মুত্তাক্বীদের পরিচয়

الٰم- ذَلِكَ الْكِتَابُ لاَ رَيْبَ فِيْهِ هُدًى لِلْمُتَّقِيْنَ- الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ- وَالَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ- أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ-

১. আলিফ লাম মীম। (এর অর্থ কেবলমাত্র আল্লাহ অবগত)। ২. এই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক। ৩. যারা গায়েবে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে। ৪. যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ বিষয়ে, যা আপনার প্রতি নাযিল করা হয়েছে এবং যা আপনার পূর্ববর্তীগণের প্রতি নাযিল করা হয়েছিল। আর পরকালীন জীবনের প্রতি যারা নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে। ৫. ঐসকল মানুষ তাদের প্রভুর দেখানো পথের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম।

বর্ণিত আয়াতগুলিতে মুত্তাক্বীদের ৬টি গুণ বর্ণনা করা হয়েছে। নিম্নে আয়াতগুলির তাফসীরসহ উক্ত গুণগুলির ব্যাখ্যা প্রদত্ত হ’ল-

هُدًى لِلْمُتَّقِيْنَ ‘আল্লাহ ভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক’।

কুরআন সকল মানুষের জন্য পথপ্রদর্শক হ’লেও এখানে মুত্তাক্বীদের খাছ করা হয়েছে এ কারণে যে, তারাই কেবল এ থেকে উপকৃত হয়ে থাকেন, অন্যেরা নয়। যেমন বিরানী সকলের জন্য উত্তম খাদ্য হলেও তা কেবল সুস্থদেহীদের জন্য উপযোগী, অন্যদের জন্য নয়। একদল ছাহাবী থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, মুত্তাক্বী বলতে ঐসব মুমিন নর-নারীকে বুঝায় যারা শিরক থেকে বেঁচে থাকেন এবং আল্লাহর অবাধ্যতার শাস্তিকে ভয় পান। তারা আল্লাহর আনুগত্যপূর্ণ কাজ করেন এবং সর্বদা তাঁর রহমতের আশা করেন (ইবনু কাছীর)

ইবনু কাছীর বলেন, তাক্বওয়ার মূল অর্থ হ’ল التوقي ما يكره ‘অপসন্দনীয় বিষয় থেকে বেঁচে থাকা’وَقٰى ِيَقِىٌ وِقَايَةً وَتُقَاهً تَقْوَي মূলে ছিল وَقْوَي অনুরূপভাবে تُقَاةٌ মূলে ছিল وُقَاةٌ ওয়াওকে ‘তা’ করা হয়েছে। অর্থ, ভয় করা পরহেয করা। যেমন আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اتَّقُوا اللهَ حَقَّ تُقَاتِهِ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর সত্যিকারের ভয়’ (আলে ইমরান ৩/১০২)। কথিত আছে যে, ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) একদিন উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। উবাই বললেন, أَمَا سَلَكْتَ طَرِيقًا ذَا شَوْكٍ؟ ‘আপনি কি কাঁটা যুক্ত পথে চলেননি? ওমর (রাঃ) বললেন, হাঁ। উবাই বললেন, কিভাবে চলেছেন? ওমর (রাঃ) বললেন, খুব সাবধানে ও কষ্ট করে চলেছি। উবাই বললেন, فَذَلِكَ التَّقْوَى ‘ওটাই হ’ল তাক্বওয়া’ (ইবনু কাছীর)।

একদিন জনৈক ব্যক্তি আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে তাক্বওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন,أَخَذْتَ طَرِيْقًا ذَا شَوْكٍ؟ ‘তুমি কি কখনো কাঁটাযুক্ত পথে চলেছ? লোকটি বলল, হাঁ। তিনি বললেন, কিভাবে চলেছ? লোকটি বলল, إِذَا رَأَيْتُ الشَّوْكَ عَدَلْتُ عَنْهُ أَوْ جَاوَزْتُهُ أَوْ قَصُرْتُ عَنْهُ ‘আমি কাঁটা দেখলে তা এড়িয়ে চলি। অথবা ডিঙিয়ে যাই অথবা দূরে থাকি’। আবু হুরায়রা (রাঃ) বললেন, ذَاكَ التَّقْوَى ‘এটাই হ’ল তাক্বওয়া’।[1] আববাসীয় খলীফা মুতাওয়াক্কিল-এর পৌত্র খ্যাতনামা কবি ও বিদ্বান আব্দুল্লাহ ইবনুল মু‘তায (মৃঃ ২৯৬ হিঃ) তাক্বওয়ার উক্ত অর্থের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন,

خَلِّ الذُّنُوْبَ صَغِيْرَهَا + وَكَبِيْرَهَا ذَاكَ التُّقَى

وَاصْنَعْ كَمَاشٍ فَوْقَ أَرْ + ضِ الشَّوْكِ يَحْذَرُ مَا يَرَى

 لاَ تَحْقِرَنَّ صَغِيْرَةً + إِنَّ الْجِبَالَ مِنَ الْحَصَى

অনুবাদ : (১) ছোট ও বড় সব গোনাহ পরিত্যাগ কর। এটাই তাক্বওয়া। (২) চলো কাঁটা বিছানো রাস্তার পথিকের মত। যে সতর্ক হয় ঐসব থেকে, যা সে দেখতে পায় (৩) ছোট পাপকে তুচ্ছ মনে করো না। নিশ্চয়ই পাহাড় সৃষ্টি হয়েছে ছোট ছোট কংকর থেকে’ (কুরতুবী, ইবনু কাছীর)

আল্লাহ অত্র আয়াতে মুত্তাক্বীদের জন্যই কেবল হেদায়াতকে খাছ করেছেন। কেননা যারা হেদায়াত চায় কেবল তারাই হেদায়াত পায়। যারা যেদী ও হঠকারী তারা হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হয়। এ বিষয়টি আল্লাহ অন্যত্র বলেন এভাবে,

