বিসমিল্লাহির রহমানির রহীম
নাহ্মাদুহু ওয়া নুছাল্লী ‘আলা রাসূলিহিল কারীম
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُوْدَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَآءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَآءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللهَ لاَ يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِيْنَ- فَتَرَى الَّذِيْنَ فِي قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيْهِمْ يَقُولُوْنَ نَخْشَى أَنْ تُصِيْبَنَا دَائِرَةٌ فَعَسَى اللهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَى مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ- وَيَقُولُ الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَهَؤُلَآءِ الَّذِيْنَ أَقْسَمُوْا بِاللهِ جَهْدَ أَيْمَانِهِمْ إِنَّهُمْ لَمَعَكُمْ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فَأَصْبَحُوا خَاسِرِيْنَ-
‘হে মুমিনগণ! তোমরা ইহূদী-নাছারাদের বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তারা একে অপরের বন্ধু। তোমাদের মধ্যে যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করবে, তারা তাদের মধ্যে গণ্য হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (৫১)। ‘অতঃপর তুমি দেখবে যাদের অন্তরে রোগ আছে দ্রুত তাদের মধ্যে প্রবেশ করবে আর বলবে, আমাদের ভয় হয় জানি না আবার কোন বিপদ এসে পড়ে। অতএব সত্বর আল্লাহ বিজয় অথবা তাঁর পক্ষ হ’তে কোন নির্দেশ নিয়ে আগমন করবেন। তখন তারা তাদের অন্তরে লুকানো বস্ত্তর কারণে লজ্জিত হবে’ (৫২)। ‘আর মুসলমানেরা বলবে, আরে এরাই তো তারা যারা আল্লাহর নামে দৃঢ় শপথ করত যে তারা তোমাদের সাথেই আছে। বস্ত্ততঃ তাদের সমস্ত কর্ম নিষ্ফল হ’ল। ফলে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল’ (মায়েদাহ ৫/৫১-৫৩)।
ব্যাখ্যা : প্রথম আয়াতে মুসলমানদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে, তারা যেন ইহূদী ও খৃষ্টানদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব না করে। সাধারণ অমুসলিম এবং ইহূদী ও খৃষ্টানদের রীতিও তাই। তারা গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুধু স্বীয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখে, মুসলমানদের সাথে নয়।
এরপর যদি কোন মুসলমান এ নির্দেশ অমান্য করে কোন ইহূদী বা খৃষ্টানের সাথে গভীর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে সে ইসলামের দৃষ্টিতে সে সম্প্রদায়েরই লোক বলে গণ্য হওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবে।
শানে নুযূল : (১) সুদ্দী বর্ণনা করেন যে, ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের ফলে কিছু নওমুসলিম ভীত হয়ে ইহূদী-নাছারাদের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করতে চায়। তার জবাবে অত্র আয়াত নাযিল হয়। (২) অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, অর্থ, অস্ত্র ও জনবলে বলিয়ান ইহূদীদের সাথে বন্ধুত্ব রক্ষা করা না করার ব্যাপারে হযরত উবাদাহ বিন ছামিত (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললেন যে, আমি তাদের সাথে বন্ধুত্ব ত্যাগ করে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাই। পক্ষান্তরে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই বলল যে, এটা আমার জন্য বিপজ্জনক’। তখন এ আয়াত নাযিল হয়।[1] (৩) আরেকটি বর্ণনায় এসেছে যে, ওহোদ যুদ্ধে বিপর্যয়ের ফলে কিছু লোক নবুঅতের যথার্থতার ব্যাপারে সন্দিহান হয়ে পড়ে। ইহূদী নেতা কা‘ব ইবনুল আশরাফ ৪০ জন ঘোড় সওয়ার নিয়ে গোপনে মক্কায় চলে যায় এবং আবু সুফিয়ানের সাথ চুক্তিবদ্ধ হয়। অতঃপর আবু সুফিয়ান তাদের সাথে কা‘বা গৃহে গিয়ে গেলাফ ধরে আল্লাহর নামে শপথ করে। এ খবর রাসূলের কানে পৌঁছলে তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাকে পাঠিয়ে কা‘বকে ভোর রাতে তার বাড়ীতে হত্যা করেন।[2] অতঃপর সেদিনই সকালে বনু নাযীর গোত্রকে অবরোধ করেন।[3] অতঃপর মুনাফিকদের আচরণ সম্পর্কে দ্বিতীয় আয়াতটি অবতীর্ণ হলঃ
فَتَرَى الَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ يُسَارِعُونَ فِيهِمْ يَقُولُونَ نَخْشَى أَنْ تُصِيبَنَا دَائِرَةٌ،
‘অতঃপর তুমি দেখবে যাদের অন্তরে রোগ আছে দ্রুত তাদের মধ্যে প্রবেশ করবে আর বলবে, আমাদের ভয় হয় জানি না আবার কোন বিপদ এসে পড়ে’ (মায়েদাহ ৫/৫২)।
আল্লাহ এর উত্তরে বলেন,
فَعَسَى اللهُ أَنْ يَأْتِيَ بِالْفَتْحِ أَوْ أَمْرٍ مِنْ عِنْدِهِ فَيُصْبِحُوا عَلَى مَا أَسَرُّوا فِي أَنْفُسِهِمْ نَادِمِينَ-
‘অতএব সত্বর আল্লাহ বিজয় অথবা তাঁর পক্ষ হ’তে কোন নির্দেশ নিয়ে আগমন করবেন। তখন তারা তাদের অন্তরে লুকানো বস্ত্তর কারণে লজ্জিত হবে’ (মায়েদাহ ৫/৫২ বাকী অংশ)।
তৃতীয় আয়াতে এ বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যে, যখন মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচিত হবে এবং তাদের বন্ধুত্বের দাবী ও শপথের স্বরূপ ফুটে উঠবে, তখন মুসলমানরা বিস্ময়াভিভূত হয়ে বলবে, এরাই কি আমাদের সাথে আল্লাহর নামে দৃঢ় শপথ করে বন্ধুত্বের দাবী করত? আজ এদের সব লোক দেখানো ধর্মীয় কার্যকলাপই বিনষ্ট হয়ে গেছে। আলোচ্য আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের ব্যর্থতা ও লাঞ্ছনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তার বাস্তব চিত্র কিছুদিন পরে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সবাই প্রত্যক্ষ করেছিল।
ইহূদী-খৃষ্টানরা মুসলমানদের বন্ধু নয় :
আল্লাহ বলেন,
