কুরআন অনুধাবন (প্রথম কিস্তি)

পর্ব ১ । পর্ব ২শেষ পর্ব

كِتَابٌ أَنْزَلْنَاهُ إِلَيْكَ مُبَارَكٌ لِيَدَّبَّرُوا آيَاتِهِ وَلِيَتَذَكَّرَ أُولُو الْأَلْبَابِ-  

অনুবাদ : ‘এটি এক কল্যাণময় কিতাব, যা আমরা তোমার প্রতি নাযিল করেছি। যাতে তারা এর আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং জ্ঞানীরা উপদেশ গ্রহণ করে’ (ছোয়াদ ৩৮/২৯)

অত্র  আয়াতে আল্লাহ মানুষকে কুরআন গবেষণা ও তার তাৎপর্য অনুধাবনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। একই মর্মে কুরআনে বহু আয়াত এসেছে। যেমন বলা হয়েছে,أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوا فِيهِ اخْتِلاَفًا كَثِيرًا- ‘তারা কেন কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? যদি এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু নিকট থেকে আসত, তাহ’লে তারা এর মধ্যে বহু গরমিল দেখতে পেত’ (নিসা ৪/৮২)। যারা কুরআন গবেষণা করেনা, তাদের প্রতি ধমক দিয়ে আল্লাহ বলেন,أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ أَمْ عَلَى قُلُوبٍ أَقْفَالُهَا- ‘তবে কি তারা কুরআনকে গভীরভাবে অনুধাবন করে না? নাকি তাদের হৃদয়গুলি তালাবদ্ধ?’ (মুহাম্মাদ ৪৭/২৪)

‘তাদাববুর’ অর্থ চিন্তা-গবেষণা। এর বিপরীত হ’ল উদাসীনতা ও অজ্ঞতা। যেকোন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা মূল জিনিষ। এটা না থাকলে জ্ঞান সম্পন্ন প্রাণী হিসাবে মানুষের পৃথক কোন মূল্য থাকে না। ‘কুরআন’ আল্লাহর কালাম। যিনি জ্ঞানের আধার। তাঁর অফুরন্ত জ্ঞানের ভান্ডার থেকে কিছু অংশ দান করে তিনি বান্দাগণের মধ্যে বণ্টন করে দিয়েছেন। মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালনার জন্য তিনি কুরআন নাযিল করেছেন তাদের বোধগম্য ও সহজবোধ্য ভাষায়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা অনুধাবন করে না। ফলে তারা শয়তানের কুহকে পড়ে প্রবৃত্তির তাড়নায় চালিত হয়। যারা পাঠ করে, তারা বুঝে না। আবার যারা শিখে, তারা অনুধাবন করে না। অনেকে উল্টা বুঝে মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ফলে নিজেরা বঞ্চিত হয়। অন্যকেও বঞ্চিত করে।

কুরআন অনুধাবনের মূলনীতি :

কুরআন অনুধাবনের প্রধান মূলনীতি হ’ল, কুরআনের যিনি বাহক, তাঁর বুঝ অনুযায়ী কুরআন অনুধাবন করা। অতঃপর তিনি যাদের কাছে কুরআন ব্যাখ্যা করেছেন, সেই ছাহাবীগণের বুঝ অনুযায়ী অনুধাবন করা। এর বাইরে ব্যাখ্যা দিতে গেলে পথভ্রষ্ট হবার সম্ভাবনা থেকে যাবে। যেমন জনৈক মুফতী কুরআনের ৮টি আয়াত দিয়ে মীলাদ অনুষ্ঠানের প্রমাণ দিয়েছেন। অথচ মীলাদের আবিষ্কারই হয়েছে রাসূল (ছাঃ)-এর মৃত্যুর বহু পরে ৬০৫ অথবা ৬২৫ হিজরীতে।

কুরআন অনুধাবনের গুরুত্ব :

কুরআন নাযিলের মূল উদ্দেশ্যই হ’ল তাকে বুঝা, অনুধাবন করা ও সে অনুযায়ী কাজ করা। শুধুমাত্র পাঠ করা ও মুখস্ত করা নয়। যদিও তাতে রয়েছে অশেষ নেকী। কসাই বলে খ্যাত ইরাকের শাসক হাজ্জাজ বিন ইউসুফ (৪০-৯৫ হি./৬৬১-৭১৪ খৃ.) প্রতি রাতে সিকি কুরআন অর্থাৎ চারদিনে কুরআন খতম করতেন এবং তাঁর উদ্যোগেই প্রথম কুরআনে নুকতা ও হরকত দেওয়া হয়’।[1] অথচ আলেমদের উপর নির্যাতনের জন্য ইতিহাসে তিনি কুখ্যাত। সেকারণ হাসান বাছরী (২১-১১০ হি./৬৪২-৭২৮ খৃ.) বলেন, আল্লাহর কসম! কুরআন অনুধাবনের অর্থ কেবল এর হরফগুলি হেফয করা এবং এর হুদূদ বা সীমারেখাগুলি বিনষ্ট করা নয়। যাতে একজন বলবে যে, সমস্ত কুরআন শেষ করেছি। অথচ তার চরিত্রে ও কর্মে কুরআন নেই’।[2] তিনি বলতেন, কুরআন নাযিল হয়েছে তা বুঝার জন্য ও সে অনুযায়ী আমল করার জন্য। অতএব তোমরা তার তেলাওয়াতকে আমলে পরিণত কর’।[3]  

