সূদ থেকে বিরত হৌন

يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ لاَ تَأْكُلُواْ الرِّبَا أَضْعَافاً مُّضَاعَفَةً وَاتَّقُواْ اللهَ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-

অনুবাদ : ‘হে মুমিনগণ! তোমরা চক্রবৃদ্ধিহারে সূদ খেয়ো না। তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তাতে তোমরা অবশ্যই সফলকাম হবে’ (আলে ইমরান ৩/১৩০)

জাহেলী আরবে ঋণদানের প্রথা ছিল এই যে, মেয়াদান্তে ঋণ পরিশোধ করলে সাধারণ সূদ। আর তা পরিশোধে ব্যর্থ হ’লে প্রতি মেয়াদে সূদ হার বৃদ্ধি পাবে এবং মেয়াদ শেষে ওটা আসলে রূপান্তরিত হবে (ইবনু কাছীর)। যেমন ১০০০ টাকা একবারে ১০% হারে ১০০ টাকা সূদ। কিন্তু তা পরিশোধে ব্যর্থ হ’লে ঐ ১১০০ টাকাই আসল টাকায় পরিণত হবে এবং তাতে মেয়াদ ও সূদের হারের তারতম্য হবে। যেমন প্রতি তিন মাস পর ২০% সূদ যোগ হবে। দিতে না পারলে ওটা আসলের সাথে যোগ হয়ে তার উপর ২৫% সূদ আরোপিত হবে। একেই বলে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ।

বাংলাদেশের দাদন ব্যবসায়ী, এনজিও এবং ব্যাংকগুলিতে বর্তমানে এই সূদই চলছে। জাহেলী আরবের লোকেরা দয়াপরবশে অনেক সময় ঋণগ্রহীতাকে সূদ মওকূফ করে দিত। কিন্তু এদেশের এই সব নব্য কাবুলীওয়ালারা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পায় এবং মামলা করে পুলিশ দিয়ে ধরে এনে পিটিয়ে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠায়। অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে আত্মহত্যা করে। যেমন বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আফসার গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আব্দুর রব তার প্রতিষ্ঠানের নামে ১৯৯০ সালে ২০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়েছিলেন। কিন্তু ব্যবসায়ে মার খেয়ে তিনি সূদাসলে শতকোটি টাকার বেশী ঋণখেলাপী হয়ে পড়েন। ব্যাংক ঋণ পরিশোধে নিজের ১০৫ বিঘা সম্পত্তি ১২ কোটি টাকায় বিক্রি করে দেন। প্রতারিত হয়ে তিনি তার গুলশানের বাড়ীটিও হারান। অবশেষে সব হারিয়ে নিজের স্ত্রীকে হত্যা করেন ও নিজে আত্মহত্যা করেন।[1] এনজিও এবং ব্যাংক ঋণের কারণে পথে বসা এরূপ আব্দুর রবের সংখ্যা শহরে-গ্রামে হাযার হাযার পাওয়া যাবে। যারা চক্রবৃদ্ধি হারে সূদের অসহায় শিকার। অথচ জনগণের সরকার জনস্বার্থের বিরোধী ও সূদখোরদের বন্ধু।

বাংলাদেশের সমাজ জীবন বিগত যুগে কাবুলীওয়ালা ও জমিদার-মহাজনী সূদ এবং বর্তমান যুগে ব্যাংক ও এনজিও সূদে জর্জরিত। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল মুসলমানরা স্বাধীনভাবে তাদের ইসলামী তাহযীব ও তামাদ্দুন নিয়ে বসবাস করবে সেই স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু সে স্বপ্ন পাকিস্তানের নেতারাই ধ্বংস করে দিয়ে গেছেন। মুসলমানের রাজনৈতিক জীবনে এখন ঢুকে পড়েছে ফেরাঊনী হিংস্রতা ও অর্থনৈতিক জীবনে ঢুকে পড়েছে কারূনী শোষণ। সাধারণ মুসলমান কখনোই তাদের প্রকৃত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ফিরে পায়নি। পায়নি তাদের জান-মাল ও ইযযতের স্বাধীনতা। যদিও ইতিমধ্যে ১৯৪৭ ও ১৯৭১-য়ে দেশ দু’বার স্বাধীন হয়েছে।

মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করা এবং তাকে জাহান্নামী করার জন্য শয়তান যত রকমের ফাঁদ পেতেছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ফাঁদ হ’ল ‘সূদ’। ধনীকে ধনী করার ও গরীবকে নিঃস্ব করার সবচেয়ে বিধ্বংসী হাতিয়ার হ’ল সূদ। এই শয়তানী প্রক্রিয়ার ফাঁদে যে একবার পড়বে সে ধ্বংস না হয়ে যাবে না। রক্ত চুষে ফুলে ঢোল হয়ে জোঁক এক সময় মারা পড়ে। শোষণ করা রক্ত তার দেহে কোন কাজে লাগে না। মশা রক্ত খেয়ে মোটা না হয়ে মরে না। অথচ ঐ রক্ত তার দেহে শক্তি যোগায় না। সূদী কারবারীরা একইভাবে নিজেরা রক্তচোষা গিরগিটির মত খাবি খায়। কিন্তু ঐ সম্পদ তার দুনিয়া ও আখেরাতে কোন কাজে লাগে না। মানুষের চোখে সে হয় নিন্দিত ও ঘৃণিত। এমনকি চাষের গরুর পায়ে লাঙ্গলের ফাল লাগা ঘায়ে পোকা ধরলে নাকি কোন সূদখোর মহাজনের নামে ফুঁক দিলে পোকাগুলো বেরিয়ে যায় ও গরু সুস্থ হয়। কারণ এরা আল্লাহর শত্রু ও শয়তানের বন্ধু। এরা দুনিয়াতে আল্লাহ ও মানুষের অভিশাপগ্রস্ত। আখেরাতেও জাহান্নামের ইন্ধন। কিন্তু এরপরেও মানুষ সূদ খায় ও সূদ নেয় শয়তানী সমাজের দুঃসহ বাধ্য-বাধকতায় পড়ে। যে সমাজের নিয়ন্ত্রক হ’ল সূদী কারবারী ধনিকশ্রেণী ও তাদের বশংবদ দলবাজ রাজনীতিকরা। গ্রাম্য মহাজনী প্রথার বদলে তারা এখন গড়ে তুলেছে বড় বড় ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান। লাখ লাখ টাকা বেতন-বোনাস দিয়ে কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়েছে যাতে তারা আইন বাঁচিয়ে সুন্দরভাবে মালিকদের চাহিদামত শোষণের কাজগুলো করতে পারে। জনগণকে ঋণ দিয়ে তাতে সূদ খেয়ে এবং জনগণের সঞ্চিত আমানত থেকে সুচতুরভাবে যাতে তারা অর্থ লুণ্ঠন করতে পারে ও বিনা পুঁজিতে দেশের সেরা পুঁজিপতি ব্যবসায়ী হিসাবে দেশে-বিদেশে সিআরপি-ভিআইপি হবার সুযোগ নিতে পারে। এজন্যই গ্রীক পন্ডিত প্লুটার্ক (৪৬-১২০ খৃঃ) এদেরকে ‘বিদেশী আক্রমণকারীদের চাইতে অধিক নির্যাতনকারী’ বলেছেন। কেননা এরা সশস্ত্র হামলা না করেই জনগণকে সূদের জালে আটকে পঙ্গু করে ফেলে এবং মানুষ তার মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে না। আল্লাহ বলেন, ‘যারা সূদ খায়, তারা ক্বিয়ামতের দিন দাঁড়াবে ঐ রোগীর মত, যার উপরে শয়তান আছর করে। তাদের এমন অবস্থা হবার কারণ এই যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সূদের মতই’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)। আসলে কি তাই?

ব্যবসা ও সূদের পার্থক্য :

আবু জাহল ব্যবসা ও সূদের পার্থক্য বুঝেনি। তাই সে বলেছিল, ‘ব্যবসা তো সূদের মতই’। এ যুগের সূদখোররাও সে পার্থক্য বুঝতে চায় না। আসলে এরা বুঝেও না বুঝার ভান করে। কেননা দু’টির মধ্যে সম্পর্ক দিন ও রাতের মত। একটা থাকলে অন্যটা থাকবে না। যেমন, (১) ব্যবসায়ে পণ্য বিক্রয়ের মুনাফা পাওয়া যায়। কিন্তু সূদ হ’ল ঋণ দানের বিনিময়ে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা। (২) সূদ হ’ল পূর্ব নির্ধারিত। কিন্তু ব্যবসায়ে লাভ আসে পরে। (৩) সূদে লাভের নিশ্চয়তা থাকে, কিন্তু ব্যবসায়ে লাভ-লোকসানের ঝুঁকি থাকে। (৪) সূদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা সময় ও শ্রম বিনিয়োগ করে না। পক্ষান্তরে মুনাফা হ’ল উদ্যোক্তার সময় ও শ্রম বিনিয়োগের ফল। (৫) সূদ হ’ল মুনাফা গ্রহণের পর পুনরায় অর্থের মূল্য নেওয়া। যা একই দ্রব্য দু’বার বিক্রির শামিল। যা মহাপাপ ও মহা প্রতারণা।

