সংস্কৃতি চর্চা নয় বরং বিশ্বাসগত ভ্রান্তি দূর করার মাধ্যমেই জঙ্গীবাদ নির্মূল করা সম্ভব

গত ২৫ ও ২৬শে আগস্ট বৃহস্পতি ও শুক্রবার ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়ায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক কর্মী সম্মেলনে প্রদত্ত উদ্বোধনী ভাষণে সংগঠনের আমীর প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব উপরোক্ত মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, গান-বাজনা আর নষ্ট সংস্কৃতির চর্চা করিয়ে কখনো আমাদের সন্তানদের জঙ্গীবাদ থেকে বিরত রাখা যাবে না, যতক্ষণ না তার বিশ্বাসের পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। বরং এধরনের ভ্রান্ত চিন্তা জঙ্গীবাদকে আরো উস্কে দিবে (দৈনিক ইনকিলাব ২৭শে আগস্ট শনিবার ৪র্থ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত)

উদ্বোধনী ভাষণ : দেশের অধিকাংশ যেলা থেকে আগত নেতা, কর্মী ও সূধী মন্ডলীর উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত উক্ত কর্মী সম্মেলনে উদ্বোধনী ভাষণের শুরুতে তিনি সর্বপ্রথম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন। অতঃপর প্রশাসনকে ধন্যবাদ দেন, যারা আগের দিন সম্মেলনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে চিঠি দেন এবং পরের দিন আবার অনুমতি দিয়ে চিঠি পাঠান। অতঃপর তিনি কর্মীদের ধন্যবাদ জানান। যারা অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মোবাইল নোটিশে দূর-দারায থেকে অনেক কষ্ট স্বীকার করে চলে এসেছেন। অতঃপর তিনি সূরা ইবরাহীম ২৭ আয়াত পাঠ করেন এবং দুনিয়াতে ও কবরে কালেমা ত্বাইয়িবার উপর দৃঢ় থাকার শুভ পরিণাম ব্যাখ্যা করেন। অতঃপর তিনি বলেন, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ এদেশের তরুণ সমাজকে আল্লাহ মুখী সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। অল্প বয়স্ক একটা তরুণের জঙ্গী হওয়ার জন্য সে একা দায়ী নয় মন্তব্য করে তিনি বলেন, নয়নের পুত্তলি ঐ সন্তানটিকে কি তার পিতা-মাতা নিজের সবটুকু উজাড় করে মানুষ করেনি? কিন্তু ঐ প্রস্ফুটিত গোলাপটি কেন আজ নষ্ট হয়ে গেল? এর জন্য পিতা-মাতা হিসাবে যেমন আমরা দায়ী, তেমনি আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা ব্যবস্থা এবং প্রশাসন দায়ী। ইসলামের বিশুদ্ধ আক্বীদা শিক্ষা না দেওয়ার কারণে সে আজ বিপথগামী হয়েছে। এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন তার বিশ্বাসগত ভ্রান্তি দূর করা। তিনি বলেন, জঙ্গীবাদ দূর করতে হ’লে অবশ্যই আমাদের সন্তানদের সঠিক ইসলামী শিক্ষা দিতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের সন্তানরা ছোট থেকেই যদি কুরআন-হাদীছ পাঠ করত, সে যদি জানতো কিয়ামতের দিন প্রথম বিচার হবে খুনীর, তবে কি সে মানুষ খুন করত? যদি সে জানতো রাসূলের হাদীছ- ‘যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের প্রতি অস্ত্র উত্তোলন করে, সে মুসলমানদের দলভুক্ত নয়’ তাহ’লে সেকি অস্ত্র হাতে নিত?... তাকে এগুলি আমরা শিখাইনি। সুতরাং শিক্ষা ব্যবস্থার কর্ণধাররা সাবধান হয়ে যান। মনে রাখবেন গান শুনিয়ে আর কথিত সংস্কৃতির পাঠদান করে কখনোই জঙ্গীবাদ দমন করা যাবে না। যতক্ষণ না তার ভিতরকার বিশ্বাসের পরিবর্তন করা যাবে এবং তার মধ্যে আল্লাহভীতি সৃষ্টি করা যাবে।

