নবচন্দ্র সমূহ

يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجّ-

‘লোকেরা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে নবচন্দ্র সমূহের ব্যাপারে। বলে দাও যে, এটি মানুষের জন্য সময় সমূহের নিরূপক ও হজ্জের জন্য সময় নির্দেশক’ (সূরা বাক্বারাহ ২/১৮৯)

اَلْأَهِلَّة একবচনে هِلاَلٌ অর্থ নতুন চাঁদ। هِلاَلٌ বলা হয় এজন্য যে, নতুন চাঁদ দেখে ছোট ছেলে-মেয়েরা খুশীতে চিৎকার করে ওঠে। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার সাথে সাথে সে যে চিৎকার ধ্বনি করে, তাকে هِلاَلٌ বলা হয়। যেমন اِسْتَهَلَّ الصَّبِىُّ ‘শিশু চিৎকার দিয়েছে’। এটা তার জীবন্ত ভূমিষ্ঠ হওয়ার প্রমাণ। هِلاَلٌ অর্থ উৎফুল্ল হওয়া। যেমন বলা হয় اِسْتَهَلَّ وَجْهُهُ فَرْحًا ‘খুশীতে তার চেহারা ঝলমল করছে’ (কুরতুবী)। এক থেকে তিন বা সাত রাতের চাঁদকে ‘হেলাল’ (الهلال) বলা হয় এবং ১৪ তারিখের পূর্ণচন্দ্রকে ‘বদর’ (البدر) বলা হয়।

এখানে ‘নতুন চাঁদ’ (هِلاَلٌ) না বলে ‘নতুন চাঁদ সমূহ’ (اَلْأَهِلَّةِ) বলার কারণ হ’ল এই যে, সদা সন্তরণশীল চাঁদ প্রতি মিনিটে ও সেকেন্ডে পৃথিবীর নতুন নতুন জনপদে নতুনভাবে উদিত হয়। ফলে এক চাঁদ বহু নতুন চাঁদে পরিণত হয়। এর সাথে মিল রেখেই বলা হয়েছে مَوَاقِيْتُ لِلنَّاسِ ‘মানুষের জন্য সময় সমূহের নিরূপক’।مَوَاقِيْتُ -এর একবচন مِيْقَاتٌ অর্থ ‘সময়’ বা ‘সময় নিরূপক’। বহুবচন আনার কারণ এই যে, চাঁদ যে অঞ্চলে ওঠে, সে অঞ্চলের সময় আগের অঞ্চল থেকে পৃথক। ফলে চাঁদ যত অঞ্চলে যখনই উদয় হবে, তত অঞ্চলে তখনই তার উদয়ের সময়কাল হিসাবে গণ্য হয়।

এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ দু’টি সূত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। (১) পৃথিবী ও চন্দ্র এবং মহাশূন্যে যা কিছু আছে সবই সন্তরণশীল। কেউই স্থির নয় (২) চন্দ্রের উদয়স্থল ভিন্ন ভিন্ন। সেকারণ পৃথিবীর সকল স্থানে একই সময়কাল প্রযোজ্য নয়। এর মাধ্যমে আরেকটি বিষয় প্রমাণিত হয় যে, চন্দ্র ও পৃথিবী চ্যাপ্টা নয়, বরং গোলাকার। ফলে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় পৃথিবীর যে অংশে চন্দ্রের আলো পড়ে, সে অংশে চন্দ্রের উদয় হয় এবং তা আলোকিত হয়। অপর অংশে তখন অন্ধকার থাকে। চন্দ্রের উদয়-অস্তের তারতম্যের কারণে চন্দ্রের ডুবে যাওয়া, সরু ও মোটা হওয়া এবং আলোর হ্রাস-বৃদ্ধি হওয়া এবং সেই সাথে আবহাওয়ার তারতম্য ঘটা ইত্যাদির মধ্যে মানুষের নানাবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। চন্দ্রের আগমন-নির্গমন ও আবর্তন-বিবর্তনের ফলে আহ্নিক গতির মাধ্যমে দৈনিক সকাল-দুপুর-বিকাল ও রাত্রির যে বিবর্তন ঘটে, তাতে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানাবিধ কার্যক্রম, বিশ্রাম, ঘুম সবই নির্ধারিত হয়। আবার বার্ষিক গতির মাধ্যমে মানুষের সাম্বৎসরিক হিসাব ও পরিকল্পনা নির্ণীত হয়। বছর শেষে ঈদ ও হজ্জ-এর আগমন এভাবেই সম্ভব হয়। এদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ অন্যত্র বলেন,وَجَعَلْنَا اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ آيَتَيْنِ فَمَحَوْنَا آيَةَ اللَّيْلِ وَجَعَلْنَا آيَةَ النَّهَارِ مُبْصِرَةً لِتَبْتَغُوا فَضْلاً مِنْ رَبِّكُمْ وَلِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ ... ‘আমরা রাত্রি ও দিবসকে দু’টি নিদর্শন হিসাবে করেছি। অতঃপর রাত্রির নিদর্শনকে আমরা নিষ্প্রভ করেছি এবং দিবসের নিদর্শনকে করেছি দৃশ্যমান। যাতে তোমরা এর মাধ্যমে তোমাদের পালনকর্তার অনুগ্রহ সন্ধান করতে পার এবং তোমরা জানতে পার বছর সমূহের গণনা ও হিসাব...(ইসরা ১৭/১২)