পৃথিবীর আদিকাল থেকে সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ একে নিকৃষ্ট পাপ বলেছেন। প্লেটো, এরিস্টটল সবাই একে নিন্দা করেছেন। যারা সূদকে সময়ের মূল্য বলে দাবী করেন, তাদের যুক্তি খন্ডন করে ইতালীয় পন্ডিত থমাস একুইনাস (১২২৫-১২৭৪ খৃঃ) বলেন, সময় এমন এক সাধারণ সম্পদ যার উপর ঋণগ্রহীতা, ঋণদাতা ও অন্যান্য সকলেরই সমান মালিকানা বা অধিকার রয়েছে। এমতাবস্থায় শুধু  ঋণদাতার সময়ের মূল্য দাবী করাকে তিনি অসাধু ব্যবসা বলে অভিহিত করেন।[2]

আসলে এটি আদৌ কোন ব্যবসা নয় বরং ঋণদানের বিনিময়ে অধিক টাকা নেওয়ার ফন্দি মাত্র। আর এটাই হ’ল সূদ। ইসলাম যা হারাম করেছে। প্রশ্ন হ’ল, যদি কেউ কাউকে এক হাযার টাকা ঋণ দেয়, আর ঋণগ্রহীতা সেটি এক বছর পরে শোধ করে, তাহ’লে কি তাকে এক হাযার টাকার সাথে আরও কিছু বেশী দিতে হবে? যদি দিতে হয়, তাহ’লে সেটা হবে সূদ। আর যদি না দিতে হয় তবে সেটাই হ’ল মানবতা এবং সেটাই হ’ল ইসলাম। যদি আসল টাকা হারানোর ভয় থাকে, তাহ’লে ঋণগ্রহীতার নিকট থেকে কিছু বন্ধক রাখুন তা ভোগ না করার শর্তে। এতে অপারগ হ’লে রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক তহবিল থেকে উক্ত ঋণ পরিশোধ করতে হবে। অথবা পরকালে দ্বিগুণ পাওয়ার আশায় ঋণ মওকূফ করবে ও ক্ষমা করে দিবে। এভাবেই সমাজে ঋণ প্রবাহ স্বাভাবিক থাকবে এবং ‘মানুষের প্রয়োজনে মানুষ’ একথার যথার্থ বাস্তবায়ন হবে। এর বাইরে সবই শঠতা ও প্রবঞ্চনা, যা এক কথায় শয়তানী কর্ম। রহমানী সমাজে যার কোন স্থান নেই।

সূদ কি বস্ত্ত?

হযরত আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,

اَلذَّهَبُ بِالذَّهَبِ وَالْفِضَّةُ بِالْفِضَّةِ وَالْبُرُّ بِالْبُرِّ وَالشَّعِيْرُ بِالشَّعِيْرِ وَالتَّمْرُ بِالتَّمْرِ وَالْمِلْحُ بِالْمِلْحِ مِثْلاً بِمِثْلٍ يَدًا بِيَدٍ فَمَنْ زَادَ أَوِ اسْتَزَادَ فَقَدْ أَرْبَى الآخِذُ وَالْمُعْطِى فِيهِ سَوَاءٌ