قُلْ هُوَ لِلَّذِيْنَ آمَنُوا هُدًى وَشِفَاءٌ وَالَّذِيْنَ لاَ يُؤْمِنُوْنَ فِيْ آذَانِهِمْ وَقْرٌ وَهُوَ عَلَيْهِمْ عَمًى أُولَئِكَ يُنَادَوْنَ مِنْ مَكَانٍ بَعِيْدٍ-

‘... বলুন এটা (কুরআন) বিশ্বাসীদের জন্য পথ প্রদর্শক ও আরোগ্যকারী। আর যারা (একে) বিশ্বাস করে না, তাদের কানে রয়েছে বধিরতা, আর তারা এ থেকে অন্ধ। যেন তাদেরকে দূরবর্তী স্থান থেকে আহবান করা হচ্ছে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৪৪)

অর্থাৎ যারা কুরআনকে বিশ্বাস করে না ও তা থেকে ফায়দা উঠাতে চায় না, তাদের অবস্থা এমন যেমন কাউকে দূর থেকে ডাকা হয়। অথচ সে শুনতেও পায় না, দেখতেও পায় না। যারা মুত্তাক্বী নয়, তাদের অবস্থা অনুরূপ। কুরআন থেকে তারা উপকৃত হ’তে পারে না। যেমন অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَنُنَزِّلُ مِنَ الْقُرْآنِ مَا هُوَ شِفَاءٌ وَرَحْمَةٌ لِلْمُؤْمِنِيْنَ وَلاَ يَزِيْدُ الظَّالِمِيْنَ إِلاَّ خَسَارًا ‘আমরা কুরআনে এমন সব বিষয় নাযিল করেছি যা আরোগ্যকারী এবং বিশ্বাসীদের জন্য রহমত স্বরূপ এবং যা সীমা লংঘনকারীদের জন্য কেবল ক্ষতিই বৃদ্ধি করে’ (বনু ইসরাঈল ১৭/৮২)। অত্র আয়াতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কুরআন যেমন সত্যসেবীদের জন্য পথ প্রদর্শক, তেমনি এর প্রতি অবিশ্বাসী ও অনীহা প্রদর্শনকারীদের জন্য কঠিন বিপদ ও গযবের কারণ।

(৩)الَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِالْغَيْبِ وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ ‘যারা গায়েবে বিশ্বাস করে ও ছালাত কায়েম করে এবং আমরা তাদেরকে যে রূযী দান করেছি, তা থেকে ব্যয় করে’।

অত্র আয়াতে মুত্তাক্বীদের ছিফাত ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনটি গুণ বর্ণিত হয়েছে। ১. অদৃশ্যে বিশ্বাস ২. ছালাত কায়েম করা এবং ৩. আল্লাহর পথে ব্যয় করা।

প্রথমতঃ অদৃশ্যে বিশ্বাস। এর অর্থ কি? আল্লাহ বলেন, إِنَّ الَّذِيْنَ يَخْشَوْنَ رَبَّهُمْ بِالْغَيْبِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيْرٌ ‘নিশ্চয়ই যারা তাদের প্রভুকে না দেখে ভয় করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার’ (মুলক ৬৭/১২)। এই ভয় হ’তে হবে একথা জেনে-বুঝে যে, এ সৃষ্টিজগত আপনা-আপনি সৃষ্টি হয়নি এবং আপনা-আপনি পরিচালিত হচ্ছে না। বরং নিশ্চিতভাবেই এর একজন সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা আছেন, যাঁর কুশলী বিধান ও দূরদর্শী পরিকল্পনা মতে পুরা সৃষ্টিজগত সুশৃংখলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا يَخْشَى اللهَ مِنْ عِبَادِهِ الْعُلَمَاءُ ‘বান্দাগণের মধ্যে আল্লাহকে ভয় করে কেবল তারাই যারা জ্ঞানী’ (ফাত্বির ৩৫/২৮)

এখানে জ্ঞানী অর্থ সূক্ষ্মদর্শী ও বিজ্ঞানী, যারা সৃষ্টিতত্ত্ব উপলব্ধি করে এবং সৃষ্টি কৌশলসমূহ প্রমাণ সহকারে জেনে-বুঝে আল্লাহর অস্তিত্ব বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান অর্জন করে। বোকা মানুষ সবকিছু চর্মচক্ষুতে দেখতে চায়। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই সে বুঝতে পারে যে, তার জীবনটা সর্বদা অদৃশ্য শক্তির ইঙ্গিতেই পরিচালিত হচ্ছে। মায়ের গর্ভ থেকে সে পৃথিবীতে এসেছিল ছোট একটি শিশু হিসাবে। অথচ এখন সে সাড়ে তিনহাত দীর্ঘ তরতাজা এক নওজোয়ান। কে তাকে টেনে লম্বা করলো? সে সবকিছু খেয়ে হযম করে। কিন্তু কিভাবে তার খাদ্য হযম হয়। কিভাবে ঐ খাদ্য থেকে রক্ত, গোশত, তাপ ও শক্তি সৃষ্টি হয় এবং অপ্রয়োজনীয় অংশ পেশাব ও পায়খানা হয়ে বেরিয়ে যায়, সেই কৌশল সে কি কখনো প্রত্যক্ষ করেছে? অথচ পেট তার সাথেই রয়েছে সর্বদা-সর্বক্ষণ। একটু পেট ব্যথা বা মাথা ব্যথা হ’লেই মুখের হাসি মিলিয়ে যায়, সামান্য ডায়রিয়া হ’লেই বিছানায় সটান হয়ে পড়তে হয়, হাতের নাগালের মধ্যেই নিজের পেটটা থাকলেও তার উপরে তার কোনই নিয়ন্ত্রণ নেই। তাহ’লে কে ওটাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন? কে ঐ মাথার মধ্যে মস্তিষ্ক ও চিন্তাশক্তি দান করলেন? বুকের মধ্যে হৃৎপিন্ড দান করলেন? একই পিতা-মাতার পাঁচটি সন্তান। কেন সবার মেধা ও প্রতিভা, যোগ্যতা ও ক্ষমতা সমান হ’ল না? একজনের হাতে কলম দিলে লাইনের পর লাইন নির্ভুলভাবে লিখে যায়, আরেকজন কলম হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকেও দু’লাইন লিখতে পারে না, এসবের জবাব বস্ত্তবাদী নাস্তিকদের কাছে আছে কি? এক সেকেন্ড পরেই তার জীবনে কি ঘটতে যাচ্ছে, সেকথা যে মানুষ বলতে পারে না, তাকে তো একথা মানতেই হবে যে, সে অবশ্যই কোন অদৃশ্য শক্তি দ্বারা প্রতি মুহূর্তে পরিচালিত হচ্ছে। তিনিই তো আল্লাহ, যিনি সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা, যিনি আদি ও যিনি অন্ত, যিনি চিরঞ্জীব ও সব কিছুর ধারক। বস্ত্ততঃ এটাই হ’ল গায়েবে বিশ্বাসের মূল কথা। মুত্তাক্বী হবার প্রথম ও প্রধান গুণ হ’ল এটাই।