তিনি বলেন, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের দাওয়াত বা আন্দোলকেই বলা হয় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’। যারা এই আন্দোলন সম্পর্কে অজ্ঞ, তারাই এ আন্দোলন সম্পর্কে নানা কথা বলেন। আজকে যাদেরকে জঙ্গী বলা হচ্ছে তাদের অনেকে নাকি রাফউল ইয়াদায়েন করে ছালাত আদায় করে। বাহ্যিক এই নিদর্শন দেখে অনেকেই ভুল বুঝছেন যে, আহলেহাদীছ জামা‘আতের সবাই জঙ্গী। তিনি বলেন, হুজিনেতা, তাহরীর নেতা, আনছারুল্লাহ নেতা সহ হানাফীদের মধ্যে শত শত জঙ্গী থাকলেও তাদের নাম হয় না, অথচ একজন রাফাদানী ধরা পড়লে গোটা আহলেহাদীছ জামা‘আতকে দোষারোপ করা হয়। তিনি এই সংকীর্ণ মানসিকতা পরিহার করার জন্য সরকার ও প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান। পাশাপাশি হানাফী আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের প্রতি আহলেহাদীছ সম্পর্কে বিদ্বেষমূলক অপপ্রচার বন্ধের আহবান জানান। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কস্মিনকালেও কোনরূপ সন্ত্রাস ও জঙ্গী তৎপরতায় জড়িত ছিল না, আজও নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না ইনশাআল্লাহ। আমরা সর্বদা মধ্যপন্থী আক্বীদার অনুসারী এবং ১৯৯৮ সাল থেকে আমরাই সর্বপ্রথম এর বিরুদ্ধে সরকার ও জনগণকে সাবধান করে আসছি। 

ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক সরবরাহকৃত জুম‘আর খুৎবার সমালোচনা করে তিনি বলেন, এর মাধ্যমে প্রকারান্তরে একথাই বুঝানো হচ্ছে যে, মসজিদগুলিই জঙ্গীবাদের প্রজনন ক্ষেত্র। খতীব ছাহেবরাই জঙ্গীবাদ উস্কে দিচ্ছেন। অথচ হাযার বছর ধরে এদেশে খুৎবা চলছে। খুৎবা শুনে কখনো কেউ জঙ্গী হয়েছে বলে আজও প্রমাণিত হয়নি। তিনি বলেন, এদেশের আলেম-ওলামারা খুৎবায় কি বলতে হবে তা ভালোভাবেই জানেন। তারা খুৎবার নামে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের শিখানো বুলি পড়তে বাধ্য নন।

তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, আমরা আপনাদেরকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে শাসন পরিচালনার আহবান জানাই। তবে এর অর্থ এই নয় যে, আমরা প্রচলিত নিয়মের মধ্যে বসবাস করতে রাযী নই। বরং সকল সরকারের শরী‘আতসম্মত নির্দেশ আমরা মেনে চলব এবং শরী‘আত বহির্ভূত আদেশের প্রতিবাদ করব এটাই আমাদের নীতি।

দরসে কুরআন : পরদিন শুক্রবার বাদ ফজর তিনি সূরা বাক্বারাহ ২১৩-১৪ আয়াতের উপর দরসে কুরআন পেশ করেন। তিনি বলেন, মানবজাতি সবাই এক উম্মতভুক্ত ছিল। অতঃপর তাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছিল আল্লাহর কিতাবকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করার কারণে। আজও সেই যিদ ও হঠকারিতার কারণে উম্মতের বিভক্তি অব্যাহত রয়েছে। মুসলিম উম্মাহ ৭৩ ফিরকায় বিভক্ত হয়েছে মূলতঃ অহংকার ও হঠকারিতার কারণে। তারা নিজেদের ভ্রান্তির উপর যিদ করবে। কিন্তু কোন সংস্কার আন্দোলনকে তারা মেনে নিবে না। তারা হাবীলের প্রতি ক্বাবীলের ন্যায় ভাল-র প্রতি হিংসা করবেই। রাসূল (ছাঃ) সহ সকল নবীর বিরুদ্ধে স্ব স্ব আমলের সমাজ নেতাদের আক্রোশের কারণ ছিল মূলতঃ ভাল-র প্রতি হিংসা। আমরাও সেটা আমাদের জীবনে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি এবং এখনো পরীক্ষা দিয়ে চলেছি। এরপরেও হিংসা পরাজিত হবে এবং তাক্বওয়া বিজয়ী হবে; আমাদের সংগঠন তার বাস্তব প্রমাণ। ইনশাআল্লাহ এমন একটা সময় আসবে, যখন এ দেশের অধিকাংশ মানুষ সত্যিকার অর্থে ‘আহলেহাদীছ’ হয়ে যাবে।