জ্যেষ্ঠ তাবেঈ মুহাম্মাদ বিন কা‘ব আল-কুরাযী বলেন, ফজর পর্যন্ত পুরা রাতে সূরা যিলযাল ও ক্বারে‘আহ পাঠ করা এবং তার বেশী পাঠ না করা আমার নিকটে অধিক প্রিয়, সারা রাত্রি কুরআন তেলাওয়াতের চাইতে’।[4] এর দ্বারা তিনি কুরআন অনুধাবনের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন।

ইবনু জারীর ত্বাবারী (২২৪-৩১০ হি./৮৩৯-৯২৩ খৃ.) বলেন, কুরআন অনুধাবন অর্থ আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণসমূহ অনুধাবন করা, তাঁর বিধান সমূহ জানা, তাঁর উপদেশ সমূহ গ্রহণ করা ও সে অনুযায়ী আমল করা’।[5]

সৈয়ূতী (৮৪৯-৯১১ হি./১৪৪৫-১৫০৫ খৃ.) বলেন, কুরআন অনুধাবন করাটাই হ’ল মূল উদ্দেশ্য। কেননা কুরআনই হবে কর্মপদ্ধতি ও আচরণে পথ প্রদর্শক। এর মাধ্যমেই মানুষ দুনিয়া ও আখেরাতে সর্বোচ্চ স্থান লাভ করবে’।[6]

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ يَرْفَعُ بِهَذَا الْكِتَابِ أَقْوَامًا وَيَضَعُ بِهِ آخَرِينَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ এই কিতাবের মাধ্যমে বহু সম্প্রদায়কে উঁচু করেন ও অনেককে নীচু করেন’।[7] কুরআনের অনুধাবনকারী ও আমলকারীদের পরকালীন উচ্চ মর্যাদা সম্পর্কে নাউওয়াস বিন সাম‘আন (রাঃ) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, ক্বিয়ামতের দিন কুরআন ও তার বাহককে আনা হবে। যারা তার উপর আমল করেছিল। যাদের সম্মুখে থাকবে সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান। সে দু’টি হবে মেঘমালা সদৃশ। যার মধ্যে থাকবে চমক’।[8]

কুরআন অনুধাবনের প্রয়োজনীয়তা :

(১) আল্লাহর আদেশ-নিষেধ অবগত হওয়া ও সে অনুযায়ী আমল করা। এটিই হ’ল প্রধান বিষয়। ইহূদী আলেমরা তাওরাত পড়ত ও তার বিপরীত আমল করত। এমনকি তারা শাব্দিক পরিবর্তন ঘটাতো। নাছারাগণ একই নীতির অনুসারী ছিল। ফলে উভয় উম্মত মাগযূব (অভিশপ্ত) ও যাল্লীন (পথভ্রষ্ট) হয়ে গেছে। মুসলিম উম্মাহর আলেমরাও যেন সে পথে না যায়। সেজন্য সতর্ক করে আল্লাহ আহলে কিতাবদের অবস্থা বর্ণনা করে বলেন,وَإِذْ أَخَذَ اللهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلاَ تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَبِئْسَ مَا يَشْتَرُونَ- ‘আর আল্লাহ যখন আহলে কিতাবদের নিকট থেকে অঙ্গীকার নিলেন যে, তোমরা অবশ্যই (শেষনবী মুহাম্মাদের আগমন ও তার উপর ঈমান আনার বিষয়টি) লোকদের নিকট বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না। অতঃপর তারা তা পশ্চাতে নিক্ষেপ করল এবং গোপন করার বিনিময়ে তা স্বল্পমূল্যে বিক্রয় করল। কতই না নিকৃষ্ট তাদের ক্রয়-বিক্রয়’ (আলে ইমরান ৩/১৮৭)

(২) ঈমান বৃদ্ধি পাওয়া :

কুরআন অনুধাবন করে পাঠ করলে পাঠকের ঈমান বৃদ্ধি পায়। প্রতিটি আয়াত ও সূরা তার মনের মধ্যে গভীরভাবে রেখাপাত করে। কারণ এসময় তার চোখ-কান-হৃদয় সবকিছু কুরআনের মধ্যে ডুবে থাকে। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,وَإِذَا مَا أُنْزِلَتْ سُورَةٌ فَمِنْهُمْ مَنْ يَقُولُ أَيُّكُمْ زَادَتْهُ هَذِهِ إِيمَانًا فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا فَزَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَهُمْ يَسْتَبْشِرُونَ- ‘আর যখন কোন সূরা  নাযিল হয়, তখন  তাদের মধ্যেকার কিছু (মুশরিক) লোক বলে, এই সূরা তোমাদের মধ্যে কার ঈমান বৃদ্ধি করল? বস্ত্ততঃ যারা ঈমান এনেছে, এ সূরা তাদের ঈমান বৃদ্ধি করেছে এবং তারা আনন্দ লাভ করেছে’ (তওবাহ ৯/১২৪)। তিনি আরও বলেন,إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ- ‘নিশ্চয়ই মুমিন তারাই, যখন তাদের নিকট আল্লাহকে স্মরণ করা হয়, তখন তাদের অন্তর সমূহ ভয়ে কেঁপে ওঠে। আর যখন তাদের উপর তাঁর আয়াতসমূহ পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং তারা তাদের প্রতিপালকের উপর ভরসা করে’ (আনফাল ৮/২)

