ইসলামী আইনের কল্যাণকারিতা

কথায় বলে ‘ঠেলার নাম বাবাজী’। দেশ যখন একের পর ধর্ষণ-গণধর্ষণে ছেয়ে যাচ্ছে, চারদিকে ছিঃ ছিঃ রব উঠছে, পিতা-মাতারা যখন তাদের ধর্ষক সন্তানদের ফাঁসি চাচ্ছে, তখনই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টনক নড়েছে। সংসদ অধিবেশন লাগেনি। কয়েকজন মন্ত্রীকে ডেকে নিয়ে মন্ত্রী সভার বৈঠকে এক নিঃশ্বাসে তিনি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করলেন। যার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে টাঙ্গাইলের যেলা আদালত ৫ ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের রায় দিলেন। একদিন পরেই ‘ধর্ষণের জন্য কেবল ডাক্তারী পরীক্ষা যথেষ্ট নয়, আনুষঙ্গিক কারণ সমূহ ধর্তব্য হবে’ বলে হাইকোর্ট এক যুগান্তকারী রায় ঘোষণা করল। এতদিন যেন আদালত সরকারের এই চূড়ান্ত ঘোষণাটির অপেক্ষায় ছিল। দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। সবাই যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন কিছু পত্রিকা মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধে প্রায়ই লেখা ছাপছে। জাতিসংঘের একজন মহিলা কর্মকর্তা এর বিরুদ্ধে মন্তব্য করেছেন। অথচ পৃথিবীর সর্বোচ্চ এই সংস্থাটির সর্বোচ্চ কর্মকর্তাদের নষ্টামির খবর প্রায়ই পত্রিকায় শিরোনাম হয়। যাদের অফিসে মহিলাদের ইয্যতের নিরাপত্তা নেই, তারা কেন চাইবে অন্য মহিলাদের ইয্যত নিরাপদ থাকুক! আমেরিকার মহিলা সেনারা তাদের পুরুষ সেনাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য পিস্তল উঁচিয়ে বাথরুমে যাবার কথাও পত্রিকায় এসেছে। অন্যান্য দেশের এরূপ নোংরা অবস্থাও মাঝে-মধ্যে পত্রিকায় শিরোনাম হয়। যাদের আত্মসম্মান বোধ নেই, তাদের কাছে এসবের বাছ-বিচার থাকবে কেন? আল্লাহর ভাষায় এরা পশু বা তার চাইতে নিকৃষ্ট। এরা জাহান্নামের কীট (আ‘রাফ ১৭৯)

ধর্ষণের এই মৃত্যুদন্ডের শাস্তি ছিল বাংলাদেশের ৪৯ বছরের ইতিহাসে ৮ম মৃত্যুদন্ডের আইন। এই আইন জারিতে নাস্তিক ও বস্ত্তবাদীদের গা জ্বালা ধরেছে। তারা ধর্ষণ বিরোধী মিছিলে হামলা পর্যন্ত করিয়েছে। আর তাদের মিডিয়াগুলিতে এর বিরুদ্ধে কোরাস গাওয়া শুরু হয়েছে। তারা জানেনা যে, এটি মুসলমানদের দেশ। গণতন্ত্রে যদি অধিকাংশের রায়ই চূড়ান্ত হয়, তাহ’লে এদেশ চলবে অধিকাংশ মুসলিম নাগরিকদের আক্বীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী। আর তা হ’ল ইসলাম। যেখানে ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেটাই করেছেন। তিনি ইসলামের স্বার্থে করলে এর জন্য অসংখ্য নেকী লাভ করবেন। শুধু এই একটি বিষয় নয়; ইসলামের প্রতিটি আইনই জনকল্যাণের সর্বোচ্চ আইন। মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তাই মানুষের সবচাইতে বড় কল্যাণকামী হ’লেন আল্লাহ। ফলে তাঁর প্রতিটি আইনই মানুষের ও সৃষ্টিজগতের সর্বোচ্চ কল্যাণে নিবেদিত। তাঁর শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন সৃষ্টিজগতের জন্য ‘রহমত’ স্বরূপ (আম্বিয়া ১০৭)। তিনি আল্লাহর বিধান সমূহ বাস্তবায়ন করে গেছেন। অথচ আমরা তাঁর উম্মত হওয়ার দাবীদার হয়েও তাঁর বিধান মানিনা। বস্ত্ততঃ অধিকাংশ দেশের ন্যায় বাংলাদেশ চলছে পাশ্চাত্য ও নিজেদের মনগড়া আইনে। এদেশের হাইকোর্টের সামনে গ্রীকদের কথিত ন্যায়বিচারের দেবী থেমিসের মূর্তি দন্ডায়মান আছে। সেখানকার মুসলিম বিচারপতি ও আইনজীবীদের বিবেকে একবারও কুরআনী ন্যায়বিচারের বাণী ধ্বনিত হয় না। ফলে দেশে বিচারের নামে চলছে প্রহসন। ধর্ষক, খুনী, মাদক কারবারী ও দুর্নীতিবাজরা বেপরোয়া। সাধারণ মানুষের জীবনে চলছে ত্রাহি অবস্থা। অথচ নতুনভাবে আইন বানানোর কোন দরকার নেই। কুরআন ও হাদীছে সব মৌলিক আইন লিপিবদ্ধ আছে। কেবল প্রয়োজন সেগুলি কার্যকর করার।