অন্যত্র আল্লাহ বলেন, هُوَ الَّذِيْ جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُوْرًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوْا عَدَدَ السِّنِيْنَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللهُ ذَلِكَ إِلاَّ بِالْحَقِّ، يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُوْنَ ‘তিনিই সেই সত্তা, যিনি সূর্যকে করেছেন কিরণময় এবং চন্দ্রকে করেছেন জ্যোতির্ময় এবং এর জন্য নির্ধারিত করেছেন কক্ষ সমূহ। যাতে তোমরা জানতে পার বছরগুলির সংখ্যা ও হিসাব। আল্লাহ এসব সৃষ্টি করেছেন সত্য সহকারে। তিনি নিদর্শন সমূহ ব্যাখ্যা করেন জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য’ (ইউনুস ১০/৫)

নবচন্দ্র বিষয়ে অন্যান্য জ্ঞাতব্য :

(১) عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ جَعَلَ اللهُ الْأَهِلَّةَ مَوَاقِيْتَ لِلنَّاسِ فَصُومُوا لِرُؤْيَتِهِ وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنَّ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَعُدُّوا ثَلاَثِيْنَ يَوْمًا.

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আললাহ চাঁদ সমূহকে করেছেন মানুষের জন্য সময়সমূহের নিরূপক হিসাবে। অতএব তোমরা তা দেখে ছিয়াম রাখো এবং তা দেখে ছিয়াম ভঙ্গ কর। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করে নাও’।[1]

(২) আল্লাহ বলেন, فَمَنْ شَهِدَ مِنْكُمُ الشَّهْرَ فَلْيَصُمْهُ ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি (রামাযানের) এ মাস পাবে, সে যেন এ মাসের ছিয়াম রাখে’ (বাক্বারাহ ২/১৮৫)। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, পৃথিবীর সব অঞ্চলের মানুষ একই দিনে রামাযান মাস পাবে না। বরং আগপিছ হবে।

(৩) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, صُومُوا لِرُؤْيَتِهِ، وَأَفْطِرُوا لِرُؤْيَتِهِ، فَإِنْ غُبِّىَ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا عِدَّةَ شَعْبَانَ ثَلاَثِينَ ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখ এবং চাঁদ দেখে ছিয়াম ভঙ্গ কর। কিন্তু যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলে শা‘বান মাস ত্রিশ দিন পূর্ণ করে নাও’।[2]

(৪) আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, الشَّهْرُ تِسْعٌ وَعِشْرُونَ لَيْلَةً، فَلاَ تَصُومُوا حَتَّى تَرَوْهُ، فَإِنْ غُمَّ عَلَيْكُمْ فَأَكْمِلُوا الْعِدَّةَ ثَلاَثِينَ ‘মাস ২৯ দিনে হয়। অতএব তোমরা ছিয়াম রেখোনা, যতক্ষণ না চাঁদ দেখো। আর যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তাহলে তোমরা ত্রিশ দিন পূর্ণ করে নাও’।[3]

উপরোক্ত বাণীসমূহে প্রতীয়মান হয় যে, ছিয়াম ও ঈদের জন্য চাঁদ দেখা শর্ত। আর এটা অঞ্চল বিশেষের সাথে সম্পৃক্ত। কেননা একই সাথে পৃথিবীর সকল অঞ্চল মেঘাচ্ছন্ন হয় না। দ্বিতীয়তঃ বিভিন্ন অঞ্চলে চন্দ্রের উদয়-অস্তের সময়কালের পার্থক্য সুবিদিত। আমেরিকায় যখন রাত, বাংলাদেশে তখন দিন। সঊদী আরবে যখন মাগরিব, বাংলাদেশে তখন এশার সময়।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আমলে এবং পরবর্তী সময়ে ছাহাবায়ে কেরাম সর্বদা স্ব স্ব অঞ্চলের চাঁদ দেখার উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। নিম্নের হাদীছগুলি তার প্রমাণ বহন করে। যেমন,

(১) عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ تَرَاءَى النَّاسُ الْهِلاَلَ فَأَخْبَرْتُ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم أَنِّى رَأَيْتُهُ فَصَامَهُ وَأَمَرَ النَّاسَ بِصِيَامِهِ ইবনু ওমর (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, লোকেরা রামাযানের চাঁদ দেখল। তখন আমি গিয়ে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম আমি চাঁদ দেখেছি। ফলে তিনি ছিয়াম রাখলেন ও লোকদের ছিয়াম রাখতে আদেশ করলেন’।[4]

উল্লেখ্য যে, জনৈক বেদুঈনের সাক্ষ্য শুনে রাসূল (ছাঃ) বেলালকে ছিয়ামের ঘোষণা দিতে বললেন মর্মে আবুদাঊদ বর্ণিত হাদীছ দু’টি (হা/২৩৪০-৪১) যঈফ।

(২) عَنْ رِبْعِىِّ بْنِ حِرَاشٍ عَنْ رَجُلٍ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ اخْتَلَفَ النَّاسُ فِى آخِرِ يَوْمٍ مِنْ رَمَضَانَ فَقَدِمَ أَعْرَابِيَّانِ فَشَهِدَا عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم بِاللهِ لَأَهَلاَّ الْهِلاَلَ أَمْسِ عَشِيَّةً فَأَمَرَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم النَّاسَ أَنْ يُفْطِرُوا زَادَ خَلَفٌ فِى حَدِيثِهِ وَأَنْ يَغْدُوا إِلَى مُصَلاَّهُمْ-

