মৌলিক পরিবর্তন কাম্য

মেয়াদী দলতন্ত্রের নিষ্ঠুর ধ্বংসযজ্ঞে দেশ এখন রক্তাক্ত জনপদে পরিণত হয়েছে। আতংকিত সাধারণ মানুষ শান্তির জন্য আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করছে, হে আমাদের প্রতিপালক! এই অত্যাচারী জনপদ থেকে তুমি আমাদের মুক্তি দাও এবং তোমার পক্ষ হ’তে আমাদের জন্য অভিভাবক ও সাহায্যকারী পাঠাও (নিসা ৭৫)

কথায় বলে, ‘রোম যখন পুড়ছে, নীরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছে’। দেশ যখন জ্বলছে, সরকার তখন উন্নয়নের বাঁশি বাজাচ্ছে। প্রত্যেক দলীয় সরকারের পতনকালে এরূপই হয়ে থাকে। সরকারী ও বিরোধী দল উভয়ে জনগণের নামে জনগণের উপর সন্ত্রাস চালাচ্ছে। মারছে ও মরছে। জ্বালাও-পোড়াও ও লুটপাট চলছে সমানে। দেশে যেন ’৭১-এর ন্যায় যুদ্ধাবস্থা ফিরে এসেছে। জেল-যুলুম, মিথ্যা মামলায় কারাগারে ঠাঁই নেই। অথচ ঠেকাবার কেউ নেই। এ দায়িত্ব ছিল তৃতীয় পক্ষ হিসাবে সরকারের ও আদালতের। কিন্তু সরকার নিজেই এখন আগ্রাসী পক্ষ। দলীয় সরকার যে কখনোই সহনশীল ও নিরপেক্ষ প্রশাসন উপহার দিতে পারে না, এই রূঢ় বাস্তবতা পূর্বের ন্যায় আবারও প্রমাণিত হ’ল।

দেশের বর্তমান অবস্থায় আমরা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি যে, চিহ্নিত মহল ইসলামকেই তাদের টার্গেট বানিয়েছে। ১ম মহাযুদ্ধে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা না থাকলেও নামধারী মিত্রশক্তি তুরষ্কের ইসলামী খেলাফতকে টার্গেট করে এবং তাকে ভেঙ্গে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতেও দেশের ইসলামী সংগঠনগুলির তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা না থাকা সত্ত্বেও সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামকেই আক্রমণের শিকারে পরিণত করা হয়েছে। আল্লাহ, রাসূল, কুরআন সবকিছুর উপর হামলা করা হয়েছে। সবশেষে আল্লাহ ও দেব-দেবীকে সমান গণ্য করে স্কুলের নবম ও দশম শ্রেণীর সরকারী পাঠ্যবই ছেপে জ্বলন্ত অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য বইতেও একইভাবে ইসলাম দুশমনীর অভিযোগ আসছে। দেশে এত প্রেস থাকতে সমস্ত বই কোটি কোটি টাকা খরচ করে ছেপে আনা হয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে। যারা এদেশকে মরুভূমি বানিয়েছে। যারা দৈনিক সীমান্তে আমাদের নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে। কখনো ফেলানীর লাশ কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখছে। সীমান্তে ফেন্সিডিল কারখানা বানিয়ে এদেশে পাচার করে তরুণদের মাতাল বানাচ্ছে। সেদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হিসাবমতে প্রতিদিন গড়ে সেদেশে একটি করে মুসলিমবিরোধী দাঙ্গা হচ্ছে। আমাদের সীমান্তের ভূমি জবরদখল করছে। অথচ তাদেরকে খুশী করার জন্য আমাদের সরকার সবকিছু উজাড় করে দিচ্ছে। ১৯৭১-এর পূর্বে এদেশ ছিল স্বাধীন পাকিস্তানের অংশ। আর ভারত ছিল এদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী ও সবশেষে হামলাকারী দেশ। বর্তমান সংসদের ডেপুটি স্পীকার লে. ক. মীর শওকত আলীর স্পষ্ট স্বীকারোক্তি ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সঠিক ছিল’ -এটুকু্ই কি যথেষ্ট নয়? অথচ বলা হ’ত যে, এটি মিথ্যা মামলা। অতএব দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে যদি কেউ সেদিন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে থাকে, তাহলে তাদেরকে যুদ্ধাপরাধী বলা যাবে কি করে? যুদ্ধ শেষে নিরাপদ পরিবেশে দেশের হাযার হাযার মানুষকে যারা একতরফাভাবে হত্যা করল, তারা কি যুদ্ধাপরাধী নয়? সত্যি কথা বলতে কি, আজ পাকিস্তান থাকলে মুক্তিযোদ্ধারাই হ’ত যুদ্ধাপরাধী, আর রাযাকাররাই হ’ত মুক্তিযোদ্ধা। সেদিন ‘জয় বাংলা’ না বলে ‘আল্লাহু আকবার’ বলার অপরাধে, কতশত তরুণকে তাদের বাপ-মায়ের সামনে লাইন দিয়ে গুলি করে শহীদ করা হয়েছে সে দৃশ্য কি তাদের বাপ-ভাইয়েরা ভুলে গেছে? তাদের কোন বিচার আজও হয়নি। প্রয়োজনও নেই। ৯৩ হাযার পাকিস্তানী সেনার ফেলে যাওয়া হাযার হাযার কোটি টাকার অস্ত্র-শস্ত্র ও দেশের কল-কারখানা সব লুট করে নিয়ে গেল বন্ধুরাষ্ট্র। এর প্রতিবাদ করায় মেজর জলিল হলেন কারাবন্দী ও মাওলানা ভাসানী হলেন কার্যত গৃহবন্দী।

