ইলমের ফযীলত

 عَنْ كَثِيْرِ بْنِ قَيْسٍ قَالَ كُنْتُ جَالِسًا مَعَ أَبِي الدَّرْدَاءِ فِيْ مَسْجِدِ دِمَشْقَ فَجَاءَهُ رَجُلٌ فَقَالَ يَا أَبَا الدَّرْدَاءِ إِنِّيْ جِئْتُكَ مِنْ مَدِينَةِ الرَّسُوْلِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِحَدِيْثٍ بَلَغَنِيْ أَنَّكَ تُحَدِّثُهُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا جِئْتُ لِحَاجَةٍ قَالَ فَإِنِّيْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيْقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ وَالْحِيْتَانُ فِيْ جَوْفِ الْمَاءِ وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا وَرَّثُوْا الْعِلْمَ فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ-

অনুবাদ : তাবেঈ বিদ্বান কাছীর বিন ক্বায়েস (রাঃ) বলেন, আমি দামেশকের মসজিদে একদিন ছাহাবী হযরত আবুদ্দারদা (রাঃ)-এর নিকটে বসে আছি। এমন সময় তার নিকটে জনৈক ব্যক্তি এলো এবং বলল, হে আবুদ্দারদা! আমি আপনার নিকটে রাসূলের শহর (মদীনা) হ’তে এসেছি কেবল একটি হাদীছের জন্য। আমার নিকটে খবর পৌঁছেছে যে, আপনি উক্ত হাদীছটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে বর্ণনা করে থাকেন। আমি অন্য কোন কারণে এখানে আসিনি।

তখন আবুদ্দারদা (রাঃ) বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি ইলম হাছিলের জন্য কোন পথ অবলম্বন করে, আল্লাহ তার মাধ্যমে তাকে জান্নাতের পথ সমূহের একটি পথে পৌঁছে দেন এবং ফেরেশতাগণ ইলম তলবকারীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানাসমূহ বিছিয়ে দেন। নিশ্চয়ই যারা আলেম তাদের জন্য আসমান ও যমীনে যারা আছে, তারা আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে থাকে, এমনকি মাছ সমূহ পানির মধ্যে থেকেও। আলেমগণের মর্যাদা আবেদগণের উপরে ঐরূপ, পূর্ণিমার রাতে চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকাসমূহের উপরে যেরূপ। নিশ্চয়ই আলেমগণ হ’লেন নবীগণের উত্তরাধিকারী। আর নবীগণ কোন দীনার বা দিরহাম উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান না। বরং তাঁরা রেখে যান কেবল ইল্ম। অতএব যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করেছে, সে ব্যক্তি পূর্ণ অংশ গ্রহণ করেছে’।[1]

হাদীছটি মুসনাদে আহমাদে (৫/১৯৬ পৃঃ) বর্ণিত হয়েছে এবং বর্ণনা করেছেন তিরমিযী ও আবুদাঊদ ‘ইলম’ অধ্যায়ে, ইবনু মাজাহ ‘সুন্নাহ’ অধ্যায়ে ও দারেমী ‘ইলম’ অধ্যায়ে। তিরমিযী তার বর্ণনায় আবুদ্দারদা (রাঃ) হ’তে বর্ণনাকারী রাবীর নাম ক্বায়েস ইবনু কাছীর (قيس بن كثير) বলেছেন। ইমাম আহমাদও একটি সূত্রে তাই বলেছেন। তবে ছাহেবে মিরক্বাত ও মির‘আত উভয়ে বলেন, والصحيح كثير بن قيس ‘সঠিক হ’ল কাছীর ইবনু ক্বায়েস’। ছাহেবে মির‘আত বলেন, وهو وهم من أحد الرواة ‘এটি (অর্থাৎ ক্বায়েস ইবনু কাছীর) কোন একজন বর্ণনাকারীর ধারণা প্রসূত নাম মাত্র’।