وَلَنْ تَرْضَى عَنْكَ الْيَهُودُ وَلاَ النَّصَارَى حَتَّى تَتَّبِعَ مِلَّتَهُمْ قُلْ إِنَّ هُدَى اللهِ هُوَ الْهُدَى وَلَئِنِ اتَّبَعْتَ أَهْوَاءَهُمْ بَعْدَ الَّذِي جَآءَكَ مِنَ الْعِلْمِ مَا لَكَ مِنَ اللهِ مِنْ وَلِيٍّ وَّلاَ نَصِيرٍ-
‘ইহূদী-নাছারারা কখনোই তোমার উপর সন্তুষ্ট হবে না, যে পর্যন্ত না তুমি তাদের ধর্মের অনুসরণ করবে। তুমি বল, নিশ্চয়ই আল্লাহর দেখানো পথই সঠিক পথ। আর যদি তুমি তাদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ কর, তোমার নিকটে (অহি-র) জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তবে আল্লাহর কবল থেকে তোমাকে বাঁচাবার মতো কোন বন্ধু বা সাহায্যকারী নেই’ (বাক্বারাহ ২/১২০)।
আয়াতে উল্লেখিত ‘মিল্লাত’ অর্থ দ্বীন ও শরী‘আত (কুরতুবী) এবং ‘ইল্ম’ অর্থ কুরআন ও সুন্নাহ (ইবনু কাছীর)। অত্র আয়াতের উপরে ভিত্তি করে ইমাম আবু হানীফা, শাফেঈ, দাঊদ ইবনে আলী, আহমাদ প্রমুখ বিদ্বানগণ বলেন,أَنَّ الْكُفْرَ كُلَّهُ مِلَّةٌ وَّاحِدَةٌ ‘কাফেরগণ সকলেই এক মিল্লাত ভুক্ত’ (কুরতুবী)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, لاَ يَرِثُ الْمُسْلِمُ الْكَافِرَ وَلاَ الْكَافِرُ الْمُسْلِمَ- ‘মুসলিম কোন কাফিরকে ওয়ারিছ বানায় না বা কোন কাফির কোন মুসলিমকে ওয়ারিছ বানায় না’।[4] তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে শত্রুতা করেছিল কেবলমাত্র ‘ইসলাম’-এর কারণে। সেকারণ আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে জানিয়ে দিলেন যে, তারা কখনোই তার উপরে খুশী হবে না, যতক্ষণ না তিনি তাদের মিল্লাতভুক্ত হবেন। অতঃপর তিনি রাসূলকে তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের নির্দেশ দিলেন’ (কুরতুবী)।
কুরআন অবতরণের পরে তাওরাত-ইঞ্জীল মানসূখ হয়ে গেছে। এসবের কোন হুকুম এখন আর কারু জন্য পালনযোগ্য নয়। মূল তাওরাত ও ইঞ্জীলের কোন অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। পুরাতন ও নতুন সমাচার (Old & New Testament) বলে প্রচলিত বই সমূহ তাদের নিজেদের রচিত। বিশ্ব মানবতাকে তাই এখন কেবলমাত্র কুরআন-সুন্নাহ মেনে চলতে হবে। ইমাম শাওকানী বলেন, ‘ইহূদী-নাছারাদের শরী‘আত এখন মানসূখ বা হুকুম রহিত। তাদের কিতাব সমূহ পরিবর্তিত হয়ে গেছে’। এখন তাদের কিতাবের অনুসরণ করা অর্থ তাদের খোশখেয়াল সমূহের অনুসরণ করা’। তিনি বলেন, ‘এই আয়াতগুলির মধ্যে উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য হুঁশিয়ারী ও সাবধানবাণী রয়েছে যে, তারা যেন ইহূদী-নাছারা বা কোন মুশরিক ও বিদ‘আতী দলসমূহের পাতা ফাঁদে পা না দেয় বা তাদের সন্তুষ্টি ও সমর্থন কামনা না করে। তারা যেন কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট বিধানসমূহ ছেড়ে এইসব দলের চোখ ধাঁধানো ও দুষ্ট মতবাদ সমূহের পিছনে না ছোটে’ (শাওকানী, ফাৎহুল ক্বাদীর)।
সৈয়দ রশীদ রিযা বলেন, অত্র আয়াতে ‘আহলুল কিতাব’ না বলে ‘ইয়াহূদ’ ও ‘নাছারা’ বলার তাৎপর্য এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও মুমিন সম্প্রদায়ের সাথে তাদের শত্রুতা মূলতঃ কিতাবের কারণে ছিল না। কেননা তাদের কিতাব রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে শত্রুতা করতে বলেনি। বরং তাদের এই দুশমনী ছিল স্রেফ রাজনৈতিক ও দলীয় হিংসার কারণে। ইবনু জারীর ত্বাবারী বলেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা সকল মুসলমানকে নির্দেশ দিচ্ছেন তারা যেন ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে ইহূদী-নাছারাকে তাদের আন্তরিক বন্ধু হিসাবে গ্রহণ না করে। যে ব্যক্তি এটা করবে, সে ব্যক্তি আল্লাহ, রাসূল ও মুমিনদের দলের বাইরে চলে যাবে। আল্লাহ ও রাসূল তাদের থেকে মুক্ত’।[5]
শুধু ইহূদী-খৃষ্টান নয়, বরং কোন কাফেরের সাথে কোনরূপ বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে নিষেধ করে বলা হচ্ছে,لاَ يَتَّخِذِ الْمُؤْمِنُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَآءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ وَمَنْ يَّفْعَلْ ذَلِكَ فَلَيْسَ مِنَ اللهِ فِي شَيْءٍ إِلاَّ أَنْ تَتَّقُوا مِنْهُمْ تُقَاةً، ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদের ছেড়ে কাফিরদের বন্ধুরূপে গ্রহণ না করে। যারা এরূপ করবে, আল্লাহর সাথে তাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। তবে তোমরা যদি তাদের থেকে কোন অনিষ্টের আশংকা কর’ (আলে ইমরান ৩/২৮)। দুনিয়াবী সম্মান লাভের জন্য যাতে এটা না করা হয়, সেজন্য বলা হয়েছে,الَّذِينَ يَتَّخِذُونَ الْكَافِرِينَ أَوْلِيَاءَ مِنْ دُونِ الْمُؤْمِنِينَ أَيَبْتَغُونَ عِنْدَهُمُ الْعِزَّةَ فَإِنَّ الْعِزَّةَ لِلَّهِ جَمِيعًا ‘যারা মুমিনদের বাদ দিয়ে কাফিরদের বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে, তারা কি তাদের কাছে সম্মান কামনা করে? জেনে রেখো সর্বপ্রকার ইযযতের মালিকানা স্রেফ আল্লাহর’ (নিসা ৪/১৩৯)। এমনকি নিজের বাপ-ভাই যদি ঈমানের উপরে কুফরীকে ভালবাসে, তবে তাদেরকেও বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না (তওবাহ ৯/২৩)। মুসলমানদের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে বিশেষ করে কোন মুসলিম দেশের জাতীয় ও পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে অত্র আয়াতগুলি স্থায়ী মূলনীতি স্বরূপ।
ইহূদী-খৃষ্টানদের ইতিহাস চির কপটতার ইতিহাস :
