যুলুমের পরিণতি ভয়াবহ

আল্লাহ বলেন, ‘আর তোমার প্রতিপালক এমন নন যে, সেখানকার অধিবাসীরা সৎকর্মশীল হওয়া সত্ত্বেও জনপদ সমূহকে অন্যায়ভাবে ধ্বংস করে দিবেন’ (হূদ ১১/১১৭)। পৃথিবীর প্রাচীন ছয়টি জাতি আল্লাহর গযবে ধ্বংস হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে তাদের যুলুমের কারণে। উক্ত ৬টি জাতি হ’ল- কওমে নূহ, ‘আদ, ছামূদ, কওমে লূত, মাদইয়ান ও কওমে ফেরাঊন। তাদের প্রধান প্রধান পাপগুলি কুরআনে ও হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। যাতে উম্মতে মুহাম্মাদী তা থেকে সাবধান হয়। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি বিষয়ে পরীক্ষার সম্মুখীন হবে : (১) যখন কোন জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তখন সেখানে মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া এমন সব ব্যাধির উদ্ভব হয়, যা পূর্বেকার লোকদের মধ্যে কখনো দেখা যায়নি। (২) যখন কোন জাতি ওযন ও মাপে কারচুপি করে, তখন তাদের উপর দুর্ভিক্ষ, কঠিন দারিদ্র্য ও শাসকদের নিষ্ঠুর দমন-নিপীড়ন নেমে আসে। (৩) যখন কোন জাতি তাদের ধন-সম্পদের যাকাত বন্ধ করে, তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূ-পৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত, তাহ’লে কখনো বৃষ্টিপাত হ’ত না। (৪) যখন কোন জাতি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে কৃত (ঈমানের) অঙ্গীকার ভঙ্গ করে, তখন আল্লাহ তাদের উপর তাদের বিজাতীয় দুশমনকে ক্ষমতাসীন করে দেন এবং তারা তাদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়। (৫) যখন তোমাদের শাসকবর্গ আল্লাহর কিতাব মোতাবেক ফায়ছালা করে না এবং আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান ব্যতীত অন্য বিধান গ্রহণ করে, তখন আল্লাহ তাদের পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দেন (ইবনু মাজাহ হা/৪০১৯; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১০৬)

বিশ্ব এখন চূড়ান্ত যুলুমের মধ্য দিয়েই অতিক্রম করছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির ছোবলে এবং হিংস্র রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের কারণে নিরীহ মানুষের জান-মাল ও ইযযতের কোন গ্যারাণ্টি নেই। বর্ণবিদ্বেষ, ধর্মবিদ্বেষ, অঞ্চল বিদ্বেষ, ভাষা বিদ্বেষ, দল বিদ্বেষ ইত্যাদি নানাবিধ হিংসা-বিদ্বেষ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। অগণিত যুলুমের মধ্যে বর্তমান শতাব্দীর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি তুলে ধরা হ’ল।-