সনদ : আলবানী ‘হাসান’ বলেছেন।

সারমর্ম : ইলমের সন্ধানী ও আলেমের উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে।

রাবীর পরিচয় : কাছীর ইবনু ক্বায়েস। শামের অধিবাসী ছিলেন। ছাহেবে মাছাবীহ তাঁকে তাবেঈগণের মধ্যে গণ্য করেছেন। বস্ত্ততঃ তিনি ছিলেন মধ্যম স্তরের তাবেঈগণের অন্তর্ভুক্ত। মুহাম্মাদ ইবনু ইয়াযীদ আল-ওয়াসেত্বী তার দু’টি বর্ণনার একটিতে তাঁর নাম ক্বায়েস ইবনু কাছীর বলেছেন। তবে এটি ছিল ধারণা প্রসূত (وهو وهم)। ইবনু হিববান তাঁকে বিশ্বস্ত রাবীদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন।

হাদীছের ব্যাখ্যা :

(فِي مَسْجِدِ دِمَشْقَ) সঠিক উচ্চারণ ‘দিমাশ্ক্ব’ হবে। যদিও দামেষ্ক বলে বাংলায় চালু রয়েছে। (أَبُو الدَّرْدَاءِ) আবুদ্দারদা শেষ অক্ষরে আলিফের মাথায় হামযা হবে না, বরং আলিফের পরে হামযা হবে। লেখার সময় সেভাবেই লিখতে হবে। (لِحَدِيْثٍ) অর্থ لأجل تحصيل حديث ‘একটি হাদীছ অনুসন্ধানের জন্য’।

(بَلَغَنِيْ أَنَّكَ تُحَدِّثُهُ عَنْ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ) ‘আমার কাছে খবর পৌঁছেছে যে, আপনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) থেকে উক্ত হাদীছটি বর্ণনা করে থাকেন’। হ’তে পারে রাবীর নিকটে হাদীছটির সার-সংক্ষেপ পৌঁছেছিল। অথবা তিনি সরাসরি স্বকর্ণে শুনে নিশ্চিন্ত হবার জন্য অথবা সনদের স্তর উপরে উঠানোর জন্য তিনি ১৩০৩ কিঃ মিঃ (প্রায় এক হাযার মাইল) রাস্তা উটে বা গাধা-ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে বহু কষ্ট স্বীকার করে মদীনা থেকে দামেষ্ক এসেছেন, لأن الإسناد من الدين قاله ابن المبارك، ‘কেননা ইসনাদ হ’ল দ্বীনের অন্তর্ভুক্ত- যা ইবনুল মুবারক বর্ণনা করেছেন (মুক্বাদ্দামা মুসলিম)। হাদীছ শিক্ষার জন্য এই ব্যগ্রতা ও কষ্ট স্বীকার অহি-র ইলমকে হেফাযত করার বিষয়ে আল্লাহ প্রদত্ত ওয়াদারই (হিজর ১৫/৯; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯) বাস্তব দলীল। উল্লেখ্য যে, বর্ণিত হাদীছ-এর আলোচ্য অংশটি মুহাম্মাদ নাছেরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর মিশকাতে (মুদ্রণ: বৈরুত ১৯৮৫) নেই।

(مَا جِئْتُ لِحَاجَةٍ) অর্থ ماجئت إلى الشام لحاجة أخرى غير أن أسمعك الحديث ‘সিরিয়াতে আমি অন্য কোন প্রয়োজনে আসিনি, আপনার নিকট থেকে হাদীছটি শ্রবণের উদ্দেশ্যে ব্যতীত’। হ’তে পারে এর দ্বারা তিনি ইলম তলবের কষ্ট স্বীকারের অশেষ নেকী হাছিল করতে চেয়েছিলেন। যদিও সেকথা তিনি মুখে বলেননি।