রিবঈ বিন হেরাশ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জনৈক ছাহাবী হতে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, লোকেরা রামাযানের শেষ দিন ঈদের চাঁদ দেখা সম্পর্কে মতভেদ করল। এ সময় দু’জন বেদুঈন ব্যক্তি নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে সাক্ষ্য দিয়ে বলল, আল্লাহর কসম! গতকাল সন্ধ্যায় তারা ঈদের চাঁদ দেখেছে’। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সকলকে ছিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ দিলেন। বর্ণনাকারী খাল্ফ তার হাদীছে বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরও নির্দেশ দেন, যেন তারা সবাই ঈদগাহে চলে যায়’।[5]

উপরোক্ত হাদীছদ্বয়ে ইবনু ওমর (রাঃ) এবং দুই বেদুঈন ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ছিয়াম রাখা ও ছিয়াম ভঙ্গের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। তাঁরা সকলে ছিলেন মদীনার ও তার আশপাশের এলাকার মানুষ। পৃথিবীর অন্য গোলার্ধের মানুষ ছিলেন না কিংবা দূরদেশের কোন অধিবাসী ছিলেন না।

খোলাফায়ে রাশেদীন বা অন্যান্য ছাহাবীগণের জীবদ্দশায় মদীনার চাঁদের হিসাবে অন্য দেশের মুসলমানগণ ছিয়াম ও ঈদ পালন করেছেন বলে জানা যায় না। বরং এর বিপরীতটাই জানা যায়। যেমন নিম্নের হাদীছটি তার প্রমাণ বহন করে।-

عَنْ كُرَيْبٍ أَنَّ أُمَّ الْفَضْلِ بِنْتَ الْحَارِثِ بَعَثَتْهُ إِلَى مُعَاوِيَةَ بِالشَّامِ قَالَ فَقَدِمْتُ الشَّامَ فَقَضَيْتُ حَاجَتَهَا وَاسْتُهِلَّ عَلَىَّ رَمَضَانُ وَأَنَا بِالشَّامِ فَرَأَيْتُ الْهِلاَلَ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ ثُمَّ قَدِمْتُ الْمَدِينَةَ فِى آخِرِ الشَّهْرِ فَسَأَلَنِى عَبْدُ اللهِ بْنُ عَبَّاسٍ- رضى الله عنهما- ثُمَّ ذَكَرَ الْهِلاَلَ فَقَالَ مَتَى رَأَيْتُمُ الْهِلاَلَ فَقُلْتُ رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ. فَقَالَ أَنْتَ رَأَيْتَهُ فَقُلْتُ نَعَمْ وَرَآهُ النَّاسُ وَصَامُوا وَصَامَ مُعَاوِيَةُ. فَقَالَ لَكِنَّا رَأَيْنَاهُ لَيْلَةَ السَّبْتِ فَلاَ نَزَالُ نَصُوْمُ حَتَّى نُكْمِلَ ثَلاَثِيْنَ أَوْ نَرَاهُ. فَقُلْتُ أَوَلاَ تَكْتَفِى بِرُؤْيَةِ مُعَاوِيَةَ وَصِيَامِهِ فَقَالَ لاَ هَكَذَا أَمَرَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم. وَشَكَّ يَحْيَى بْنُ يَحْيَى فِى نَكْتَفِى أَوْ تَكْتَفِى-

‘কুরাইব হতে বর্ণিত হয়েছে যে, উম্মুল ফযল বিনতুল হারিছ তাকে সিরিয়ায় মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নিকটে পাঠালেন। তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় পৌঁছলাম এবং তার দেওয়া প্রয়োজনীয় কাজটি সম্পন্ন করলাম। এমতাবস্থায় রামাযানের চাঁদ উদিত হ’ল। আমি জুম‘আর দিন সন্ধ্যায় নতুন চাঁদ দেখলাম। অতঃপর মাসের শেষদিকে আমি মদীনায় পৌঁছলাম। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) আমাকে কুশল জিজ্ঞেস করলেন এবং চাঁদ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। অতঃপর বললেন, কবে তোমরা রামাযানের চাঁদ দেখেছিলে? বললাম, জুম‘আর দিন সন্ধ্যায়। তিনি বললেন, তুমি চাঁদ দেখেছিলে? বললাম, হ্যাঁ এবং লোকেরাও দেখেছে। তারা ছিয়াম রেখেছে এবং মু‘আবিয়াও ছিয়াম রাখেন। অতঃপর তিনি বললেন, কিন্তু আমরা চাঁদ দেখেছি শনিবার সন্ধ্যায়। ফলে আমরা ছিয়াম রেখে যাব যতক্ষণ না ত্রিশ দিন পূর্ণ করব অথবা ঈদের চাঁদ দেখব। আমি বললাম, আপনি কি মু‘আবিয়ার চাঁদ দেখা ও তাঁর ছিয়াম রাখাকে যথেষ্ট মনে করেন না? তিনি বললেন, না। এভাবেই করার জন্য আমাদেরকে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন। বর্ণনাকারী ইয়াহইয়া ইবনে ইয়াহইয়া সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, نَكْتَفِى ‘আমরা কি যথেষ্ট মনে করি না’ অথবা تَكْتَفِى ‘আপনি কি যথেষ্ট মনে করেন না’- বাক্যের ব্যাপারে।[6]