(৩) আল্লাহভীতি অর্জন :

অনুধাবনের সাথে কুরআন পাঠ করার মাধ্যমে হৃদয়-মন শিহরিত হয়। আল্লাহর অসীম ক্ষমতা অবহিত হয়ে ভয়ে অন্তর জগত কেঁপে ওঠে। ফলে পাপ চিন্তা দূরীভূত হয় এবং আল্লাহর উপর ভরসা করে হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,اللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيثِ كِتَابًا مُتَشَابِهًا مَثَانِيَ تَقْشَعِرُّ مِنْهُ جُلُودُ الَّذِينَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ ثُمَّ تَلِينُ جُلُودُهُمْ وَقُلُوبُهُمْ إِلَى ذِكْرِ اللهِ ذَلِكَ هُدَى اللهِ يَهْدِي بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُضْلِلِ اللهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ- ‘আল্লাহ সর্বোত্তম বাণী (কুরআন) নাযিল করেছেন যা পরস্পরে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যা পুনঃ পুনঃ পাঠ করা হয়। এতে তাদের দেহচর্ম ভয়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে, যারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে। অতঃপর তাদের দেহমন প্রশান্ত হয়ে আল্লাহর স্মরণে ঝুঁকে পড়ে। এটি (কুরআন) হ’ল আল্লাহর পথনির্দেশ। এর মাধ্যমে তিনি যাকে চান পথ প্রদর্শন করেন। আর যাকে আল্লাহ পথভ্রষ্ট করেন, তাকে পথ দেখানোর কেউ নেই’ (যুমার ৩৯/২৩)

অন্যত্র তিনি বলেন, قُلْ آمِنُوا بِهِ أَوْ لَا تُؤْمِنُوا إِنَّ الَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ مِنْ قَبْلِهِ إِذَا يُتْلَى عَلَيْهِمْ يَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ سُجَّدًا-وَيَقُولُونَ سُبْحَانَ رَبِّنَا إِنْ كَانَ وَعْدُ رَبِّنَا لَمَفْعُولًا- وَيَخِرُّونَ لِلْأَذْقَانِ يَبْكُونَ وَيَزِيدُهُمْ خُشُوعًا- ‘তুমি বলে দাও (হে অবিশ্বাসীগণ!), তোমরা কুরআনে বিশ্বাস আনো বা না আনো (এটি নিশ্চিতভাবে সত্য)। যাদেরকে ইতিপূর্বে জ্ঞান দান করা হয়েছে (আহলে কিতাবের সৎ আলেমগণ), যখন তাদের উপর এটি পাঠ করা হয়, তখনই তারা সিজদায় লুটিয়ে পড়ে’। ‘আর তারা বলে, মহাপবিত্র আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতিপালকের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই কার্যকর হয়’। ‘আর তারা কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে এবং তাদের বিনয় আরও বৃদ্ধি পায়’ (ইসরা ১৭/১০৭-০৯)। ইবনু হাজার (৭৭৩-৮৫২ হি.) বলেন, খুশূ‘ তথা আল্লাহভীতি অর্জনই কুরআন তেলাওয়াতের মূল উদ্দেশ্য(الْخُشُوعَ الَّذِي هُوَ مَقْصُودُ التِّلاَوَةِ)।[9]

(৪) সার্বিক হেদায়াত লাভ :

তাৎপর্য অনুধাবনের মাধ্যমে কুরআন পাঠ করলে জীবনের চলার পথে সার্বিক হেদায়াত লাভ করা যায়। ছোট-খাট বিষয়গুলি তখন বড় হয়ে দেখা দেয় না। বরং বৃহত্তর কল্যাণের বিষয় ও সার্বিক মঙ্গলের বিষয়টি তার সামনে প্রতিভাত হয়। ফলে সে পথভ্রষ্ট হওয়া থেকে বেঁচে যায়। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,إِنَّ هَذَا الْقُرْآنَ يَهْدِي لِلَّتِي هِيَ أَقْوَمُ وَيُبَشِّرُ الْمُؤْمِنِينَ الَّذِينَ يَعْمَلُونَ الصَّالِحَاتِ أَنَّ لَهُمْ أَجْرًا كَبِيرًا ‘নিশ্চয় এই কুরআন এমন পথের নির্দেশনা দেয় যা সবচাইতে সরল। আর তা সৎকর্মশীল মুমিনদের সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহা পুরস্কার’ (ইসরা ১৭/৯)

(৫) কুরআনের স্বাদ আস্বাদন ও হৃদয়ে প্রশান্তি লাভ :