আবুল ‘আলিয়াহ বলেন, গায়েবে বিশ্বাস বলতে আল্লাহ, ফেরেশতা, আল্লাহর কিতাব সমূহ, তাঁর রাসূলগণ, বিচার দিবস, পরকাল ইত্যাদি সবকিছুকে বুঝায়। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি বান্দার চোখের বাইরে যা কিছু রয়েছে এবং যা কিছু কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, সবকিছু গায়েবে বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত’ (ইবনু কাছীর)

(ক) আব্দুর রহমান ইবনু ইয়াযীদ বলেন, একদিন আমরা হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর নিকটে বসেছিলাম। এ সময় আমরা আল্লাহর নবী (ছাঃ)-এর ছাহাবীগণ সম্পর্কে এবং কোন বিষয়ে তাঁরা অগ্রণী ছিলেন, সে সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তখন আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বললেন, মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কাজ-কর্ম পরিষ্কার ছিল যারা তাঁকে দেখেছেন। সেই সত্তার কসম করে আমি বলছি, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, مَا آمَنَ أَحَدٌ قَطُّ إِيْمَانًا أَفْضَلَ مِنْ إِيمَانٍ بِغَيْبٍ ‘অদৃশ্যে বিশ্বাস স্থাপনের চাইতে বড় ঈমান আর নেই’। অতঃপর তিনি ‘আলিফ লাম মীম’ থেকে ‘মুফলেহূন’ পর্যন্ত পাঁচটি আয়াত তেলাওয়াত করেন’।[2] তিনি একে শায়খায়নের শর্তানুযায়ী ছহীহ বলেন এবং যাহাবী তা সমর্থন করেন।

(খ) আবু জুম‘আহ আনছারী (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে দুপুরের খানা খাচ্ছিলাম। এ সময় আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের চাইতে উত্তম কেউ আছে কি? আমরা আপনার কাছে ইসলাম কবুল করেছি এবং আপনার সাথে জিহাদ করেছি। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, قَوْمٌ يَكُوْنُوْنَ مِنْ بَعْدِىْ يُؤْمِنُوْنَ بِىْ وَلَمْ يَرَوْنِىْ ‘হ্যাঁ। তারা হ’ল আমার পরবর্তী লোকেরা, যারা আমার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করবে অথচ তারা আমাকে দেখেনি’।[3]

(গ) প্রায় একই মর্মে হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, যেখানে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন,يَا رَسُولَ اللهِ، هَلْ مِنْ قَوْمٍ أَعْظَمُ أَجْرًا مِنَّا؟ آمَنَّا بِكَ وَاتَّبَعْنَاكَ ‘আমাদের চাইতে অধিক পুরস্কারের অধিকারী কেউ আছে কি? আমরা আপনার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছি এবং আপনার পদাংক অনুসরণ করেছি’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَا يَمْنَعُكُمْ مِنْ ذَلِكَ وَرَسُوْلُ اللهِ بَيْنَ أَظْهُرِكُمْ يَأْتِيْكُمْ بِالْوَحْيِ مِنَ السَّمَاءِ، بَلْ قَوْمٌ مِنْ بَعْدِكُمْ يَأْتِيْهِمْ كِتَابٌ بَيْنَ لَوْحَيْنِ يُؤْمِنُوْنَ بِهِ وَيَعْمَلُوْنَ بِمَا فِيْهِ، أُولَئِكَ أَعْظَمُ مِنْكُمْ أَجْرًا مَرَّتَيْنِ ‘ঐ মহাপুরষ্কার থেকে তোমাদের কে বাধা দিবে? এমতাবস্থায় যে, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তোমাদের মধ্যে আছেন, যিনি তোমাদের নিকটে আসমান থেকে ‘অহী’ নিয়ে আসছেন। বরং অধিক পুরষ্কারের মালিক হবে তারাই, যারা তোমাদের পরে আসবে। যাদের নিকটে দুই মলাটে মোড়ানো কিতাব (কুরআন) আসবে, যার উপরে তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং সে অনুযায়ী আমল করবে। তারা তোমাদের চাইতে দ্বিগুণ পুরস্কারের মালিক হবে’।[4]

