ইসলামে বাক স্বাধীনতা (২য় কিস্তি)

পর্ব ১ ।

(৫) ইউসুফ বিন আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) খুওয়াইলাহ (খাওলা) বিনতে ছা‘লাবাহ থেকে বর্ণনা করেন যে, আল্লাহর কসম! আমার ও (আমার স্বামী) আউস বিন ছামেতের ব্যাপারে আল্লাহ সূরা মুজাদালাহর প্রথম দিকের আয়াতগুলি নাযিল করেছেন। তিনি বলেন, আমার অতি বৃদ্ধ স্বামী আমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন ও ক্রোধবশে বলেন, ‘তুমি আমার উপর আমার মায়ের পিঠের মত’। একথা বলে তিনি বাইরে চলে যান। পরে আমার নিকট ফিরে এলে আমি তাকে বললাম, যার হাতে খুওয়াইলার প্রাণ তাঁর কসম করে বলছি তুমি আমার নিকট আসবেনা, যতক্ষণ না আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদের ব্যাপারে কোন নির্দেশ প্রদান করেন। ...অতঃপর আমি প্রতিবেশী এক মহিলার কাছ থেকে বড় চাদর ধার করে নিয়ে পরিধান করি এবং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করি। তখন রাসূল (ছাঃ) বলেন, يَا خُوَيْلَةُ، ابْنُ عَمِّكِ شَيْخٌ كَبِيرٌ، فَاتَّقِ اللهَ فِيهِ- ‘হে খুওয়াইলাহ! তোমার চাচাতো ভাই অতি বৃদ্ধ। তার ব্যাপারে আল্লাহ্কে ভয় কর’। কিন্তু আমি কুরআন নাযিল না হওয়া পর্যন্ত অভিযোগ করতেই থাকি। হঠাৎ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বেহুঁশের মত হয়ে গেলেন, যেমনটি অহি নাযিলের সময় হয়ে থাকে। অতঃপর সেটি কেটে গেল। তখন তিনি বললেন,يَا خُوَيْلَةُ، قَدْ أَنْزَلَ اللهُ جَلَّ وَعَلاَ فِيكِ وَفِي صَاحِبِكِ، ‘হে খুওয়াইলাহ! তোমার ও তোমার স্বামীর ব্যাপারে মহান আল্লাহ কুরআন নাযিল করেছেন’। অতঃপর তিনি আমার নিকট মুজাদালাহ ১ থেকে ৪ আয়াত পর্যন্ত চারটি আয়াত পাঠ করে শুনালেন।[1] অন্য বর্ণনায় এসেছে,حَتَّى نَزَلَ فِىَّ الْقُرْآنُ، ‘যতক্ষণ না আল্লাহ আমার ব্যাপারে কুরআন নাযিল করেন’ (আহমাদ হা/২৭৩৬০ সনদ যঈফ)

ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ছাঃ) মহিলাকে বলেন,يَا خُوَيْلَةُ مَا أُمِرْنَا فِى أَمْرِكِ بِشَىْءٍ، ‘হে খুওয়াইলাহ! তোমার ব্যাপারে আমাদের কোন কিছু আদেশ করা হয়নি’। কিছুক্ষণ পর অহি নাযিল হ’ল। তখন তিনি তাকে বলেন,يَا خُوَيْلَةُ أَبْشِرِي، ‘হে খুওয়াইলাহ! তুমি সুসংবাদ গ্রহণ কর! অতঃপর তিনি তাকে সূরা মুজাদালাহ ২-৪ আয়াত ৩টি শুনিয়ে দিলেন।[2] অতঃপর বললেন, তুমি তোমার স্বামীর কাছে যাও এবং যিহারের কাফফারা আদায় কর।[3]