অতঃপর তিনি ‘ফিরক্বা নাজিয়াহ’ তথা মুক্তিপ্রাপ্ত জামা‘আতের বৈশিষ্ট্যগুলির উপর আলোকপাত করে বলেন, নাজী ফের্কার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হ’ল- (১) তাঁরা সংস্কারক হবেন। (২) আক্বীদার ক্ষেত্রে তারা সর্বদা মধ্যপন্থী হবেন এবং কখনোই চরমপন্থী বা শৈথিল্যবাদী হবেন না (৩) আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে তারা সর্বদা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের প্রকাশ্য অর্থের অনুসারী হবেন এবং ছাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরী‘আত ব্যাখ্যা করবেন (৪) তারা জামা‘আতবদ্ধভাবে আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করবেন এবং কখনোই উদ্ধত ও বিশৃংখলা সৃষ্টিকারী হবেন না (৫) তারা কুফর ও কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে কঠোর ও শক্তিশালী থাকবেন এবং নিজেদের মধ্যে সর্বদা রহমদিল ও আল্লাহর প্রতি বিনীত থাকবেন (৬) তাঁরা যেকোন মূল্যে সুন্নাতকে অাঁকড়ে থাকবেন ও বিদ‘আত হ’তে দূরে থাকবেন (৭) তারা সর্বাবস্থায় সমবেতভাবে হাবলুল্লাহকে ধারণ করবেন এবং কখনোই সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হবেন না। কেউ তাদেরকে ছেড়ে গেলে সে অবস্থায় তারা আল্লাহর উপর ভরসা করবেন ও তাঁর গায়েবী মদদ কামনা করবেন।

আলোচনার একপর্যায়ে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, যত ষড়যন্ত্র, যত অত্যাচারই হৌক না কেন, আমাদেরকে সর্বদা নাজী ফের্কার বৈশিষ্ট্য ধারণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আমাদের আপোষহীন থাকতেই হবে। প্রকৃত ইসলামের আলো ছড়িয়ে যেতেই হবে। ইসলামী অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতির কথা বললে যদি কেউ ক্ষিপ্ত হন, তাতে আমাদের কিছুই যায় আসে না। আমরা সূদের বিরুদ্ধে, প্রচলিত হানাহানির রাজনীতির বিরুদ্ধে, দ্বিমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে, শিরক ও বিদ‘আতেপূর্ণ ধর্মীয় রীতির বিরুদ্ধে সর্বদা জাতিকে সতর্ক করেই যাবো ইনশাআল্লাহ। কারণ এখনি যদি আমার মরণ আসে, তাহ’লে আল্লাহর নিকটে কি জবাব দেব? তাই সত্য যতই তিক্ত হৌক না কেন, আমাদেরকে অবশ্যই তা বলে যেতে হবে।

অতএব হে কর্মী ভাইয়েরা! যে আদর্শ নিয়ে আমরা পথে নেমেছি, তার উপর সর্বদা দৃঢ় থাকুন। অল্পতেই যারা টল-টলায়মান হয়, তাদের জন্য ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ নয়। যারা দোদুল্যমান, যারা কিছু সুবিধা ভোগ করতে চান, যারা দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে চান, তাদের জন্য এ আন্দোলন নয়। আদর্শ কখনই অর্থের নিকট বিক্রয় হয় না, আদর্শ কখনো স্বার্থের নিকট বিক্রি হয় না। আদর্শবান ব্যক্তিকে কখনো জেল-যুলুমের ভয় দেখিয়ে পিছপা করা যায় না। আদর্শবান ব্যক্তি দুনিয়াতে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত হ’লেও আখেরাতে তারা হন সম্মানিত। সেকারণেই রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘ক্বিয়ামত পর্যন্ত একটি দল হক-এর উপর বিজয়ী থাকবে। পরিত্যাগকারীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না’ (মুসলিম হা/১৯২০)। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনে হক-এর উপর আমৃত্যু টিকে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!

বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে তিনি বর্তমান আওয়ামী সরকারের প্রতি মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করার আহবান জানিয়ে বলেন, দেশপ্রেম কোন নির্দিষ্ট একটি দলের জন্য একচেটিয়া নয়, বরং এদেশের প্রত্যেক নাগরিকই দেশপ্রেমিক। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের। তাই কাউকে অধিক প্রাধান্য দিয়ে ও কাউকে দূরে ঠেলে দিয়ে কাজ করলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এভাবে একদেশদর্শী হয়ে কাজ করে বিদেশীদের অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিবেন না।

তিনি বলেন, এটা এমন একটি দেশ যা লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। কেবল ১৯৭১ সালেই জীবন যায়নি, ১৯৪৭ সালেও বহু মানুষের জীবন গেছে। আমাদের বাপ-দাদারা স্রেফ ইসলামের জন্যই ৪৭-এ জীবন দিয়েছিলেন। আর ৪৭-এর মানচিত্রের উপরেই ৭১-এর ‘বাংলাদেশ’ গড়ে উঠেছে। আর সেই দেশ থেকে ইসলাম হারিয়ে যাবে তা আমরা কখনোই মেনে নেব না। সুতরাং দ্বীনদার-পরহেযগার মানুষদেরকে স্বাধীনভাবে চলতে দিন। বরং এরূপ কিছু মানুষের কারণেই আজ সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলি টিকে আছে। সাথে সাথে মুসলমানের দেশে মুসলমানদের নিগৃহীত করার মানসিকতা পরিত্যাগ করুন। সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল  বিশ্ববিদ্যালয় সহ শিক্ষা ও চাকুরীর বিভিন্ন ক্ষেত্রে কিছু মানুষরূপী শয়তান রয়েছে, যারা মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার বুলি আওড়ালেও ইসলামের বিরুদ্ধে, পুরুষের দাড়ি-টুপী ও নারীদের বোরকা-হিজাবের বিরুদ্ধাচরণ করতে আদৌ পিছপা হন না। এইসব লোকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুন।