কুরআনের শব্দালংকার বুঝদার পাঠকের অন্তরে ঝংকার তোলে। এর গভীর তাৎপর্য জ্ঞানজগতকে চমকিত করে। এর বিজ্ঞান ও অতীত ইতিহাস মানুষকে হতবিহবল করে। বহু অজানা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে হৃদয় প্রশান্ত হয়। এক পর্যায়ে সমর্পিত চিত্ত প্রশান্তিতে ভরে যায়। ইবনু জারীর ত্বাবারী বলেন, আমি বিস্মিত হই ঐ ব্যক্তির জন্য, যে ব্যক্তি কুরআন তেলাওয়াত করে। অথচ এর তাৎপর্য অনুধাবন করে না। সে কিভাবে এর স্বাদ আস্বাদন করবে?[10]

(৬) আল্লাহর কিতাবের জন্য দন্ডায়মান হওয়া :

কুরআনের তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারলে এর হক ও সীমারেখা সমূহ আদায়ে পাঠক দন্ডায়মান হবে। এর মর্যাদা রক্ষায় উৎসর্গীতপ্রাণ হবে। সর্বাবস্থায় এর প্রতি শ্রদ্ধা পোষণ করবে এদিকে ইঙ্গিত করেই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,«الدِّينُ النَّصِيحَةُ» قُلْنَا لِمَنْ؟ قَالَ : لِلَّهِ وَلِكِتَابِهِ وَلِرَسُولِهِ وَلأَئِمَّةِ الْمُسْلِمِينَ وَعَامَّتِهِمْ ‘দ্বীন হ’ল নছীহত’। আমরা বললাম, কাদের জন্য হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, আল্লাহর জন্য, তাঁর কিতাবের জন্য, তাঁর রাসূলের জন্য, মুসলিম নেতৃবৃন্দের জন্য ও সকল মুসলমানের জন্য’।[11]

এখানেالنَّصِيْحَةُ لِكِتَابِهِ  ‘আল্লাহর কিতাবের জন্য নছীহত’-এর তাৎপর্য হ’ল এ বিষয়ে হৃদয়ে পরিচ্ছন্ন ঈমান পোষণ করা যে, আল্লাহর কালাম চূড়ান্ত সত্য। এটি কোন মানুষের কালামের সদৃশ নয়। এরূপ কালাম কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। অতঃপর আল্লাহর কিতাবের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে হবে ও শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তেলাওয়াত করতে হবে। এর ‘মুহকাম’ বা স্পষ্ট আয়াত সমূহের অর্থ বুঝতে হবে। তার আদেশ-নিষেধের উপরে আমল করতে হবে ও ‘মুতাশাবিহ’ বা অস্পষ্ট অর্থবোধক আয়াত সমূহের উপরে ঈমান রাখতে হবে যে, এগুলির প্রকৃত তাৎপর্য কেবলমাত্র আল্লাহ জানেন। অমুসলিম বিদ্বানদের অহংকার চূর্ণ করার জন্যই এগুলি নাযিল হয়েছে। কিতাবে বর্ণিত বিজ্ঞানময় আয়াত সমূহে গবেষণা করতে হবে। তা থেকে আলো নিয়ে সমাজ পরিশুদ্ধ করার সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে হবে। এই কালামের সর্বোচ্চ মর্যাদা রক্ষার জন্য সর্বদা দন্ডায়মান থাকতে হবে।

(৭) হালাল-হারাম জানা :

জীবন সংশ্লিষ্ট বহু বৈধ-অবৈধ বিষয় মানুষ জানতে পারবে কুরআন অনুধাবনের মাধ্যমে। যা তার বৈষয়িক জীবনকে সঠিক পথে পরিচালিত করবে এবং শয়তানের ধোঁকা থেকে দূরে থাকতে পারবে। সেকারণ আল্লাহ বলেন, يَاأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا ادْخُلُوا فِي السِّلْمِ كَافَّةً وَلاَ تَتَّبِعُوا خُطُوَاتِ الشَّيْطَانِ إِنَّهُ لَكُمْ عَدُوٌّ مُبِينٌ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা পরিপূর্ণভাবে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাংক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য দুশমন’ (বাক্বারাহ ২/২০৮)

(৮) ভিতর ও বাইরের রোগ সমূহের আরোগ্য :

গভীর অনুধাবনের সাথে কুরআন পাঠের মাধ্যমে ভিতরকার বহু সন্দেহবাদ দূরীভূত হয়। বহু অন্যায় আকাংখা অন্তর্হিত হয়। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ قَدْ جَاءَتْكُمْ مَوْعِظَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ وَشِفَاءٌ لِمَا فِي الصُّدُورِ وَهُدًى وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ ‘হে মানব জাতি! তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হতে এসে গেছে উপদেশবাণী (কুরআন) এবং অন্তরের রোগসমূহের নিরাময়কারী এবং বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও রহমত’ (ইউনুস ১০/৫৭)। তিনি আরও বলেন,وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِينَ وَلاَ يَزِيدُ الظَّالِمِينَ إِلاَّ خَسَارًا ‘আর আমরা কুরআন নাযিল করি, যা বিশ্বাসীদের জন্য আরোগ্য ও রহমত স্বরূপ। কিন্তু পাপীদের জন্য তা কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (ইসরা ১৭/৮২)