(قَالَ : فَإِنِّيْ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ) অর্থ قال أبو الدرداء إذا كان الأمر كذلك فاعلم إني سمعت ‘আবুদ্দারদা বললেন, যদি কথা সেটাই হয়, তবে জেনে নাও যে, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি..’।

(مَنْ سَلَكَ طَرِيْقًا يَطْلُبُ فِيْهِ عِلْمًا سَلَكَ اللهُ بِهِ طَرِيْقًا مِنْ طُرُقِ الْجَنَّةِ) অর্থ من دخل أو مشى طريقا قريبا كان أو بعيدا يبتغي فيه علمًا شرعيا ارشده الله طريقا إلى الجنة وسهل له به إليها- ‘যে ব্যক্তি প্রবেশ করল কিংবা পথে চলল নিকটের হৌক বা দূরের হৌক দ্বীনী ইলম শিক্ষার জন্য, আল্লাহ তাকে জান্নাতের দিকে পথপ্রদর্শন করেন এবং তার জন্য তার ইলমের দ্বারা জান্নাতের পথ সহজ করে দেন’। এর দ্বারা তাকে দুনিয়াতে সৎকর্মের তাওফীক দান করা অর্থ হ’তে পারে কিংবা সহজে জান্নাতে প্রবেশও হ’তে পারে।

(وَإِنَّ الْمَلاَئِكَةَ لَتَضَعُ أَجْنِحَتَهَا رِضًا لِطَالِبِ الْعِلْمِ) ‘ফেরেশতাগণ উক্ত ইলম সন্ধানীর সন্তুষ্টির জন্য নিজেদের ডানা সমূহ বিছিয়ে দেন’। এটি বাস্তবেও হ’তে পারে ইলম শিক্ষার প্রতি সম্মান ও বিনয় প্রদর্শনের জন্য। তাছাড়া ফেরেশতাগণ আল্লাহর হুকুমে তাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করে থাকে, যাতে তার পথ চলা সহজ হয়।

ছাহেবে মিরক্বাত এ বিষয়ে হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) কর্তৃক আহমাদ ইবনু শু‘আয়েব হ’তে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তিনি বলেন যে, আমরা একদিন বছরায় কয়েকজন মুহাদ্দিছের নিকটে উপস্থিত ছিলাম এবং অত্র হাদীছটি আলোচনা করছিলাম। ঐ মজলিসে একজন মু‘তাযেলী ব্যক্তি (অতি যুক্তিবাদী ভ্রান্ত ফের্কার অনুসারী) উপস্থিত ছিল। সে হাদীছটি নিয়ে ঠাট্টা করতে থাকল এবং এক পর্যায়ে বলল, والله لأطرقن غدا نعلي وأطأ بها أجنحة الملائكة ‘আল্লাহর কসম! আমি কালকে জুতা পায়ে রাস্তায় চলব এবং তা দিয়ে ফেরেশতাদের ডানা দাবিয়ে দেব’। পরের দিন সে তাই-ই করল। ফলে তার দু’পা শুকিয়ে গেল ও তাতে অবশতা (الاكلة) এসে গেল।

ত্বাবারাণী বলেন, আমি ইবনু ইয়াহইয়া সাজীকে বলতে শুনেছি যে, একদিন আমরা বছরার গলিপথে চলছিলাম একজন মুহাদ্দিছ-এর নিকটে যাওয়ার জন্য। এক পর্যায়ে আমরা দ্রুত চলতে লাগলাম। আমাদের সঙ্গে একজন লোক ছিল, যার দ্বীন সম্পর্কে কারু জানা ছিল না। হঠাৎ সে বলে উঠল, ارفعوا أرجلكم عن أجنحة الملائكة لا تكسروها كالمستهزىء بالحديث ‘আপনারা ফেরেশতাদের ডানা হ’তে আপনাদের পা উঁচু করুন। হাদীছকে তাচ্ছিল্যকারীর ন্যায় ওগুলিকে ভেঙ্গে দিবেন না’। বলেই লোকটি ওখানেই পা ফুলে মাটিতে পড়ে গেল।