সমাপনী ভাষণ : পরদিন জুম‘আর প্রাক্কালে সম্মেলন শেষে তিনি কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে ইসলামী সমাজ গড়ার জন্য ইমারতের অধীনে দৃঢ়ভাবে জামা‘আতবদ্ধ থাকুন। দেশী-বিদেশী চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ থাকুন। ভ্রান্ত পথে পা বাড়াবেন না। ইমারতের পক্ষ থেকে যে নির্দেশ যাবে, তাতে অটল থাকবেন। বাধা আসলে ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করবেন। কেবল আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইবেন। তিনি গায়েবী মদদ করবেন ইনশাআল্লাহ।

জুম‘আর খুৎবা : হামদ ও ছানা পাঠের পর আমীরে জামা‘আত বার্ষিক কর্মী সম্মেলন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হওয়ায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলেন, বর্তমান ভীতিকর রাজনৈতিক অবস্থা উপেক্ষা করে কেবলমাত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টিকে সামনে রেখে অত্যন্ত স্বল্প সময়ের নোটিশে মারকাযে উপস্থিত হওয়ার জন্য আমরা আপনাদের প্রতি আন্তরিক শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি।

তিনি বলেন, প্রিয় সাথী ভাইয়েরা! কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে এখানে এসেছেন কেবলমাত্র নিজেদের ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ সাধন ও ঈমান-আমল সংশোধনের দিকনির্দেশনা লাভের উদগ্র বাসনা নিয়ে। একইভাবে স্রেফ আল্লাহভীতির পুঁজি হৃদয়ে ধারণ করে ছহী-সালামতে স্ব স্ব গন্তব্যে পৌঁছে যাবেন বলে আমরা আশা পোষণ করি।

তিনি ‘রিয়া’ থেকে সাবধান করে বলেন, শিরক-বিদআত যেমন আমলকে ধ্বংস করে দেয়, তেমনি রিয়া বা লোক দেখানো আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হয় না। তাই যতটুকু আমল করবেন তাতে যেন তিনটি বিষয় থাকে। (১) শিরক বিমুক্ত নির্ভেজাল তাওহীদ বিশ্বাস (২) বিদ‘আত মুক্তভাবে ছহীহ সুন্নাহর পূর্ণ অনুসরণ (৩) ইখলাছে আমল অর্থাৎ কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করা।

বহু অর্থ ব্যয়ে মানুষ রাস্তাঘাট, বিদ্যালয়, মসজিদ-মাদ্রাসা স্থাপন করে থাকে, হাসপাতাল নির্মাণ করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করে। কিন্তু তাদের এই কার্যক্রম যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য না হয়ে লোক দেখানো হয় বা ভোটারদের মনস্ত্তষ্টির জন্য হয়, তাহ’লে দুনিয়ায় ‘দানবীর’ খেতাব পেয়ে সকল উপার্জন দুনিয়াতে রেখেই পরকালে পাড়ি দিতে হবে। তার এই লোক দেখানো আমল আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। কেননা তা তো সে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করেনি।

তাই সংগঠন করার পূর্বে নিয়তকে পরিশুদ্ধ করুন। মানুষকে দেখানোর জন্য, শোনানোর জন্য, দুনিয়া লাভের জন্য এক পাও আগে বাড়বেন না। যে কাজে নেকী নেই, সে কাজ থেকে বিরত থাকবেন। নেকীর কাজগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করবেন। যে কাজে গুনাহের সম্ভাবনা আছে, তা থেকে দূরে থাকবেন। যে ব্যক্তি আপনাকে মহান আল্লাহর পথে ডাকে আপনি তার সাথী হউন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর পথ থেকে আপনাকে বিচ্যুত করার চেষ্টা করে, আপনি তাকে এড়িয়ে চলুন।

অতঃপর তিনি দুনিয়ার ফিৎনা থেকে নিজেকে ও নিজ পরিবারকে বাঁচানোর জন্য কয়েকটি পরামর্শ প্রদান করেন।-