যুদ্ধ শেষে সবাই যখন স্বাধীন দেশকে মেনে নিয়েছে, তখন শুকনো ক্ষত পুনরায় কার স্বার্থে ঘা করা হচ্ছে? এরশাদ পতন আন্দোলনে এবং ’৯৬-২০০১-য়ে সরকার গঠনের সময় যাদের সমর্থন নিয়ে বর্তমান সরকারী দল ক্ষমতায় গিয়েছিল, তখন কেন এই ইস্যু তোলা হয়নি? তখন যাদেরকে দু’টি মহিলা সীট দিয়ে পুরস্কৃত করা হ’ল, এখন আবার তাদের নিষিদ্ধ করার পাঁয়তারা কেন? তাদের প্রতি এত ভয় কিসের? সাহস থাকলে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করুন। যে যার জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় যাবে? হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ও নাস্তিকদের যদি এ দেশে রাজনীতি করার অধিকার থাকে, তাহ’লে তাদের থাকবে না কেন? কে না জানে যে, নিষিদ্ধ ফলের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বেশী। ইখওয়ানকে মিসরে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন তারাই ক্ষমতায়। নিষিদ্ধকারী হোসনি মোবারক এখন বিচারের কাঠগড়ায়। অতএব এইসব বাহুল্য চিন্তা বাদ দিয়ে দেশ ও জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করাই সরকারের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হবে। পৃথিবীতে সবকিছুর বিচার মানুষ করতে পারে না। বিশ্বসেরা যুদ্ধাপরাধী বুশ-ব্লেয়ার ও পাশ্চাত্য অপশক্তির বিরুদ্ধে বিচার চাওয়া দূরে থাক, তাদের প্রতি টুঁ শব্দটি করার ক্ষমতা কোন নেতার হয়েছে কি? অতএব অনেক কিছুর বিচার আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিতে হয়। প্রকৃত অপরাধীরা কখনোই আল্লাহর শাস্তি থেকে বাঁচতে পারবে না। আখেরাতে তাদের জন্য জাহান্নাম অপেক্ষা করছে। অতএব আসুন! পরস্পরকে ক্ষমা করে দেশকে গড়ে তুলি। সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করি।

এ দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী ইসলামী শক্তিকে সরকার তার প্রতিপক্ষ বানিয়েছে। ইসলামী দলগুলিকে একে একে ধ্বংস করার নীল নকশা বাস্তবায়ন করছে। এতে সরকার বা তাদের নেপথ্য শক্তি যেটাই ভাবুন না কেন দেশ ক্রমেই এগিয়ে চলেছে একটা মৌলিক পরিবর্তনের দিকে। নিঃসন্দেহে সে পরিবর্তন হবে ইসলামের পক্ষে, বিপক্ষে কখনোই নয়। আর এটাই রাসূল (ছাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী যে, পৃথিবীতে এমন একটি মাটির ঘর বা ঝুপড়ি ঘরও থাকবে না, যেখানে ইসলামের কলেমা প্রবেশ করবে না (আহমাদ)। অতএব ইসলামের উপর যতই হামলা হবে, ততই ইসলামের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টি হবে। সম্প্রতি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় শাহবাগী জাগরণের চূড়ান্ত ব্যর্থতা তার বাস্তব প্রমাণ। ঐ অপতৎপরতা কেবল মানুষের ঘৃণা কুড়িয়েছে। কখনোই তাদের হৃদয়ে স্থান করতে পারেনি। আদালতের উপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করাই যে এর উদ্দেশ্য ছিল, তা এখন পরিষ্কার। ভোলা যাবে না যে, গত টার্মে এই সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাইকোর্টের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল করেছিলেন।