ইবনু জারীর বলেন, কুরআন মূর্খতা ও পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তি দেয়। মুমিনগণ এর মাধ্যমে অন্ধকারে আলোর পথ খুঁজে পান। অবিশ্বাসীরা নয়। কেননা মুমিনগণ কুরআনের হালাল-হারাম মেনে চলেন। সেজন্য আল্লাহ তাদের জান্নাতে প্রবেশ করান ও আযাব থেকে রক্ষা করেন। আর এটাই হ’ল তাঁর পক্ষ হ’তে রহমত ও অনুগ্রহ’।[12] যা তিনি তাদেরকে দান করেন। এছাড়া শারঈ ঝাড়-ফুঁক মুমিনের দৈহিক আরোগ্য দান করে থাকে আল্লাহর হুকুমে। এটা কেবল তার জন্যই হয়ে থাকে, যিনি কুরআন অনুধাবন করেন ও সে অনুযায়ী আমল করেন। ঐ ব্যক্তির জন্য নয়, যে কেবল ভান করে তেলাওয়াত করে। যার মধ্যে কোন খুশূ-খুযূ ও আনুগত্য নেই। এ কারণেই ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, কুরআন হ’ল আরোগ্য গ্রন্থ। যা আত্মা ও দেহ এবং দুনিয়া ও আখেরাত সবকিছুকে শামিল করে। ঐ ব্যক্তির জন্য যে ব্যক্তি একে পূর্ণ বিশ্বাস ও ভালোবাসার সাথে গ্রহণ করে এবং এর প্রতি অকুণ্ঠ আনুগত্যের শর্ত সমূহ পূরণ করে। এটি আসমান ও যমীনের মালিকের কালাম। যদি এটি পাহাড়ের উপর নাযিল হ’ত, তাহ’লে তা ফেটে চৌচির হয়ে যেত। যমীনের উপর নাযিল হ’লে তা বিদীর্ণ হয়ে যেত। অতএব আত্মার ও দেহের এমন কোন রোগ নেই, কুরআনে যার আরোগ্যের নির্দেশনা নেই’।[13]

অনুধাবন ছাড়াই পাঠ করার ক্ষতি :

ঐ ব্যক্তি চিনির বলদের মত কেবল বোঝা বহন করেই জীবন কাটায়। কিন্তু চিনি মিষ্টি না তিতা বুঝতে পারে না। এই স্বভাব ছিল ইহূদী-নাছারাদের। যেমন আল্লাহ বলেন,وَمِنْهُمْ أُمِّيُّونَ لاَ يَعْلَمُونَ الْكِتَابَ إِلاَّ أَمَانِيَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَظُنُّونَ ‘আর তাদের মধ্যে একদল নিরক্ষর ব্যক্তি রয়েছে, যারা আল্লাহর কিতাবের কিছুই জানে না স্রেফ একটা ধারণা ব্যতীত। আর তারা স্রেফ কল্পনা করে মাত্র’ (বাক্বারাহ ২/৭৮)। শাওকানী (১১৭২-১২৫০ হি.) বলেন, বলা হয়েছে যে, (أَمَانِيَّ) অর্থ তেলাওয়াত। অর্থাৎ তাদের নিকট আল্লাহর কিতাবের কোন বুঝ ও অনুধাবন ছিল না, কেবলমাত্র পাঠ করা ব্যতীত’।[14] ইবনুল ক্বাইয়িম (৬৯১-৭৫১ হি.) বলেন, অত্র আয়াতে আল্লাহ তাঁর কিতাবের পরিবর্তনকারীদের এবং উম্মীদের নিন্দা করেছেন, যারা পাঠ করা ব্যতীত আর কিছুই জানে না। আর এটাই হ’ল (أَمَانِيَّ) বা কল্পনা’।[15] অনুরূপভাবে ক্বিয়ামতের দিন উম্মতের পতনদশার কারণ সম্পর্কে আল্লাহর প্রশ্নের উত্তরে আমাদের রাসূল (ছাঃ) কৈফিয়ত দিয়ে বলবেন, وَقَالَ الرَّسُولُ يَارَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُورًا ‘সেদিন রাসূল বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! নিশ্চয়ই আমার উম্মত এই কুরআনকে পরিত্যক্ত গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)। এর ব্যাখ্যায় হাফেয ইবনু কাছীর (৭০১-৭৭৪ হি.) বলেন, কুরআন পরিত্যাগ করা অর্থ হ’ল এর অনুধাবন ও যথার্থ বুঝ হাছিলের চেষ্টা পরিত্যাগ করা’ (ঐ, তাফসীর)। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, কুরআন পরিত্যাগ করার কতগুলি অর্থ হ’তে পারে। তার মধ্যে অন্যতম হ’ল, কথক (আল্লাহ) কি বলতে চান, সেটা অনুধাবন না করা, বুঝার চেষ্টা না করা ও গভীর তত্ত্ব উদঘাটনের প্রচেষ্টা ত্যাগ করা’।[16]

কুরআন অনুধাবনের ফযীলত :