সুনান ও মুসনাদ সমূহে হযরত ছাফওয়ান বিন ‘আসসাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! جئت لطلب العلم ‘আমি ইলম শিক্ষার জন্য এসেছি’। একথা শুনে তিনি বললেন, مرحبًا بطالب العلم ‘তালেবে ইলমের জন্য মুবারকবাদ’! নিশ্চয়ই তালেবে ইলমকে ফেরেশতাগণ ঘিরে রাখে। তাকে তাদের ডানা সমূহ দিয়ে ছায়া করে এবং তাদের মহববতে তারা একজনের উপরে একজন সওয়ার হয়ে দুনিয়াবী আসমান পর্যন্ত পৌঁছে যায়’।[2]

(وَإِنَّ الْعَالِمَ لَيَسْتَغْفِرُ لَهُ مَنْ فِي السَّمَوَاتِ وَمَنْ فِي الْأَرْضِ) ‘নিশ্চয়ই আলেমের জন্য অবশ্যই ক্ষমা প্রার্থনা করে যারা অবস্থান করে আসমান সমূহে এবং যমীনে, এমনকি পানির নীচে মাছ সমূহ’। এটি বাস্তবে হ’তে পারে এভাবে যে, আল্লাহ ঐসব দৃশ্য ও অদৃশ্য সৃষ্টি সমূহকে ইলহাম করে থাকেন আলেমের পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য, যদি তার দ্বারা কোন ভুল-ভ্রান্তি কোন গোনাহের কাজ হয়ে যায়। আর এটি করা হয়ে থাকে আলেমের বৃহৎ সৎকর্মাদির বদলা হিসাবে। কেননা ইলমের কল্যাণকারিতার ব্যাপকতা এবং সৃষ্টির জন্য তার উপকারিতা সমূহ নির্ভর করে আলেমের উপরে’। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে যে, ما من شيء من الموجودات حيها وميتها إلا وله مصلحة متعلقة بالعلم ‘সৃষ্টিজগতে জীবিত বা মৃত এমন কিছুই নেই, যার কল্যাণকারিতা ইলমের সাথে সম্পর্কিত নয়’।

(وَالْحِيْتَانُ فِيْ جَوْفِ الْمَاءِ) ‘পানির মধ্যকার মাছ সমূহ’ একথা বলার অর্থ আসমান ও যমীনের সৃষ্ট বস্ত্তসমূহের ব্যাপকতা বুঝানো। যেমন আল্লাহর দয়াগুণের ব্যাপকতা বুঝানোর জন্য সূরা ফাতিহাতে ‘আর-রহমান’-এর পরে ‘আর-রহীম’ বলা হয়েছে। নিঃসন্দেহে মাছ হ’ল মানুষের জন্য পানিতে উৎপাদিত শ্রেষ্ঠতম রূযী। ইলম হ’ল পানির ন্যায়, যা না থাকলে মাছ বাঁচতে পারে না। অনুূরূপভাবে ইলম ব্যতীত মানুষ ও আসমান-যমীনের কিছুই টিকে থাকতে পারে না।

(وَإِنَّ فَضْلَ الْعَالِمِ عَلَى الْعَابِدِ كَفَضْلِ الْقَمَرِ لَيْلَةَ الْبَدْرِ عَلَى سَائِرِ الْكَوَاكِبِ) অর্থوان فضل العالم المشتغل بالعلم والقائم بنشره بعد أدائه الفرائض والسنن المؤكدة على العابد الغالب عليه العبادة بالنوافل مع كونه عالما بما ةصح به العبادة، كفضل القمر ليلة الرابع عشر على سائر الكواكب-