একদিন তিনি ছাহাবীগণের মাঝে অবস্থানকালে বলেন,وَدِدْتُ أَنِّيْ لَقِيْتُ إِخْوَانِيْ ‘আমি আমার ভাইদের সাথে সাক্ষাতের আকাংখা পোষণ করছি।’ ছাহাবীগণ বললেন, আমরা কি আপনার ভাই নই? তিনি বললেন,أَنْتُمْ أَصْحَابِيْ وَلَكِنْ إِخْوَانِيْ الَّذِيْنَ آمَنُوْا بِيْ وَلَمْ يَرَوْنِيْ ‘তোমরা আমার সাথী। আর আমার ভাই হ’ল তারা, যারা আমাকে না দেখেই আমার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করেছে’।[5]

ইমাম কুরতুবী বলেন, আলোচ্য আয়াতে ‘ঈমান বিল গায়েব’ বলতে ‘ঈমানে শারঈ’ বুঝানো হয়েছে, যা হাদীছে জিব্রীলে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে ‘ঈমান কি?’ জিব্রীলের এমন প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছিলেন,أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلاَئِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. قَالَ صَدَقْتَ ‘তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে আল্লাহর উপর, তাঁর ফেরেশতাগণের উপরে, তাঁর কিতাব সমূহের উপরে, তাঁর রাসূলগণের উপরে, বিচার দিবসের উপরে এবং তুমি বিশ্বাস স্থাপন করবে তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপরে’। জিব্রীল বলেন, আপনি সঠিক বলেছেন’।[6] বস্ত্ততঃ উপরোক্ত বিষয়গুলির সবই গায়েবী বিষয়।

وَيُقِيْمُوْنَ الصَّلاَةَ অর্থাৎ মুত্তাক্বী তারাই যারা ছালাতের ফরয-ওয়াজিব-সুন্নাত, কিয়াম-কুঊদ, রুকূ-সুজূদ, ওযূ এবং ছালাতের ওয়াক্তের যথাযথ হেফাযত করে। ইবনু আববাস, ক্বাতাদাহ প্রমুখ একথা বলেন (ইবনু কাছীর)। ... অন্যত্র আল্লাহ মুছল্লীর ব্যাখ্যায় বলেন, الَّذِيْنَ هُمْ عَلَى صَلاَتِهِمْ دَائِمُوْنَ ‘যারা নিয়মিতভাবে সর্বদা ছালাত আদায় করে’ (মা‘আরেজ ৭০/২৩)। এর অর্থ, যারা সর্বদা ছালাত আদায় করে। হযরত ওমর (রাঃ)-এর বক্তব্যে একথার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি বলেন, مَنْ حَفِظَهَا وَحَافَظَ عَلَيْهَا حَفِظَ دِيْنَهُ، وَمَنْ ضَيَّعَهَا فَهُوَ لِمَا سِوَاهَا أَضْيَعُ ‘যে ব্যক্তি ছালাতের হেফাযত করল এবং তার উপরে নিষ্ঠাবান রইল, সে ব্যক্তি তার দ্বীনকে রক্ষা করল এবং যে ব্যক্তি ছালাতকে বিনষ্ট করল, সে ব্যক্তি অন্য সবকিছুর চাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হ’ল’।[7]

وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُوْنَ মুত্তাক্বীদের তৃতীয় গুণ হ’ল এই যে, আল্লাহ তাদেরকে যাকিছু খাদ্য-পানীয় ইত্যাদি দান করেছেন, তা থেকে তারা আল্লাহর পথে ব্যয় করে। জ্ঞান, স্বাস্থ্য ও চিন্তাশক্তি ইত্যাদি আল্লাহর দেওয়া অন্যতম মূল্যবান রিযিক। এগুলিকে মুত্তাক্বীগণ আল্লাহর পথে ব্যয় করে থাকেন। তবে অত্র আয়াতে খাদ্য ও ধন-সম্পদকেই বুঝানো হয়েছে।

ইবনু কাছীর বলেন, ফরয যাকাত সহ সকল প্রকার দান-ছাদাকা একথার মধ্যে শামিল রয়েছে। এজন্য ফরয যাকাত কে ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, بُنِىَ الإِسْلاَمُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، وَإِقَامِ الصَّلاَةِ، وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ، وَالْحَجِّ، وَصَوْمِ رَمَضَانَ ‘ইসলাম প্রতিষ্ঠিত রয়েছে পাঁচটি স্তম্ভের উপরে। (১) তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য দেওয়া এই মর্মে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল (২) ছালাত কায়েম করা (৩) যাকাত আদায় করা (৪) হজ্জ করা ও (৫) রামাযানের ছিয়াম পালন করা।[8] আলোচ্য আয়াতে কেবল ছালাত ও ইনফাক্ব ফী সাবীলিল্লাহর কথা বলা হয়েছে এ কারণে যে, ছালাত হ’ল দৈহিক ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এবং যাকাত হ’ল আর্থিক ইবাদতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাকী সব ইবাদত এ দুইয়ের অনুষঙ্গ।

(৪)وَالَّذِيْنَ يُؤْمِنُوْنَ بِمَا أُنْزِلَ إِلَيْكَ وَمَا أُنْزِلَ مِنْ قَبْلِكَ وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ ‘এবং যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ঐ সকল বিষয়ে, যা আপনার প্রতি নাযিল হয়েছে এবং যা আপনার পূর্ববর্তীগণের প্রতি নাযিল হয়েছিল। আর পরকালীন জীবনের উপরে যারা নিশ্চিত বিশ্বাস পোষণ করে’।