আবুল আলিয়াহর বর্ণনায় এসেছে, তিনি ছিলেন দৃষ্টিহীন(ضَرِيرَ الْبَصَرِ) এবং ফকীর ও বদস্বভাবের মানুষ। তিনি উক্ত কথা বলেন। কিন্তু তালাকের এরাদা করেননি (وَلَمْ يُرِدِ الطَّلاَقَ)। রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন,مَا أَعْلَمُ إِلاَّ قَدْ حَرُمْتِ عَلَيْهِ، ‘তোমার ব্যাপারে আমি এটা ব্যতীত জানিনা যে, তুমি তার উপরে হারাম হয়ে গেছ’। তখন খাওলা বলল,أَشْتَكِى إِلَى اللهِ مَا نَزَلَ بِى وَبِصِبْيَتِى- ‘আমি আল্লাহর নিকটে অভিযোগ পেশ করছি; দেখি তিনি কি নাযিল করেন আমার ব্যাপারে ও আমার সন্তানদের ব্যাপারে’। তখন রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। তাতে আয়েশা তাকে সরিয়ে দিলেন। কিছুক্ষণ পর রাসূল (ছাঃ)-এর উপরে অহি নাযিল হ’ল। তখন তিনি আয়েশাকে বললেন, মহিলাটি কোথায়? তাকে ডাক। অতঃপর আয়েশা তাকে ডেকে আনেন। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে বললেন, তুমি যাও তোমার স্বামীকে ডেকে আন। তখন মহিলাটি দ্রুত চলে গেল এবং স্বামীকে নিয়ে এল। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকট সূরা মুজাদালাহর আয়াত ৪টি শুনিয়ে দিলেন।[4]

উক্ত স্বামীর নাম আওস বিন ছামেত আনছারী। যিনি উবাদাহ বিন ছামেত আনছারী (রাঃ)-এর ভাই ছিলেন (আল-ইছাবাহ ১/১৫৬)

সাঈদ ইবনু জুবায়ের বলেন, জাহেলী যুগে যিহার ও ঈলাকে তালাক হিসাবে গণ্য করা হ’ত। অতঃপর ইসলামী যুগে ঈলার মেয়াদ চার মাস নির্ধারণ করা হয় এবং যিহারের জন্য কাফফারা আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয় (ইবনু কাছীর)। ‘ঈলা’ অর্থ কসম করা। জাহেলী আরবের লোকেরা স্ত্রী নির্যাতনের জন্য কসম করে বলত যে, তার সঙ্গে মিলিত হবেনা। এভাবে তারা এক বছর বা দু’বছর পার করে দিত। তখন তার মেয়াদ চার মাসে সীমিত করে সূরা বাক্বারাহ ২২৬ আয়াত নাযিল হয় (কুরতুবী)। অমনিভাবে তারা যদি স্ত্রীকে বলত, তুমি আমার উপর আমার মায়ের পিঠের মত’ তাহ’লে তার উপর স্ত্রী তালাক হয়ে যেত। ‘যিহার’ অর্থ পিঠ (ঐ)। 

খাওলা বিনতে ছা‘লাবাহর ঘটনাটি ছিল ইসলামী যুগে যিহারের প্রথম ঘটনা। যে প্রেক্ষিতে কাফফারার বিধান সহ সূরা মুজাদালাহ ২-৪ তিনটি আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয় যে, যিহার করা মহাপাপ। কিন্তু এর ফলে স্ত্রী কখনো মা হয়ে যায়না। 

এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, উক্ত মহিলা তার অভিযোগ নিয়ে এসেছিলেন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে। অথচ প্রার্থনা করে বলেছেন, أَشْتَكِى إِلَى اللهِ مَا نَزَلَ بِى وَبِصِبْيَتِى- ‘আমি আল্লাহর নিকটে অভিযোগ পেশ করছি; দেখি তিনি কি নাযিল করেন আমার ও আমার সন্তানদের ব্যাপারে’। এই প্রার্থনা তিনি ঘরে বসেও করতে পারতেন। কিন্তু তিনি এসেছেন আল্লাহর রাসূলের নিকট। কারণ তাঁর মাধ্যমেই আল্লাহ জবাব পাঠাবেন এবং তাঁর মাধ্যমেই বিধান বাস্তবায়িত হবে। এতে ইঙ্গিত রয়েছে ইমারত ও বায়‘আতের মাধ্যমে ইসলামী সমাজ গঠনের প্রতি। যেখানে আমীর আল্লাহর বিধান মতে সিদ্ধান্ত দিবেন। তিনি শাসন ক্ষমতার মালিক হ’লে সরাসরি বিধান বাস্তবায়ন করবেন। আর সাংগঠনিক ক্ষমতার মালিক হ’লে আল্লাহর বিধান মতে উপদেশ দিবেন ও অন্যায় থেকে তওবা করার আহবান জানাবেন।