(১) রাসূলকে হত্যার ষড়যন্ত্র : হিজরতের পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত বনু নাযীর, বনু কুরায়যা প্রমুখ ইহূদী-নাছারা গোত্রসমূহের সাথে এক সন্ধিচুক্তি স্বাক্ষর করেন, যা ইতিহাসে ‘মদীনার সনদ’ নামে পরিচিত। উক্ত চুক্তির শর্ত অনুযায়ী কেউ কারু বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে না। বরং পরষ্পরে মিলে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। কিন্তু কিছু সংখ্যক মুনাফিকের প্ররোচনায় ও কাফিরদের আহবানে তাদের গোত্রে দ্বীন প্রচারের জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ৭০ জনের একটি প্রচারকদল পাঠালে তারা সকলেই মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের শিকার হন। ইতিহাসে যা বি’রে মা‘ঊনার ঘটনা বলে প্রসিদ্ধ। উক্ত হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যাওয়া মাত্র একজন ছাহাবী আমর বিন উমাইয়া যামীরী মদীনায় ফেরার পথে শত্রুপক্ষীয় দু’জন কাফেরকে পেয়ে হত্যা করে ফেলেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এ দু’জন ছিল বনু আমের গোত্রের লোক, যাদের সঙ্গে রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর শান্তিচুক্তি ছিল। কিন্তু সেকথা উক্ত ছাহাবী জানতেন না। তাদের সাথে বনু নাযীরেরও শান্তিচুক্তি ছিল। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তখন ঐ দুই নিহত ব্যক্তির রক্তমূল্য আদায়ের জন্য মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়ার পরে মদীনা থেকে কয়েক মাইল দূরে বনু নাযীর ইহূদী গোত্রে গমন করেন। হযরত আবুবকর, ওমর, আলী প্রমুখ ছাহাবী তাঁর সাথে ছিলেন। বনু নাযীর গোত্র তাঁদেরকে সসম্মানে একটি প্রাচীরের ছায়ায় বসতে দিল এবং গোত্রের লোকদের নিকট থেকে চাঁদা তুলে এনে তাঁকে দেবার প্রতিশ্রুতি দিল। ইতিমধ্যে তাদের মধ্যে দুষ্টবুদ্ধি জেগে উঠল এবং এই সুযোগে রাসূলকে হত্যা করার ফন্দি অাঁটলো এবং বললঃ কে আছ এই লোকটিকে হত্যা করে এর হাত থেকে আমাদের শান্তি দিতে পার? তখন আমর বিন জাহহাশ বিন কা‘ব নামক জনৈক ইহূদী সঙ্গে সঙ্গে রাযী হয়ে গেল এবং বড় একটি পাথর তাঁদের উপরে ফেলে মারার জন্য প্রাচীরের উপরে উঠে গেল। অহি-র মাধ্যমে এ ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলেন এবং চুক্তিভঙ্গের অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন। অবশ্য তিনি তাদেরকে অস্ত্র ব্যতীত কেবল এক উট বোঝাই মাল-সামান নিয়ে তাদের ইচ্ছামত স্থানে চলে যাবার জন্য ১০ দিনের সুযোগ দিলেন। কিন্তু মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই ও তার সাথীদের প্ররোচনায় তারা তাদের মযবূত প্রাচীর বেষ্টিত দুর্ভেদ্য ঘাঁটিতে অবস্থান নেয়। কিন্তু পরিশেষে মুনাফিকদের নিকট থেকে কোন সাহায্য না পাওয়ায় এবং রাসূল (ছাঃ)-এর চূড়ান্ত নির্দেশ প্রাপ্ত হওয়ায় তারা ২১ দিন পরে দুর্গ ছেড়ে বের হয়ে আসে এবং রাসূলের নির্দেশ মতে তারা أرض الحشر অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন মানুষের জমা হওয়ার স্থান শাম দেশ (সিরিয়া) অভিমুখে চলে যায়। হুয়াই বিন আখত্বাব, আব্দুল্লাহ বিন আবিল হুক্বাইক্ব, কিনানা বিন রাবী‘ প্রমুখ ইহূদী নেতৃবৃন্দ ও তাদের সাথীরা খায়বারে বসতি স্থাপন করেন। কেউ কেউ শামের অন্যস্থানে চলে যায়। ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক বলেন যে, এই ঘটনা ওহোদ যুদ্ধের পরে ৪র্থ হিজরীতে এবং বি’রে মা‘ঊনার মর্মান্তিক ঘটনার পরে সংঘটিত হয়। কুরতুবী এ মত সমর্থন করেন। তবে বুখারী যুহরীর মাধ্যমে ওরওয়া (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, এ ঘটনা ২য় হিজরীতে অনুষ্ঠিত বদর যুদ্ধের ছয় মাস পরে এবং ওহোদে পূর্বে সংঘটিত হয়’।[6] মদীনা তথা আরব উপদ্বীপ থেকে তাদের এই উচ্ছেদ ঘটনাকে কুরআনে أول الحشر বা ‘প্রথম একত্রিত উচ্ছেদ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।[7]
তাদের দুর্ভেদ্য দুর্গ থেকে খায়বরে এটা ছিল প্রথম উচ্ছেদ। দ্বিতীয় উচ্ছেদ ঘটে ওমর ফারূকের সময়ে তাদের কুফরী ও ওয়াদা ভঙ্গের কারণে খায়বর থেকে নাজদ ও আযরি‘আতে। কেউ কেউ বলেন, যেরুযালেমের আরীহা ও তাইমাতে’।[8] মূলতঃ হারূণ (আঃ)-এর বংশোদ্ভূত এই গোত্র সিরিয়া থেকে মদীনায় এসে বসতি স্থাপন করেছিল শেষনবীর আগমনের আশায়। কিন্তু শেষনবী বনু ইসরাঈল না হয়ে বনু ইসমাঈল হওয়ায় তারা তাঁকে চিনতে পেরেও অস্বীকার করে স্রেফ বংশীয় অহংকারের যিদে পড়ে (ঐ)।
(২) চুক্তি ভঙ্গ : মদীনার বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা প্রভৃতি ইহূদী-নাছারা গোত্রগুলি বদর যুদ্ধ পর্যন্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে কৃত চুক্তির প্রতি অনুগত ছিল। বরং বদর যুদেধ অভাবিত বিজয় লাভের ফলে তাদের মধ্যে রাসূলেল প্রতি আগ্রহ অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু ওহোদ যুদ্ধ বিপর্যয়ের ফলে ও মুশরিকদের অব্যাহত প্ররোচনার ফলে তাদের মধ্যে চুক্তি ভঙ্গের প্রবণতা দানা বেঁধে ওঠে এবং তাদের অন্যতম নেতা কা‘ব বিন আশরাফ ৪০ জন ইহূদীকে সাথে নিয়ে গোপনে মক্কায় চলে যায় ও সেখানে কুরায়েশ নেতাদের নিয়ে কা‘বা গৃহের গেলাফ স্পর্শ করে আল্লাহকে সাক্ষী রেখে চুক্তিবদ্ধ হয় যে, তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরস্পরকে সহযোগিতা করবে।[9]
(৩) শত্রুর সহযোগিতা : ৪র্থ হিজরীর শাওয়াল মাসে খন্দকের যুদ্ধের সময় বনু কুরায়যা গোত্র মদীনা আক্রমণকারী কাফের দলসমূহের সাথে সহযোগিতা করে। ফলে সন্ধি চুক্তি ভঙ্গের কারণে তাদের পুরুষদের হত্যা করা হয় ও বাকীদের বন্দী করা হয় ও মাল-সম্পদ সবকিছু মুসলমানদের মধ্যে বন্টিত হয়।[10]