(১) প্রথমে নিজের গৃহকে ইসলামী গৃহে পরিণত করুন। রহমতের ফেরেশতারা যেন সর্বদা আপনার বাড়িতে বিচরণ করতে পারে, তার জন্য নিজ গৃহকে ছবি-মূর্তি থেকে মুক্ত রাখুন।

(২) পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ছালাত আদায়ে অভ্যস্ত করুন। পুরুষ সদস্যদের মসজিদে জামা‘আতে যেতে বাধ্য করুন। যিকির-আযকারে বাড়ী পূর্ণ রাখুন। কিছু কিছু নফল ছালাত বাড়িতে আদায় করবেন। নিয়মিত তাহাজ্জুদে অভ্যস্ত হউন। বৃদ্ধ হ’লে পড়বেন এই মানসিকতা পরিহার করে যৌবন বয়সকেই অগ্রাধিকার দিন।

ফজরের ওয়াক্তে আপনার সন্তানটি মসজিদে না গিয়ে ঘুমিয়ে আছে। আপনি মনে করছেন সারারাত পড়াশুনা করেছে বা দাওয়াতী কাজে ব্যস্ত থেকেছে। থাক পরে ক্বাযা করে নিবে। পিতা ডাকলেন না, মা-ও ডাকলেন না। কিন্তু না! এখানে অন্ধ হলে চলবে না। তাহ’লে ছেলেমেয়েরা ছালাত ক্বাযা করায় অভ্যস্ত হয়ে উঠবে। আর অবহেলার কারণে পিতা-মাতাও গুনাহগার হবেন।

(৩) বিশুদ্ধ জ্ঞানের আলোয় নিজ গৃহকে আলোকিত করে রাখুন। পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের পাশাপাশি ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য সমৃদ্ধ সাহিত্য নিজে পড়বেন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের পড়তে উৎসাহিত করবেন। ভালো বই ও ভালো মানুষের সান্নিধ্য উন্নত চরিত্র গঠনে সহায়তা করে। বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখবেন এমন কোন বই যেন আপনার পরিবার না পড়ে, যা চারিত্রিক সৌন্দর্য্যকে ধীরে ধীরে কালিমালিপ্ত করে দেয়। 

(৪) মোবাইল, ট্যাব, ল্যাপটপসহ বিভিন্ন ডিজিটাল পণ্য ব্যবহারে সতর্ক হউন। বিশেষ করে অপ্রয়োজনে আপনার পরিবারের সদস্যদের মোবাইল ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করুন। যারা ব্যবহার করছে তাদের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখুন, সে কোন কাজে তা ব্যবহার করছে। এসব পণ্যের ব্যবহারে ভালোর তুলনায় মন্দটাই বেশী হয়। অতএব সাবধান থাকুন।

(৫) অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা পৃথিবীতে পরীক্ষাস্বরূপ। এটা আল্লাহ কাউকে দিয়ে, আবার কাউকে না দিয়ে পরীক্ষা করেন। যেমন ফেরাউন রাষ্ট্রক্ষমতা পেয়ে তা যুলুমের পথে ব্যয় করেছিল। পক্ষান্তরে মূসা (আঃ)-কে আল্লাহ তদ্রুপ ক্ষমতা প্রদান করেননি। কিন্তু মূসার জন্যই আল্লাহ শক্তিশালী ফেরাউনকে দলবলসহ সাগরে ডুবিয়ে মেরেছেন। তাই যে যত বড় শক্তিশালীই হৌক না কেন, একজন তাওহীদপন্থী ঈমানদারের দো‘আর সামনে কখনোই সে টিকতে পারবে না ইনশাআল্লাহ।

(৬) তিনি স্ব স্ব পরিবারকে শরী‘আতের উপর দৃঢ় রাখার জন্য মা-বোনদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন,  স্বামী-সন্তান যদি ভ্রান্ত পথে যাওয়ার চেষ্টাও করে, তথাপি তারা আপনার দৃঢ়তায় ও ভালোবাসায় ফিরে আসতে বাধ্য হবে ইনশাআল্লাহ। আপনার স্বামী সূদ-ঘুষের টাকা নিয়ে আসছেন, স্ত্রী-সন্তানের জন্য দামী দামী কাপড় ক্রয় করছেন। স্বামীকে প্রশ্ন করুন- অল্প বেতনে কিভাবে তিনি এসব করছেন। বলুন- আপনার এই অবৈধ উপার্জন পরিবারের কোন সদস্য স্পর্শ করবেনা। যে স্ত্রী দ্বীনের ব্যাপারে এরূপ দৃঢ়চিত্ত হ’তে পারবেন, তিনিই হবেন হাদীছে বর্ণিত সেই স্ত্রীর মত, যাকে বলা হয়েছে ‘দুনিয়ার সেরা সম্পদ’ (মুসলিম হা/১৪৬৭)