(১) ১৯২৪ সালে তুরস্কের ইসলামী খেলাফত ধ্বংসকারী তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শাসক ইংরেজদের হাতের পুতুল কামাল পাশার মাধ্যমে ১৯৩৪ সালে ঐতিহ্যবাহী ‘আয়া সোফিয়া’ জামে মসজিদকে জাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়। প্রতিটি মুসলিমের হৃদয়ের রক্তস্রাবী এই যুলুম আল্লাহ বরদাশত করেননি। তাই দীর্ঘ ৮৬ বছর পরে গত ২০শে জুলাই’২০ বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগানের মাধ্যমে পুনরায় সেটি মসজিদে রূপান্তরিত হয় এবং আযানের ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়। (২) ভিন্নমতের কারণে সর্বস্বহারা বিহারী মুসলমানরা আজ ৫০ বছর যাবৎ বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দী দশায় মানবেতর জীবন যাপন করছে। তাদের বর্তমান প্রজন্ম পুরাপুরি বাংলাদেশী। কিন্তু নাগরিকত্ব না পেয়ে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তারা এই মুসলিম দেশে মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত। (৩) ১৯৭২ সালে পদ্মার উজানে ‘ফারাক্কা বাঁধ’ নির্মাণ করে, অতঃপর ১৯৯৮ সালে তিস্তার উজানে ‘গজলডোবা বাঁধ’ নির্মাণ করে অদ্যাবধি ভারত বাংলাদেশকে শুকিয়ে ও ডুবিয়ে মারছে। ফলে পদ্মা এখন পৃথিবীর সবচাইতে ভাঙন প্রবণ নদীতে পরিণত হয়েছে। অব্যাহত ভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের ভিটামাটি ও অগণিত ভৌত কাঠামো। দেশের শ্রেষ্ঠ নদী পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা, সুরমা ও শাখা নদী সমূহের ভাঙনে পুরা দেশের অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। সেইসাথে সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যা নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে। যার কোন প্রতিকার নেই। (৪) ১৯৪৭ সালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীর প্রদেশকে যবরদস্তী ভারতভুক্ত করে নেওয়ার পর ২০১৯ সালের ৫ই আগস্ট প্রদেশটির স্বায়ত্ত শাসন কেড়ে নিয়ে পুরাপুরি আত্মীকরণ করা হয়েছে। আর সেখানকার মুসলমানদের উপর চাপানো হয়েছে কয়েক লাখ সেনার হিংস্র শাসন। এই যুলুম চলছে গত ৭৩ বছর ধরে। (৫) ১৫২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত অযোদ্ধার বাবরী মসজিদকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে ৪৯২ বছর পর গত ৫ই আগস্ট’২০ সেখানে ৪০ কেজি ওযনের রূপার ইট বসিয়ে রাম মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছেন কথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। যে মসজিদ রক্ষার জন্য ইতিপূর্বে কয়েক হাযার মুসলমানের জীবন গেছে। অথচ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোক কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের মতে, রাম শুধু মহাকাব্যে রয়েছেন। বাস্তবে কেউ ছিলেন না। (৬) প্রতিবেশী দেশ মায়ানমারে ৭৮৮ খৃষ্টাব্দে বৌদ্ধ আগমনের দেড়শ’ বছরের অধিককাল পূর্ব থেকে সেখানকার স্থায়ী নাগরিক ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে সেদেশের বৌদ্ধ প্রশাসন ভিটে-মাটি হ’তে বিতাড়িত করল। যারা এখন বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে কার্যতঃ বন্দী জীবন যাপন করছে। তাদেরকে তাদের স্বদেশে ফিরিয়ে নেওয়ার কোন সক্রিয় উদ্যোগ এযাবৎ বিশ্ব সম্প্রদায়ের মধ্যে দেখা যায়নি। (৭) চীনের ঝিংঝিয়াং প্রদেশের ‘উইঘুর’ মুসলমানরা ১৯৪৯ সাল থেকে রাষ্ট্রীয় যুলুমের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছে। যার কোন প্রতিকার নেই। (৮) ১৯৪৮ সাল থেকে ফিলিস্তীনের হাযার বছরের স্থায়ী নাগরিক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা সেখান থেকে উৎখাত হয়ে অদ্যাবধি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলিতে শরণার্থী জীবন যাপন করছে। ফিলিস্তীন আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় কারাগার। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারাই এজন্য দায়ী। (৯) বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ২০০১ সালে ‘অপারেশন ক্লীনহার্ট’ থেকে দেশে ক্রসফায়ার ও বন্দুক যুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড শুরু হয়। তখন থেকে গত ২০ বছরের হত্যার ঘটনাপঞ্জি প্রমাণ করে যে, এটা কার্যতঃ রাষ্ট্রের নীতি হয়ে উঠেছে। সরকারের দেওয়া অঘোষিত দায়মুক্তির জেরে সারা দেশেই এটা চলছে। পুলিশ ও মানবাধিকারকর্মীদের হিসাব বলছে, ২০১৮ সালের ৪ঠা মে থেকে সারা দেশে মাদকবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকে গত দুই বছরে বিভিন্ন বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ৫৮৬ জন নিহত হয়েছে। এর প্রায় অর্ধেকই (২৩০ জন) নিহত হয়েছে কক্সবাজার যেলায়। এর অর্ধেক আবার মেরিন ড্রাইভ সড়কে ও তার আশপাশে। সারা দেশের হিসাবে ক্রসফায়ারে মোট নিহতের প্রতি ছয়জনের একজনের লাশ পাওয়া গেছে এখানে। কক্সবাজার থেকে টেকনাফ পর্যন্ত ৮৪ কিলোমিটার মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশ, বিজিবি ও সেনাবাহিনীর মোট ১১টি তল্লাশী চৌকি থাকার পরও কী করে এত বন্দুকযুদ্ধ হয়, কেন এখানে এত লাশের মিছিল? এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কাছে নেই (প্রথম আলো ১৭.০৮.২০২০)। ফলে সাগর তীরবর্তী সৌন্দর্য্যের বেলাভূমি স্বপ্নের ‘মেরিন ড্রাইভ সড়ক’ এখন আতঙ্কের মহাসড়কে পরিণত হয়েছে। 