‘যে আলেম নিয়মিত ফরয ইবাদত ও সুন্নাতে মুওয়াক্কাদাহ সমূহ আদায় করার পরে নিরন্তর ইলমের সন্ধানে ও তার প্রচার-প্রসারে লিপ্ত থাকেন, ঐ আলেমের মর্যাদা অনেক উঁচু ঐ আবেদের চাইতে যিনি অধিকহারে নফল ইবাদত সমূহে রত থাকেন এবং তিনি অন্ততঃ এতটুকু ইলমের অধিকারী হন যদ্বারা ইবাদত বিশুদ্ধ হয়, উভয়ের তুলনা যেমন চতুর্দশী রাতের পূর্ণিমার চাঁদের মর্যাদা অন্যান্য তারকা সমূহের উপরে’।

ক্বাযী আয়ায বলেন, এই তুলনার কারণ এই যে, নক্ষত্রের আলো দ্বারা সে কেবল নিজেই আলোকিত হয়। কিন্তু চাঁদের আলো নিজেকে ছাড়াও অন্যকে আলোকিত করে। অনুরূপভাবে আবেদ তার ইবাদত দ্বারা কেবল নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতি ঘটায়। কিন্তু আলেম তার ইল্ম দ্বারা নিজে যেমন উপকৃত হন, তেমনি অন্যকে উপকৃত করে থাকেন। আলেম উক্ত নূর লাভ করেন রাসূল (ছাঃ) থেকে। যেমন চন্দ্র জ্যোতি লাভ করে থাকে সূর্য থেকে। আর সূর্য কিরণ লাভ করে আল্লাহ থেকে। একইভাবে রাসূল (ছাঃ) ‘অহি’ লাভ করে থাকেন আল্লাহ থেকে’।

এখানে ইলম শূন্য আবেদ এবং আমল ও তাক্বওয়া শূন্য আলেমের কথা বলা হয়নি। যার জাহান্নামী হবার সম্ভাবনা সর্বাধিক এ কারণে যে, আবেদ ইলম ছাড়াই ইবাদত করে। ফলে তাতে ভুল-ত্রুটি থাকাই স্বাভাবিক। পক্ষান্তরে আমল ও তাক্বওয়া শূন্য আলেমের অবস্থা গুণশূন্য ঔষধের ন্যায়, যা স্রেফ ডাষ্টবিনে ফেলে দিতে হয়। যেমন বলা হয়ে থাকে, ويل للجاهل مرة وويل للعالم سبع مرات ‘জাহিল ধ্বংস হৌক একবার এবং আলেম ধ্বংস হৌক সাতবার’ (মিরক্বাত)

(وَإِنَّ الْعُلَمَاءَ وَرَثَةُ الْأَنْبِيَاءِ) অর্থ وإن العلماء الاةقياء الحقة ورثة الأنبياء والرسل في ةركاةهم العلوم الشرعية- ‘সত্যিকারের মুত্তাক্বী আলেমগণ নবী ও রাসূলগণের রেখে যাওয়া দ্বীনী ইলম সমূহের উত্তরাধিকারী’। ইমাম গাযযালী বলেন, نتيجة هذا العلم أن يعرض عن الفاني ويقبل على الباقي، ‘এই ইলমের ফলাফল এই যে, সে নশ্বর দুনিয়াকে এড়িয়ে চলে এবং অবিনশ্বর আখেরাতের দিকে এগিয়ে যায়’।