‘স্বর্ণের বদলে স্বর্ণ, রৌপ্যের বদলে রৌপ্য, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর, লবণের বদলে লবণ সমান সমান হাতে হাতে নিবে। অতঃপর যে ব্যক্তি তাতে বেশী দিল বা বেশী চাইল, সে সূদে পতিত হ’ল। গ্রহীতা ও দাতা উভয়ে সমান’।[3] নগদে বেশী নিলে সেটা হবে রিবা আল-ফাযল এবং বাকীতে বেশী নিলে সেটা হবে রিবা আন-নাসীআহ। দু’টিই সূদ এবং দু’টিই নিষিদ্ধ। মাছ বিক্রির সময় কেজিতে ২০০ গ্রাম বা মণে ৫ কেজি বেশী, ধান, আলু, আম ইত্যাদি বিক্রির সময় মূল ওযনের চাইতে বেশী লেনদেনের যে প্রচলন এদেশে রয়েছে, যাকে ‘ধল’ বা ‘ফাও’ বলা হয়, এগুলি অত্যাচারমূলক সূদী প্রথা, যা রিবা আল-ফযলের অন্তর্ভুক্ত। অনুরূপভাবে মেয়াদ ভিত্তিক ঋণ দিয়ে তার উপর অতিরিক্ত অর্থ আদায় করার যে সূদী প্রথা রয়েছে, তা রিবা আন-নাসীআহর অন্তর্ভুক্ত। সবগুলিই পরিত্যাজ্য। একইভাবে ব্যবহৃত পুরাতন স্বর্ণের বদলে নতুন স্বর্ণ নেওয়ার সময় ওযন ও মূল্যে যে কমবেশী করা হয়, সেটাও নিষিদ্ধ। বরং এটাই সঠিক যে, পুরাতন সোনা বিক্রি করে তার মূল্য দিয়ে নতুন সোনা ক্রয় করতে হবে।

উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, الرِّبَا فِى النَّسِيئَةِ ‘সূদ হ’ল বাকীতে’। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, لاَ رِبًا فِيمَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ ‘হাতে হাতে নগদ লেনদেনে কোন সূদ নেই’।[4] উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ...فَإِذَا اخْتَلَفَتْ هَذِهِ الأَصْنَافُ فَبِيعُوا كَيْفَ شِئْتُمْ إِذَا كَانَ يَدًا بِيَدٍ. ‘যখন দ্রব্য ভিন্ন হবে, তখন তোমরা যেভাবে খুশী ক্রয়-বিক্রয় কর, যখন তা হাতে হাতে নগদে হবে’।[5] অর্থাৎ স্বর্ণের বদলে রৌপ্য, চাউলের বদলে গম, মাছের বদলে গোশত ইত্যাদি।

সূদের পরিণতি

(১) সূদ সমাজকে নিঃস্ব করে : আললাহ বলেন,يَمْحَقُ اللهُ الْرِّبَا وَيُرْبِي الصَّدَقَاتِ وَاللهُ لاَ يُحِبُّ كُلَّ كَفَّارٍ أَثِيْمٍ ‘আল্লাহ সূদকে সংকুচিত করেন ও ছাদাক্বাকে প্রবৃদ্ধি দান করেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ কোন অকৃতজ্ঞ পাপিষ্ঠকে ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৬)। আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, إِنَّ الرِّبَا وَإِنْ كَثُرَ فَإِنَّ عَاقِبَتَهُ تَصِيْرُ إِلَى قُلٍّ ‘সূদ যতই বৃদ্ধি পাক, এর পরিণতি হ’ল নিঃস্বতা’।[6] কেননা এতে সূদগ্রহীতাই কেবল ফেঁপে ওঠে। যাদের সংখ্যা কম। কিন্তু সূদদাতা ক্লিষ্ট হয়। যাদের সংখ্যা অধিক। সূদে তাদের ক্রয়ক্ষমতা লোপ পায়। তখন সূদখোরের প্রাপ্য সূদ পরিশোধ হয় না। সে শিল্পপতি বা ব্যবসায়ী হ’লে তার উৎপাদিত পণ্য অবিক্রীত থাকে। যার পরিণতিতে সূদখোরের সূদ ও আসল সবই ধ্বংস হয়। বর্তমানে পুঁজিবাদী আমেরিকার শতাধিক ব্যাংক দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া যার বাস্তব প্রমাণ। তাছাড়া নিউইয়র্কের ওয়াল স্ট্রীট আন্দোলন পুঁজিবাদী বিশ্বের ভিত কাঁপিয়ে তুলেছে। যাদের বক্তব্য ছিল, শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষের খাদ্য মাত্র ১ ভাগ মানুষ শোষণ করে চলেছে সূদের মাধ্যমে, আমরা এর অবসান চাই।