ইসলামী যুগে শাসকের সাথে শাসিতদের সম্পর্ক কেমন সহজ ও খোলামেলা ছিল, খাওলা বিনতে ছা‘লাবাহর উক্ত ঘটনা তার একটি জাজ্বল্যমান প্রমাণ। যেমন একবার ওমর (রাঃ) দলবল নিয়ে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তখন ঐ মহিলা রাস্তায় তাঁকে দাঁড়াতে বললে তিনি দাঁড়ালেন ও তার নিকটে এগিয়ে গেলেন। অতঃপর যতক্ষণ না মহিলা তার কথা শেষ করলেন ও ফিরে গেলেন, ততক্ষণ ওমর তার সাথে কথা বললেন। এসময় একজন সাথী খলীফাকে বলল, হে আমীরুল মুমেনীন! আপনি কুরায়েশের সম্মানী লোকদের এই বৃদ্ধার জন্য আটকে রাখলেন? জবাবে খলীফা বললেন,وَيْحَكَ! وَتَدْرِي مَنْ هَذِهِ؟ ‘তোমার ধ্বংস হৌক! তুমি কি জানো এই মহিলা কে?’ লোকটি বলল, না। তখন তিনি বললেন,هَذِهِ امْرَأَةٌ سَمِعَ اللهُ شَكْوَاهَا مِنْ فَوْقِ سَبْعِ سَمَوَاتٍ، هَذِهِ خَوْلَةُ بِنْتُ ثَعْلَبَةَ وَاللهِ لَوْ لَمْ تَنْصَرِفْ عَنِّي إِلَى اللَّيْلِ مَا انْصَرَفْتُ عَنْهَا حَتَّى تَقْضِيَ حَاجَتَهَا إِلَى أَنْ تَحْضُرَ صَلاَةٌ فَأُصَلِّيَهَا ثُمَّ أَرْجِعَ إِلَيْهَا حَتَّى تَقْضِيَ حَاجَتَهَا- ‘ইনি হ’লেন সেই মহিলা, সাত আসমানের উপর থেকে যার অভিযোগ আল্লাহ শ্রবণ করেছিলেন। ইনি হ’লেন খাওলা বিনতে ছা‘লাবাহ। আল্লাহর কসম! যদি তিনি কথা শেষ না হওয়ার জন্য রাত্রি পর্যন্ত ফিরে না যেতেন, তথাপি আমি দাঁড়িয়ে থাকতাম, কেবল ছালাতের জন্য ব্যতীত। আবার তার কাছে ফিরে আসতাম। যতক্ষণ না তার প্রয়োজন শেষ হ’ত’ (আল-ইস্তী‘আব, কুরতুবী, ইবনু কাছীর)

(৬) ৯ম হিজরীতে প্রতিনিধি দল সমূহের আগমনের বছরে বনু তামীম প্রতিনিধি দল মুহাররম মাসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আগমন করে। তারা এসেيَا مُحَمَّدُ يَا مُحَمَّدُ، اُخْرُجْ إلَيْنَا- ‘হে মুহাম্মাদ! হে মুহাম্মাদ! বেরিয়ে এসো’ বলে চিৎকার দিতে থাকে। এ সময় রাসূল (ছাঃ) দুপুরে খেয়ে ঘুমাচ্ছিলেন। অতঃপর তিনি বেরিয়ে এসে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন। উক্ত ঘটনা উপলক্ষে সূরা হুজুরাত ৪-৫ আয়াত দু’টি নাযিল হয়।[5]