(৭) তিনি পিতা-মাতাদের প্রতি স্বীয় সন্তানকে দ্বীনের উপর দৃঢ় রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর আহবান জানিয়ে বলেন, যখন আপনি জানলেন আপনার সন্তান কোন সূদভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করছে বা হারাম ব্যবসায়ে জড়িত হচ্ছে, তখন তাকে বলে দিন- আমি অভুক্ত থাকব, কিন্তু তোমার হারাম উপার্জন কখনোই স্পর্শ করবনা’। দেখবেন সন্তান একসময় উপলব্ধি করবে যে, আমার জন্মদাতা পিতা যখন আমার অর্থ নিচ্ছেন না, তখন কার জন্য আমি এসব উপার্জন করছি? এই উপলব্ধি তাকে অবশ্যই একদিন ফিরিয়ে আনবে হালাল পথে ইনশাআল্লাহ।

এভাবে সকলে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা করুন ঈমানের আলোকে স্ব স্ব পরিবারকে গড়ে তুলতে। পরিবারের সদস্যদের ঈমান যেন কখনই হ্রাসপ্রাপ্ত না হয়, সে ব্যাপারে সর্বদা সচেতন থাকবেন।

তিনি বলেন, কিছু ব্যাংক কর্মকর্তা আমার নিকট দো‘আ চান এবং বলেন যেন তিনি একটা হালাল চাকুরী পেয়ে যান, তারপর ব্যাংকের চাকুরী ছেড়ে দিবেন। আমি বলি- আগে ব্যাংকের চাকুরী ছাড়ুন, তারপর চাকুরী খুঁজুন। আপনাকে কে গ্যারান্টি দিয়েছে যে, চাকুরী ছাড়া পর্যন্তত আপনি বেঁচে থাকবেন? সূদের উপর মৃত্যু হলে পরিণতি কেমন হবে একবার ভেবে দেখুন তো? অতএব মানসিক শক্তি যোরদার করুন এবং বিশ্বাস দৃঢ় রাখুন যে, আপনার রূযির মালিক আপনি নন; আপনার প্রভু আল্লাহ।

তিনি বক্তা ভাইদের উদ্দেশ্যে বলেন, সংগঠনের যারা বক্তা রয়েছেন, তাদেরকে আমরা জোরালোভাবে বলে দিয়েছি- আপনারা অবশ্যই দাওয়াতী কাজে আত্মনিয়োগ করবেন। তবে মনে রাখবেন- ওয়ায-নছীহত ব্যবসার বস্ত্ত নয়, তা কেবল পরকালীন মুক্তির জন্য নিবেদিত হ’তে হবে। আমাদের কর্মী ও শুভাকাংখীগণ আপনাদের যথাসাধ্য আপ্যায়ন ও পাথেয়র ব্যবস্থা করেন এবং করবেন। অতএব যাতায়াতের খরচ ব্যতীত কিছুই গ্রহণ করবেন না। একান্ত নিতে হ’লে কেন্দ্রীয় বায়তুল মাল ফান্ডে তা জমা করবেন।

সংগঠনের আমীর হিসেবে আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিচ্ছি- সাবধান! ব্যবসার জন্য দাওয়াতী কাজ করবেন না। নইলে সমস্ত নেকী বরবাদ হয়ে যাবে।

তিনি সকলের প্রতি আখেরাতের স্বার্থে দুনিয়ার প্রতিটি কর্ম সম্পাদন করার আহবান জানিয়ে বলেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার জন্য দুনিয়া করে, সে কেবল দুনিয়া পায়, আখেরাত হারায়। যে দুনিয়ার জন্য দ্বীন করে, সে দুনিয়া-আখেরাত দু’টিই হারায়। আর যে ব্যক্তি আখেরাতের জন্য দুনিয়া করে, সে দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই পায়। তাই স্রেফ আখেরাতের জন্য কাজ করুন। দেখবেন দুনিয়া আপনার পায়ের নিচে লুটাবে। বিশ্বাস রাখুন- আল্লাহ আমাদের রিযিকদাতা। তিনি স্বয়ং আমাদের রূযির দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই আল্লাহর সাহায্য পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র তাঁর উপরেই নির্ভর করুন। তাঁর পথে সাধ্যমত সময়, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করুন। বখীল হবেন না। তবেই আল্লাহর গায়েবী মদদ আসবে।

তিনি বলেন, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর নেতা-কর্মীরা কারা নির্যাতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। তারা গীবত-তোহমত ও যুলুম-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে সদা-সর্বদা। বিভিন্ন ব্যক্তি, দল ও গোষ্ঠীর হিংসার শিকার হতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণে সর্বদা দগ্ধীভূত হতে হচ্ছে আমাদের। এগুলো কি আমাদের জন্য পরীক্ষা নয়? মহান আল্লাহর কাছে বিনীতভাবে প্রার্থনা জানাচ্ছি, তিনি যেন আন্দোলনের সাথী ভাই ও বোনদের সকল কষ্ট ও বাধা দূর করে দেন- আমীন!

আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বিশ্বাসী। কোন অবস্থাতেই আমরা অশান্তি সৃষ্টিকারী কোন কাজ করি না। আমরা যাবতীয় জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের ঘোর বিরোধী। সবসময় জনগণকে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী সকল কাজে আমরা সজাগ করে আসছি। সাথে সাথে সরকারকেও আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক করেছি, বর্তমানেও করছি এবং ভবিষ্যতেও করে যাবো ইনশাআল্লাহ।

আমরা মনে-প্রাণে কামনা করি, পৃথিবীর মানুষ সত্যিকারার্থে ঈমানদার ও সৎকর্মশীল হয়ে গড়ে উঠুক। তাদের ঈমানে যেন কোন শিরক ও বিদ‘আত না থাকে। তাদের প্রাত্যহিক কর্মে যেন হাদীছ বিরোধী কোন আমল না থাকে। আমাদের এই দাওয়াত আমাদের এই কর্মতৎপরতার বিনিময়ে আমরা মহান আল্লাহর কাছে শুধু রহমত ও জান্নাত কামনা করি। আমরা জাহান্নামকে যেমন ভয় করি, তেমনি জান্নাতের আকাংখা করি। এই ভয় ও আকাংখা নিয়েই আমরা আহলেহাদীছ আন্দোলন করি। যার বিনিময় আমরা দুনিয়াতে চাই না। চাই কেবল আখেরাতে। হে আল্লাহ! তুমি আমাদের এই প্রার্থনা কবুল কর!

আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে প্রকৃত ঈমানদার হওয়ার ও আমলে ছালেহ করার এবং ছিরাতে মুস্তাক্বীমের উপর দৃঢ় থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় হওয়ার তাওফীক দান করুন- আমীন!

সম্মেলনের অন্যান্য রিপোর্ট :

১ম দিন বাদ আছর পবিত্র কুরআন থেকে তেলাওয়াত ও জাগরণীর মাধ্যমে সম্মেলন শুরু হয়। অতঃপর প্রচার সম্পাদক ড. সাখাওয়াত হোসাইনের পরিচালনায় স্বাগত ভাষণ পেশ করেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম এবং উদ্বোধনী পেশ করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। অতঃপর মাগরিবের পূর্ব পর্যন্ত ‘প্রশিক্ষণ’ কর্মসূচী হিসাবে সদ্য প্রকাশিত ‘শারঈ ইমারত’ বইয়ের উপর দেড় ঘণ্টার একটি ‘সামষ্টিক পাঠ’ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে বিভিন্ন যেলার কর্মীদের পৃথক পৃথক নেতৃত্বে ভাগ করে ‘সামষ্টিক পাঠ’ শেষ করা হয়। অতঃপর একত্রিতভাবে পর্যালোচনা করা হয়। যার নেতৃতব দেন কেন্দ্রীয় প্রশিক্ষণ সম্পাদক ডঃ কাবীরুল ইসলাম ও ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’-এর গবেষণা সহকারী নূরুল ইসলাম।

অতঃপর বাদ মাগরিব মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল (পাবনা) ইনফাক্ব ফী সাবীলিল্লাহর উপর বক্তব্য রাখেন। এরপর এশার ছালাত পর্যন্ত যেলা প্রতিনিধিগণ স্ব স্ব যেলার কর্মতৎপরতা ব্যাখ্যা করেন ও মূল্যবান পরামর্শ সমূহ পেশ করেন। বাদ এশা ‘কর্মীদের গুণাবলী ও পারস্পরিক সহনশীলতা’র উপর বক্তব্য রাখেন মজলিসে শূরা সদস্য অধ্যাপক জালালুদ্দীন (নরসিংদী) এবং ‘সংগঠনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা’র উপর বক্তব্য পেশ করেন সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম।

পরদিন বাদ ফজর আমীরে জামা‘আত ‘দরসে কুরআন’ পেশ করার পর শূরা সদস্য কাযী হারূণুর রশীদ (ঢাকা)-এর পরিচালনায় ‘জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আহলেহাদীছ আন্দোলনের ভূমিকা’-এর উপর বক্তব্য রাখেন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন। অতঃপর ‘ইহতিসাব’ বইয়ের উপর কেন্দ্রীয় দফতর ও যুববিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক আমীনুল ইসলাম, ‘হিসাব সংরক্ষণের গুরুত্ব ও অফিস ব্যবস্থাপনা’-এর উপর কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক বাহারুল ইসলাম এবং ‘মৃত্যুকে স্মরণ’-এর উপর খুলনা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মাওলানা জাহাঙ্গীর আলম আলোচনা পেশ করেন। 