(২) সূদী লোকেরা কিয়ামতের দিন শয়তানের আছর করা রোগীর মত দাঁড়াবে : আল্লাহ বলেন, الَّذِيْنَ يَأْكُلُوْنَ الرِّبَا لاَ يَقُوْمُوْنَ إِلاَّ كَمَا يَقُوْمُ الَّذِيْ يَتَخَبَّطُهُ الشَّيْطَانُ مِنَ الْمَسِّ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ قَالُوْا إِنَّمَا الْبَيْعُ مِثْلُ الرِّبَا وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا فَمَنْ جَاءهُ مَوْعِظَةٌ مِّن رَّبِّهِ فَانتَهَىَ فَلَهُ مَا سَلَفَ وَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ وَمَنْ عَادَ فَأُوْلَـئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيْهَا خَالِدُوْنَ- ‘যারা সূদ খায় তারা (ক্বিয়ামতের দিন) শয়তানের স্পর্শে আবিষ্ট রোগীর মত দন্ডায়মান হবে। এটা এজন্য যে, তারা বলে, ব্যবসা তো সূদের মতই। অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সূদকে হারাম করেছেন। অতএব যার নিকট তার পালনকর্তার পক্ষ হ’তে উপদেশ পৌঁছে যায়, অতঃপর সে বিরত হয়, তার জন্য রয়েছে ক্ষমা, যা সে পূর্বে করেছে। আর তার (তওবা কবুলের) বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। কিন্তু যে ব্যক্তি পুনরায় (সূদী কাজে) ফিরে আসবে, সে হবে জাহান্নামের অধিবাসী। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২৭৫)

(৩) সূদখোর আল্লাহর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণাকারী : আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُواْ اتَّقُوْا اللهَ وَذَرُوْا مَا بَقِيَ مِنَ الرِّبَا إِنْ كُنْتُم مُّؤْمِنِيْنَ، فَإِن لَّمْ تَفْعَلُوْا فَأْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللهِ وَرَسُوْلِهِ وَإِنْ تُبْتُمْ فَلَكُمْ رُؤُوْسُ أَمْوَالِكُمْ لاَ تَظْلِمُوْنَ وَلاَ تُظْلَمُوْنَ- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং সূদের বাকী পাওনা ছেড়ে দাও যদি তোমরা মুমিন হও’। ‘কিন্তু যদি তোমরা তা না কর, তাহ’লে তোমরা আল্লাহ ও তার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কর। অতঃপর যদি তোমরা তওবা কর, তাহলে তোমরা (সূদ ব্যতীত) কেবল আসলটুকু পাবে। তোমরা অত্যাচার করো না এবং অত্যাচারিত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৮-৭৯)

অতএব হে সূদী মহাজন, হে দাদন ব্যবসায়ী, হে ব্যাংক ও এনজিও-র মালিকগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা কেবল ঋণের আসলটুকু নাও ও সূদের অংশটি পরিত্যাগ কর। তাহ’লে তোমরা আল্লাহর কাছে এর বহুগুণ বেশী পাবে। যেমন তিনি বলেন,إِنْ تُقْرِضُوا اللهَ قَرْضًا حَسَنًا يُضَاعِفْهُ لَكُمْ وَيَغْفِرْ لَكُمْ وَاللهُ شَكُوْرٌ حَلِيْمٌ  ‘যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তাহ’লে তিনি তোমাদের জন্য এটা বহুগুণ বর্ধিত করবেন এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করবেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ সর্বাধিক প্রতিদান দাতা ও সর্বাধিক সহনশীল’ (তাগাবুন ৬৪/১৭)। এখানে যে ব্যক্তি ঋণের টাকার সাথে বাড়তি দাবী করে, সে হ’ল অত্যাচারী এবং যে ব্যক্তি বাড়তি টাকা দেয়, সে হ’ল অত্যাচারিত।