আমরা মনে করি, দেশের সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের আক্বীদা-বিশ্বাসকে আক্রমণ করা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে হামলা করার শামিল। আর সেই সাথে যখন যুক্ত হয় কয়েকটি চিহ্নিত মিডিয়া ও মিডিয়াম্যানদের এবং প্রতিবেশী আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রের সরব সমর্থন ও উসকানি, তখন সন্দেহ আরও ঘনীভূত হয়। মনে রাখা ভাল যে, ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীদের হিংস্র থাবা থেকে বাঁচার জন্য এবং ইসলামী স্বাতন্ত্র্যকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য হাযার হাযার বাঙ্গালী মুসলমানের রক্তের বিনিময়ে এদেশ একদিন ‘পাকিস্তান’ নামে স্বাধীন হয়েছিল। হক-ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী-শেখ মুজিব ছিলেন সেই সময়ে পাকিস্তান আন্দোলনের সামনের কাতারের সৈনিক। বর্তমান বাংলাদেশের মানচিত্র তাঁদেরই রেখে যাওয়া আমানত। যদিও নেহরু গংদের কুটিল চক্রান্তে নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দিনাজপুর, শিয়ালপাড়া এবং আসামের শিলচর ও করিমগঞ্জ যেলাগুলি সহ বহু মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। আজও ইসলামের স্বার্থেই এ দেশের স্বাধীনতা প্রয়োজন। তাই ইসলাম ও দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এদেশের ঈমানদার মুসলমানেরা কখনোই আপোষ করবে না। ভুলে যাওয়া উচিৎ নয় যে, ভারতীয় নেতারা কখনোই পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার চাননি। রবীন্দ্রনাথ নিজেই ছিলেন পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী। জানিনা হঠাৎ কোন মতলবে শ্বশুরবাড়ি ঘোরার নামে প্রণব মুখার্জি রবীন্দ্রনাথের জমিদারী এলাকা কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ও টাঙ্গাইলের পতিসর কুঠি ঘুরে গেলেন। যদিও নজরুলের নাম তাঁর হয়তবা স্মরণে আসেনি। সময়ই একদিন সব বলে দেবে। যারা ’৭৫-এর ২১ এপ্রিল মাত্র ৪১ দিনের জন্য ফারাক্কা বাঁধ চালু করার ধোঁকা দিয়ে বিগত ৩৮ বছর যাবৎ পানি আটকে রেখে পদ্মাকে হত্যা করেছে, যারা তিস্তা থেকে এক ফোঁটা পানি দিতে চায় না, ঐসব কপট বাঙ্গালীর সঙ্গে প্রায়ই সীমান্তে মিলনমেলার ভড়ং দেখলে দুঃখ হয় বৈকি!

পরিশেষে নেতাদের বলব, যে ইসলামের নামে আপনারা সর্বদা ভোট চান, সেই ইসলামের একটা বিধান অন্ততঃ মেনে নিন এবং নিজেদের সত্যিকারের জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। অবিলম্বে দেশে দল ও প্রার্থী বিহীন নেতৃত্ব নির্বাচন দিন। জনগণকে ভয় ও চাপমুক্তভাবে তাদের নেতা নির্বাচনের সুযোগ দিন। ইনশাআল্লাহ রাজনৈতিক সহিংসতা বন্ধ হয়ে যাবে। ব্যালট পেপারে মাত্র দু’টি দফা দিন, (১) ইসলামী খেলাফত চান, না ধর্মনিরপেক্ষ শাসন চান? (২) দেশের প্রেসিডেন্ট হিসাবে কাকে চান? নির্বাচন কমিশন ইসলামী নীতি মেনে স্বাধীনভাবে নির্বাচন পরিচালনা করবে। সরকার পদত্যাগ করবে এবং পরবর্তী সরকার না আসা পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেশ চালাবেন। এভাবে দেশে মৌলিক পরিবর্তন আনুন এবং স্থায়ী শান্তির পথে ফিরে আসুন।

[এ বিষয়ে মাননীয় সিইসি সমীপে ইতিপূর্বে আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব প্রেরণ করেছি। উক্ত মর্মে এপ্রিল’১২ সম্পাদকীয়টি পাঠ করুন- সম্পাদক]