ইহূদী-খৃষ্টানদের এই মুসলিম বিদ্বেষের ইতিহাস রাসূলের যুগ থেকে এ যাবত জারি আছে। যদিও সে যুগে আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশীর মত সরলপ্রাণ খৃষ্টান নরপতি ছিলেন। যিনি শুধু মুসলমানদের সাহায্য করেননি; বরং গোপনে ইসলাম কবুল করেছিলেন বলে হাদীছে বর্ণিত হয়েছে। অমনিভাবে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও বহু ইহূদী-খৃষ্টান রয়েছেন, যারা ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি সহানুভূতিশীল সে যুগেও ছিলেন, এ যুগেও আছেন। বনু নাযীরকে যখন মদীনা থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তখনও তাদের মধ্যকার দু’জন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে নিরাপদে মদীনায় থেকে যান। আজও যখন ফিলিস্তীনের অসহায় মুসলমান নর-নারী ও শিশুদের উপরে আমেরিকা ও বৃটেনের সহায়তায় বর্বর ইহূদী শাসকরা নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে, তখনও সেখানে বহু শান্তিপ্রিয় ইহূদী আরব এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতবিাদ মিছিল করে যাচ্ছে। নিউইয়র্কে ও পেন্টাগনে আত্মঘাতি বিমান হামলা চালানোর প্রতিশোধ নিতে যুদ্ধবাজ বুশ প্রশাসন যখন ওসামা বিন লাদেনকে সন্দেহ করে ভূখা-নাঙ্গা আফগান জনগণের উপর ভয়ংকর হামলা পরিচালনার হুমকি দিচ্ছে এবং আমেরিকার সরকারী ও বিরোধীদল সর্বসম্মতিক্রমে এই হামলা পরিকল্পনা অনুমোদন করছে, তখনও দেখা যাচ্ছে নিউইয়র্ক সিটিতে হাযার হাযার খৃষ্টান ছাত্র যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করে প্লাকার্ড বহন করে মিছিল করছে। এধরনের ব্যতিক্রম চিরকাল ছিল আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ।
কিন্তু সাধারণভাবে সকল ইহূদী-খৃষ্টান মুসলিম উম্মাহর শত্রু। বিশেষ করে ইহূদীরাই সবচেয়ে বড় শত্রু। ইবনু কাছীর বলেন, এর কারণ হ’ল এই যে, এদের ইসলাম বিদ্বেষ হ’ল হঠকারিতাসূলভ। এরা ইসলাম ও শেষ নবীকে হক জেনেই অস্বীকার করে কেবল বংশীয় অহংকার বশে। তারা বনী ইসরাঈলের বহু নবীকে হত্যা করেছে। অবশেষে আখেরী নবীকে কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টা চালিয়েছে। তাঁকে বিষ প্রয়োগ করেছে ও জাদু করেছে’। ইহূদীদের চাইতে নাছারাগণ মুসলমানদের কিছুটা নিকটবর্তী হবার কারণ এই যে, তারা নিজেদেরকে ঈসা (আঃ)-এর আনীত ইঞ্জীল কিতাবের অনুসারী বলে দাবী করে। তাছাড়া নাছরাদের মধ্যে বহু দুনিয়াত্যাগী সরলপ্রাণ ধর্মযাজক আছেন, যাদের সম্পর্কে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে’।[11]
(৪) খাদ্যে বিষপ্রয়োগ : খায়বরের ইহূদীরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মেহমান হিসাবে দা‘ওয়াত দিয়ে খাদ্যে বিষ মিশ্রিত করে তাঁকে হত্যার চেষ্টা করে।[12]
(৫) চূলে জাদু : মুনাফিক লাবীদ বিন আ‘ছাম রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর চূলে জাদু করে তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটানোর চেষ্টা করে।[13]
(৬) ক্রুসেড ঘোষণা : ১০৯৮-১২৯১ খৃষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর ব্যাপী ক্রুসেড যুদ্ধের ফলে খৃষ্টান-মুসলিম সম্ভাব দূর হয়ে যায়। অবশেষে ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর হাতে গোটা ইউরোপীয় খৃষ্টান শক্তি চরমভাবে মার খায়। এই পরাজয়ের গ্লানি তারা কখনো ভুলেনি। তাই ১ম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে যখন যেরুযালেম মুসলমানদের হাত থেকে বৃটিশ খৃষ্টানদের হাতে চলে যায়, সেদিন যেরুযালেমের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে বৃটিশ জেনারেল এলেনবাই বলেছিল "Today ends the crusade" ‘আজকে ক্রুসেড শেষ হ’ল’। ১৯২০ সালে ফরাসী জেনারেল গুরিয়ান একইভাবে সুলতান ছালাহুদ্দীন আইয়ূবীর কবরে পা রেখে বলে ওঠেন, "We have come back Saladin" ‘ছালাহুদ্দীন আমরা আবার ফিরে এসেছি’।
(৭) অবৈধ ইসরাঈল রাষ্ট্রের প্রতিষ্টা: রাশিয়া থেকে বিতাড়িত ইহূদীদেরকে খৃষ্টানরাই ফিলিস্তীনে জোরপূর্বক বসতি স্থাপনে বাধ্য করে এবং তাদেরকে সামনে রেখে ১৯৪৮ সালের ১৪ই মে তারিখে অবৈধ ‘ইসরাঈল’ রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে এ যাবত তাদেরকে দিয়েই দৈনিক মুসলিমদের রক্ত ঝরাচ্ছে এবং সমস্ত মধ্যপ্রাচ্যের উপরে ছড়ি ঘুরাচ্ছে।
(৮) চির অভিশপ্ত : সূরায়ে ফাতিহাতে বর্ণিত ‘মাগযূব’ (অভিশপ্ত) ও ‘যা-ল্লীন’ (পথভ্রষ্ট)-এর ব্যাখ্যায় ইমাম আহমাদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বাণী উদ্ধৃত করেন যে, إِنَّ الْمَغْضُوبَ عَلَيْهِمُ الْيَهُودُ وَإِنَّ الضَّالِّينَ النَّصَارَى ‘অভিশপ্ত হ’ল ইহূদীরা এবং পথভ্রষ্ট হ’ল নাছারাগণ’ (সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৬৩)। মুসলিম মুফাসসিরগণের মধ্যে এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই। হাফেয ইবনু কাছীর বলেন, উভয় দলই আল্লাহর গযব ও লা‘নতপ্রাপ্ত। তবে উভয়ের মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য এই যে, ইহূদীরা ইসলাম-এর সত্যতা উপলব্ধি করেও তা যিদ ও অহংকারবশে প্রত্যাখ্যান করে (কারণ শেষ নবী (ছাঃ) তাদের বংশে জন্মগ্রহণ না করে ইসমাঈলের বংশে জন্মগ্রহণ করেছেন)। পক্ষান্তরে নাছারাগণের নিকটে ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান নেই। ফলে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছে। তারা ভ্রষ্টতার অন্ধকারে পথ হাতড়িয়ে ফিরছে। আল্লাহ নিজেই তাদের এ বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে বলেন, قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ ‘তারা পূর্বেই পথভ্রষ্ট হয়েছে এবং বহু লোককে পথভ্রষ্ট করেছে। তারা সঠিক রাস্তা হতে পথভ্রষ্ট হয়েছে’ (মায়েদাহ ৭৭)।
নবী হত্যাকারী ও কিতাব পরিবর্তনকারী :