(وَإِنَّ الْأَنْبِيَاءَ لَمْ يُوَرِّثُوْا دِيْنَارًا وَلاَ دِرْهَمًا) অর্থ-وإن الأنبياء ما ورثوا أولادهم وأزواجهم شيئاً من اموال الدنيا بل بقى بعدهم ان بقى شئ تركة لبيت المال لعامة المسلمين- ‘নবীগণ তাঁদের স্ত্রী ও সন্তানাদির জন্য কোন দুনিয়াবী মাল-সম্পদ রেখে যান না। যদি কিছু রেখে যান, তবে তা তাদের অনুসারী মুসলিমদের ‘বায়তুল মাল’ তথা সাধারণ ধন ভান্ডারের জন্য পরিত্যক্ত হিসাবে গণ্য হয়’। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, نَحْنُ مَعْشَرَ الأنْبِيَاءِ لاَ نُوْرَثُ مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ ‘আমরা নবীগণ কাউকে (সম্পত্তির) উত্তরাধিকারী করি না। আমরা যা কিছু ছেড়ে যাই, সবই ছাদাক্বা হয়ে যায়’।[3] আর একারণেই ফাতেমা (রাঃ) স্বীয় পিতা রাসূল (ছাঃ)-এর ছেড়ে যাওয়া বনু নাযীরের পরিত্যক্ত বাগিচা (صفايا بني النضير) ও খায়বারের ফিদক খেজুর বাগানের উত্তরাধিকার পাননি। এর উদ্দেশ্য একথা বুঝানো যে, নবী-রাসূলগণ দুনিয়াতে নিজেদের ও নিজেদের পরিবারের জন্য মাল-সম্পদ জমা করার জন্য আসেন না। তাঁরা স্বীয় পরিবারকে সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দুনিয়া থেকে বিদায় হন। এর মাধ্যমে তাঁদের অনুসারীদের মধ্যে ত্যাগের জাযবা সৃষ্টি হয়। ইবরাহীম, শু‘আয়েব, আইয়ূব, দাঊদ, সুলায়মান প্রমুখ নবী-রাসূলগণ প্রভূত ধন-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর পরে সবকিছুই স্ব স্ব উম্মতের বায়তুল মালে পরিণত হয়।

(وَإنَّمَا وَرَّثُوْا الْعِلْمَ) ‘তাঁরা উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে যান ইলমকে’। অর্থাৎ শরী‘আতের বিধি-বিধান সমূহ ছাড়াও মানুষের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পন্থা ও পদ্ধতি সমূহ যা তারা উম্মতের জন্য বাৎলিয়ে যান, সেগুলিই হ’ল তাঁদের প্রকৃত উত্তরাধিকার। যা নিয়ে উম্মত বেঁচে থাকে ও দুনিয়াবী জীবনে কল্যাণ ও পরকালীন জীবনে মুক্তি লাভে ধন্য হয়।

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন তিনি বাজারে গিয়ে ব্যবসায়ে মশগূল লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা এখানে ব্যস্ত রয়েছ, অথচ ওদিকে রাসূল (ছাঃ)-এর মীরাছ সব মসজিদে বণ্টিত হয়ে যাচ্ছে। একথা শুনে তারা দ্রুত মসজিদে চলে গেল। যেয়ে দেখল যে, সেখানে কেবল কুরআন ও হাদীছের ইলমী আলোচনা চলছে। লোকেরা বলল, হে আবু হুরায়রা! আপনার কথা মতো কিছুই তো বণ্টিত হচ্ছে না। জওয়াবে তিনি বললেন, هذا ميراث محمد يقسم بين ورثته وليس بمواريثه دنياكم ‘এটাই হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর মীরাছ, যা তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বণ্টিত হচ্ছে। এটা তোমাদের দুনিয়াবী কোন মীরাছ নয়’।

(فَمَنْ أَخَذَهُ أَخَذَ بِحَظٍّ وَافِرٍ) অর্থ فمن أخذ العلم الشرعي أخذ نصيبا تاما إذ لاحظ أوفر منه- ‘যে ব্যক্তি দ্বীনী ইলম অর্জন করল, সে ব্যক্তি পূর্ণ অংশ অর্জন করল। কেননা এর চাইতে পরিপূর্ণ অংশ আর কিছুই নেই’।