টেকনাফে গত ২২ মাসে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের হাতে ১৪৪টি ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় নিহত হয়েছে ২০৪ জন। তাদের অর্ধেকের বেশী লাশ পড়েছে মেরিন ড্রাইভ সড়কে (দৈনিক ইনকিলাব ৩.৮.২০২০)। এরপরেও ওসি প্রদীপ ২০১৯ সালে পুলিশের সর্বোচ্চ পদক ‘বিপিএম’ লাভ করেছে। ইতিমধ্যে তার স্থাবর সম্পত্তির যে হিসাব বের হয়েছে, তা রীতিমত পিলে চমকানোর মত। চট্টগ্রাম শহরে চার শতক জমির উপরে ৬ তলা বাড়ী, কক্সবাজারে দু’টি হোটেল, ফ্ল্যাট, দু’টি গাড়ি, স্ত্রীর নামে চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে আছে মৎস্য খামার। এছাড়াও ভারতের আগরতলা ও অষ্ট্রেলিয়াতে একাধিক ফ্ল্যাট, রেস্টুরেন্টসহ কোটি কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে। তার ভাই সদীপ কুমার দাশ চট্টগ্রাম মহানগরীর ডবলমুরিং থানার ওসি এবং বর্তমানে এক স্কুল ছাত্র হত্যাকান্ডের আসামী। আরেক ভাই দিলীপ কুমার দাশ চট্টগ্রাম যেলা পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত হেডক্লার্ক। যিনি তার ভাইদেরকে সর্বদা চট্টগ্রাম রেঞ্জে কর্মরত থাকতে সহযোগিতা করতেন।  

বর্তমানে প্রদীপ কুমার দাশ ঈদুল আযহার আগের রাতে ৩১শে জুলাই শুক্রবার মেরিন ড্রাইভ সড়কে সাবেক ব্রিগেড মেজর ও প্রধানমন্ত্রীর এসএসএফ সদস্য মেজর সিনহা মুহাম্মাদ রাশেদ (৩৬) হত্যাকান্ডের প্রধান আসামী। গত তিন সপ্তাহে ব্যাপক তদন্ত শেষে বর্তমানে সেটি থমকে দাঁড়িয়েছে একটি স্পর্শকাতর স্থানে যে, কোনরূপ জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই মাত্র ২ মিনিটে নিরস্ত্র মেজর (অবঃ) সিনহা হত্যাকান্ডের আগে-পরে ১১ দিন যাবৎ টেকনাফ থানা ভবনের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলি কেন অচল ছিল? (১০) আমরা আজও জানিনা যে, বিগত চারদলীয় ‘ইসলামী মূল্যবোধে’র জোট সরকার কেন ২০০৫ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারী গভীর রাতে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে মারকায থেকে গ্রেফতার করেন? কেন তাদের বিরুদ্ধে ১০টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়? অতঃপর সেই মিথ্যা মামলার পিছনে জনগণের লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করা হয়? কেন মানহানি করা হয় শ্রদ্ধেয় নেতৃবৃন্দের? অবশেষে বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত হন তারা সবাই। যালেমদের দুনিয়াবী পরিণতি সবাই দেখেছেন। আখেরাতের পরিণতি হবে আরও ভয়াবহ। বর্তমান ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সরকারের আমলে বস্ত্তনিষ্ঠ নামধারী সরকারী ও বেসরকারী কিছু মিডিয়ায় মাঝে-মধ্যে জঙ্গী হামলাকারীদের তালিকায় বেকসুর খালাসপ্রাপ্ত এইসব আহলেহাদীছ নেতৃবৃন্দের ছবি দেখানো হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি যুলুম। আর এই যুলুমের প্রতিকার আমরা সেদিনের মত আজও কেবল আল্লাহর নিকটেই কামনা করি।

পরিশেষে বলতে চাই, নগদে হৌক বা দেরীতে হৌক, যুলুমের শাস্তি পেতেই হবে। আর তা হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। আল্লাহ বলেন, ‘কেউ অণু পরিমাণ সৎকর্ম করলেও তা সে দেখতে পাবে’। ‘আর কেউ অণু পরিমাণ মন্দকর্ম করলেও তা সে দেখতে পাবে’ (যিলযাল ৯৬/৭-৮)। তিনি বলেন, ‘আর তোমরা ঐ দিনকে ভয় কর, যেদিন তোমরা সকলে আল্লাহর নিকটে ফিরে যাবে। অতঃপর সেদিন প্রত্যেকে স্ব স্ব কর্মের ফল পুরোপুরি পাবে এবং তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১)। আর এটাই ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে নাযিলকৃত পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ আয়াত। আল্লাহ যালেমদের বারিত করুন ও মাযলূমদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)।