অত্র আয়াতে মুত্তাক্বীদের চতুর্থ ও পঞ্চম গুণ বর্ণিত হয়েছে। চতুর্থটি হচ্ছে কুরআন ও হাদীছ, যা রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি নাযিল হয়েছে, তার উপরে ঈমান আনা এবং যে সকল কিতাব ও শরী‘আত পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণের উপরে নাযিল হয়েছিল, সেগুলির উপরে ঈমান আনা। যেমন ইবরাহীম (আঃ)-এর উপরে ছহীফা সমূহ, মূসা (আঃ)-এর উপরে তওরাত, দাঊদ (আঃ)-এর উপরে যবূর, ঈসা (আঃ)-এর উপরে ইনজীল প্রভৃতি। মুত্তাক্বীগণ বিগত সকল নবী ও রাসূলগণ এবং তাঁদের আনীত কিতাব ও শরী‘আতের উপরে ঈমান রাখেন এই মর্মে যে, ঐ সকল কিতাব আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছিল এবং সেগুলি সে যুগের নবীগণের স্ব স্ব গোত্রের জন্য পালনীয় ছিল। অতঃপর বিশ্বমানবের জন্য সর্বশেষ নবী ও সর্বশেষ এলাহী কিতাব আসার পরে বিগত সব কিতাবের হুকুম রহিত হয়ে গেছে। এলাহী কিতাব ও শরী‘আতের উপরে বিশ্বাস এভাবে রাখতে হবে যে, এগুলি আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। এর মধ্যে নবীর কপোল কল্পিত কিছুই নেই এবং এ বিশ্বাস রাখতে হবে যে, এলাহী কিতাব ও শরী‘আতের বিধি-বিধান সমূহ মানব কল্যাণে সর্বোচ্চ ও অতুলনীয়। মানব রচিত কোন বিধান এর চাইতে উত্তম নয় বা এর সমতুল্য নয়।

আলোচ্য আয়াতের ব্যাখ্যা অন্যত্র এসেছে। যেমন আল্লাহ বলেন,قُوْلُوْا آمَنَّا بِاللهِ وَمَا أُنْزِلَ إِلَيْنَا وَمَا أُنْزِلَ إِلَى إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْمَاعِيْلَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوْبَ وَالْأَسْبَاطِ وَمَا أُوْتِيَ مُوْسَى وَعِيْسَى وَمَا أُوتِيَ النَّبِيُّوْنَ مِنْ رَبِّهِمْ لاَ نُفَرِّقُ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْهُمْ وَنَحْنُ لَهُ مُسْلِمُوْنَ ‘তোমরা বলো আমরা ঈমান এনেছি আল্লাহর উপর এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে আমাদের প্রতি এবং যা অবতীর্ণ হয়েছে ইবরাহীম, ইসমাঈল, ইসহাক্ব, ইয়াকূব ও তাঁর বংশধরগণের প্রতি এবং যা দান করা হয়েছে মূসা ও ঈসাকে এবং যা দান করা হয়েছে নবীগণকে তাঁদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে। আমরা তাঁদের কারুর মধ্যে প্রভেদ করি না। আমরা তাঁরই প্রতি আত্মসমর্পণকারী’ (বাক্বারাহ ২/১৩৬; কাছাকাছি প্রায় একইরূপ বক্তব্য এসেছে বাক্বারাহ ২/২৮৫ ও আলে ইমরান ৩/৮৪ এবং নিসা ৪/১৩৬ আয়াতে)

শেষ যামানায় ‘কুরআন’ ও ‘ইসলাম’ আসার পরে এখন আর কোন এলাহী কিতাব ও দ্বীন নেই। বিগত সকল কিতাব এখন অস্তিত্বহীন হয়ে গেছে। ইহুদী-নাছারাসহ বিগত সকল দ্বীন এখন বাতিল হয়ে গেছে। এখন ইসলামই বিশ্বমানবতার জন্য একমাত্র দ্বীন। যেমন আল্লাহ বলেন, إِنَّ الدِّيْنَ عِنْدَ اللهِ الْإِسْلاَمُ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে তাঁর মনোনীত দ্বীন হ’ল ইসলাম’ (আলে ইমরান ৩/১৯)। ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন আল্লাহর নিকটে গৃহীত হবে না। যেমন তিনি বলেন, وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلاَمِ دِيْنًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ ‘যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কোন দ্বীন তালাশ করবে, কখনোই তা কবুল করা হবে না এবং ঐ ব্যক্তি আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে’ (আলে ইমরান ৩/৮৫)

হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, وَالَّذِى نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ لاَ يَسْمَعُ بِىْ أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الأُمَّةِ يَهُودِىٌّ وَلاَ نَصْرَانِىٌّ ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِى أُرْسِلْتُ بِهِ إِلاَّ كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ ‘যাঁর হাতে মুহাম্মাদের জীবন নিহিত তাঁর কসম করে বলছি, ইহুদী হৌক বা নাছারা হৌক, এই উম্মতের যে কেউ আমার আবির্ভাবের খবর শুনেছে, অতঃপর মারা গেছে। অথচ আমি যা নিয়ে আগমন করেছি তার উপরে ঈমান আনেনি, সে অবশ্যই জাহান্নামের অধিবাসী হবে’।[9] হাদীছে ‘এই উম্মত’ অর্থ এ যুগের সকল জিন ও ইনসান।

এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় উল্লেখযোগ্য যে, অত্র আয়াত সহ কুরআনের অন্যূন ৫০টি স্থানে ঈমানের আলোচনায় পূর্ববর্তী নবীগণের ও তাঁদের প্রতি প্রেরিত কিতাব ও ছহীফা সমূহের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কোথাও পরবর্তী কোন নবী বা কিতাবের উল্লেখ নেই। এমনকি এ বিষয়ে কোন ইশারা-ইঙ্গিতও নেই। এ বিষয়টি কুরআনের সর্বশেষ ইলাহী গ্রন্থ হওয়ার এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সর্বশেষ নবী হওয়ার একটি প্রকৃষ্ট দলীল। মূসা, দাঊদ, ঈসা প্রমুখ শ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূলগণ বনু ইসরাঈল গোত্রের নবী ছিলেন। অথচ শেষনবী সম্পর্কে আল্লাহ ঘোষণা করেন, وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيْرًا وَنَذِيْرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘আমরা আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দাতা ও জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী রূপে প্রেরণ করেছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানেনা’ (সাবা ৩৪/২৮)। সেকারণ শেষনবীর আগমনের পর থেকে ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল মানুষ শেষনবীর উম্মত হিসাবে গণ্য। তবে যারা তাঁর দাওয়াত কবুল করে মুসলমান হয়েছে, তাদেরকে বলা হয় উম্মতে ঈজাবী (أمة الإجابة) অর্থাৎ দাওয়াত কবুলকারী উম্মতে মুহাম্মাদী। বাকী সবাই أمة الدعوة অর্থাৎ তাঁর সাধারণ উম্মতের অন্তর্ভুক্ত।

এক্ষণে মুত্তাক্বীদের চতুর্থ গুণ এই হবে যে, তিনি সর্বশেষ নবী ও তাঁর আনীত শরী‘আত তথা ইসলামের প্রতি আনুগত্যশীল হবেন এবং পূর্ববর্তী সকল নবী ও ইলাহী গ্রন্থের প্রতি ঈমান রাখবেন।

وَبِالْآخِرَةِ هُمْ يُوْقِنُوْنَ ‘এবং তারা আখেরাতের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করবে’। এটি হ’ল মুত্তাক্বীদের পঞ্চম গুণ। আখেরাত অর্থ পরবর্তী, যা تأخر হ’তে ব্যুৎপন্ন। যেমন দুনিয়া অর্থ নিকটবর্তী, যা الدنو হ’তে ব্যুৎপন্ন (কুরতুবী)। এখানে আখেরাত বলতে পরকালীন জীবনকে বুঝানো হয়েছে, যা মৃত্যুর পরে শুরু হবে। এর মধ্যে কবর, কিয়ামত, হাশর, শেষবিচার, জান্নাত, জাহান্নাম সবকিছু শামিল রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ইতিপূর্বে يُؤْمِنُوْنَ ক্রিয়াপদ ব্যবহার করা হ’লেও আখেরাত বিশ্বাসের ক্ষেত্রে يُوْقِنُوْنَ ক্রিয়াপদ ব্যবহারের মাধ্যমে এই বিশ্বাসের দৃঢ়তার প্রতি অধিক জোর দেওয়া হয়েছে।

‘ইয়াক্বীন’ অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস, যার মধ্যে সন্দেহের অবকাশ থাকে না (العلم دون الشك)। যেমন কিয়ামত দিবস সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, كَلاَّ لَوْ تَعْلَمُوْنَ عِلْمَ الْيَقِيْنِ ‘কখনোই না। যদি তোমরা নিশ্চিত জ্ঞান রাখতে’ (তাকাছুর ১০২/৫)। অর্থাৎ যদি তোমরা কিয়ামত সম্পর্কে আজকে নিশ্চিত জানতে, যা পরে জানবে, তাহ’লে অবশ্যই তোমরা আল্লাহ ও আখেরাত সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাসী হ’তে এবং কোনমতেই তা থেকে গাফেল হ’তে না।

বস্ত্ততঃ নবীগণের দর্শন ব্যতীত অন্যদের দর্শনে পার্থিব জীবনই সবকিছু। পরকালীন জীবন বলে কিছু নেই। যেমন প্লেটো ও এরিষ্টটলের দর্শনে পরজগত বলে কিছু নেই। মৃত্যুর সাথে সাথে মানুষ পরম সত্তার মধ্যে লীন হয়ে যাবে। এই অদ্বৈতবাদী দর্শনের ফলে খৃষ্টীয় ৭ম শতাব্দীর আগেকার ইউরোপীয় মানুষ স্বাভাবিক ভাবেই সংসার বিরাগী অথবা চরম বস্ত্তবাদী হয়ে যায়। কেননা মরার পরেই যখন সব শেষ, তখন মানুষ যা খুশী তাই করুক। ভারতীয়দের মধ্যেও এই নাস্তিক্যবাদী প্লেটোনিক দর্শনের অনুপ্রবেশ ঘটে। তাদের মতে মানব জন্মে যদি কেউ পাপকর্ম করে, তাহলে তাকে পরজন্মে পশু-পক্ষী, গাছ-পাথর ইত্যাদি যেকোন রূপে জন্মগ্রহণ করতে হবে। এটাই হ’ল জন্মান্তরবাদ। যতদিন তার পাপ স্খলন না হবে, ততদিন তাকে জন্মান্তরের বেড়াজালে ঘুরপাক খেতে হবে। আর যখন সে মুক্তি পাওয়ার মত কোন কর্ম করবে, তখন সে ব্রহ্মায় অর্থাৎ পরম সত্তায় লীন হয়ে যাবে। কেননা সকল জীবাত্মা ভগবানের অংশ বিশেষ’। হিন্দু দর্শনের ন্যায় বৌদ্ধ দর্শনেও পরকাল বলে কিছু নেই। সেখানে জীবন যন্ত্রণা থেকে বাঁচার জন্য ‘নির্বাণ’ অর্থাৎ মহাপ্রস্থান কামনা করা হয়েছে। যার পর কোন প্রত্যাবর্তন নেই। বস্ত্ততঃ এটা হ’ল জীবন থেকে পলায়নের দর্শন। এ দর্শনে মৃত্যুর পর মানুষের আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই। এভাবে গ্রীক দর্শন, বেদান্ত দর্শন, বৌদ্ধ দর্শন প্রভৃতি মানুষকে তার জীবনবোধ সম্পর্কে গভীর নৈরাশ্যের ঘোর অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছে। উল্লেখ্য, মুসলমান নামধারী মা‘রেফতী পীর-ফকীরদের মধ্যে যে কবরপূজা, ফানাফিল্লাহ, বাক্বাবিল্লাহ প্রভৃতি দেখা যায়, তা ঐসব কুফরী দর্শন থেকে অনুপ্রবেশ করেছে।