ইহূদীদের সম্বন্ধে আল্লাহ বলেন, وَضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ وَالْمَسْكَنَةُ وَبَاءُوا بِغَضَبٍ مِنَ اللَّهِ ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَانُوا يَكْفُرُونَ بِآيَاتِ اللَّهِ وَيَقْتُلُونَ النَّبِيِّينَ بِغَيْرِ الْحَقِّ ذَلِكَ بِمَا عَصَوْا وَكَانُوا يَعْتَدُونَ ‘এবং তাদের উপরে আরোপ করা হ’ল লাঞ্ছনা ও পরমুখাপেক্ষিতা। তারা আল্লাহর গযবে পতিত হ’ল। এটা এজন্য যে, তারা আল্লাহর আয়াত সমূহকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং অন্যায়ভাবে নবীদেরকে হত্যা করেছিল। কারণ তারা ছিল না-ফরমান ও সীমালংঘনকারী’ (বাক্বারাহ ২/৬১)। ইবনু আববাস বলেন, ১০ জন ব্যতীত বাকী সকল নবী ছিলেন বনী ইসরাঈলের।[14] কিন্তু তারা কোন নবীকেই মানতে চায়নি। বরং একই দিনে ৩০০ নবীকে এরা হত্যা করেছে বলে ইবু মাসঊদের একটি বর্ণনায় জানা যায়।[15]
ইহূদী-নাছারাদের অভিশপ্ত ও পথভ্রষ্ট হওয়ার যে চারটি কারণ পবিত্র কুরআনে (মায়েদাহ ৪১-৪২) বর্ণিত হয়েছে, তন্মধ্যে অন্যতম প্রধান কারণ হ’ল: আল্লাহর কিতাব তাওরাত ও ইঞ্জীলকে বিকৃত করা। তাওরাত-ইঞ্জীল বিকৃত হওয়ার কারণ হ’ল এই যে, এর হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ ইহূদী-নাছারাদের উপরেই ন্যস্ত করেছিলেন (মায়েদাহ ৪৪)। কিন্তু যথাযথ হেফাযত না করে তারা ইচ্ছামত সেখানে শব্দগত ও অর্থগত পরিবর্তন ঘটায় (বাক্বারাহ ৭৫, নিসা ৪৬, মায়েদাহ ১৩-১৪)। পক্ষান্তরে কুরআনের হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহ নিজেই নিয়েছেন (হিজর ৯)। ফলে বিগত ১৪০০ বছরেও তার একটি নুকতা-হরফ পরিবর্তন হয়নি। যদিও ইসলামের শত্রুরা এ যাবত বহু অপতৎপরতা চালিয়েছে।
অন্য আয়াতে আল্লাহ বলেন, ضُرِبَتْ عَلَيْهِمُ الذِّلَّةُ أَيْنَ مَا ثُقِفُوا إِلَّا بِحَبْلٍ مِنَ اللَّهِ وَحَبْلٍ مِنَ النَّاسِ ‘তারা পৃথিবীর যেখানেই অবস্থান করবে, সেখানেই তাদের উপরে লাঞ্ছনা আরোপিত হবে কেবলমাত্র আল্লাহ প্রদত্ত ও মানব প্রদত্ত মাধ্যম ব্যতীত’ (আলে ইমরান ৩/১১২)। আল্লাহ প্রদত্ত মাধ্যম অর্থ যাদেরকে আল্লাহ পাক নিজ বিধান অনুসারে আশ্রয় ও অভয় দিয়েছেন। যেমন নারী-শিশু, সাধক-উপাসকগণ, যারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় না। তারা নিরাপদে থাকবে। অতঃপর মানবপ্রদত্ত মাধ্যম অর্থ হ’লঃ মুসলমান বা অমুসলিম কোন শক্তির সাথে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তাদের আশ্রয়াধীন হয়ে সাময়িক নিরাপদে বসবাস করতে পারবে। ১৯৪৮ সালে ‘ইসরাঈল’ নামে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ রাষ্ট্রটি মূলতঃ আমেরিকা, বৃটেন ও রাশিয়া তথা খৃষ্টান ও অমুসলিম অক্ষশক্তির সৃষ্ট মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি সামরিক ঘাঁটি ছাড়া আর কিছুই নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বৃটেনের সাহায্যমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে তথাকথিত এ রাষ্ট্রটি একমাসও টিকতে পারবে কি-না সন্দেহ। এরপরেও বিগত ৫২ বছর তাদেরকে সর্বদা যুদ্ধাবস্থার মধ্যে থাকতে হয়েছে এবং থাকতে হয়েছে এক প্রকার বিশ্বপরিত্যক্ত ও নিঃসঙ্গ অবস্থায়। অতএব বাহ্যিক নিরাপত্তা লাভ করলেও মানসিক শান্তিতে তারা একটি রাতও কাটাতে পারেনি। এসবই আল্লাহর গযবের ফল। একই অবস্থা এখন বৃটেন-আমেরিকান-ইউরোপিয়ান খৃষ্টান অক্ষশক্তির। সর্বত্র তারাএখন ‘বিশ্ব সন্ত্রাসী’ নামে অভিহিত। সর্বত্র আজ আমেরিকা নিন্দিত ও ধিকৃত। বস্ত্তগত শক্তিতে বলিয়অন হলেও তাদের মানসিক জগত ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। ফলে খোদ আমেরিকায় এখন দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করছে। মুসলমান এখন সেদেশের দ্বিতীয় প্রধান সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায়ে পরিণত হয়েছে।
ইহূদী-খৃষ্টান পরিচিতি:
হযরত ইবরাহীমের প্রথমা স্ত্রী সারার গর্ভে ইসহাক্ব-এর জন্ম হয়। তাঁর বংশধরগণ ‘বনু ইসরাঈল’ নামে পরিচিত। এই বংশে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। এদের ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস। আহলে কিতাবদের মধ্যে এই দলই বড়। এই বংশের শ্রেষ্ঠ নবী হলেন মূসা (আঃ)। তাঁর নিকটে ‘তাওরাত’ নাযিল হয়। যা ছিল মূলতঃ হালাল-হারাম ইত্যাদি ব্যবহারিক বিধি-বিধান সম্বলিত গ্রন্থ। তাঁর অনুসারীগণ ‘ইয়াহূদ’ নামে পরিচিত। তারপরে শ্রেষ্ঠ নবী ছিলেন ঈসা (আঃ)। ইনি হযরত দাঊদ (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। তাঁর নিকটে ‘ইঞ্জীল’ নাযিল হয়। এটি ছিল মূলতঃ পরকালীন মুক্তির সুসংবাদবাহী ও উপদেশমূলক গ্রন্থ। তাঁর অনুসারীগণ ‘নাছারা নামে খ্যাত। এঁদের ক্বিবলা ছিল কা‘বাগৃহ। ইহূদীদের প্রতিপক্ষ ছিল ফেরাঊন, হামান প্রমুখ কাফের নেতাগণ এবং নাছারাদের প্রতিপক্ষ ছিল মূর্তিপূজারী মুশরিকগণ। ইঞ্জীলে যেহেতু তাওরাতের বিধি-বিধানের তেমন কোন পরিবর্তিত ছিল না, সেকারণ তারা ঈসা (আঃ)-কে মূসা (আঃ)-এর অনুসারী হিসাবে গণ্য করত। যদিও তারা নিজেরা তাওরাতের বিধি-বিধান সমূহকে পরিবর্তন করেছে। যেমন শনিবারের সাপ্তাহিক ইবাদতের দিনকে রবিবার করা, শূকরের গোশতকে হালাল করা ইত্যাদি। তবে একটি বিষয়ে উভয় দল একমত ছিল যে, শেষ নবী মুহাম্মাদ সত্ত্বর আগমন করবেন এবং তাঁর নাম, চেহারা, জন্মস্থান সবই তারা আসমানী কিতাবের মাধ্যমে জানত। সেকারণ তাদের পূর্ব পুরুষগণ শেষনবীকে সাহায্য করার জন্য সিরিয়া থেকে হিজরত করে মদীনার নিকটবর্তী এলাকায় এসে বসতি স্থাপন করেন ও বড় বড় দুর্গ নির্মাণ করেন। কিন্তু যখন শেষ নবীর আবির্ভাব হ’ল এবং তিনি হিজরত করে মদীনায় এলেন, তখন তারা তাঁকে স্পষ্টভাবে চিনতে পারলেও বংশীয় অহমিকা মাথাচাড়া দেওয়ায় তাঁকে সহযোগিতা দূরে থাক, বরং সবরকমের শত্রুতায় লিপ্ত হ’ল। উল্লেখ্য যে, ইয়াহূদ-নাছারাগণ পরষ্পরের শত্রু ছিল এবং প্রত্যেকেই প্রতিপক্ষ দলকে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন বলে দাবী করত (বাক্বারাহ ২/১১৩)। শেষ নবী এসে তাদেরকে বললেন, لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّى تُقِيمُوا التَّوْرَاةَ وَالْإِنْجِيلَ ‘তোমরা কিছুর উপরে নেই, যতক্ষণ না তোমরা তাওরাত ও ইঞ্জীলকে প্রতিষ্ঠিত করবে’ (মায়েদাহ ৬৮)। যেহেতু তাওরাত ও ইঞ্জীল মানতে গেলে কুরআনকে মানতে বাধ্য হতে হয়, তাই তারা সবকিছুকে অস্বীকার করল ও শেষ নবীর বিরুদ্ধে শত্রুতায় লিপ্ত হ’ল।[16]