বস্ত্ততঃ ইসলামী আইনে বিবাহিত যেনাকারের জন্য ‘রজম’ এবং অবিবাহিতের জন্য একশ’ বেত্রাঘাত ও এক বছরের নির্বাসন তথা কারাবাস (মুসলিম হা/১৬৯০; নূর ২৪/২)। সেই সাথে ইসলামী সমাজে প্রকাশ্য ও গোপন সকল প্রকার বেহায়াপনা ও হত্যাকান্ড (আন‘আম ৬/১৫১) এবং নারী-পুরুষের পরস্পরে পর্দাহীনতা সর্বদা নিষিদ্ধ (নূর ২৪/৩০-৩১)। যার ফলে রাসূল (ছাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের হাতে গড়া খেলাফতকালে খৃষ্টীয় ৭ম শতাব্দীতে পৃথিবীর বুকে গড়ে ওঠে ন্যায়বিচারে পূর্ণ একটি শান্তিময় সমাজ। যে সমাজে ছিল না কোন কারাগার, ছিল না কোন পুলিশ-র‌্যাব। অথচ সেখানে ছিল শান্তি ও সমৃদ্ধিময় একটি উন্নত মানবিক জনপদ।

কিছু নমুনা :

(১) জনৈকা মহিলা অন্ধকারে মসজিদে যাওয়ার পথে ধর্ষিতা হয়। লোকেরা ধর্ষককে ধরে এনে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে পেশ করলে সে দোষ স্বীকার করে। তিনি তাকে তখনই ‘রজম’ করার নির্দেশ দেন এবং ধর্ষিতাকে বলেন, তুমি যাও! আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করুন’। রজমের পূর্বে লোকটি অনুতপ্ত হয়ে একান্তভাবে আল্লাহর নিকট তওবা করে। তাতে আপ্লুত হয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন, লোকটি এমন তওবা করেছে, যদি পুরা মদীনাবাসী এমন তওবা করত, তাহ’লেও তা কবুল করা হ’ত (তিরমিযী হা/১৪৫৪ প্রভৃতি)। (২) মা‘এয আসলামী নামক জনৈক ব্যক্তি একদিন এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন! তিনি বললেন, কিসের থেকে পবিত্র করব? সে বলল, যেনা থেকে। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তোমার ধ্বংস হৌক! তুমি ফিরে যাও। আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাও ও তওবা কর। লোকটি ফিরে গেল। আবার এল এবং একই কথা বলল। এভাবে চারবার গেল এবং ফিরে এল। রাসূল (ছাঃ) বললেন, দেখতো লোকটি পাগল কি-না? পরে বললেন, দেখতো সে মাতাল কি-না? সবটাতে সুস্থ প্রমাণ হ’লে তিনি তাকে রজমের আদেশ দেন। দু’দিন পর তিনি এসে বলেন, তোমরা মা‘এয-এর জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর। সে এমন তওবা করেছে, যদি তা পুরা উম্মতের  মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হ’ত, সেটি তাদের জন্য যথেষ্ট হ’ত (মুসলিম হা/১৬৯৫)

