বাঁচার পথ

আধুনিক জাহেলিয়াত তার সর্বগ্রাসী প্রতারণার জাল ফেলে মানবতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও বিচারব্যবস্থা সবই আল্লাহ বিরোধী। এমনকি ধর্মনীতিতেও জমাট বেঁধেছে ধর্মনেতাদের বানোয়াট রীতিনীতি ও অগণিত শিরক ও বিদ‘আতের জঞ্জাল। আজ সত্যের হাত-পা বাঁধা। মিথ্যার রয়েছে বল্গাহীন স্বাধীনতা। এমতাবস্থায় মানুষের বাঁচার পথ কি? আমরা মনে করি, সামনে মাত্র তিনটি পথ খোলা রয়েছে। ১. পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে বাতিলকে অাঁকড়ে ধরা। ২. হক-এর উপর দৃঢ় থেকে বাতিলপন্থীদের হামলায় ছবর করা। ৩. বাতিলকে সাহসের সাথে মুকাবিলা করে হক-এর বিজয় লাভের পথ সুগম করা।

উপরোক্ত তিনটি পথের মধ্যে প্রথমটি কোন বাঁচার পথ নয়, বরং ওটা মরণের পথ। দ্বিতীয়টি সাময়িকভাবে গ্রহণ করা গেলেও স্থায়ীভাবে গ্রহণ করলে তার পরিণতি এটাই হবে যে, তিলে তিলে মরতে হবে। যার কোন ভবিষ্যত নেই। এখন কেবলমাত্র তৃতীয় পথটাই খোলা রয়েছে। আর তা হ’ল বাতিলের সাথে আপোষ করে নয়, বরং বাতিলের মুকাবিলা করে হক-এর বিজয়ের পথ সুগম করা। এখানে বিষয় হ’ল দু’টি। ১. বাতিলের মুকাবিলা করা এবং ২. বিজয়ের পথ সুগম করা। মুকাবিলার ক্ষেত্রে হক ও বাতিল দু’টিরই নিজস্ব পথ ও পদ্ধতি রয়েছে। বাতিলের প্রতিটি গলিপথে পাহারা বসানো নিয়ম হলেও হক কখনোই বাতিলের পথে যায় না। কেননা ওটাও বাতিলের পাতানো ফাঁদ মাত্র। যেমন বাতিলপন্থীরা হকপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা ও নানাবিধ নোংরামির আশ্রয় নিলেও হকপন্থীরা তা পারে না। হকপন্থীকে হক পথে থেকে বাতিলের মুকাবিলা করতে হবে ও আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে হবে। আল্লাহ চাইলে সাহায্য করবেন ও দুনিয়াবী বিজয় দান করবেন। আর পরাজিত হলে  সেটা আগামী দিনের বিজয়ের সোপান হবে। তবে উভয় অবস্থায় হকপন্থীর জন্য আখেরাতের বিজয় সুনিশ্চিত। মক্কার নেতাদের দাবী অনুযায়ী কেবল কালেমা ত্যাগ করলেই মুহাম্মাদ (ছাঃ) সারা আরবের নেতৃত্ব পেয়ে যেতেন। অবশেষে কেবল তাদের মূর্তিগুলোকে মেনে নিয়ে যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করার আপোষ প্রস্তাবেও তিনি রাযী হননি। ফলে তিনি বাহ্যত: পরাজিত হলেন ও মক্কা ছেড়ে মদীনায় হিজরত করতে বাধ্য হলেন। কিন্তু মক্কার নেতাদের বিজয়ের হাসি বেশী দিন স্থায়ী হয়নি। মাত্র আট বছরের মাথায় মুহাম্মাদ (ছাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন বিজয়ীর বেশে। পুরা মক্কা ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সেদিন বিনাযুদ্ধে তাঁর করতলগত হয় এবং সবাই তাঁর দ্বীন কবুল করে নেয়। এ বিজয় ছিল আদর্শের বিজয়। সত্যের বিজয়। যা স্রেফ আল্লাহর গায়েবী মদদেই সম্ভব হয়েছিল। অতএব হক-এর উপর দৃঢ় থেকেই বাতিলের মুকাবিলা করতে হবে। বাতিলের সাথে আপোষ করে বাতিলের দেখানো পথে গিয়ে কখনোই বাতিল হটানো যায় না। আর এটাই বাস্তব যে, হক ও বাতিল আপোষ করলে বাতিল লাভবান হয় এবং হক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাতিলের যুক্তিসমূহ বড়ই মনোহর ও লোভনীয়। তাই হকপন্থীরা অনেক সময় পদস্খলিত হয়। ব্যক্তি ও সাংগঠনিক জীবনে যার অসংখ্য প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে এবং হরহামেশা ঘটছে। এমনকি বিভিন্ন দেশের ইসলামী নেতারা যারা সারা জীবন ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের জন্য কাজ করেছেন, অবশেষে বাতিলের পথ ধরে এগোতে গিয়ে বাতিলের হামলায় পরাভূত হয়েছেন। নিয়ত শুদ্ধ হলেও রাস্তা পরিবর্তন করায় শেষ মুহূর্তে তিনি পথভ্রষ্ট হলেন। আবার এমনও কিছু মানুষ এই উপমহাদেশেই ছিলেন, যারা স্রেফ আল্লাহর স্বার্থে লড়াই করেছেন নিজস্ব ঈমানী তেজে সর্বাধুনিক অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে। এমনকি বাঁশের কেল্লা দিয়ে কামানের গোলার মোকাবিলা করেছেন। তারা শহীদ হয়েছেন কিন্তু বাতিলের সঙ্গে আপোষ করেননি। ফলে তারাই হলেন জাতির প্রেরণা। তাদের সেই রক্তপিচ্ছিল পথ বেয়েই জাতি পরে স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছে।