উক্ত মর্মে মুহাদ্দিছগণ স্ব স্ব কিতাবে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন। যেমন (১) ইমাম নববী ছহীহ মুসলিমের অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, باب بَيَانِ أَنَّ لِكُلِّ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ وَأَنَّهُمْ إِذَا رَأَوُا الْهِلاَلَ بِبَلَدٍ لاَ يَثْبُتُ حُكْمُهُ لِمَا بَعُدَ عَنْهُمْ ‘প্রত্যেক শহরের জন্য শহরবাসীর চাঁদ দেখা প্রযোজ্য হবে এবং যখন এক শহরের অধিবাসীগণ চাঁদ দেখবে, তখন তার হুকুম তাদের থেকে দূরের লোকদের জন্য প্রযোজ্য হবে না’।

(২) ইমাম তিরমিযী লিখেছেন, لِكُلِّ أَهْلِ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُمْ ‘প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য স্ব স্ব চাঁদ দেখা প্রযোজ্য হবে’।[7] অতঃপর কুরাইব বর্ণিত উপরের হাদীছটি বর্ণনা শেষে ইমাম তিরমিযী বলেন, اَلْعَمَلُ عَلَى هَذَا الْحَدِيثِ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ أَنَّ لِكُلِّ أَهْلِ بَلَدٍ رُؤْيَتَهُ ‘এই হাদীছের উপর আমল জারি আছে বিদ্বানগণের নিকট যে, প্রত্যেক অঞ্চলের জন্য স্ব স্ব চাঁদ দেখা প্রযোজ্য হবে’।

(৩) ইমাম আবুদাঊদ উপরোক্ত হাদীছের আলোকে অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন, باب إِذَا رُؤِىَ الْهِلاَلُ فِى بَلَدٍ قَبْلَ الآخَرِينَ بِلَيْلَةٍ ‘যখন এক শহরে অন্য শহরের এক রাত্রি পূর্বে চাঁদ দেখা যায়’।

(৪) ইমাম নাসাঈ রচনা করেছেন, باب اخْتِلاَفِ أَهْلِ الآفَاقِ فِى الرُّؤْيَةِ ‘নতুন চাঁদ দেখা বিষয়ে ভিনদেশীদের ভিন্নতা প্রসঙ্গে’ অনুচ্ছেদ-৭

(৫) ইমাম ইবনু খুযায়মা লিখেছেন, باب الدليل على أن الواجب على أهل كل بلدة صيام رمضان لرؤيتهم لا رؤية غيرهم ‘প্রত্যেক শহরবাসীর জন্য স্ব স্ব চন্দ্রদর্শন অনুযায়ী রামাযানের ছিয়াম রাখা ওয়াজিব। যা অন্যদের জন্য প্রযোজ্য নয়’

(৬) ইমাম বায়হাক্বী রচনা করেছেন, باب الْهِلاَلِ يُرَى فِى بَلَدٍ وَلاَ يُرَى فِى آخَرَ ‘নবচন্দ্র যা এক শহরে দেখা যায়, অন্য শহরে নয়’।

এর দ্বারা বুঝা যায় যে, বিগত মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ ও সালাফে ছালেহীন চন্দ্রের উদয়স্থলের ভিন্নতা (اختلاف المطالع) স্বীকার করেছেন এবং সে অনুযায়ী তারা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ছিয়াম ও ঈদ পালনের নির্দেশনা দিয়েছেন।

এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল, বর্তমান যুগে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে চাঁদ দেখা ও তা সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী প্রচারের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, তাতে করে এক এলাকার চাঁদ দেখার বিষয়টি পৃথিবীর সকল এলাকার জন্য প্রযোজ্য হবে কি-না। এর জওয়াবে নিম্নোক্ত হাদীছগুলি প্রণিধানযোগ্য। যেমন-

(১) عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنَّا أُمَّةٌ أُمِّيَّةٌ لاَ نَكْتُبُ وَلاَ نَحْسُبُ، الشَّهْرُ هَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا وَعَقَدَ الإِبْهَامَ فِى الثَّالِثَةِ ثُمَّ قَالَ : اَلشَّهْرُ هَكَذَا وَهَكَذَا وَهَكَذَا. يَعْنِى تَمَامَ ثَلاَثِيْنَ يَعْنِى مَرَّةً تِسْعًا وَّعِشْرِيْنَ وَمَرَّةً ثَلاَثِيْنَ ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, আমরা নিরক্ষর উম্মত। আমরা লিখতে জানি না, হিসাবও জানি না। মাস হ’ল এরূপ, এরূপ ও এরূপ। তৃতীয় বারে তিনি বৃদ্ধাঙ্গুলী মুষ্টিবদ্ধ করলেন। অতঃপর তিনি পুনরায় বললেন, এরূপ, এরূপ ও এরূপ। অর্থাৎ পূর্ণ ত্রিশ দিন। রাবী বলেন, এর দ্বারা তিনি একবার ২৯ ও একবার ৩০ বুঝালেন’।[8] ইবনু বাত্ত্বাল বলেন, অত্র হাদীছে মুসলমানদেরকে জ্যোতির্বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হতে এবং সকল প্রকার বাড়াবাড়ি ও ভান করা হতে নিষেধ করা হয়েছে এবং কেবলমাত্র চোখে দেখার উপর নির্ভর করার জন্য বলা হয়েছে’ (মির‘আত)