এর অর্থ এটাও হ’তে পারে যে, يجوز أن يكون أخذ بمعنى الأمر (أي خذ) أي فمن أراد أخذه فليأخذ بحظ وافر ولا يقتنع بقليل অতীত কালের (أَخَذَ) ক্রিয়াটি ‘আদেশ’ (خُذْ) অর্থে নেওয়া হবে। তখন মর্ম হবে, যে ব্যক্তি ইলম হাছিল করতে চায়, সে যেন পূর্ণরূপে তা হাছিল করে এবং অল্প কিছু জেনেই যেন তুষ্ট না হয়’। ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, هذا زبدة كلام الشرح هنا ‘ব্যাখ্যা সমূহের সারৎসার এটাই’। أخذ بحظ-এর ‘বা’ অব্যয়টি ‘অতিরিক্ত’ এসেছে তাকীদ বুঝানোর জন্য। অত্র হাদীছে অধিকহারে হাদীছের ইলম অর্জনের প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে।

শিক্ষণীয় বিষয় সমূহ :

(১) হাদীছ শিক্ষার প্রতি মুসলমানদের প্রবল আগ্রহ। কেননা হাদীছ হ’ল রাসূল (ছাঃ)-এর বক্তব্য। যা মূলতঃ আল্লাহর বক্তব্য বা অহিয়ে গায়ের মাতলু। আল্লাহর ‘অহি’ অভ্রান্ত সত্যের উৎস। অতএব তা দুনিয়ার সবচাইতে মূল্যবান সম্পদের চাইতে অধিক মূল্যবান। যে তা হাছিল করতে পারে, সেই-ই সবচেয়ে ভাগ্যবান। নিঃসন্দেহে তা হ’তে হবে ছহীহ হাদীছ। জাল বা যঈফ হাদীছ নয়।

(২) হাদীছ শিক্ষা হবে স্রেফ আল্লাহর ওয়াস্তে। দুনিয়া উপার্জনের লক্ষ্যে নয়।

(৩) হাদীছ শিক্ষাকে অন্য সবকিছুর উপরে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

(৪) হাদীছ শিক্ষার একমাত্র বিনিময় হ’ল জান্নাত। আর এটি হবে হাদীছের আলোকে নিজের চরিত্র গঠন ও দুনিয়াবী জীবন পরিচালনার পরকালীন পুরস্কার মাত্র।

(৫) হাদীছ শিক্ষার্থীর প্রতি সম্মান, বিনয়, ভালবাসা ও মর্যাদা প্রদর্শনের জন্য ফেরেশতারা তাদের ডানা বিছিয়ে দেয় এ কারণে যে, সে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া উত্তরাধিকার বহন করে। আর ফেরেশতা হ’ল মানুষের প্রতি সর্বাধিক সহানুভূতিশীল ও সর্বাধিক কল্যাণকামী। তারা সর্বদা ঈমানদারগণের জন্য আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে। অতএব দ্বীনী ইলম অর্জনকারীদের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও ক্ষমা প্রার্থনা অন্য বান্দাদের চাইতে নিঃসন্দেহে বেশী।

(৬) আলেমগণের ভুল হ’তে পারে। কিন্তু ভুল ধরা পড়লে তারা সুধরে নেন। অতঃপর নিজে আলোকিত পথে চলেন। অন্যকেও আলো দিয়ে থাকেন। সেকারণ তাদের জন্য সকল সৃষ্টি এমনকি পানির মধ্যেকার মাছও ক্ষমা প্রার্থনা করে। পক্ষান্তরে যে আলেম অহংকারী এবং হঠকারিতা বশে সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করে ও মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করে, তার জন্য কেউ ক্ষমা চায় না। সে মারা গেলেও আসমান ও যমীনের কেউ তার জন্য কাঁদে না।

(৭) মুত্তাক্বী আলেম নবীগণের উত্তরাধিকারী। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল তার সবচেয়ে বড় মর্যাদা। কেননা নবীগণ হলেন সৃষ্টির সেরা। আর আলেমগণ হলেন তাদের ওয়ারিছ এবং তাদের পরবর্তী মর্যাদার অধিকারী। মীরাছ পেয়ে থাকে মৃতের সর্বাধিক নিকটাত্মীয়েরা। আর নবীগণের ইলমের মীরাছ পান আলেমগণ। অতএব তারাই নবীগণের সর্বাধিক নিকটজন। যদি নাকি তিনি যথার্থ আল্লাহভীরু ও যথাযোগ্য আমলকারী হন।