বিভিন্ন ফিরকা সমূহ :
ইয়াহূদ-নাছারাগণ অসংখ্য দলে বিভক্ত। হাদীছে ৭২ ফেরকা বলা হলেও তার অর্থ হল অসংখ্য। যদিও মুসলমানদের সাথে শত্রুতার বেলায় তারা সবাই এক। আল্লাহর গযবের শিকার হয়ে বনু ইসরাঈলের সবচেয়ে বড় দল ইহূদীরা এখন বিশ্বের অন্যতম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে পরিণত হয়ে এবং অপরের দয়ার ভিখারী হয়ে আমেরিকা ও ইসরাঈলে কোন রকমে টিকে আছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী খৃষ্টানরা অহংকারে বুঁদ হয়ে আসন্ন ধ্বংসের অপেক্ষায় প্রহর গুণছে।
আধুনিককালের খৃষ্টানরা প্রধানত: তিনভাগে বিভক্ত: ক্যাথলিক, অর্থোডক্স ও প্রটেষ্ট্যান্ট। এরা সবাই যীশু খৃষ্টের অনুসারী হওয়ার দাবীদার। খৃষ্টান ধর্ম কোন বিশ্বধর্ম ছিল না। কেননা শেষনবী ব্যতীত সকল নবীই ছিলেন গোত্রীয় নবী’।[17] ঈসা (আঃ) কেবলমাত্র বনী ইসরাঈলের আত্মশুদ্ধি ও পাপমুক্তির জন্য দা‘ওয়াত দিয়েছিলেন। এই ধর্মের কোন রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক রূপ ছিল না। ৩০৬ খৃষ্টাব্দে রোমান সম্রাট কনষ্টান্টাইন খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন এবং তাঁর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘নিকিয়া’ (Nicaea) অধিবেশনে রোমানদের মূর্তিপূজা ত্রিত্ববাদের আকারে এ ধর্মে ঢুকে পড়ে ও ত্রিত্ববাদের বুনিয়াদ স্বীকৃত হয়। ৫২৯ খৃষ্টাব্দের মধ্যে খৃষ্টান ধর্ম গোটা রোমান সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ৮০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে গোটা ইউরোপ এই ত্রিত্ববাদী খৃষ্টধর্ম গ্রহণ করে। যদিও বহু খৃষ্টান এতে বিশ্বাসী নয়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের অরচেষ্টার হলিক্রস কলেজের ধর্ম বিষয়ক বিভাগের চেয়ারম্যান ডঃ জন, এল, ইসপোসিটো বলেন, ...একমাত্র কুরআনই আসমানী কেতাব সমূহের মধ্যে অবিকৃত রয়েছে। ...বহু খৃষ্টানই আল্লাহর ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে না’।[18] সম্রাট কনষ্টান্টাইনের আমলেই ইউরোপকে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে ভাগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলের রাজধানী হয় কনস্টান্টিনোপল বা আজকের ইস্তাম্বুল। এ অঞ্চলের ধর্মীয় প্রধানকে বলা হয়, ‘পেত্রিয়ার্ক’। ইউরোপের বলকান রাজ্যগুলি, গ্রীস, মধ্য এশিয়া, মিসর ও আবিসিনিয়া হয় পশ্চিমাঞ্চল। যার রাজধানী হয় রোম এবং ধর্মীয় প্রধানকে বলা হয় ‘পোপ’। শুরু হয় দু’অংশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিবাদ। চলে নিজ নিজ শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা শত শত বছর ধরে। বর্তমানে বিশ্ব ক্যাথলিকদের প্রধান কেন্দ্র। পোপের কর্তৃত্ব ও মতবাদ অস্বীকার করেন পেত্রিয়ার্ক। তাই পোপ-পেত্রিয়ার্ক দ্বন্দ্ব খৃষ্টধর্মের আদিকাল থেকেই চলে আসছে।
১২৫৪ খৃষ্টাব্দে পেত্রিয়ার্ক মিখাইল কারোনারিউস-এর আমলে জন্ম নেয় গ্রীক ‘অর্থোডক্স চার্চ’। যার প্রধান কেন্দ্র হয় কনস্টান্টিনোপল। সংস্কারক মার্টিন লুথার প্রথমে ছিলেন ক্যাথলিক ও স্বধর্মে সুপন্ডিত। পরে রোমান চার্চ ও পোপ-পাদ্রীদের অপকর্ম ও পাপাচারের বিরুদ্ধে তিনি যখন সংগ্রাম শুরু করেন, তখন পোপ জার্মান সম্রাটের সাহায্যে তার নাগরিকত্ব হরণের ব্যবস্থা করেন। লুথারের অনুসারীরা এই আদেশের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং তীব্র প্রতিবাদ (Protest) জানায়। ফলে ১৫২৯ সালে জন্ম হয় ‘প্রটেষ্ট্যান্ট’ সম্প্রদায়ের। ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম হেনরী ও চতুর্থ এডওয়ার্ডের এই ধর্মমত গ্রহণ করায় প্রটেষ্ট্যান্ট মতবাদ ক্যাথলিক মতবাদের শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হয়। পরবর্তীতে খৃষ্টানরা আরো বহু দলে বিভক্ত হয়। তাদের এক দল অন্য দলকে যথার্থ খৃষ্টান বলে বিশ্বাস করে না। ক্যাথলিক ধর্মমতে বিশ্বাসীর জন্য অর্থোডক্স ও প্রটেষ্ট্যান্টদের সাথে বিয়ে-শাদী সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। কিন্তু মজার কথা হ’ল এই যে, দুনিয়ার সব জায়গায় অন্য ধর্মাবলম্বী বিশেষ করে মুসলমানদের মুকাবিলায় এরা পরস্পরের সহযোগী।
উপমহাদেশে আগমন :
পঞ্চদশ শতাব্দীতে স্পেনে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। অতঃপর সেখানে সৃষ্টি হয় বর্তমান স্পেন ও পর্তুগাল। পর্তুগালের খৃষ্টান মিশনারীরাই প্রথম পর্তুগীজ বণিকের বেশে এদেশে আসে এবং ১৫১৭ সালে মোগল সম্রাটের কাছ থেকে চট্টগ্রামে বাণিজ্যকুঠি স্থাপনের অনুমতি পায়। ১৫৭৯-৮০ সালে ভাগীরথীর তীরে হুগলীতে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতি পায় এবং এটিই হয়ে ওঠে তাদের প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। ঢাকার অদূরে কালীগঞ্জে প্রথম গীর্জা নির্মাণ করে ও ঢাকায় খৃষ্টের বাণী প্রচার শুরু করে। পরে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে কুঠি স্থাপন করে। এভাবে তাদের বাণিজ্য ও ধর্ম প্রচার সমান ভাবে চলতে থাকে। এরা ছিল ‘ক্যাথলিক’। ১৬৭৭ সালে তারা ঢাকার ফার্মগেটের নিকটে ‘চার্চ অব হোলি রোজারিও’ প্রতিষ্ঠা করে। তেজগাঁর এই চার্চই বাংলাদেশের প্রাচীনতম চার্চ।