রাফেযী শী‘আগণ এবং তাদের সমর্থক কিছু সংখ্যক ফক্বীহ জ্যোতির্বিজ্ঞানের শরণাপন্ন হওয়ার প্রতি মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বাজী বলেন যে, সালাফে ছালেহীনের ইজমা তাদের বিরুদ্ধে দলীল স্বরূপ’। ইবনু বাযীযাহ বলেন, তাদের এই মাযহাব সম্পূর্ণ বাতিল। কেননা ইসলামী শরী‘আত তার অনুসারীদেরকে জ্যোতির্বিজ্ঞানে মাথা ঘামাতে নিষেধ করেছে। কেননা এগুলি স্রেফ কল্পনা ও অনুমান ব্যতীত কিছুই নয়। যার মধ্যে নিশ্চিত সত্য এমনকি নিশ্চিত ধারণাও পাওয়া সম্ভব নয়।[9]

অতঃপর অত্র হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হাতের ১০টি আঙ্গুল তিনবার দেখিয়ে এমনভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে দিয়েছেন যা একজন মূক ও বধির ব্যক্তির জন্যও যথেষ্ট হয়। একজন দক্ষ প্রশিক্ষকের মত তিনি এ সংক্রান্ত বিধান স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে গেছেন। অতএব এ ব্যাপারে ধূম্রজালের কোন অবকাশ নেই।

(২) عَنْ أَبِىْ بَكْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم شَهْرَا عِيْدٍ لاَ يَنْقُصَانِ : رَمَضَانُ وَذُو الْحِجَّةِ আবু বাকরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ঈদের দু’টি মাস (একই বছরে) কম হয় না। রামাযান ও যুলহিজ্জাহ’।[10] অর্থাৎ রামাযান ২৯ দিনে হলে সে বছর যিলহাজ্জ মাস ৩০ দিনে হবে। পক্ষান্তরে রামাযান ৩০ দিনে হলে যিলহাজ্জ ২৯ দিনে হবে। একই বছরে দু’টি মাস ২৯ দিনে হবে না। এর দ্বারা মাস গণনার বিষয়টি আরও সহজ করে দেওয়া হয়েছে।

(৩) عَنْ أَبِىْ هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الصَّوْمُ يَوْمَ تَصُومُوْنَ وَالْفِطْرُ يَوْمَ تُفْطِرُوْنَ وَالأَضْحَى يَوْمَ تُضَحُّوْنَ আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ছওম হল যেদিন তোমরা ছিয়াম রাখো। ঈদুল ফিৎর হ’ল যেদিন তোমরা তা পালন কর এবং ঈদুল আযহা হ’ল যেদিন তোমরা সেটা কর’।[11]

অত্র হাদীছে ইঙ্গিত রয়েছে এক অঞ্চলের অধিবাসী সকলের একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালনের প্রতি। কোন বাংলাদেশী যদি প্রবাসে থাকেন অথবা কোন বিদেশী যদি বাংলাদেশে থাকেন, তাহলে প্রত্যেকে বসবাসরত দেশের মুসলমানদের সাথে একত্রে ছিয়াম ও ঈদ পালন করবেন, নিজ দেশের হিসাবে নয়।

(৪) عَنْ أَبِى الْبَخْتَرِىِّ قَالَ خَرَجْنَا لِلْعُمْرَةِ فَلَمَّا نَزَلْنَا بِبَطْنِ نَخْلَةَ قَالَ تَرَاءَيْنَا الْهِلاَلَ فَقَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ هُوَ ابْنُ ثَلاَثٍ. وَقَالَ بَعْضُ الْقَوْمِ هُوَ ابْنُ لَيْلَتَيْنِ قَالَ فَلَقِينَا ابْنَ عَبَّاسٍ فَقُلْنَا لَهُ كَذَا وَكَذَا... فَقَالَ إِنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ إِنَّ اللهَ مَدَّهُ لِلرُّؤْيَةِ فَهُوَ لِلَيْلَةٍ رَأَيْتُمُوهُ তাবেঈ বিদ্বান আবুল বাখতারী বলেন, আমরা ওমরার উদ্দেশ্যে বের হলাম। অতঃপর যখন আমরা (মক্কার পূর্ব সীমান্তবর্তী) নাখলা উপত্যকায় পৌঁছলাম, তখন আমরা চাঁদ দেখলাম। এমতাবস্থায় আমাদের কেউ বলল, এটি তিনদিনের চাঁদ, কেউ বলল দু’দিনের চাঁদ। তখন আমরা ইবনু আববাস (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাত করে, অন্য বর্ণনায় তাঁর কাছে লোক পাঠিয়ে চাঁদের বড় হওয়া বিষয়ে জিজ্ঞেস করলাম। জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ চাঁদকে বর্ধিত করেন তাকে দেখার জন্য। অতএব উক্ত চাঁদ ঐ রাতের, যে রাতে তোমরা তাকে দেখেছ’।[12] অর্থাৎ বড় বা ছোট কোন বিষয় নয়। যে রাতে তোমরা চাঁদ দেখেছ, ওটাই হ’ল তোমাদের জন্য চন্দ্রোদয়ের রাত এবং ঐ রাত থেকেই তোমরা চাঁদ গণনা করবে।