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আল্লাহর কোন গৃহে একদল লোক যখন সমবেত হয় এজন্য যে, তারা আল্লাহর কিতাব পাঠ করে ও নিজেদের মধ্যে তার পর্যালোচনা করে, সেখানে কেবলই আল্লাহর পক্ষ হ’তে বিশেষ রহমত হিসাবে ‘সাকীনাহ’ (السكينة) অবতীর্ণ হয়। আল্লাহর রহমত তাদের বেষ্টন করে রাখে ও ফেরেশতারা স্থানটি ভরে ফেলে। আর আল্লাহ তাদের সম্পর্কে তাঁর নিকটবর্তী ফেরেশতাদের সঙ্গে আলোচনা করেন’।[17] এখানে ‘সাকীনাহ’ ও রহমত নাযিলের প্রধান কারণ হ’ল তেলাওয়াত ও অনুধাবন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের মধ্যে তেলাওয়াত আছে অনুধাবন নেই। ফলে রহমতও নেই।

কুরআন অনুধাবনে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) :

(ক) হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বলেন, তিনি এক রাতে রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে ছালাত আদায় করছিলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) থেমে থেমে (مترسِّلا) ক্বিরাআত পড়ছিলেন। যখনই কোন তাসবীহ অর্থাৎ আল্লাহর গুণগানের আয়াত অতিক্রম করতেন, তখন ‘সুবহানাল্লাহ’ বলতেন। যখন কোন প্রার্থনার আয়াত অতিক্রম করতেন, তখন প্রার্থনা করতেন। যখন আল্লাহর নিকট পানাহ চাওয়ার আয়াত অতিক্রম করতেন, তখন পানাহ চেয়ে ‘আঊযুবিল্লাহ’ বলতেন’।[18] এটাই ছিল রাসূল (ছাঃ)-এর কুরআন বুঝে পড়া ও তার তাৎপর্য অনুধাবনের নমুনা।

(খ) আবু যার গেফারী (রাঃ) বলেন, এক রাতে রাসূল (ছাঃ) স্রেফ একটি আয়াত দিয়ে তাহাজ্জুদ শেষ করেন। এমতাবস্থায় ফজর হয়ে যায়। সেটি হ’ল,إِنْ تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِنْ تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ ‘যদি আপনি তাদেরকে শাস্তি দেন, তাহ’লে তারা আপনার বান্দা। আর যদি আপনি তাদের ক্ষমা করেন, তাহ’লে আপনি মহাপরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’।[19] এতে বুঝা যায়, তাঁর কুরআন অনুধাবন কত গভীর ছিল।

(গ) তরুণ ছাহাবী আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ (রাঃ) যখন প্রতিদিন এক খতম কুরআন পাঠ করতে চাইলেন, তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে তিনদিনের কমে খতম করতে নিষেধ করে বললেন, তিনদিনের কমে খতম করলে সে কিছুই বুঝবে না’।[20] এতে পরিষ্কার যে, কুরআন বুঝে পড়াটাই উদ্দেশ্য। কেবলমাত্র পাঠ করা নয়।  

কুরআন অনুধাবনে ছাহাবায়ে কেরাম :

(১) আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমাদের মধ্যে একজন ছিলেন, যিনি ১০টি আয়াত পাঠ করার পর আর  আগে বাড়তেন না। যতক্ষণ না তার মর্ম অনুধাবন করতেন ও সেমতে আমল করতেন।[21]

(২) আবু আব্দুর রহমান আব্দুল্লাহ বিন হাবীব আস-সুলামী (মৃ. ৭২ হি.) বলেন, আমাদেরকে যারা কুরআন পাঠ করিয়েছেন তারা বলতেন, তারা রাসূল (ছাঃ)-এর নিকট থেকে যখন কুরআন পাঠ শিখতেন, তখন ১০টি আয়াত জানলে তারা আর তাঁর পিছে পড়তেন না, যতক্ষণ না ঐ আয়াতগুলির উপর তারা আমল করতেন। এভাবে আমরা কুরআন ও তদনুযায়ী আমল সবই শিখতাম।[22]

(৩) এদের মধ্যে ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচাতো ভাই তরুণ ছাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস। আল্লাহর রাসূল তাঁর জন্য দো‘আ করেছিলেন,اللَّهُمَّ فَقِّهْهُ فِى الدِّينِ وَعَلِّمْهُ التَّأْوِيلَ ‘হে আল্লাহ তুমি তাকে দ্বীনের বুঝ দান কর এবং এর যথার্থ ব্যাখ্যা শিক্ষা দাও’।[23] সেকারণে ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, نِعْمَ تُرْجُمَانُ الْقُرْآنِ بْنُ عَبَّاسٍ ‘কুরআনের কতই না সুন্দর ব্যাখ্যাতা ইবনু আববাস’! (হাকেম হা/৬২৯১)। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) মারা গেছেন ৩২ হিজরীতে। তারপরেও ইবনু আববাস (রাঃ) ৩৬ বছর বেঁচে ছিলেন এবং ত্বায়েফে মৃত্যুবরণ করেন ৬৮ হিজরীতে। তাহ’লে বাকী জীবনে তিনি কুরআনকে আরও কত সুন্দরভাবেই না অনুধাবন করেছিলেন!

