মানুষ না মনুষ্যত্ব

বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক আছে। যেমন ধর্মের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য ধর্ম। একইভাবে আইনের জন্য মানুষ, না মানুষের জন্য আইন। কথাগুলির জওয়াব এককথায় দেওয়া মুশকিল। অথচ এক কথায় জবাব দিতেই হবে। নইলে আপনি সারা জীবন দিশেহারা হয়ে ঘুরবেন।

প্রশ্ন হ’ল, আমরা মানুষ কেন? পশুর সাথে আমাদের ফারাক কি? জৈবিক কামনা-বাসনায় পশুর সাথে কোন ফারাক নেই। অথচ ওদের মা-বোন বাছ-বিচার নেই। মানুষের আছে। পশুদের কোন হালাল-হারাম জ্ঞান নেই। মানুষের আছে। পশুরা নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। খাও-দাও-ফূর্তি করো, আর অপরের ঘাড় মটকাও- এটাই ওদের সারাক্ষণের কর্মযজ্ঞ। কিন্তু মানুষ নিজে না খেয়ে অন্যকে খাওয়ায়। সে ত্যাগের মধ্যেই তৃপ্তি পায়। সে দুনিয়ার বিনিময়ে আখেরাত লাভে ব্যস্ত থাকে। মৃত্যুর পূর্বক্ষণেও হাতে ধরা পানির পাত্র অন্য প্রার্থীকে দেয়। সে মরে যায়। কিন্তু বেঁচে থাকে তার মনুষ্যত্ব। যুগ যুগ ধরে মানুষ তাকে স্মরণ করে ও পরকালে রূহের মাগফিরাতের জন্য দো‘আ করে। রেজাল্ট কি দাঁড়াল? মানুষ বড় নয় বরং মনুষ্যত্ব বড়। মনুষ্যত্বই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে। পৃথিবীতে চিরকাল এটাই সত্য। যদিও নাস্তিক ও বস্ত্তবাদীরা কেবল বস্ত্তকেই মুখ্য গণ্য করে। মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা তাদের কাছে গৌণ। আর তাইতো দেখা যায় ছোট ভাই হাবীলের সুনামে ক্ষুব্ধ হয়ে বড় ভাই কাবীল তাকে হত্যা করে। পরে কাবীলও মরেছে। কিন্তু অমর হয়েছে হাবীল। ইব্রাহীম তার পিতা ইরাকের ধর্মগুরু আযরকে নিজ হাতে গড়া মূর্তির অক্ষমতা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। তাতে ক্ষেপে গেলেন পিতা, সমাজ ও দেশের সম্রাট নমরূদ। প্রচলিত ধর্ম অবমাননার দায়ে বিচারে তাকে জ্বলন্ত হুতাশনে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার দন্ড দেওয়া হ’ল। তিনি আগুনে নিক্ষিপ্ত হ’লেন। বিজয়ী হ’ল সমাজ। কিন্তু পরাজিত হ’ল মনুষ্যত্ব ও ন্যায়বিচার। ফলে ইতিহাসে অমর হ’লেন ইব্রাহীম। ঘৃণার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হ’ল তার সমাজ ও সরকার। একই অপরাধে নিজ জন্মভূমি মক্কা থেকে রাতের অন্ধকারে হিজরত করতে বাধ্য হ’লেন শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আপাতত বিজয়ী হ’ল আবু জাহল, আবু লাহাবরা। কিন্তু পরাজিত হ’ল তাদের মনুষ্যত্ব ও নৈতিকতা। পুত্রহারা মুহাম্মাদকে বলা হ’ল ‘লেজকাটা’। অথচ তাঁর রেখে যাওয়া ন্যায় ও সত্যের অনুসারী কোটি কোটি মুমিন এখন বিশ্বের কোণায় কোণায়। তার সাথে মুনাফেকী করল ইবনে উবাই ও তার সাথীরা। তিনি তাদের ক্ষমা করলেন। উভয়ে মারা গেছেন। কিন্তু চিহ্নিত হয়ে আছে ইবনে উবাই। পলাশীতে গাদ্দারী করেছে মীরজাফর ও তার সাথীরা। সিরাজের পর সে বাংলার নবাব হয়েছিল। সিরাজ ও মীরজাফর উভয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়েছেন। কিন্তু অবাঙ্গালী হয়েও সিরাজুদ্দৌলা সর্বদা বাঙ্গালীর গর্ব। তার নৈতিকতা ও দেশপ্রেম চিরঞ্জীব। পক্ষান্তরে সুবিধাভোগী মীরজাফর-উমিচাঁদরা বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দে পরিণত হয়েছে।

আখেরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি যার যত তীব্র, তার নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব তত উন্নত। তাইতো দেখি গুহায় আটকে পড়া ও সাক্ষাত মৃত্যুমুখে পতিত তিনজন ঈমানদার যুবকের মুক্তিলাভের অবিশ্বাস্য ঘটনা (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৪৯৩৮)। যা যেকোন মানুষের হৃদয়কে নাড়া দেয় এবং অদৃশ্য আল্লাহর অস্তিত্বের প্রতি মাথা নুইয়ে পড়ে। হিজরতের রাতে ছওর গিরিগুহায় শত্রুর সাক্ষাত হামলা থেকে রাসূল (ছাঃ) ও আবুবকরের অকল্পনীয় মুক্তি যেকোন বিশ্বাসী হৃদয়ে দৃঢ়তা আনয়ন করে। ধনলোভী ক্বারূণ, অত্যাচারী নমরূদ ও ফেরাঊন ইতিহাসের ঘৃণিত জীব। অথচ সর্বস্বহারা ইব্রাহীম ও মূসা মানবজাতির গর্ব ও সর্বমহলে প্রশংসিত ও নন্দিত। মুতার যুদ্ধে ২ লক্ষ ৪০ হাযার খৃষ্টান সেনার বিরুদ্ধে মাত্র তিন হাযার মুসলিম সেনার অবিস্মরণীয় বিজয় সাধিত হওয়ার পিছনে ছিল একই কারণ। সেদিন তরুণ সেনাপতি আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (রাঃ) দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছিলেন, আমাদের সামনে খোলা রয়েছে মাত্র দু’টি পথ- হয় বিজয়, নয় শাহাদাত। ব্যস এতেই আল্লাহর সরাসরি মদদ নেমে এসেছিল সেদিন। সেনাপতি সহ মাত্র ১২ জন শহীদের বিনিময়ে বিশাল খৃষ্টান বাহিনী অগণিত হতাহতের মধ্য দিয়ে মর্মান্তিক পরাজয় বরণ করে। যার বাস্তব ফল আজকের মুসলিম মধ্যপ্রাচ্য। এখন সংখ্যা বেড়েছে মুসলমানের। কিন্তু বাড়েনি ঈমান ও তাওয়াক্কুল। আর তাইতো দেখি সর্বত্র ধর্ষক, মদ্যপ, ভদ্রবেশী রিলিফ চোর, ব্যাংক লুটেরা ও চোর-বাটপারদের দৌরাত্ম্য।