শেষোক্ত হাদীছে এ সংশয় নিরসন করা হয়েছে যে, মক্কায় চাঁদ দেখার এক বা দু’দিন পরে ঢাকায় চাঁদ দেখা গেলে এবং তাতে চাঁদ বড় হয়ে গেলেও তা ঢাকার জন্য নতুন চাঁদ হিসাবে গণ্য হবে এবং সে হিসাবেই তারা ছিয়াম ও ঈদ পালন করবে।

উল্লেখ্য যে, সূর্য পূর্ব থেকে পশ্চিমে যায় এবং চন্দ্র পশ্চিম থেকে পূর্বে যায়। এক্ষণে পৃথিবীর যেসব অঞ্চল কা‘বা গৃহের পশ্চিম দিকে অবস্থিত তারা চাঁদ আগে দেখে এবং যেসব অঞ্চল পূর্ব দিকে অবস্থিত, তারা চাঁদ পরে দেখে। যেমন মক্কার পশ্চিম দিকের দেশ মিসর, সূদান, লিবিয়া, আলজেরিয়া, চাদ, নাইজেরিয়া, নাইজার এবং আফ্রিকা ও ইউরোপীয় দেশ সমূহের লোকেরা চাঁদ আগে দেখতে পায় এবং আগের দিন ছিয়াম ও ঈদ পালন করে।

পক্ষান্তরে মক্কার পূর্বদিকের দেশ পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, চীন প্রভৃতি অঞ্চলের লোকেরা চাঁদ পরে দেখতে পায় এবং সঊদী আরবের এক বা দু’দিন পরে ছিয়াম ও ঈদ পালন করে। যেমন গত ২০০৯ সালের রামাযানের ছিয়াম সঊদী আরবের পশ্চিম দিকের লিবিয়া, চাদ, আলবেনিয়া, বসনিয়া প্রভৃতি দেশে শুরু হয়েছে ২১শে আগষ্ট তারিখে। সঊদী আরবে হয়েছে ২২শে আগষ্ট এবং পূর্বদিকের দেশ পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশে হয়েছে ২৩শে আগষ্ট তারিখে। একইভাবে ঈদও হয়েছে যথাক্রমে ১৯, ২০ ও ২১শে সেপ্টেম্বর।

আরেকটি বিষয় হ’ল এই যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সর্বাধুনিক হিসাব মতে নবচন্দ্রের উদয়কালের উচ্চতার হিসাবে উদয়স্থল থেকে অন্যূন ৫৬০ মাইল দূরত্বের লোকদের জন্য উক্ত চাঁদ গণ্য হবে।[13] এটি সরাসরি আকাশপথের দূরত্বের হিসাব, সড়ক পথের নয়।

উক্ত হিসাব অনুযায়ী মক্কার নিকটবর্তী ও পূর্বদিকের ৫৬০ মাইল দূরত্বের বাইরের অধিবাসীদের জন্য মক্কার চাঁদ প্রযোজ্য নয়। সম্ভবতঃ সেকারণে মদীনা থেকে প্রায় ৭০০ মাইল উত্তর-পশ্চিমে সিরিয়ায় একদিন পূর্বে দেখা চাঁদ মদীনায় গণ্য করা হয়নি। মদীনা ও সিরিয়ার মধ্যে সময়ের পার্থক্য ১৪ মিনিট ৪০ সেকেন্ড। অনুরূপভাবে মক্কা থেকে পূর্বদিকে ইসলামাবাদের দূরত্ব ২ ঘণ্টা ১১ মিঃ ৪৪ সেকেন্ড। নয়াদিল্লীর দূরত্ব ২ ঘণ্টা ২৭ মিঃ ৪ সেকেন্ড। কলিকাতার দূরত্ব ৩ ঘণ্টা ১২ মিঃ ৩৬ সেকেন্ড এবং ঢাকার দূরত্ব ৩ ঘণ্টা ২০ মিঃ ৪৮ সেকেন্ড। ফলে মক্কায় চাঁদ দেখার নির্ধারিত সময় পরে ঢাকায় চাঁদ দেখা সম্ভব। কিন্তু ঢাকায় তখন রাত থাকায় পরের দিন সন্ধ্যায় সেটা দেখা যায়। সে কারণ কখনো একদিন বা কখনো দু’দিন পরে বাংলাদেশে ছিয়াম বা ঈদ করা হয়, স্রেফ চাঁদ দেখার আগপিছ হওয়ার কারণে। এভাবে মক্কায় যখন মাগরিব হয়, ঢাকায় মুছল্লীগণ তখন এশার ছালাত আদায় করে রাতের খানাপিনা শেষ করেন। অনুরূপভাবে ঢাকায় যখন মাগরিব হয় আমেরিকা বা কানাডায় তখন ফজর হয় অথবা সকাল হয়ে যায়। বাংলাদেশে যখন লায়লাতুল ক্বদর, ঐসব দেশে তখন যোহর হয়। অতএব সারা বিশ্বে একই সময়ে চাঁদ দেখা ও একই দিনে ছিয়াম, লায়লাতুল ক্বদর ও ঈদ পালন করা সম্ভব নয়।