(৪) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, পিতা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ১২ বছরে সূরা বাক্বারাহ শেষ করেন। অতঃপর যেদিন শেষ হয়, সেদিন তিনি কয়েকটি উট নহর করে সবাইকে খাওয়ান’।[24] ওমর (রাঃ)-এর ন্যায় একজন মহান ব্যক্তির এই দীর্ঘ সময় লাগার অর্থ সূরাটির গভীর তাৎপর্য অনুধাবনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা।

(৫) আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, জনৈক ব্যক্তি ওমর (রাঃ)-এর দরবারে এল। তখন তিনি তাকে লোকদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে লোকটি বলল, হে আমীরুল মুমেনীন! তাদের মধ্যে কেউ কেউ এরূপ এরূপভাবে কুরআন তেলাওয়াত করে। তখন আমি বললাম, এত দ্রুত কুরআন তেলওয়াত করা আমি পসন্দ করি না। তখন ওমর (রাঃ) আমাকে থামালেন। এতে আমি দুঃখিত মনে বাড়ী ফিরে এলাম। অতঃপর তিনি আমার নিকটে এলেন এবং বললেন, ঐ লোকটি যা বলল, তার কোনটা তুমি অপসন্দ করলে? আমি বললাম, ওরা যত দ্রুত কুরআন পড়বে, তত আপোষে ঝগড়া করবে। প্রত্যেকেই নিজেরটাকে সঠিক বলবে। আর যখনই ঝগড়া করবে, তখনই বিরোধে লিপ্ত হবে। অবশেষে নিজেরা লড়াইয়ে রত হবে। তখন ওমর (রাঃ) বললেন, তোমার পিতার জন্য আমার  জীবন উৎসর্গীত হৌক।  আমি  এটা  লুকিয়ে  রেখেছিলাম।  অবশেষে তুমিই

সেটা বলে দিলে’।[25]

বস্ত্ততঃ ওমর ও ইবনু আববাস (রাঃ) যেটা ধারণা করেছিলেন, পরে সেটাই হয়েছিল।  খারেজীরা বের হ’ল। তারা কুরআন পাঠ করত। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করত না। অর্থাৎ তারা কুরআন অনুধাবন করত না এবং এর মর্ম উপলব্ধি করত না। ইতিহাসে এরাই প্রথম চরমপন্থী জঙ্গীদল হিসাবে কুখ্যাত। এরাই হযরত আলী (রাঃ)-কে কাফের আখ্যা দিয়ে হত্যা করে।

(৬) ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, আল্লাহর রাসূলের ছাহাবীদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি, যারা এই উম্মতের শীর্ষে অবস্থান করেন, তারা কুরআন হেফয করতেন না একটি সূরা বা অনুরূপ কিছু অংশ ব্যতীত। তারা কুরআনের উপর আমল করার রিযিক লাভ করেছিলেন। কিন্তু এই উম্মতের শেষ দিকের লোকেরা কুরআন তেলাওয়াত করবে। তাদের মধ্যে শিশু, অন্ধ সবাই থাকবে। কিন্তু তারা আমল করার রিযিক পাবে না’।[26]

(৭) একই মর্মে আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমাদের জন্য কুরআনের শব্দাবলী মুখস্ত করা খুবই কঠিন। কিন্তু এর উপর আমল করা সহজ। আর আমাদের পরের লোকদের অবস্থা হবে এই যে, তাদের জন্য কুরআন হেফয করা সহজ হবে। কিন্তু তার উপর আমল করা কঠিন হবে।[27]

(৮) মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, তোমরা যতটুকু চাও ইলম অর্জন কর। মনে রেখ, আল্লাহ তোমাদেরকে কোনই পুরস্কার দিবেন না, যতক্ষণ না তোমরা তার উপরে আমল করবে’।[28]

কুরআন অনুধাবনের অর্থ :

কুরআন অনুধাবনের অর্থ হ’ল কোন আয়াতের যথাযথ মর্ম নির্ধারণ করা এবং আয়াতের মুখ্য উদ্দেশ্য উপলব্ধি করা এবং সেখান থেকে আহকাম নিশ্চিত করা। এটা মোটেই সহজ নয় এবং এর জন্য রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ শর্তাবলী। সেই সকল শর্ত ও নিয়ম-পদ্ধতি অনুসরণ না করে কেউ কুরআন অনুধাবনের দাবী করতে পারে না। এতদ্ব্যতীত কুরআনে রয়েছে কেবল মৌলিক বিষয়াদির বর্ণনা। অতএব মূল হ’তে শাখা-প্রশাখা বের করার যোগ্যতা থাকতে হবে।

কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা দানের বিরুদ্ধে সাবধানবাণী :

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ قَالَ فِى الْقُرْآنِ بِغَيْرِ عِلْمٍ فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنَ النَّارِ ‘যে ব্যক্তি ইলম ব্যতিরেকে কুরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা প্রদান করল, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা করে নিল’।[29]