নাশতার বিরতির পর ‘আদর্শ মানুষ গঠনে ‘সোনামণি’ সংগঠনের ভূমিকা’-এর উপর ‘সোনামণি’র কেন্দ্রীয় পরিচালক আবদুল হালীম, ‘যুবকদের ইসলামী আদর্শে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অভিভাবকদের ভূমিকা’-এর উপর ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি আব্দুর রশীদ আখতার, ‘চরমপন্থীদের দলীল ও তার জবাব’-এর উপর রাজশাহী-পশ্চিম যেলা সহ-সভাপতি মাওলানা দুর্রুল হুদা, ‘দ্বীনের উপর দৃঢ়তা’-এর উপর ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা দুর্রুল হুদা বক্তব্য পেশ করেন। এরপর ‘বার্ষিক সাংগঠনিক রিপোর্ট’ পেশ করেন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। অতঃপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের সমাপনী ভাষণের মাধ্যমে সম্মেলন শেষ হয়।

কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য সম্মেলন :

২য় দিন শুক্রবার সকাল ৯-টা থেকে ১১-টা পর্যন্ত আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর পূর্ব পার্শ্বস্থ মাদরাসার ৩য় তলায় ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে গঠনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী কেন্দ্রীয় বার্ষিক আয়-ব্যয়ের অডিটকৃত হিসাব সহ সংগঠনের সার্বিক রিপোর্ট পেশ করা হয়। সাথে সাথে তাঁদের মূল্যবান পরামর্শ সমূহ গ্রহণ করা হয়।

উল্লেখ্য যে, বিরূপ রাজনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও অত্র সম্মেলনে দেশের অধিকাংশ যেলা থেকে সহস্রাধিক কর্মী অংশগ্রহণ করেন।

গৃহীত প্রস্তাব সমূহ :

বার্ষিক কর্মী সম্মেলন ২০১৬-তে নিম্নোক্ত প্রস্তাবসমূহ বিবেচনার জন্য দেশের সরকার ও জনগণের নিকটে পেশ করা হয় এবং তা বিপুলভাবে সমর্থিত হয়-

(১) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে দেশের আইন ও শাসন ব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং মানুষের রক্তচোষা সূদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা বাতিল করে ইসলামী অর্থনীতি চালু করতে হবে। (২)  হিংসা ও প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করে দল ও প্রার্থীবিহীন ইসলামী নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। (৩) জঙ্গীবাদের বিশ্বাসগত ভ্রান্তি দূর করার জন্য শিক্ষার সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। (৪) ইসলামের বিরুদ্ধে যেকোন ধরনের উসকানীমূলক কার্যক্রম বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। (৫) ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কর্তৃক প্রচারিত Hallo CT apps-এর প্রমোশনাল ভিডিও থেকে ‘ইক্বামতে দ্বীন : পথ ও পদ্ধতি’ এবং ‘আক্বীদায়ে মোহাম্মদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ’ বই দু’টির ছবি অতি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। (৬) ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পরিচালনা কমিটি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিলেবাস কমিটি ও ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা কমিটিতে ‘আহলেহাদীছ’ প্রতিনিধি রাখতে হবে। (৭) আহলেহাদীছদের বিরুদ্ধে বিষোদগার বন্ধ করতে হবে এবং নির্দোষ কাউকে জঙ্গীবাদের অপবাদে অভিযুক্ত না করে প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। (৮) সুন্দরবনকে রক্ষার জন্য রামপাল কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের অনুমতি অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। (৯) মরণফাঁদ ফারাক্কা তুলে ফেলার জন্য এবং তিস্তার বিপরীতে গজলডোবা ও সিলেটের বিপরীতে টিপাইমুখ বাঁধসহ আন্তঃ নদীসংযোগ প্রকল্প বাতিল করার জন্য ভারত সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করার জন্য এ সম্মেলন সরকারের প্রতি জোর দাবী জানাচ্ছে। (১০) বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সর্বস্বহারা মানুষদের পর্যাপ্ত সহযোগিতা প্রদান ও পুনর্বাসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকার ও সচ্ছল ভাই-বোনদের প্রতি এ সম্মেলন উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে। (১১) কাশ্মীর, সিরিয়া ও ফিলিস্তীন সহ বিভিন্ন মুসলিম দেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের রক্তের হোলিখেলা বন্ধে আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। (১২) ডা. যাকির নায়েক পরিচালিত ‘পীস টিভি’র উপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে তুলে নিতে হবে এবং এর সম্প্রচার পুনরায় শুরু করতে হবে।