অতঃপর তাদের নেতা হিসাবে কাকে নির্বাচন করা হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ চাইলে আবুবকর (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে প্রস্তাব দিলেন ক্বা‘ক্বা‘ বিন মা‘বাদকে নেতা করা হৌক। কিন্তু ওমর (রাঃ) প্রস্তাব দিলেন আক্বরা‘ বিন হাবেসকে নেতা করা হৌক। তখন আবুবকর (রাঃ) বললেন,مَا أَرَدْتَ إِلاَّ خِلاَفِي، ‘তুমি কেবল আমার বিরোধিতাই করতে চাও’। জবাবে ওমর (রাঃ) বললেন, مَا أَرَدْتُ خِلاَفَكَ، ‘আমি আপনার বিরোধিতা করতে চাই না’। এভাবে তাদের মধ্যে বিতর্ক হয়। যাতে তাদের কণ্ঠস্বর কিছুটা উঁচু হয়ে যায়। তখন ১-৩ আয়াত নাযিল হয়।[6] এরপর থেকে তাঁরা রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে কথা বলতেন এমন নিম্নস্বরে যে, তা বুঝতে কষ্ট হ’ত।[7]

(৭) হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) একদিন মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় জনৈক বেদুঈন সেখানে প্রবেশ করল। অতঃপর ছালাত আদায় করল এবং ছালাতে দাঁড়িয়ে দো‘আ করতে লাগল,اللَّهُمَّ ارْحَمْنِىْ وَمُحَمَّدًا، وَلاَ تَرْحَمْ مَعَنَا أَحَدًا- ‘হে আল্লাহ! আমার ও মুহাম্মাদের প্রতি দয়া করো এবং আমাদের মধ্যে আর কারু প্রতি দয়া করো না’। সালাম ফিরানোর পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, لَقَدْ حَجَّرْتَ وَاسِعًا- ‘তুমি একটি প্রশস্ত বিষয়কে সংকুচিত করলে অর্থাৎ আল্লাহর সীমাহীন অনুগ্রহকে তুমি সংকীর্ণ করলে’ (বুখারী হা/৬০১০)

কিছুক্ষণ পর লোকটি মসজিদেই পেশাব করতে শুরু করল। ফলে সবাই তাকে বাধা দিতে ছুটে গেলেন। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন তোমরা ওখানে এক বালতি পানি ঢেলে দাও। এরপর বললেন, তোমাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে সহজ করার জন্য, কঠিন করার জন্য নয় (তিরমিযী হা/১৪৭)

(৮) আয়েশা (রাঃ) বলেন, একদল ইহূদী রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে প্রবেশের অনুমতি চেয়ে বলল, ‘আস-সামু আলায়কা’ (তোমার মৃত্যু হোক)। রাসূল (ছাঃ) বললেন, وَعَلَيْكُمْ ‘তোমাদেরও’। (আয়েশা বলেন) আমি বললাম,السَّامُ عَلَيْكُمْ وَلَعَنَكُمُ اللهُ وَغَضِبَ عَلَيْكُمْ- ‘তোমাদের উপর মৃত্যু, আল্লাহর লা‘নত ও গযব আপতিত হোক’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন,مَهْلاً يَا عَائِشَةُ، عَلَيْكِ بِالرِّفْقِ وَإِيَّاكِ وَالْعُنْفَ أَوِ الْفُحْشَ- ‘থাম, হে আয়েশা! তোমার দায়িত্ব হ’ল সদাচরণ করা। তুমি কঠোর ও অশ্লীল ভাষা হ’তে বিরত থাক। আয়েশা বললেন, আপনি কি শোনেননি ওরা কি বলেছে? রাসূল (ছাঃ) বললেন, তুমি কি শোননি আমি তাদের জওয়াবে কি বলেছি? তাদের সম্পর্কে আমার দো‘আ কবুল হবে। কিন্তু আমার ব্যাপারে তাদের দো‘আ কবুল হবে না’।[8]