ছাহেবে মির‘আত বলেন, উক্ত হাদীছের অর্থ হ’ল নিজস্ব রায় অনুযায়ী ব্যাখ্যা করা। মরফূ‘ ও মওকূফ হাদীছ সমূহ থেকে এবং শারঈ বিধান সমূহে ও ভাষা জ্ঞানে অভিজ্ঞ শ্রেষ্ঠ বিদ্বানগণের বক্তব্য সমূহ অনুসন্ধান না করেই নিজের ধারণা মতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।

শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিছ দেহলভী বলেন, ঐ ব্যক্তির জন্য কুরআনের তাফসীরে প্রবেশ করা হারাম, যে ব্যক্তি কুরআনের ভাষা জানেনা, যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে এবং রাসূল (ছাঃ) ও তাঁর ছাহাবী ও তাবেঈগণ থেকে বর্ণিত ব্যাখ্যা সম্পর্কে অবগত নয়। যে ব্যক্তি কুরআনের সূক্ষ্ম তত্ত্ব ও আয়াত নাযিলের কারণ এবং নাসেখ-মানসূখ সম্পর্কে অবগত নয়’।

হাফেয ইবনু কাছীর (রহঃ) বলেন, (ক) কুরআনের তাফসীরের জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি হ’ল কুরআন দিয়ে কুরআনের ব্যাখ্যা করা। কেননা এক স্থানে আয়াতটি সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হ’লেও, অন্য স্থানে সেটির বিস্তারিত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। (খ) যদি তুমি এতে ব্যর্থ হও, তাহ’লে সুন্নাহতে এর ব্যাখ্যা তালাশ কর। কেননা এটি কুরআনের ব্যাখ্যা ও তার মর্ম স্পষ্টকারী। আল্লাহ বলেন, ‘আমরা তোমার নিকটে নাযিল করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যেন তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)। আর সুন্নাহ নিজেই তাঁর উপরে অহি আকারে নাযিল হয়েছে, যেমন তাঁর উপরে কুরআন নাযিল হয়েছে। যদিও তা কুরআনের ন্যায় তেলাওয়াত করা হয় না। অতঃপর যখন আমরা কুরআনে বা সুন্নাহতে কোন তাফসীর না পাব, তখন ছাহাবীগণের বক্তব্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করব। কেননা কোন অবস্থায় বা কোন প্রেক্ষিতে আয়াতটি নাযিল হয়েছিল, সে বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার কারণে তাঁরা উক্ত বিষয়ে অধিক জ্ঞানী ছিলেন। আর এ বিষয়ে তাঁদের ছিল পূর্ণ বুঝ ও সঠিক জ্ঞান ও সঠিক আমল। বিশেষ করে তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ও গুরুজন ব্যক্তিগণ। যেমন চার খলীফা এবং আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ, আব্দুল্লাহ বিন আববাস প্রমুখ বিদ্বানগণ।

অতঃপর যখন তুমি কোন তাফসীর কুরআনে বা সুন্নাহতে বা ছাহাবীগণ থেকে না পাবে, তখন বহু বিদ্বান তাবেঈদের বক্তব্য সমূহের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছেন। যেমন মুজাহিদ, আত্বা বিন আবী রাবা, সাঈদ বিন জুবায়ের প্রমুখ তাবেঈগণ। অনেকে বলেছেন, শাখা-প্রশাখাগত বিষয়ে তাবেঈদের বক্তব্য দলীল নয়। তাহ’লে কিভাবে সেটি তাফসীরের ক্ষেত্রে দলীল হবে? অর্থাৎ এটি তাদের বিরোধীদের বক্তব্যের উপরে দলীল হবে না, আর এটাই সঠিক। অতঃপর যখন তারা সবাই একটি ব্যাপারে একমত হবেন, তখন সেটার দলীল হওয়ায় কোন সন্দেহ থাকবে না। কিন্তু যদি তারা মতভেদ করেন, তাহ’লে তাদের একজনের বক্তব্য অন্যজনের উপর দলীল হবে না। যা তাদের পরবর্তীদের উপরেও হবে না। এমতাবস্থায় কুরআনের ভাষা অথবা সুন্নাহ অথবা আরবদের সার্বজনীন ভাষা রীতি অথবা উক্ত বিষয়ে ছাহাবীগণের বক্তব্যের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।فَأَمَّا تَفْسِيرُ الْقُرْآنِ بِمُجَرَّدِ الرَّأْيِ فَحَرَامٌ ‘মোটকথা কুরআনের তাফসীর স্রেফ রায়-এর মাধ্যমে করা হারাম’। এটাই হ’ল ইবনু কাছীরের বক্তব্যের সংক্ষিপ্ত সার।[30]

হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) বলতেন,أَيُّ أَرْضٍ تُقِلُّنِي، وَأَيُّ سَمَاءٍ تُظِلُّنِي، إِذَا قُلْتُ فِي الْقُرْآنِ مَا لاَ أَعْلَمُ ‘যদি আমি না বুঝে কুরআন সম্পর্কে কিছু বলি, তবে কোন যমীন আমাকে বহন করবে এবং কোন আকাশ আমাকে ছায়া দিবে?’ (তাফসীর ত্বাবারী ১/৭৮)

[চলবে]