করোনার ভয়ে নিজ পিতাকে ঘরে উঠতে দেয়না স্ত্রী ও সন্তানেরা। অবশেষে তাদের চোখের সামনে রাত্রিতে বাড়ীর উঠানে প্রচন্ড বৃষ্টিপাতে ভিজে মৃত্যুর মুখ থেকে উঠিয়ে নিয়ে যায় পুলিশ। মৃত ছেলের লাশ এনেছে অন্য ছেলেরা পরিবারের সদস্যদের শেষবারের মত দেখানো ও কাফন-দাফনের জন্য। কিন্তু দূর থেকে পিতার নির্দেশ ওকে উঠানে এনো না। তখন বাধ্য হয়ে উঠানের বাইরে বৃষ্টি-কাদার মধ্যে গোসল-কাফন সেরে গোরস্থানে নিয়ে গেল। কিন্তু সেখানেও লোকদের বাধা। অবশেষে অজ্ঞাত স্থানে লাশ দাফন করা হ’ল। ঐ ছেলেরা ঐ বাপকে বলে গেল, ছেলেটি আপনার। তাই হাসপাতাল থেকে এনেছিলাম আপনার কাছে। আপনি কাছে এলেন না, এমনকি উঠানেও লাশটা রাখতে দিলেন না নিজের মৃত্যুর ভয়ে। অথচ আমরা তো আপনার ছেলে নই। আমাদের কি মৃত্যুভয় নেই? হ্যাঁ এখানেই পিতা ও পরিবার পরাজিত হয়েছে চিরদিনের মত। পক্ষান্তরে ঐ অচেনা যুবকগুলো নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বকে উড্ডীন করেছে। ওরা অমর হয়েছে ইহকালে ও পরকালে। বৃদ্ধা মাকে সন্তানরা ফেলে গেছে জঙ্গলে। অবশেষে পুলিশ তাকে শিয়াল-কুকুরের হাত থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনে। এ্যাম্বুলেন্সে একজন রোগী হাঁচি দিয়েছে। তাতেই তাকে রাস্তায় ফেলে পালিয়েছে এ্যাম্বুলেন্স সহ তার আরোহীরা। ঢাকা থেকে রংপুর যাওয়ার পথে একজন যাত্রী হঠাৎ জ্বরাক্রান্ত হয়েছে। গভীর রাতে তার পরিচিত সাথীরা তাকে রাস্তায় ফেলে দিয়ে চলে গেছে। পরে লোকেরা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। একই ফ্ল্যাটে বসবাসকারী কোটিপতি ব্যবসায়ী অন্য রোগে মারা গেলেন। কিন্তু পাশের ফ্ল্যাটের কেউই তার পরিবারের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। কেউ হাঁচি দিলেও এখন তাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। চিরচেনা বন্ধু আজ অচেনা হয়ে গেছে। তাই আজ মানুষ বাঁচানোর আগে প্রয়োজন মনুষ্যত্বকে বাঁচানো। ক্বিয়ামতের শেষ বিচারে যখন পরস্পরে সাক্ষাত হবে, সেদিন কি জবাব দিবে ঐ নিষ্ঠুর পিতা-মাতা ও ভাই-বোনেরা এবং পরিচিত জনেরা!

হাযার হাযার করোনা রোগীকে নীরবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মীগণ। ইতিমধ্যেই তাদের অনেকে মৃত্যু বরণ করেছেন। আরো মৃত্যু বরণ করেছেন কয়েকশ’ পুলিশ সদস্য। তাদের ঋণ জাতি কখনোই ভুলবে না। করোনায় মৃত হিন্দু-মুসলিমের লাশ সৎকার করে আজ নারায়ণগঞ্জের মোকছেদ কমিশনারের মত অনেকে প্রবাদ পুরুষে পরিণত হয়েছেন। বিদেশী গণমাধ্যমে তাদের কথা প্রচারিত হয়েছে। তিনি ও  তার স্ত্রী  করোনায়  আক্রান্ত হ’লে লেখক নিজে  জুম‘আর খুৎবায় এবং দেশের হাযার হাযার ঈমানদার মানুষ তাদের জন্য আল্লাহর নিকট প্রাণখোলা দো‘আ করেছে। আল্লাহর ইচ্ছায় তারা উভয়ে এখন করোনা মুক্ত ও সুস্থ। একদিন তারাও মারা যাবে। কিন্তু রেখে যাবে তাদের চিরস্থায়ী স্মৃতি। তার বংশধররাও পিতার সুনামের সুফল ভোগ করবে যুগ যুগ ধরে, যদি তারা পিতার মত হয়। বস্ত্ততঃ এদের মাধ্যমেই নৈতিকতা ও মনুষ্যত্ব বেঁচে আছে।