(৯) একবার এক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে এসে ভয়ে বিহবল হয়ে পড়ে। তখন তিনি তাকে বলেন,هَوِّنْ عَلَيْكَ فَإِنِّىْ لَسْتُ بِمَلِكٍ إِنَّمَا أَنَا ابْنُ امْرَأَةٍ مِنْ قُرَيْشٍ تَأْكُلُ الْقَدِيْدَ- ‘স্থির হও! আমি কোন বাদশাহ নই। আমি একজন কুরায়েশ মহিলার সন্তান মাত্র। যিনি শুকনা গোশত ভক্ষণ করতেন’।[9] উল্লেখ্য যে, আরবের গরীব লোকেরা শুকনা গোশত খেতেন। এ ঘটনায় বাস্তব জীবনে রাসূল (ছাঃ)-এর বিনয় ও নম্রতা অবলম্বনের ও নিরহংকার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। তিনি বলতেন,لاَ تُطْرُونِى كَمَا أَطْرَتِ النَّصَارَى ابْنَ مَرْيَمَ فَإِنَّمَا أَنَا عَبْدُهُ، فَقُولُوا عَبْدُ اللهِ وَرَسُولُهُ- ‘তোমরা আমার ব্যাপরে বাড়াবাড়ি করোনা। যেমন বাড়াবাড়ি করেছিল নাছারারা মারিয়াম তনয় ঈসা-র ব্যাপারে। আমি আল্লাহর বান্দা মাত্র। সুতরাং তোমরা আমাকে বলবে আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল’।[10]

(১০) হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর মুক্তদাসী বারীরাহ তার ক্রীতদাস স্বামী মুগীছ থেকে পৃথক হ’তে চায়। কিন্তু মুগীছ তাকে ছাড়তে চায়না। বারীরাকে পাওয়ার জন্য সে মদীনার অলিতে-গলিতে যাকে পায় তাকে ধরে কাঁদতে থাকে। তার এই দুঃখে ব্যথিত হয়ে রাসূল (ছাঃ) স্বীয় চাচা আববাস (রাঃ)-কে বললেন, لَوْ رَاجَعْتِهِ، যদি সে তার স্বামীকে ফিরিয়ে নিত! বারীরাহ একথা জানতে পেরে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে এসে বলল, يَا رَسُولَ اللهِ تَأْمُرُنِى؟ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাকে এ ব্যাপারে নির্দেশ দিচ্ছেন?’ তিনি বললেন, না। إِنَّمَا أَنَا أَشْفَعُ، ‘আমি কেবল সুফারিশ করছি মাত্র’। জবাবে বারীরাহ বলল,لاَ حَاجَةَ لِى فِيهِ، তাকে আমার কোন প্রয়োজন নেই’।[11]

উপরের ঘটনাগুলিতে রাসূল (ছাঃ)-এর সামনে ছাহাবীদের, মহিলাদের এমনকি ইহূদীদের বাক ও ব্যক্তি স্বাধীনতা কেমন ছিল, তার নিশ্চিত ধারণা পাওয়া যায়। তাঁর জীবনের এরূপ অসংখ্য ঘটনা হাদীছে ও আছারে লিপিবদ্ধ আছে।

খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে বাক স্বাধীনতা

ক. আবুবকর (রাঃ)-এর যুগে :

(১) খেলাফতে আসীন হওয়ার পর তিনি যে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ فَإِنِّي قَدْ وُلِّيْتُ عَلَيْكُمْ وَلَسْتُ بِخَيْرِكُمْ فَإِنْ أَحْسَنْتُ فَأَعِينُونِي وَإِنْ أَسَأْتُ فَقَوِّمُونِي، الصِّدْقُ أَمَانَةٌ وَالْكَذِبُ خِيَانَةٌ، وَالضَّعِيْفُ فِيْكُمْ قَوِيٌّ عِنْدِيْ حَتَّى أَرْجِعَ إِلَيْهِ حَقَّهُ إِنْ شَاءَ اللهُ، وَالْقَوِيُّ فِيْكُمْ ضَعِيْفٌ عِنْدِيْ حَتَّى آخُذَ الْحَقَّ مِنْهُ إِنْ شَاءَ اللهُ، لاَ يَدَعُ قَوْمٌ الْجِهادَ فِي سَبِيْلِ اللهِ إِلاَّ خَذَلَهُمُ اللهُ بِالذُّلِّ وَلاَ تَشِيْعُ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ إِلاَّ عَمَّهُمُ اللهُ بِالْبَلاَءِ، أَطِيعُونِي مَا أَطَعْتُ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَإِذَا عَصَيْتُ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَلاَ طَاعَةَ لِي عَلَيْكُمْ، قُومُوا إِلَى صَلاَتِكُمْ، يَرْحَمُكُمُ اللهُ-