উপরোক্ত আয়াতগুলিতে একথা পরিষ্কার যে, সূদ একটি অত্যাচারমূলক প্রথা। নগদে হৌক বা বাকীতে হৌক, ঋণদাতা কেবল অতটুকু ফেরত পাবেন, যতটুকু তিনি ঋণ দিয়েছেন। অতিরিক্ত নিলে সেটা সূদ হবে। ঋণ দিয়ে অতিরিক্ত নেওয়ার চুক্তি করলেও তা বাতিল হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, যেকোন শর্ত যা আল্লাহর কিতাবে নেই, তা বাতিল। যদিও তা একশত শর্ত হয়’।[7] যেকোন মানুষ যেকোন সময়ে কপর্দকহীন হয়ে বিপাকে পড়তে পারে। তাই পরস্পরকে ঋণ দিতে হবে মানবিক তাকীদে। বাগে পেয়ে বা সুবিধা দেখিয়ে তার কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা যাবে না। করলে সেটা সূদ হবে।

জাহেলী আরবে আজকের মত ব্যক্তিগত ঋণের উপর যেমন সূদ আদায় করা হ’ত, তেমনি ব্যবসায়ে লগ্নিকৃত মূলধনের উপর সূদ নেওয়া হ’ত। উভয় প্রকার সূদকে ‘রিবা’ বলা হ’ত। আর কুরআনে সেই রিবাকেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। তাই প্রথমটিকে ইউজুরী (Usury) এবং দ্বিতীয়টিকে ইন্টারেস্ট (Interest) বলে সূদ হালাল করার কোন সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চাচা আববাস ইসলাম কবুলের আগে ব্যবসায়ে পুঁজি খাটিয়ে সূদ নিতেন। এ ব্যাপারে তাঁর ব্যাপক প্রসিদ্ধি ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিদায় হজ্জের ভাষণে চাচার প্রাপ্য সকল সূদ রহিত করার ঘোষণা দেন।[8]

সূদের ইহকালীন ও পরকালীন শাস্তি :

(১) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, যখন কোন সম্প্রদায়ে বা কোন জনপদে সূদ ও ব্যভিচার বৃদ্ধি পাবে, তারা নিজেরা আল্লাহর শাস্তিকে অবধারিত করে নিবে’।[9] আল্লাহর এই শাস্তি নানাবিধ হ’তে পারে। আসমানী গযব, যেমন অনাবৃষ্টি, ঝড়-ঝঞ্ঝা, উষ্ণ বায়ু, নানাবিধ রোগ-জীবাণু ও ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ইত্যাদি। যমীনী গযব, যেমন বন্যা, খরা, ফসলহানি, ভূর্গস্থ পানি শুকিয়ে যাওয়া, ভূমিকম্প, দাবানল ইত্যাদি।

এছাড়া আখেরাতের শাস্তি হবে অত্যন্ত মারাত্মক। যেমন-

(২) হযরত সামুরাহ বিন জুনদুব (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফজরের ছালাত অন্তে আমাদের দিকে ফিরে বসতেন এবং বলতেন তোমরা কেউ রাতে স্বপ্ন দেখেছ কি? কেউ দেখে থাকলে তিনি তার ব্যাখ্যা দিতেন। এভাবে একদিন বললেন, আমি আজ রাতে একটি স্বপ্ন দেখেছি, তোমরা শোন। অতঃপর তিনি বললেন, দু’জন লোক এসে আমাকে নিয়ে গেল। কিছুদূর গিয়ে মাঠের মধ্যে দেখলাম যে একজন লোক বসে আছে। পাশেই একজন লোক মাথা বাঁকানো ধারালো অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তার এক কান থেকে আরেক কান পর্যন্ত সেটা দিয়ে চিরে দিচ্ছে। তাতে তার মুখমন্ডল দ্বিখন্ডিত হয়ে যাচ্ছে ও পুনরায় জোড়া লাগছে। এভাবে ডান কান থেকে বাম কান পর্যন্ত এবং বাম কান থেকে ডান কান পর্যন্ত ঐ অস্ত্র দিয়ে মুখমন্ডল চিরে দু’ভাগ করে দিচ্ছে। আর লোকটি যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আমি বললাম, এ ব্যক্তির এই কঠিন শাস্তি কেন? জবাবে তারা বললেন, সামনে চল।

এরপর আমরা গিয়ে পেলাম একজন লোককে যে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। আরেকজন দাঁড়ানো ব্যক্তি তার মাথায় পাথর মেরে তা চূর্ণ করে দিচ্ছে। অতঃপর লোকটি পাথর কুড়িয়ে আনার অবসরে মাথাটি আবার পূর্বের ভাল অবস্থায় ফিরে আসছে। অতঃপর পুনরায় তা পাথর মেরে চূর্ণ করা হচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, লোকটির এ শাস্তি কেন? জবাবে তারা বললেন, সামনে চল।