আরব উপদ্বীপে সর্বদা নবীদের শিক্ষা জাগরুক থাকলেও ঈসা (আঃ) থেকে মুহাম্মাদ (ছাঃ) পর্যন্ত প্রায় ছয়শো বছরের দীর্ঘ বিরতিকালে তাদের মধ্যেও এইসব বাতিল চিন্তাধারার ঢেউ লাগে। যা তাদের পরজাগতিক বিশ্বাসকে হালকা করে দেয়। ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এসে যখন তাদের কিয়ামতের কথা ও পরকালে জান্নাত ও জাহান্নামের কথা শুনান, তখন তারা হতবাক হয়ে বলে ওঠে أَإِذَا مِتْنَا وَكُنَّا تُرَابًا ذَلِكَ رَجْعٌ بَعِيْدٌ ‘যখন আমরা মরে মাটি হয়ে যাব। আবার সেখান থেকে ফিরে জীবন্ত হয়ে উঠব, এটা তো খুবই দূরতম ব্যাপার’ (ক্বাফ ৫০/৩)

বস্ত্ততঃ আখেরাতে জবাবদিহিতা এবং ভাল-মন্দ ফলাফলের বিশ্বাস থাকলেই কেবল মানুষ দুনিয়াতে মঙ্গলময় জীবন যাপন করতে পারে। নইলে তার জীবন হয় ছন্নছাড়া। যা কোন জীবনই নয়।

ইতিপূর্বে ‘ইউমিনূন’ শব্দ ব্যবহার করা হলেও আখেরাতের বেলায় আল্লাহ ‘ইউক্বিনূন’ শব্দ ব্যবহার করেছেন এদিকে ইঙ্গিত করার জন্য যে, কেবল বিশ্বাস নয় বরং দৃঢ় প্রত্যয় রাখতে হবে। যা কেবল চোখে দেখা বস্ত্ত সম্পর্কেই হ’তে পারে। আখেরাতের উপরে দৃঢ় বিশ্বাস আনার ফলেই আরবদের জীবনে এসেছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আজও তা যেকোন মানুষের জীবনে সম্ভব। প্রয়োজন কেবল দৃঢ় প্রত্যয়ের।

বলা বাহুল্য এ সৃষ্টিজগতের সবকিছুই আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন তাঁর সেরা ও প্রিয় সৃষ্টি মানুষের সেবার জন্য। অথচ মাত্র অনধিক একশ’ বছরের মধ্যেই মানুষ মৃত্যুবরণ করছে। যার মধ্যে যালেম যুলুম করেও প্রশংসা পাচ্ছে। অন্যদিকে নিরপরাধ মযলূম অত্যাচারিত হয়েও বদনামগ্রস্ত হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিচ্ছে। তাহ’লে যালেমের যুলুমের শাস্তি এবং মযলূমের যথাযথ পুরস্কার পাবার পথ কি? সেটারই জওয়াব হ’ল পরকাল। মৃত্যুর পরেই যার সূচনা হয় এবং শেষ বিচারের দিন যা চূড়ান্ত হয়। অতঃপর যালেম জাহান্নামী হয়ে তার যোগ্য শাস্তি পায় এবং ঈমানদার মযলূম জান্নাতী হয়ে তার যোগ্য প্রতিদান পেয়ে ধন্য হয়। আল্লাহর হুকুমে যে রূহ মায়ের গর্ভে প্রেরিত হয়। তাঁরই হুকুমে সে রূহ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর কাছে ফিরে যায় এবং নেককার রূহ ইল্লিয়ীনে ও বদকার রূহ সিজ্জীনে স্থিত হয়। অতঃপর কিয়ামতের পর তা পুনরায় স্ব স্ব দেহে সংযোজিত হয়ে আল্লাহর সম্মুখে বিচারের জন্য নীত হয়। অতঃপর সে হয় জান্নাতী নয় জাহান্নামী হবে। সে কখনোই আল্লাহর সত্তায় লীন হয়ে যাবে না। কেননা সৃষ্টিকর্তা ও সৃষ্টি কখনোই এক নয়। অতএব মানুষের জীবন একটি চলন্ত প্রক্রিয়া। আল্লাহর নিকট থেকে এর আগমন। অতঃপর দুনিয়াতে তার সাময়িক অবস্থান। অতঃপর ফের সেখানেই প্রত্যাবর্তন, যেখান থেকে সে এসেছিল। অতঃপর সেখানেই তার চিরস্থায়ী নিবাস। দুনিয়ার এ মুসাফিরখানা হ’ল দারুদ্দুনিয়া, কবরের অপেক্ষমান জগত হ’ল দারুল বারযাখ এবং আখেরাতের চিরস্থায়ী জগত হ’ল দারুল ক্বারার (মুমিন ৪০/৩৯)। আখেরাতের উপরে এই দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করা তাই মুমিন জীবনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি। আল্লাহ আমাদের আখেরাত বিশ্বাসকে মযবূত করুন- আমীন!