‘হে লোক সকল! আমি তোমাদের উপরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছি। অথচ আমি তোমাদের চাইতে উত্তম নই। এক্ষণে যদি আমি কোন ভাল কাজ করি, তাহ’লে তোমরা আমাকে সাহায্য করো। আর যদি আমি ভুল করি, তাহ’লে আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করো। সত্য হ’ল আমানত, আর মিথ্যা হ’ল খেয়ানত। তোমাদের মধ্যেকার দুর্বল ব্যক্তি আমার নিকট সবল, যতক্ষণ না আমি তার হক আল্লাহর ইচ্ছায় তাকে ফিরিয়ে দেই। আর তোমাদের মধ্যেকার সবল ব্যক্তি আমার নিকট দুর্বল, যতক্ষণ না আমি তার নিকট হ’তে আল্লাহর ইচ্ছায় দুর্বলের হক আদায় করে দেই। আর যারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ পরিত্যাগ করে, আল্লাহ তাদের উপর লাঞ্ছনা চাপিয়ে দেন। আর যে সমাজে অশ্লীলতার প্রসার ঘটে, আল্লাহ তাদের উপর মহামারি ব্যাপক করে দেন। তোমরা আমার আনুগত্য কর, যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করি। আর যখন আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করব, তখন আমার প্রতি তোমাদের কোন আনুগত্য নেই। তোমরা ছালাতের জন্য দন্ডায়মান হও, আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন![12] উক্ত ভাষণে নাগরিকদের বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে।

খ. ওমর (রাঃ)-এর যুগে :

(১) খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর ওমর ফারূক (রাঃ) স্বীয় ভাষণে বলেন,وَأَعِيْنُونِى عَلَى نَفْسِى بِالْأَمْرِ بِالْمَعْرُوْفِ وَالنَّهْىِ عَنِ الْمُنْكَرِ، وَإِحْضَارِ النَّصِيْحَةُ فِيْمَا وَلاَّنِىَ اللهُ مِنْ أُمُوْرِكُمْ- ‘তোমরা আমাকে ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের নিষেধের মাধ্যমে সাহায্য করো। তোমাদের যে বিষয়ের উপর আল্লাহ আমাকে দায়িত্বশীল করেছেন, সে বিষয়ে আমাকে উপদেশ দিয়ো’। তিনি প্রজাদের উদ্দেশ্যে বলেন,أَيَّتُهَا الرَّعِيَّةُ! إنَّ لَنَا عَلَيْكُمْ حَقًّا، اَلنَّصِيْحَةُ بِالْغَيْبِ، وَالْمُعَاوَنَةُ عَلَى الْخَيْرِ- ‘হে প্রজাগণ! নিশ্চয়ই আমাদের জন্য তোমাদের হক হ’ল দূর থেকে থেকে উপদেশ দেওয়া এবং কল্যাণের কাজে সহযোগিতা করা’ (তারীখে ত্বাবারী ৪/২২৪)

(২) একদা তিনি মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহকে বলেন,

كَيْفَ تَرَانِي يَا مُحَمَّدُ؟ فَقَالَ: أَرَاكَ وَاللهِ كَمَا أُحِبُّ...أَرَاكَ قَوِيًّا عَلَى جَمْعِ الْمَالِ، عَادِلاً فِي قِسْمِهِ، وَلَوْ مِلْتَ عَدَلْنَاكَ كَمَا يَعْدِلُ السَّهْمُ فِي الثِّقَافِ، فَقَالَ عُمَرُ: اَلْحَمْدُ للهِ الَّذِي جَعَلَنِي فِي قَوْمٍ إِذَا مِلْتُ عَدَلُوْنِي-