অথচ তথাকথিত বিশ্ব নেতারা যারা পূর্বের ন্যায় এখনো বিশ্ব বিপর্যয়ের মূল নায়ক। তারা জঙ্গলের হিংস্র পশুর ন্যায় একে অপরের উপর হামলে পড়ার ছক অাঁকায় ব্যস্ত। বঙ্গোপসাগরে ও ভূমধ্যসাগরে পেটের দায়ে ভাসছে হাযারো মানুষ। মিয়ানমার সহ বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০ কোটির উপর মানুষ সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছে একটু আশ্রয়ের জন্য। কিন্তু কোন নেতা তাদের আশ্রয় দিচ্ছেনা। ধর্মভেদ, বর্ণভেদ, অঞ্চলভেদ, জাতিভেদ ইত্যাদি ভেদাভেদের রাজনীতি করে তারা সর্বত্র মনুষ্যত্বকে হত্যা করছে। বনের পশুও এদের চাইতে ভাল। তাইতো দেখি উহানের জনৈক ব্যক্তির পোষা কুকুরটি পাঁচদিন হাসপাতালের সামনে ক্ষুধার্ত অবস্থায় পড়ে থাকে মনিবের আগমনের অপেক্ষায়। অবশেষে লোকেরা বিষয়টি বুঝতে পেরে তাকে উদ্ধার করে। কিন্তু না, সুস্থ হয়ে সে আবার ছুটে আসে হাসপাতালের সামনে। কেননা সে জানেনা যে তার মনিব মৃত্যুবরণ করেছে। অথচ মোদীর সেনারা সর্বদা কাশ্মীরের মুসলমানদের জান-মাল-ইয্যত লুট করছে। সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার জন্য ইতিমধ্যে ২৫ হাযার অ-কাশ্মীরীদের নাগরিকত্ব দিয়েছে। অন্যদিকে সীমান্তে নিরীহ নিরস্ত্র বাংলাদেশীদের হত্যা করছে প্রতিদিন। এখন বর্ষা মওসুমে বাঁধের পানি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ডুবিয়ে মারছে। বাবরী মসজিদের স্থানে রামমন্দির নির্মাণকারী মোদীর রাজধানী দিল্লীতে পঙ্গপালের হামলা শুরু হ’লেও মোদী এখনো তওবা করেনি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত-রাশিয়া-চীন কেউ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। ইস্রাঈলের ইহূদী প্রশাসন গাযায় বিমান হামলা করে ফিলিস্তীনের নির্যাতিত ও অবরুদ্ধ মুসলিমদের হত্যা করে চলেছে। অথচ করোনা ভাইরাস সে দেশেও হানা দিয়েছে। আমেরিকায় করোনার হানা সবচেয়ে বেশী হ’লেও সেদেশের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হুমকি বন্ধ হয়নি। তারা যে কেবল নগদ স্বার্থ দেখেছে। স্থায়ী স্বার্থের খবর জানেনা। আর তাই মানুষ ও মনুষ্যত্ব কোনটাই এদের কাছে নিরাপদ নয়।

করোনার সাথে আবার আসছে ডেঙ্গু মহামারী ও বন্যা। এ অবস্থায় আল্লাহর অনুগ্রহ কামনার সাথে সাথে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ব্যবস্থা অবলম্বন করা আবশ্যক। সেই সাথে দেশে দেশে ও মানুষে মানুষে পরস্পরে সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও মানবতা প্রদর্শন করা অপরিহার্য। অতএব হে মানুষ! সর্বাগ্রে মনুষ্যত্বকে বাঁচাও। করোনার সাথে যুদ্ধের ফালতু হুমকি ছাড়। বরং মনুষ্যত্বের মৃত্যু ঠেকাও।  করোনাকে যিনি পাঠিয়েছেন, তাকে ভয় করো। তাঁর বিধান মেনে চলো। মানুষকে ভালবাস ও মানুষের সেবার মাধ্যমে আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)