নৃশংস হত্যাকান্ডে আমরা গভীর ভাবে দুঃখিত ও মর্মাহত। আমরা এ ঘটনার নায়কদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও নিন্দা জানাই। হিংস্র মানুষ যে হিংস্র পশুর চাইতে নিকৃষ্ট এটা তার অন্যতম প্রমাণ। ঘটনার নায়ক ছয়জন আত্মঘাতিকে তাদের নেতারা শহীদ ও জাতীয় বীর আখ্যা দিয়েছে এবং আরও এরূপ হামলা হবে বলে পাকিস্তান সরকারকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে। ওদিকে পাক সেনাপ্রধান ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ৩০০০ তালেবান জঙ্গিকে ফাঁসিতে ঝুলাবার জন্য সেদেশের সরকারের প্রতি আল্টিমেটাম দিয়েছেন এবং ঘটনার পরদিন থেকেই তাঁর হুকুমে তালেবান এলাকায় সমানে বিমান হামলা চলছে। তাতে গত কয়দিনে শতাধিক মরেছে ও মরছে। ১৯৭১-এ টিক্কা খান ও রাও ফরমান আলীদের কণ্ঠে যে হুংকার আমরা শুনেছিলাম, আদমী নেহী, মেট্টী চাহিয়ে’ আজও সেকথাই শুনছি পাক সেনাপতির কণ্ঠে। সেদিনের সেই যুলুমের পরিণতিতে তারা পূর্ব পাকিস্তান হারিয়েছিল। কিন্তু তাদের শিক্ষা হয়নি। সেনাপতি বুঝেন না যে, তিন হাযার মারলে বহু হাযার মরবে। এমনকি তার নিজের পরিবার ও সন্তানেরাও হামলার শিকার হতে পারে। কেননা হিংসা কেবল হিংসাই আনয়ন করে। ওদিকে পাক সরকার তাদের মৃত্যুদন্ড বাতিলের আইন প্রত্যাহার করেছেন। ফলে এখন কারাগারে থাকা মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কয়েকশ’ তালেবানের ফাঁসি দ্রুত কার্যকর করা হবে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানে নতুন করে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে সরকার বনাম তালেবানের মধ্যে। পার্থক্য এই যে, সরকার জনগণের কাছে ও আইনের কাছে দায়বদ্ধ। তালেবানরা তা নয়। তাই তারা যা পারে, সরকার তা পারবে না। অতএব এ যুদ্ধে সরকার হারবে এটা নিশ্চিত। অবশেষে তারা হয় সন্ধি করবে অথবা ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর এটাই ইসলামের শত্রুদের লক্ষ্য। তালেবানরা বলেছে ‘স্বজন হারানোর বেদনা বুঝাতেই তারা এ হামলা করেছে’। কারণ সরকার তাদের উপর আমেরিকার বিমান হামলা বন্ধ করতে পারেনি। তদুপরি আমেরিকাকে খুশী করতে গিয়ে গত কয়েক বছর ধরে সরকার তাদের উপর সেনা হামলা চালাচ্ছে। ইতিপূর্বে রাতের অন্ধকারে হামলা করে সেনাবাহিনী তাদের ৮৬ জনকে এক সাথে হত্যা করেছে। সেনা পরিচালিত যারব-ই-আযব অপারেশনে ইতিমধ্যে ১৬০০ তালেবান ও নারী-শিশু নিহত হয়েছে। তারা বলছে, এখন আমরা প্রতিশোধ নিচ্ছি। আমাদের কোন সহযোগীকে ফাঁসি দেওয়া হলে প্রধানমন্ত্রীর পরিবার সহ পাকিস্তানের রাজনীতিবিদ ও সেনা কর্মকর্তাদের সন্তানদের হত্যা করা শুরু হবে। আমরা নেতাদের গৃহগুলিকে শোকের আধারে পরিণত করব’।

মুশকিল হ’ল এই যে, উভয় পক্ষ ইসলামের দাবী করছে। তালেবানরা তাদের ভাষায়, তাগূতী সরকার হটিয়ে ইসলামী খেলাফত কায়েমের জন্য ‘জিহাদ’ করছে। অন্যদিকে পাক সরকার ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত দেশটিতে ইসলাম টিকিয়ে রাখার স্বার্থে তালেবানদের হত্যা করছে। অথচ এখানে কেবলই রয়েছে ক্ষমতার লড়াই, ইসলামের কিছু নেই। কেননা ইসলামের জন্য হলে ইসলামী বিধান ও নীতি-আদর্শ মেনে চলতে হয়। বিগত ৬৬ বছর যাবত পাকিস্তান খ্রিষ্টানী রাজনীতি ও ইহূদী অর্থনীতি অনুসরণ করছে। তারা নগ্নভাবে পরাশক্তিগুলির খেলনায় পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে তালেবানরাও আমেরিকার সৃষ্টি। তাদেরকে ব্যবহার করেই তারা আফগানিস্তান থেকে রাশিয়াকে হটাতে সক্ষম হয়েছিল। প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এখন তারাই হয়েছে তাদের দৃষ্টিতে ‘সন্ত্রাসী’। যে পাক সরকার তাদেরকে কাজে লাগিয়েছে, তারাই এখন তাদেরকে মারছে পাশ্চাত্যকে খুশী করার জন্য। পাকিস্তান সরকার সেদেশে ইসলামী শাসন কায়েম করেনি, এটা সুস্পষ্ট। কিন্তু তালেবান যারা ইসলাম কায়েম করতে চায়, তারা কি ইসলামী বিধান মেনে তাদের কথিত জিহাদ পরিচালনা করছে?