এরপরে আমরা এলাম মেঠে সদৃশ একটা বড় পাত্রের নিকট। যার মুখ সরু এবং নীচের দিকে প্রশস্ত। পাত্রটির নীচে আগুন জ্বলছে। যার ভিতরে একদল উলংগ পুরুষ ও নারী। যারা আগুনের প্রচন্ড তাপে দগ্ধ হয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। আমি বললাম, এদের এরূপ শাস্তি কেন? জবাবে তারা বললেন, সামনে চল।

এরপরে আমরা এলাম একটা রক্তনদীর কাছে। যার মাঝখানে একজন লোক মাথা উঁচু করে আছে। আর নদীর তীরে একজন লোক পাথরের খন্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যখনই ঐ লোকটি সাঁতরে কিনারে উঠতে চাচ্ছে, তখনই তার মাথায় পাথর মেরে তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে। লোকটি এভাবে রক্তের নদীতে সাতরাচ্ছে। কিন্তু তীরে উঠতে পারছে না। যখনই সে কাছে আসছে তখনই পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে। যা পুনরায় ঠিক হয়ে যাচ্ছে। আমি বললাম, লোকটির এ শাস্তি কেন হচ্ছে? জবাবে তারা বললেন, সামনে চল।

এবার কিছু দূর গিয়ে তারা বললেন, ১ম ব্যক্তি যার মুখ চেরা হচ্ছিল, সে হ’ল মিথ্যাবাদী। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে। ২য় ব্যক্তি যার মাথা চূর্ণ করা হচ্ছিল, ঐ ব্যক্তিকে আল্লাহ কুরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু সে তা ছেড়ে রাতে ঘুমাত এবং দিনের বেলায় সে অনুযায়ী আমল করত না। ক্বিয়ামত পর্যন্ত তার সাথে এরূপ আচরণ করা হবে। ৩য় ব্যক্তিরা যাদেরকে মাথা সরু বড় পাত্রের মধ্যে দেখা গেছে, ওরা হ’ল ব্যভিচারী। ৪র্থ যে ব্যক্তি রক্তনদীর মধ্যে সাতরাচ্ছে ও পাথর মেরে তার মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে, ওটা হ’ল সূদখোর। ... এবারে তারা নিজেদের পরিচয় দিয়ে বললেন, আমরা হ’লাম জিব্রীল ও মীকাঈল। এবার তুমি মাথা উঁচু কর। আমি মাথা উঁচু করলাম। দেখলাম এক খন্ড মেঘের মত বস্ত্ত। তারা বললেন, ওটাই তোমার বাসগৃহ। আমি বললাম, আমি আমার বাসগৃহে প্রবেশ করব। তারা বললেন, তোমার বয়স পূর্ণ হওয়ার পর তুমি ওখানে প্রবেশ করবে’।[10]

মনে রাখা আবশ্যক যে, ‘নবীগণের স্বপ্ন অহী’।[11] আল্লাহ আমাদেরকে সূদের মহাপাপ থেকে রক্ষা করুন-আমীন!


[1]. দৈনিক ইনকিলাব ৪ঠা সেপ্টেম্বর’১৪ প্রথম পৃষ্ঠা

[2]. প্রফেসর শাহ হাবীবুর রহমান, সূদ, পৃঃ ১২

[3]. মুসলিম হা/১৫৮৪, মিশকাত হা/২৮০৯

[4]. মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, মিশকাত হা/২৮২৪

[5]. মুসলিম হা/১৫৮৭

[6]. আহমাদ হা/৩৭৫৪, ইবনু মাজাহ হা/২২৭৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৫১৮; মিশকাত হা/২৮২৭

[7]. বুখারী হা/২১৬৮, ২৫৬৩; মুসলিম হা/১৫০৪;  মিশকাত হা/২৮৭৭

[8]. আবুদাঊদ হা/১৯০৫

[9]. আহমাদ হা/৩৮০৯; ছহীহুল জামে‘ হা/৫৬৩৪

[10]. বুখারী হা/১৩৮৬; মিশকাত হা/৪৬২১ ‘স্বপ্ন’ অধ্যায়

[11]. বুখারী হা/১৩৮, ৮৫৯, তিরমিযী হা/৩৬৮৯