পরে বণিকের বেশে আসে ইংরেজ খৃষ্টানরা। এরা বাংলার নবাবের কাছ থেকে এদেশে বাণিজ্য করার অনুমতি পায় ১৬৫০ সালে। প্রথমে কুঠি নির্মাণ করে হুগলীতে। পরে ১৬৯৬ সালে কলিকাতায় দুর্গ গড়ে তোলে ও ইংল্যান্ডের রাজার নামে নাম রাখে ‘ফোর্ট উইলিয়াম’। ফলে শত বর্ষ পরে এদেরই ষড়যন্ত্রে ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশী প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। ইংরেজরা রাতারাতি হয়ে বসে বাংলাদেশের মালিক-মুখতার। পরবর্তীতে দখল করে গোটা উপমহাদেশ। ১৯৪৭ সালের মধ্য আগষ্টে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এদেশে খৃষ্টান ইংরেজদের ১৯০ বছরে শাসনের যবনিকাপাত ঘটে।
খৃষ্টানী তৎপরতা :
এ দেশে ইংরেজ আমলে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খৃষ্টানী তৎপরতা সর্বাধিক জোরেসোরে চলে। তবুও ১৮৮১ সালের আদমশুমারীতে দেখা যায় যে, গোটা ভারতবর্ষে খৃষ্টান জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫০ হাযার। এর মধ্যে কোন মুসলমানের খৃষ্টান হওয়ার রেকর্ড নেই। বরং এদের অধিকাংশ ছিল নিম্ন বর্ণের অস্পৃশ্য হিন্দু। ১৯৪১ সালে গোটা অবিভক্ত বাংলায় মোট দেশী খৃষ্টানের সংখ্যা ছিল ১,১১,৪২৬ জন। দেশ বিভাগকালে পূর্ব পাকিস্তানের তথা বাংলাদেশের ভাগে এসেছে ৪০ শতাংশ অর্থাৎ ৫০ হাযারেরও কম। অথচ তখন সমস্ত উপমহাদেশে মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশা, অভাব ও দারিদ্র্য ছিল চরমে। তারা ছিল অশিক্ষিত, শোষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত। তবুও দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিলের লোভে তারা বিভ্রান্ত হয়নি। ইসলাম খৃষ্টধর্ম গ্রহণের কল্পনাও করেনি। বরং বলা চলে যে, দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনামলে কোন মুসলমানের খৃষ্টান হওয়াটা ছিল দুর্ঘটনার মত। কিন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশে স্বাধীন মুসলিম সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অলস মস্তিষ্ক দুনিয়াদার শাসকদের কারণে খৃষ্টান জনসংখ্যার হার হু হু করে বেড়ে যায়।
পাকিস্তান আমলে ১৯৬১ সালের একটি হিসাবে দেখা যায় যে, পাকিস্তানের উভয় অংশে খৃষ্টধর্ম প্রচারের জন্য ৪০টি সংস্থা কর্মতৎপর ছিল। পাকিস্তান সরকার বাধা না দিয়ে বরং তাদেরকে নানা রকম সুযোগ-সুবিধা দান করে। ফলে ১৯৪১ সালে যেখানে বাংলাদেশে রোমান ক্যাথলিক খৃষ্টানদের সংখ্যা ছিল ১৫ বা ২০ হাযার। সেখানে ১৯৬১ সালে হয় ৮০,০০০ এবং ১৯৭০ সালে হয় ১,২০,০০০। অপরদিকে ১৯৪১ সালে প্রটেষ্ট্যান্ট খৃষ্টানদের সংখ্যা ছিল ৩০,০০০; যা ১৯৭১ সালে হয় ৮০,০০০। অর্থাৎ বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রাক্কালে এদেশে মোট খৃষ্টান জনসংখ্যা ছিল ২ লাখের মত।[19]
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাহায্যের নামে পঙ্গপালের মত ঝাঁকে ঝাঁকে এদেশে আসতে থাকে খৃষ্টান মিশনারী ও সাহায্য সংস্থাগুলো। তারা ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র। ফলে বাংলাদেশ সৃষ্টির মাত্র ১০ বছর পরে ১৯৮২ সালে খৃষ্টানদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২,৯০,০০০। এই সময় দেশের স্বাভাবিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২.৯০%। অথচ খৃষ্টান বৃদ্ধির হার ছিল ৩.২৫%।
‘বাংলাদেশে ক্যাথলিক খৃষ্টানদের সংখ্যা বেশী। তারপরেই প্রটেষ্ট্যান্টদের সংখ্যা। ক্যাথলিকরা দুনিয়ার সর্বত্র পোপের একক নেতৃত্বের অধীন। তাই তারা ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত। তাদের মিশনারী তৎপরতা অত্যন্ত সুপরিকল্পিত। সেকারণ সর্বত্র তাদের সংখ্যা অধিক। পক্ষান্তরে এর অভাবে প্রটেষ্ট্যান্টদের তৎপরতা কম কার্যকর। তাই তাদের সংখ্যাও কম’।[20]
তৎপরতার ধরণ :
এদেশে খৃষ্টানদের যাবতীয় তৎপরতা প্রধানতঃ দু’ধরনেরঃ ১- চার্চ সংস্থা ২- স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ‘চার্চ সংস্থা’গুলো নিজস্ব মিশনারী হাসপাতাল, ক্লিনিক, স্কুল-কলেজ, প্রচারক দল, পুস্তক ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে সরাসরি ধর্ম প্রচার করে থাকে। এসব বহুমুখী সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমে তারা ধর্ম প্রচারের অনুকূল প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রথমে তারা ধর্ম প্রচারের অনুকূল পরিবেশ গড়ে তোলে। মানুষকে চাকুরী দেয়া, অর্থ দেয়, সমর্থক বানায় ও ভক্তকুলের সৃষ্টি করে। পরে লোকেরা আপনা-আপনি খৃষ্ট ধর্মের ফাঁদে পা দেয়। পক্ষান্তরে ‘স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা’গুলি বাহ্যতঃ ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার ভাব দেখায়। প্রকাশ্যে এরা মানবদরদী সেজে জনসেবা করে। কিন্তু মূল উদ্দেশ্য থাকে সেবার মাধ্যমে ‘চার্চ সংস্থা’গুলোর জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা। এরা ‘চার্চ সংস্থা’গুলোর সহায়ক শক্তি হিসাবে ছদ্মবেশী মিশনারী।
বর্তমানে দেশী-বিদেশী মিলিয়ে ১৭০০০ এনজিও এদেশে কর্মরত। যার অধিকাংশ আমেরিকা, বৃটেন, আয়ারল্যান্ড, ফ্রান্স, সুইডেন, অষ্ট্রেলিয়া, জাপান প্রভৃতি খৃষ্টান রাষ্ট্র ও সেসব দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি ও চার্চ সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। বাংলাদেশে ‘এডাব’ হ’ল এইসব খৃষ্টান সংস্থাগুলির সমন্বয়কারী কেন্দ্রীয় সংস্থা। সবার মূল লক্ষ্য এক। সে লক্ষ্য সামনে রেখে ভিন্ন ভিন্ন মত ধর্মমত পোষণকারী এতগুলো সংস্থার ঐক্য গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সেই লক্ষ্যটা কি? সচেতন মহলের অবশ্যই ভাববার অবকাশ রয়েছে।
এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচনাযোগ্য। তা হ’লঃ খৃষ্টান পাদ্রীদের মূল প্রচারণা হ’ল পরকালীন মুক্তির একমাত্র পথ তাদের কথিত ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস পোষণ করা। অথচ সবাই জানেন যে, পাশ্চাত্যে ব্যক্তিগত জীবনে তাদের এই কথিত ধর্ম মতের কোন আবেদন নেই। গীর্জাগুলো সেখানে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে ধর্মের কোন কার্যকারিতা ও প্রয়োজনীয়তা তারা স্বীকার করে না। এমনকি এদেশে কর্মরত মিশনারী সংস্থাগুলোর অনেক বিদেশী খৃষ্টান কর্মকর্তা ব্যক্তিজীবনে তাদের ধর্মকে স্বীকারও করেন না, মানেনও না। তাহলে এদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য তাদের কোটি কোটি ডলার ব্যয়ের পিছনে কারণ কি? এটা কি স্রেফ মানব দরদ? তাই যদি হবে, তাহলে খোদ আমেরিকাতেই বর্তমানে ১৩% লোক দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করছে। তাদেরকে তারা কেন সাহায্য করছে না। কেন মার্কিন সরকার সেদেশের কৃষকদের অধিক গম উৎপাদনে বাধা দিচ্ছে? আসলে ধর্মপ্রচারের মুখোশে তারা চায় এদেশে তাদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ চরিতার্থ করতে। বাংলাদেশকে পুনরায় তাদের করতলগত করতে।
বাংলাদেশে কর্মরত ব্র্যাক, কারিতাস, কেয়ার, আশা, প্রশিক্ষা, হীড, এম, সি, সি, অক্সফাম, ব্যাপ্টিষ্ট মিশন প্রভৃতি প্রায় দু’শতাধিক খৃষ্টান ও মিশনারী সংস্থার মাধ্যমে গত ১৯৮১ সালের মধ্যেই প্রায় ৫ লাখ লোক খৃষ্টান হয়ে গেছে। লক্ষ্য তাদের ৫০ লাখ। তারপর তাদেরকে দেশের এক স্থানে জড়ো করে বসতি স্থাপনের ব্যবস্থা করা হবে সরকারের উপরে চাপ দিয়ে। তারপরে সেটা হবে আরেক লেবানন কিংবা ইসরাঈল। মুসলিম স্পেনের করুণ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হওয়াও বিচিত্র নয়। এর প্রারম্ভিক আলামত ইতিমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে দেখা গিয়েছে।
এরা এখন এদেশের রাজনীতিকেও নিয়ন্ত্রণ করছে। এদেরকে বহিষ্কার করার কিংবা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার মত কোন দেশপ্রেমিক শক্তিশালী সরকার এযাবত বাংলাদেশে আসেনি। মোগল আমলে সম্রাট জাহাঙ্গীর ও সম্রাট আকবরন এবং বাংলার নবাব খৃষ্টানদেরকে এ দেশে বাণিজ্য কুঠি নির্মাণের অনুমতি দিয়ে যে ভুল করেছিলেন। যার ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে তাদের মৃত্যুর পরে ভারতবর্ষ তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল। আজকের সরকারগুলি যদি তা থেকে শিক্ষা না নেয়, তাহলে সেদিন বেশী দূরে নয়, যেদিন বর্তমান বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা হারিয়ে লেবানন ও পূর্ব-তিমূরের মত পরাশ্রিত আধা-খৃষ্টান বা পূর্ণ খৃষ্টান রাজ্যে পরিণত হবে।
অতএব এই সংকটময় মুহূর্তে এদেশের আলেম, খত্বীব, ইমাম, বক্তা, লেখক, শিক্ষক, ছাত্র, সংগঠক, রাজনীতিক, সমাজনেতা সবাইকে সচেতন হতে হবে। ইতিমধ্যে পশ্চিম বঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার সেখানে সবরকম মিশনারী তৎপরতা নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। মিসর, তুরষ্ক ও সুদানের মত দেশ এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা নিয়েছে। তাহলে আমাদের বাধা কোথায়? লেবাননের অর্ধেক লোককে খৃষ্টান করে তাকে আধা-খৃষ্টান রাষ্ট্র বানিয়ে এবং অতি সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমূর প্রদেশকে আগে খৃষ্টান করে নিয়ে পরে তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকা সহ খৃষ্টান রাষ্ট্রপুঞ্জ কর্তৃক স্বীকৃতি দেওয়ার পরেও কি আমাদের চোখ খুলবে না?
আজকের আমেরিকা-বৃটেন ও ন্যাটো জোটভুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন আন্তর্জাতিক খৃষ্টান রাষ্ট্র সংস্থা হিসাবে কাজ করছে। ইসরাঈলকে তারা বানিয়ে রেখেছে বারুদের গোলা হিসাবে। সুযোগ মত তাকে মধ্যপ্রাচ্যের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে এবং পরিশেষে মক্কা-মদীনা দখল করবে। যেখানে থেকে একদিন তারা সমূলে উচ্ছেদ হয়েছিল রাসূল (ছাঃ)-এর হুকুমে। যদিও সে আশা তাদের কখনোই পূরণ হবে না। তবুও উক্ত লক্ষ্য হাছিলের জন্য তারা বিশ্বের সর্বত্র মুসলমানদের উপরে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভাবে যুলুম ও নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তীনী মুসলমানেরা তাদের সরাসরি যুলমের শিকার হচ্ছে।
উপসংহারে তাই বলব, আমাদেরকে যেকোন মূল্যে কুরআনী শিক্ষার দিকে ফিরে যেতে হবে এবং সে হেদায়াত অনুযায়ী আমাদের জাতীয় লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র নীতিকে অবশ্যই কুরআনী নির্দেশের আলোকে ঢেলে সাজাতে হবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।
[1]. কুরতুবী ৬/২১৬; ইবনু কাছীর ২/৭১; ইবনু জারীর ৬/১৭৮-১৭৯।
[2]. বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪০৩৯।
[3]. কুরতুবী ১৮/৪।
[4]. বুখারী হা/৬৭৬৪; মুসলিম হা/১৬১৪; মিশকাত হা/৩০৪৩ ‘ফারায়েয’ অধ্যায়, রাবী উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)।
[5]. মুখতাছার তাফসীরুল মানার ২/৩৪৮।
[6]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/৩৫৪-৩৪৮; তাফসীরে কুরতুবী ১৮/৪-৮; ফাৎহুল বারী ‘মাগাযী’ অধ্যায়, অনুচ্ছেদ ৬৪; ৭/৩৮৪।
[7]. সূরা হাশর ২য় আয়াত; বুখারী ২/৫৭৪।
[8]. তাফসীরে কুরতুবী ১৮/২।
[9]. কুরতুবী ১৮/৪; বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪০৩৯।
[10]. ফাৎহুল বারী ৭/৪৫২-৫৩ ‘মাগাযী’ অধ্যায় হা/৪০৯৭-৪১০০।
[11]. মায়েদাহ ৮২-৮৫; তাফসীর ইবনে কাছীর ২/৮৮।
[12]. তাফসীর ইবনু কাছীর ২/৮৮; বুখারী ১/৪৪৯, ২/৬২০/৮৬০।
[13]. তাফসীর ইবনে কাছীর ৪/৬১৪।
[14]. তাফসীর ইবনে কাছীর ১/১৯৩।
[15]. তাফসীর ইবনে কাছীর ১/১০৬।
[16]. শহরস্তানী, আল-মিলাল ১/২০৯-১৪।
[17]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুসলিম, মিশকাত হা/৫৭৪৭-৪৮; শেষনবীর মর্যাদা’ অধ্যায়।
[18]. সাইফুল্লাহ, প্রচলিত খৃষ্টবাদের স্বরূপ পৃঃ ৯।
[19]. রূহুল আমীন, বাংলাদেশে খৃষ্টান মিশনারী তৎপরতা পৃঃ ২২।
[20]. ঐ পৃঃ ২৯।