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, রামাযান, হজ্জ, ঈদায়েন প্রভৃতি ইবাদতের হিসাব আল্লাহ চান্দ্র মাসের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন, সৌর হিসাবে করেননি। যাতে পৃথিবীর সকল প্রান্তের মুসলমানের জন্য সকল ঋতুতে এগুলি পালনের সুযোগ হয়। অন্যথায় সৌর মাসের সাথে সম্পৃক্ত হ’লে কোন দেশে কেবল গ্রীষ্মকালেই রামাযান আসত, আবার কোন দেশে কেবল শীতকালেই আসত। এতে নির্দিষ্ট অঞ্চলের লোকদের উপর অবিচার হ’ত। চান্দ্র মাস সৌর মাসের চেয়ে ছোট এবং প্রতি বছর ১১ দিন করে এগিয়ে আসে। ইসলাম বিশ্বধর্ম। তাই বিশ্বের সকল এলাকার প্রতি সুবিচার করার জন্য এবং সকল মওসুমে এগুলি পালনের জন্য উপরোক্ত ইবাদতগুলি আল্লাহ চান্দ্র মাসের সাথে যুক্ত করেছেন। পক্ষান্তরে ছালাতের সময়কালকে আল্লাহ সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত করেছেন। যেমন ছুবহে ছাদিক হলে ফজর হয়, দুপুরে সূর্য ঢললে যোহর হয় ও সন্ধ্যায় সূর্য ডুবলে মাগরিব হয়। অতএব চাঁদের হিসাবে সারা বিশ্বে একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ পালন করা প্রকারান্তরে আল্লাহর উক্ত কল্যাণ বিধান থেকে মাহরূম হওয়ার শামিল।

তাছাড়া একই দিনে সর্বত্র ছিয়াম ও ঈদ করলে তাতে চন্দ্রের উদয়স্থলের পার্থক্যকে (اختلاف المطالع) অস্বীকার করা হবে, যা বাস্তবতার বিরোধী এবং তাতে ছিয়াম ও ঈদের সময়কালে এক বা দু’দিন আগপিছ হবেই। এটা করলে নিম্নোক্ত হাদীছের সরাসরি বিরোধিতা করা হবে। যেমন-

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لاَ يَتَقَدَّمَنَّ أَحَدُكُمْ رَمَضَانَ بِصَوْمِ يَوْمٍ أَوْ يَوْمَيْنِ، إِلاَّ أَنْ يَكُونَ رَجُلٌ كَانَ يَصُومُ صَوْمَهُ فَلْيَصُمْ ذَلِكَ الْيَوْمَ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেছেন, তোমাদের কেউ যেন রামাযানের একদিন বা দু’দিন পূর্বে ছিয়াম না রাখে। তবে যদি কেউ অভ্যস্ত থাকে, সে-ই কেবল ঐদিন ছিয়াম রাখতে পারে’।[14] অর্থাৎ যদি কারু ঐদিন মানতের ছিয়াম থাকে কিংবা সোমবার ও বৃহস্পতিবারের নিয়মিত নফল ছিয়ামের দিন থাকে, তিনিই কেবল ঐদিন ছিয়াম রাখতে পারেন। অন্য কোন কারণে নয়। যেমন রাফেযী শী‘আরা ও বাতেনী ভ্রান্ত ফের্কার লোকেরা রামাযানকে স্বাগত জানিয়ে চাঁদ দেখার এক বা দু’দিন আগে ছিয়াম রেখে থাকে (মির‘আত ৬/৪৩৯)। তাছাড়া এর অর্থ এটা নয় যে, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় চাঁদ দেখতে না পাওয়ায় এহতিয়াত্ব বা সাবধানতা অবলম্বন করে এক বা দু’দিন আগেই রামাযান শুরু করবে। কেননা এ ব্যাপারে পরিষ্কার বলা আছে যে, সন্দেহের দিনে ছিয়াম রাখবে না। বরং শা‘বানের ত্রিশ দিন পূর্ণ করে নিবে। এক্ষণে নিজ নিজ দেশে বা অঞ্চলে চাঁদ দেখা না গেলেও পৃথিবীর অন্য প্রান্তে চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে নিজ এলাকায় রামাযানের ছিয়াম শুরু করা রামাযানকে এক বা দু’দিন এগিয়ে আনার শামিল। যা উক্ত হাদীছে নিষেধ করা হয়েছে।

একই মর্মে নিম্নের হাদীছটিতে বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

عَنْ حُذَيْفَةَ بْنِ الْيَمَانِ عَنْ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ تَقَدَّمُوا الشَّهْرَ حَتَّى تَرَوُا الْهِلاَلَ قَبْلَهُ أَوْ تُكْمِلُوا الْعِدَّةَ ثُمَّ صُومُوا حَتَّى تَرَوُا الْهِلاَلَ أَوْ تُكْمِلُوا الْعِدَّةَ قَبْلَهُ-

হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা রামাযান মাসকে এগিয়ে এনো না যতক্ষণ না তোমরা তার পূর্বে চাঁদ দেখ। অথবা তোমরা শা‘বান মাসের (ত্রিশ দিনের) গণনা পূর্ণ কর। অতঃপর ছিয়াম রাখ যতক্ষণ না (ঈদের) চাঁদ দেখ অথবা তার পূর্বে (রামাযানের ত্রিশ দিনের) গণনা পূর্ণ কর’।[15]