(৮) নবুঅতের এই অমূল্য মীরাছ পাওয়ার জন্য আল্লাহ যাকে খুশী বেছে নেন। এই মীরাছ যারা পান পৃথিবীতে তারাই সবচেয়ে ভাগ্যবান।

(৯) এই ভাগ্যবান ব্যক্তিদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও তাদেরকে যথাযথ মর্যাদা প্রদান করা সকলের জন্য একান্ত কর্তব্য।

(১০) আল্লাহর এই বন্ধুদের বিরুদ্ধে যারা বিদ্বেষ পোষণ করে, আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন, যা অন্য হাদীছ দ্বারা প্রমাণিত এবং আলোচ্য হাদীছের যা অন্তর্নিহিত তাৎপর্য।

ফায়েদা :

অনেকের ধারণা হাদীছের ইলম স্রেফ দ্বীনী কাজে প্রয়োজন হয়, দুনিয়াবী কাজে লাগে না। সেহেতু এর প্রয়োজনীয়তা ব্যাপক নয়। এর জওয়াব এই যে, উক্ত ধারণা ভুল। কেননা হাদীছের ইলম দ্বীন ও দুনিয়া সবকিছুকে শামিল করে। মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগে কুরআন ও হাদীছে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা রয়েছে, যা নির্ভুল ও চূড়ান্ত সত্য। যাদের মধ্যে কুরআন-হাদীছের পূর্ণ জ্ঞান নেই অথবা থাকলেও তা থেকে তারা দুনিয়াবী স্বার্থে দূরে অবস্থান করতে চায়, কিংবা যারা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের নামে নিজ নিজ প্রবৃত্তির দাসত্ব করে, তারা হাদীছ থেকে নেবার মত কিছুই খুঁজে পায় না। অথচ মানবজীবনের ইহকালীন ও পরকালীন যেকোন বিষয়ের সমাধান হাদীছ থেকে পাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন কেবল আন্তরিকতার। ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেন, মানবজাতি তার খাদ্য ও পানীয়ের চাইতে বেশী মুখাপেক্ষী হ’ল ইলমের। কেননা দিনে একবার বা দু’বার মানুষের খাদ্য ও পানীয়ের প্রয়োজন হয়, অথচ প্রতি নিঃশ্বাসে তার জন্য ইলম আবশ্যক’। নিঃসন্দেহে এই ইলম হ’ল কুরআন ও হাদীছের ইলম।

উল্লেখ্য যে, জ্ঞানার্জন থেকে যখন কুরআন-হাদীছকে পৃথক করা হবে, তখন সেখানে থাকবে কেবল শয়তান। বর্তমান বিশ্বে অধিকাংশ মেধা ব্যয় হচ্ছে নতুন নতুন মারণাস্ত্র আবিষ্কারে ও বিভিন্ন ভেজাল বস্ত্ত সৃষ্টিতে। যা স্রেফ শয়তানী জ্ঞান। যা থেকে বিরত না হ’লে পৃথিবী মানুষ নামক শয়তানদের হাতেই জাহান্নামে পরিণত হবে। বর্তমানে আমরা যার মধ্যে ডুবে গেছি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন- আমীন!


[1]. আহমাদ, তিরমিযী, আবু দাঊদ, ইবনু মাজাহ, দারেমী; তিরমিযী রাবীর নাম ক্বায়েস বিন কাছীর বলেছেন, মিশকাত হা/২১২ ‘ইলম’ অধ্যায়।

[2]. ত্বাবারানী, ছহীহাহ হা/৩৩৯৭

[3]. বুখারী হা/৪০৩৪।