(৩) জনৈকা গামেদী মহিলা একদিন এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে পবিত্র করুন! তিনি বললেন, তোমার ধ্বংস হৌক। ফিরে যাও। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাও ও তওবা কর। এ সময় সে যেনার মাধ্যমে গর্ভবতী ছিল। সে বলল, আপনি কি আমাকে মা‘এয আসলামীর মত ফেরৎ দিতে চান? তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, বেশ। তাহ’লে গর্ভ খালাসের পর এসো। মহিলাটি তাই করল। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, যাও বাচ্চা দুধ ছাড়িয়ে শক্ত খাবার খেতে শিখুক, তারপর এসো। মহিলাটি পরে এল। সে সময় বাচ্চার হাতে রুটির একটি টুকরা ছিল। সে বলল, হে আল্লাহর নবী! বাচ্চাকে দুধ ছাড়িয়েছি। সে এখন খাবার খাচ্ছে। তিনি বললেন, বাচ্চাটির লালন-পালনের ভার কে নিতে পারে? তখন আনছারদের জনৈক ব্যক্তি উঠে দাঁড়িয়ে সম্মতি দিল। তখন তিনি তার হাতে বাচ্চাটি সোপর্দ করলেন। অতঃপর মহিলাকে রজম করার নির্দেশ দিলেন। পরে রাসূল (ছাঃ) বললেন, মহিলাটি এমন তওবা করেছে, যদি অন্যায়ভাবে ট্যাক্স আদায়কারী ব্যক্তি এমন তওবা করত, তবুও তাকে ক্ষমা করা হ’ত। অতঃপর তিনি তার জানাযা পড়েন ও তাকে দাফন করা হয়’ (মুসলিম হা/১৬৯৫)। যে জানাযায় স্বয়ং আল্লাহর রাসূল তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন, কতইনা সৌভাগ্যবতী সে! জান্নাত যেন তাকে ডাকছে!

(৪) কুরায়েশ নেতা আবু জাহলের সম্ভ্রান্ত মাখযূম গোত্রের জনৈকা মহিলা চুরির আসামী হয়। তাকে বাঁচানোর জন্য নেতাদের পক্ষে নাতি উসামা বিন যায়েদকে দিয়ে সুফারিশ করানো হয়। রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি আমার নিকট আল্লাহর দন্ডবিধির ব্যাপারে সুফারিশ করছ? অতঃপর তিনি খুৎবা দিয়ে বলেন, তোমাদের পূর্বেকার উম্মত ধ্বংস হয়েছে একারণে যে, যখন তাদের মধ্যেকার  কোন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি  চুরি

করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিত। আর যখন কোন দুর্বল শ্রেণীর লোক চুরি করত, তখন তাকে দন্ড দিত। আল্লাহর কসম! যদি আজ মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমা চুরি করত, আমি তার হাত কেটে দিতাম (বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৩৬১০)। (৫) মদখোরের শাস্তি  ৪০ থেকে ৮০ বেত্রাঘাত (বুখারী হা/৬৭৭৯)। চতুর্থবারে মৃত্যুদন্ড। তবে বিচারক মৃত্যুদন্ড অথবা বেত্রাঘাত যেকোন একটি দন্ড দিতে পারেন (তিরমিযী হা/১৪৪৪)। মদখোর জাহান্নামে ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ অর্থাৎ জাহান্নামীদের দেহ নিঃসৃত পুঁজ-রক্ত খাবে (মুসলিম হা/২০০২)। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার ‘মদ্য নিবারক আইন’-এর কথা বলা যেতে পারে। ১৯২০ সালের জানুয়ারী মাসে আমেরিকার সিনেট ‘মদ্য নিবারক আইন’ (Prohibition law) পাস করে। কিন্তু ১৯৩৩ সালের ডিসেম্বরে উক্ত আইন বাতিল করে এবং মদ্যপান বৈধ করা হয়। অথচ ৭ম শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে মদীনায় যখন মদ নিষিদ্ধের আয়াত নাযিল হয়, তখন ঘোষণা শোনা মাত্র মুসলিমরা মদ পান রত অবস্থায় মদের পাত্র ছুঁড়ে ফেলে দিল। গলায় আঙ্গুল ঢুকিয়ে বমি করে দিল। মদের কলসীগুলো সাথে সাথে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিল। মদীনার অলিতে-গলিতে মদের স্রোত বয়ে গেল (বুঃ মুঃ)। যারা মদ ছাড়তে চায়নি, তাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করা হ’ল। সমাজ জীবন থেকে মদ বিদায় নিল (দ্র. দরসে কুরআন, ১৫/১২ সংখ্যা, সেপ্টেম্বর ২০১২)