সবচেয়ে বড় কথা হ’ল এর ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর সাধারণ নির্দেশ ‘তোমরা চাঁদ দেখে ছিয়াম রাখো ও চাঁদ দেখে ছিয়াম ছাড়ো’-এর বিরোধিতা করা হবে। তাছাড়া বিগত চৌদ্দশ’ বছরে ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র কখনো একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ হয়েছে বলে জানা যায় না।

উপরে বর্ণিত হাদীছ সমূহের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, রামাযানের ছিয়াম ও ঈদ চাঁদ দেখার সাথে শর্তযুক্ত এবং তা স্ব স্ব দেশ বা অঞ্চলের সাথে সম্পৃক্ত। পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে কোন একজনের দেখার সাথে সম্পর্কযুক্ত নয়। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।

উল্লেখ্য যে, কিছু মানুষ যুক্তি দিয়ে মক্কার সাথে একই দিনে পৃথিবীর সর্বত্র ছিয়াম ও ঈদ প্রমাণ করতে চান। অথচ কুরআন ও হাদীছ তার বিপরীত কথা বলে। সেজন্য তারা কুরআন-হাদীছের প্রকাশ্য অর্থ থেকে সরে গিয়ে নিজেদের মনগড়া ব্যাখ্যা করেন। অথচ কুরআন ও হাদীছের ব্যাখ্যা ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী হতে হবে। অন্য কোন বুঝ অনুযায়ী নয়। রাসূল (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরামের আমলে যেটা দ্বীন ছিল না, এ যুগে সেটা দ্বীন নয়। তাঁদের আমলে মক্কার সাথে মিলিয়ে ইসলামী দুনিয়ার সর্বত্র একই দিনে ছিয়াম ও ঈদ ছিল না, এযুগেও সেটা থাকবে না। যুক্তি দিয়ে করতে চাইলে সেটা হবে পথভ্রষ্টতা। কেননা কুরআন-হাদীছ হ’ল আল্লাহর অহী। তা মানুষের জ্ঞানের মুখাপেক্ষী নয়। জ্ঞান তো তাকে বলা হয়, যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা অর্জিত অনুভূতি থেকে একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সেকারণ ইন্দ্রিয়গুলির ক্রিয়া যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন জ্ঞানও নিষ্ক্রীয় হয়ে যায়। জ্ঞান মানুষের মস্তিষ্ক থেকে আসে। যাতে সত্য-মিথ্যা, ভুল-শুদ্ধ দু’টিরই সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু ‘অহি’ আল্লাহর পক্ষ থেকে আসে। যাতে ভুল বা মিথ্যার কোন অবকাশ নেই। প্রকৃত মুমিন সর্বদা তার সামনে মাথা নত করে ও তাকে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করে। মুমিন হাদীছের পক্ষে যুক্তি দিবে, বিপক্ষে নয়। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, আমার পরে তোমরা যারা বেঁচে থাকবে, তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে। সে সময় তোমাদের উপর অপরিহার্য হ’ল আমার সুন্নাত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। তোমরা সেটা অাঁকড়ে থাকবে ও মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। আর (ধর্মের নামে) নবোদ্ভূত বিষয় সমূহ হতে দূরে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নবোদ্ভূত বিষয় হ’ল বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আত হ’ল ভ্রষ্টতা (আহমাদ, আবুদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হ’ল জাহান্নাম’ (নাসাঈ হা/১৫৭৮)


[1]. আহমাদ হা/১৬৩৩৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৯৩।

[2]. বুখারী হা/১৯০৯, মুসলিম হা/১০৮১, মিশকাত হা/১৯৭০ ‘নতুন চাঁদ দেখা’ অনুচ্ছেদ।

[3]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ হা/১৯০৭, মিশকাত হা/১৯৬৯।

[4]. আবুদাঊদ হা/২৩৪২, দারেমী, মিশকাত হা/১৯৭৯।

[5]. আবুদাঊদ হা/২৩৩৯; ছহীহাহ হা/২০৫১।

[6]. মুসলিম হা/১০৮৭ ‘ছিয়াম’ অধ্যায় অনুচ্ছেদ-৫।

[7]. তিরমিযী হা/৬৯৭, অনুচ্ছেদ ৯।

[8]. বুখারী হা/১৯১৩; মুসলিম হা/১০৮০; মিশকাত হা/১৯৭১।

[9]. দ্রঃ মির‘আত হা/১৯৯১-এর ব্যাখ্যা; ৬/৪৩৪-৩৬ পৃঃ।

[10]. বুখারী হা/১৯১২, মুসলিম হা/১০৮৯, মিশকাত হা/১৯৭২।

[11]. আবুদাঊদ হা/২৩২৪; তিরমিযী হা/৭০১; ইবনু মাজাহ হা/১৬৬০।

[12]. মুসলিম হা/১০৮৮, মিশকাত হা/১৯৮১।

[13]. মির‘আত ৬/৪২৯ হা/১৯৮৯-এর ব্যাখ্যা।

[14]. বুখারী হা/১৯১৪, মুসলিম হা/১০৮২, মিশকাত হা/১৯৭৩।

[15]. নাসাঈ হা/২১২৬; আবুদাঊদ হা/২০১৫।