‘মুমিনকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব’ (রূম ৩০/৪৭)। তাই বাহ্যিকভাবে পরাজিত হওয়ার অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহ তাঁর দায়িত্ব পালন করেননি (নাঊযুবিল্লাহ)। বরং এর অর্থ এই যে, বাহ্যিক এই পরাজয় তার ভবিষ্যত বিজয়ের সোপান। যা আল্লাহর ইলমে রয়েছে। কিন্তু বান্দার ইলমে নেই। মক্কায় যখন বেলালকে মেরে-পিটিয়ে হাত-পা বেঁধে নগ্নদেহে অগ্নিঝরা রোদে স্ফুলিংগ সদৃশ মরুবালুকার উপর পাথর চাপা দিয়ে নির্যাতন করা হ’ত, তখন নেতারা ভাবত, বেলালরা শেষ হয়ে গেল। কিন্তু মক্কা বিজয়ের পর যখন বেলাল কা‘বা গৃহের ছাদে দাঁড়িয়ে দরায কণ্ঠে আযান দিলেন, তখন মক্কার নেতাদের হৃদয় জ্বলে গেল। তারা বলে উঠল কি সৌভাগ্যবান আমাদের পিতারা! যে এই দৃশ্য দেখার আগেই তারা মারা গেছেন। ইয়াসির ও তার স্ত্রী সুমাইয়া মক্কায় যখন শহীদ হলেন, সাইয়িদুশ শোহাদা হামযা যখন ওহোদ প্রান্তরে শহীদ হলেন, তখন তারা জানতেন না যে, কিছুদিন পরেই তারা বিজয়ী হবেন ও মক্কা তাদের করতলগত হবে। আল্লাহ কিন্তু তাদের এই ত্যাগ ও কুরবানীর সাময়িক পরাজয়ের মাধ্যমে পরবর্তীতে স্থায়ী বিজয়ের পুরস্কার দান করেছেন। দুনিয়াতে বিজয়ের খবর না পেলেও জান্নাতে গিয়ে সকলে বিজয়ীদের মিলনমেলায় সমবেত হবেন। তাই মুমিন যদি লক্ষ্যচ্যুত না হয় এবং তার কর্মসূচী ও কর্মপদ্ধতিতে দৃঢ় থাকে, তাহ’লে জীবদ্দশায় হৌক বা মৃত্যুর পরে হৌক, তার জন্য বিজয় অবধারিত।

হক-এর বিজয়ে যিনি যতটুকু অবদান রাখবেন, তিনি ততটুকু প্রতিদান পাবেন। তিনি আল্লাহকে খুশী করার জন্য কাজ করবেন, অন্যের জন্য নয়। শয়তান নানা অজুহাত দেখিয়ে তাকে প্রতি পদে পদে বাধা দিবে এবং তার অগ্রগতিকে ব্যাহত করবে। এমতাবস্থায় আল্লাহর পথের দাঈ শয়তানকে চিহ্নিত করবে এবং তাকে পদদলিত করে নিজ কর্তব্য সাধনে এগিয়ে যাবে। ৪র্থ হিজরীতে নাজদের নেতারা এসে তাদের এলাকায় দাওয়াতের জন্য লোক চাইল। তারা তাদের নিরাপত্তার ওয়াদা করল। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) সরল বিশ্বাসে তাদের নিকটে ৭০ জন সেরা দাঈকে পাঠালেন। কিন্তু তারা ওয়াদা ভঙ্গ করে সবাইকে হত্যা করল। কিন্তু বি’রে মাঊনার এই মর্মন্তুদ ঘটনা নিয়ে কেউ কথা তুলল না। নেতার ভুল ধরল না। দ্বীন পরিত্যাগ করে চলে গেল না। কারণ সবাই কাজ করেছেন আল্লাহর জন্য। আল্লাহর ইচ্ছায় তারা পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন ও তার ইচ্ছায় শহীদ হয়েছেন। ফলে তারা হাসিমুখে জীবন দিয়েছেন। নবীর বিরুদ্ধে তাদের বা তাদের পরিবারের কারু কোন অভিযোগ ছিল না। বরং আল্লাহর পথে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করতে পেরে তারা ও তাদের পরিবারগুলি ছিল মহা খুশী।

অর্থ ও অস্ত্রধারী কপট শক্তিবলয়ের বিরুদ্ধে এখন প্রতিরোধের একটাই পথ খোলা আছে। আর তা হ’ল, আল্লাহর উপর দৃঢ় ঈমান রেখে বাতিলের বিরুদ্ধে দ্ব্যর্থহীন প্রত্যয় ঘোষণা করা এবং ঈমানদারগণের মধ্যে সীসাঢালা সাংগঠনিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহ ইচ্ছা করলে একটি কুন-এর মাধ্যমে বাতিলকে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। যেমন ইতিপূর্বে মূসা ও তাঁর নিরস্ত্র সাথীদের বিরুদ্ধে বাতিলের শিখন্ডী ফেরাঊন সসৈন্যে ডুবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। আল্লাহ তুমি হকপন্থীদের শক্তিশালী কর- আমীন! (স.স.)