ইসলামী আইন ও মানব রচিত আইনের পার্থক্য :

(১) ইসলামী আইন মূলতঃ ধর্মীয় আইন। এখানে ধর্মীয় মূল্যবোধই মুখ্য। পরকালীন জবাবদিহিতার চেতনায় এখানে দোষীরা শাস্তি চেয়ে নেয়। যাতে সে মৃত্যুর আগেই পবিত্র হ’তে পারে এবং পরকালে জাহান্নামের আগুন থেকে বাঁচতে পারে। মানবরচিত আইনে এসবের কিছু নেই। (২) ইসলামী আইনে মানুষের চাইতে মানবতার গুরুত্ব বেশী। ব্যভিচার পরস্পরের সম্মতিতে হৌক বা  যবরদস্তিতে হৌক, দুই অবস্থাতেই মানবিক মূল্যবোধ ধ্বংস হয়। সেই নিরিখে তার শাস্তি দৃষ্টান্তমূলক হয়। যা অন্যদের মধ্যে মানবতার উজ্জীবন ঘটায়।

(৩) ইসলামী আইনে ব্যক্তির ঊর্ধ্বে সমাজকে স্থান দেওয়া হয়। হত্যার বদলে হত্যা, যখমের বদলে যখম, চোরের হাত কাটা প্রভৃতি আইন উক্ত উদ্দেশ্যে নির্ধারিত। পক্ষান্তরে মানবরচিত আইনে সমাজের ঊর্ধ্বে ব্যক্তি মুখ্য হয়। সেকারণ সেখানে পরস্পরের সম্মতিতে ব্যভিচার, সমকামিতা, পায়ুকামিতা, গর্ভপাত, লিভ টুগেদার প্রভৃতি পশুসুলভ আচরণ ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে সিদ্ধ হয়। যাতে ব্যাপকভাবে সমাজ দূষণ ঘটে। ইসলামী আইনে এগুলি চিরতরে নিষিদ্ধ এবং কঠোর শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফলে ইসলামী সমাজে মানবতা নিরাপদ থাকে এবং মানুষ শান্তিতে বসবাস করে।

(৪) ইসলামী আইনে যাকাত ফরয ও সূদ হারাম। এতে অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ হয় ও সমাজে অর্থের প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। ফলে সুস্থ ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠিত হয়। একই কারণে জুয়া-লটারী সহ পুঁজিবাদের সকল পথ ও পদ্ধতি ইসলামে পুরাপুরি নিষিদ্ধ।

(৫) ইসলাম কখনোই দন্ডনির্ভর  নয়। বরং সর্বদা মানুষকে আল্লাহভীরু করে গড়ে তোলায় সচেষ্ট থাকে। যাতে সে নিজেই অপরাধ থেকে বিরত হয় এবং তওবায় উদ্বুদ্ধ হয়। বস্ত্ততঃ কেবল দন্ড দিয়ে নয়, বরং আল্লাহভীরু মানুষ সৃষ্টির মাধ্যমেই সমাজের পরিবর্তন সম্ভব। নবী-রাসূলগণ সে কাজটিই করে গেছেন। উম্মতের রাষ্ট্রশক্তি ও সমাজশক্তি সে পথেই পরিচালিত হৌক আমরা সর্বদা সেই কামনা করি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)