ইসলামের প্রতিশোধ নীতি কি? আল্লাহ বলেন, যদি তোমরা প্রতিশোধ নিতে চাও, তাহলে অতটুকু নাও যতটুকু তোমাদের থেকে নেওয়া হয়েছে। আর যদি তোমরা ছবর কর, তাহলে সেটাই ধৈর্যশীলদের জন্য উত্তম হবে’ (নাহল ১৬/১২৬)। এখানে সরকার ও তালেবান উভয় পক্ষই ইসলামের ধৈর্যধারণ নীতি লংঘন করেছে। তিনি বলেন, একের পাপের বোঝা অন্যে বইবে না’ (আন‘আম ৬/১৬৪)। অথচ তালেবানরা মারল নিরপরাধ শিশুদের। এটাতো কাফেরদের নীতি। গত ৮ই জুলাই’১৪ থেকে ৫১ দিন ব্যাপী একতরফাভাবে ইস্রাঈল গাযায় বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো ছাড়াও সেখানে প্রায় আড়াই হাযার মুসলিমকে হত্যা করে। তার মধ্যে প্রায় ৮০০ শিশু-কিশোর এবং অসংখ্য বৃদ্ধ-বৃদ্ধা নারী-পুরুষ ছিল। তখন কিন্তু বিশ্বশান্তির মোড়লরা কিছুই বলেনি। কেননা এগুলি তাদের যুদ্ধনীতিতে কোন অপরাধ নয়। কিন্তু ইসলামী শাসন কায়েমকারীরা কোন অজুহাতেই ইসলামী বিধান লংঘন করতে পারে না।

ইসলামের যুদ্ধনীতি কি? ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন কোন সেনাদল প্রেরণ করতেন তখন তাদেরকে আল্লাহভীতির নির্দেশ দিতেন।  অতঃপর বলতেন, ‘আল্লাহর নাম নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধে গমন কর এবং যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে তাদের সাথে যুদ্ধ কর... (মুসলিম)। অন্যত্র তিনি বলেন, ‘তোমরা... বাড়াবাড়ি করবে না, শিশু-কিশোরদের হত্যা করবে না, গীর্জার অধিবাসী কোন পাদ্রী-সন্ন্যাসীকে, কোন মহিলাকে এবং কোন বৃদ্ধকে হত্যা করবে না (আহমাদ, বায়হাক্বী)। আরেকটি বিষয় হ’ল, সরকার ও তালেবান দু’পক্ষের বিধান কি সমান? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি তার আমীরের কোন কাজ অপসন্দনীয় মনে করে, সে যেন তাতে ছবর করে’ (বুখারী, মুসলিম)। অতএব সরকার যুলুম করলেও তাতে ধৈর্য ধারণ করাই হ’ল ইসলামের নীতি। সবশেষে পাকিস্তান সরকার কি কাফের? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি খালেছ অন্তরে কালেমা শাহাদাত পাঠ করে, সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে (বুখারী, মুসলিম)। এক্ষণে কোন মুসলিম সরকার ইসলাম কায়েম না করলে তারা বেশীর বেশী ফসেক, যালেম বা মুনাফিক হতে পারে। কাফের কখনোই নয়। তাদের রক্ত  হালাল নয়। মায়েদাহ ৪৪ আয়াতে যে তাদেরকে ‘কাফের’ বলা হয়েছে, তার অর্থ ঐ কাফের নয়, যার জন্য তারা ইসলামের গন্ডী থেকে বেরিয়ে যায়। এটাই হ’ল ইবনু আববাস (রাঃ)-এর ব্যাখ্যা। তাছাড়া ৪৫ ও ৪৭ আয়াতে একই অপরাধে তাদের ‘যালেম’ ও ‘ফাসেক’ বলা হয়েছে।  কিন্তু তালেবানরা মুসলিম সরকারকে সরাসরি তাগূত ও কাফের বলছে। বিভিন্ন দেশে তাদের অনুসারীরা একই আক্বীদা পোষণ করে। ফলে তাদের এই চরমপন্থী আক্বীদা ও হঠকারী কর্মকান্ডের ফলে ইসলাম সর্বত্র প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। যার সুযোগ নিচ্ছে বিরোধীরা।

এক্ষণে দেশে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার উপায় কি সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা? না। বরং সে পথ হ’ল, উত্তম পন্থায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করা। ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য জনমত গঠন করা এবং বৈধপন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা। অবশেষে যালেম সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা’। মনে রাখতে হবে, মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া ফরয, ইসলামকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসানো মুমিনের উপর ফরয করা হয়নি। আমাদের দাওয়াত জনগণ কবুল করলে এবং আমাদের নিঃস্বার্থপরতায় আল্লাহ খুশী হলে তিনি যেকোন সময় আমাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসাবেন। এটা তাঁর এখতিয়ার। অতএব সকলের প্রতি আবেদন, চরমপন্থা ও হঠকারিতা পরিহার করুন। মধ্যপন্থা অবলম্বন করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)