(৫) أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ وَأُولَئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ ‘ঐ সকল মানুষ তাদের প্রভুর দেখানো পথের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই সফলকাম’।

‘সফলকাম’ অর্থ الْفَائِزُونَ بِالْجَنَّةِ وَالْبَاقُونَ فِيهَا ‘জান্নাতের অধিকারী ও সেখানে অবস্থানকারী’ (কুরতুবী)। অত্র আয়াতে বলা হয়েছে যে, পূর্বে বর্ণিত ছয়টি গুণের অধিকারী ব্যক্তিগণ আল্লাহ প্রদত্ত নূর ও হেদায়াতের উপরে কায়েম থাকে। যার ফলে তারা ইহকাল ও পরকালে সফলকাম হয়। দুনিয়াতে বাহ্যদৃষ্টিতে অনেক মুমিন নর-নারীকে বিফল মনে হলেও তারা আখেরাতে অবশ্যই সফলকাম হয় এবং আখেরাতের সফলতাই হ’ল প্রকৃত সফলতা। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ তাকে প্রবেশ করাবেন জান্নাতে, যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হয় নদী সমূহ। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহান সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)।

উল্লেখ্য যে, هُدًى مِنْ رَبِّهِمْ কথার মধ্যে তাক্বদীরে অবিশ্বাসী ভ্রান্ত ফের্কা ক্বাদারিয়াদের প্রতিবাদ রয়েছে। তারা এর ব্যাখ্যা করেন يَخْلُقُونَ إِيمَانَهُمْ وَهُدَاهُمْ ‘তারা তাদের ঈমান ও হেদায়াত সৃষ্টি করে’। অর্থাৎ বান্দাই তার কাজের সৃষ্টিকর্তা, আল্লাহ নন। তাদের এ বক্তব্য সঠিক হলে তো আল্লাহ এখানে বলতেন أَنْفُسِهِمْ أُولَئِكَ عَلَى هُدًى مِنْ ‘মুত্তাক্বীরা তাদের নিজেদের পক্ষ হ’তে হেদায়াতের উপরে প্রতিষ্ঠিত’ (কুরতুবী)। বস্ত্ততঃ ‘হেদায়াত’ আল্লাহর পক্ষ হ’তেই এসে থাকে। তিনিই তার নেক বান্দাদের অন্তরে সুপথ গ্রহণের শক্তি ও যোগ্যতা দান করেন। এটা মানুষের ক্ষমতার বাইরে। যেমন তিনি স্বীয় রাসূলকে বলেন, إِنَّكَ لاَ تَهْدِي مَنْ أَحْبَبْتَ وَلَكِنَّ اللهَ يَهْدِي مَنْ يَشَاءُ وَهُوَ أَعْلَمُ بِالْمُهْتَدِيْنَ ‘আপনি যাকে চান, তাকে হেদায়াত করতে পারেন না। বরং আল্লাহ যাকে চান তাকে হেদায়াত দান করেন এবং হেদায়াত প্রাপ্তদের বিষয়ে তিনিই সর্বাধিক জ্ঞান রাখেন’ (ক্বাছাছ ২৮/৫৬)। যদিও হেদায়াত গ্রহণের স্বাভাবিক যোগ্যতা আল্লাহ প্রত্যেক মানুষের মধ্যে দান করেছেন। যেমন তিনি বলেন, فَأَقِمْ وَجْهَكَ لِلدِّيْنِ حَنِيفًا فِطْرَتَ اللهِ الَّتِي فَطَرَ النَّاسَ عَلَيْهَا لاَ تَبْدِيْلَ لِخَلْقِ اللهِ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لاَ يَعْلَمُونَ ‘তুমি তোমার চেহারাকে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের উপরে দৃঢ় রাখ। এটাই হ’ল আল্লাহর দেয়া স্বভাবধর্ম। যার উপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই হ’ল সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানেনা’ (রূম ৩০/৩০)।

মানুষকে তাই হেদায়াত লাভের তাওফীক কামনা করে সর্বদা আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করতে হবে এবং এজন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাতে হবে। কেননা সে জানেনা যে সে হেদায়াত প্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত কি-না। এটাতো কেবল আল্লাহ জানেন। সেকারণেই সূরা ফাতিহাতে ছিরাতে মুস্তাক্বীমের হেদায়াত নবী ও সাধারণ মানুষ সবাইকে চাইতে বলা হয়েছে। তাকদীরে অবিশ্বাসীগণ আল্লাহর এই ক্ষমতাকে নিজেদের হাতে নিতে চায়। এটা নিতান্তই হঠকারিতা মাত্র।

আলোচ্য আয়াতগুলিতে মুত্তাক্বীদের ছয়টি গুণ বর্ণিত হয়েছে। যথা- (১) অদৃশ্যে বিশ্বাস (২) ছালাত কায়েম করা (৩) আল্লাহর পথে ব্যয় করা (৪) কুরআন ও হাদীছে বিশ্বাস স্থাপন করা (৫) পূর্ববর্তী ইলাহী ক্বিতাবসমূহ বিশ্বাস করা এবং (৬) আখেরাতে দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা। আল্লাহ আমাদেরকে উপরোক্ত গুণাবলী অর্জনের তাওফীক দান করুন- আমীন।


[1]. বায়হাক্বী, যুহদুল কাবীর ১/৩৫০, সনদে হিশাম বিন যিয়াদ আছেন, যাঁর মধ্যে দূর্বলতা রয়েছে

[2]. হাকেম হা/৩০৩৩, ২/২৬০, যাহাবী ছহীহ বলেছেন

[3]. আহমাদ হা/১৭০১৭; মিশকাত হা/৬২৮২, সনদ ছহীহ

[4]. ইবনু হাজার, আল-ইছাবাহ; হাকেম ৪/৮৫; বুখারী, তারীখ কাবীর ২/৩১১, ত্বাবারাণী, মু‘জামুল আওসাত্ব, সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩৩১০

[5]. আহমাদ হা/১২৬০১; ছহীহাহ হা/২৮৮৮

[6]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/২

[7]. কুরতুবী, মিশকাত হা/৫৮৫, সনদ যঈফ

[8]. বুখারী হা/৮, মুসলিম হা/১৬, মিশকাত হা/৪

[9]. মুসলিম হা/১৫৩; মিশকাত হা/১০