‘হে মুহাম্মাদ! তুমি আমাকে কেমন মনে কর? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম আমি আপনাকে তেমনটি মনে করি যেমনটি আমি চাই। ...আমি আপনাকে শক্তিশালী মনে করি মাল জমা করার ব্যাপারে এবং ন্যায়পরায়ণ মনে করি সেটির বণ্টনের ব্যাপারে। যদি আপনি অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েন, তাহ’লে আমরা আপনাকে সোজা করে দিব, যেমনটি তীর নিশানার দিকে সোজা করা হয়। তখন ওমর বললেন, আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা, যিনি আমাকে এমন একটি জাতির উপর কর্তৃত্ব প্রদান করেছেন, যারা আমি অন্যায় করলে আমাকে সোজা করে দেয়।[13] উল্লেখ্য যে, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (রাঃ) ছিলেন, ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তাঁর হিসাব দফতরের প্রধান পরিদর্শক’।[14] এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, ওমরের অনুরূপ এক প্রশ্নে জনৈক ব্যক্তি তরবারি উঁচু করে বলে যে, এই তরবারি আপনাকে সোজা করে দিবে, কথাটির কোন বিশুদ্ধ ভিত্তি পাওয়া যায় না।[15]

(৩) একদা ওমর (রাঃ)-এর সাথে জনৈক ব্যক্তির সাক্ষাত হ’লে সে ওমর (রাঃ)-কে বলল, আলী ও যায়েদ বিন ছাবেত এই ফায়ছালা দিয়েছেন। জবাবে তিনি বললেন, আমি ফায়ছালা দিলে অন্যভাবে দিতাম। তিনি বললেন, তাহ’লে আপনি ফায়ছালা দিচ্ছেন না কেন? অথচ শাসন ক্ষমতার মালিক আপিন! জবাবে তিনি বললেন, যদি আমি কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরিয়ে দিতাম, তাহ’লে সেটাই করতাম। কিন্তু বিষয়টি আমি আমার নিজের রায়ের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আর এখানে আলী ও যায়েদের রায়ও শরীক আছে।[16] এভাবে তিনি ইজতিহাদী বিষয়ে ছাহাবীদের স্বাধীনভাবে রায় প্রদানের নিশ্চয়তা দেন। তিনি তাদের ইজতিহাদে নিষেধ করেননি এবং কারু রায়ের উপর নিজের রায় চাপিয়ে দেননি।

(৪) ওমর (রাঃ) বলেন,أَحَبُّ النَّاسِ إِلَيَّ مَنْ رَفَعَ إِلَيَّ عُيُوبِي- ‘আমার নিকট সর্বাধিক প্রিয় সেই ব্যক্তি, যে আমার ত্রুটিগুলি আমার নিকট তুলে ধরে’।[17]

(৫) তিনি একবার লম্বা জামা পরিধান করে খুৎবা দিচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, اَيُّهَا النَّاسُ اِسْمَعُوْا وَأَطِيعُوْا‘হে জনগণ! তোমরা আমার কথা শোন ও মান্য কর’। তখন খুৎবার মধ্যে তাঁর কথা কেটে দিয়ে এক ব্যক্তি বলল,لاَ سَمْعَ وَلاَ طَاعَةَ يَا عُمَرُ، ‘হে ওমর! আপনার কথা শুনব না, মানবও না’। তখন ওমর ধীর-স্থিরভাবে বললেন, কেন হে আল্লাহর বান্দা? লোকটি বলল, আমরা প্রত্যেকে একটি করে জামা পেয়েছি। অথচ আপনার দেহে দেখতে পাচ্ছি এক জোড়া। ওমর বললেন, থাম। তখন তিনি তাঁর পুত্র আব্দুল্লাহ বিন ওমরকে ডাকলেন। তিনি বললেন, আমার আববার জামাটিকে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য আমার অংশের জামাটি তাঁকে দিয়েছি’। তখন সবাই সন্তুষ্ট হ’ল। এবার ঐ লোকটি সম্মান ও বিনয়ের সাথে বলল, اَلْاَنَ السَّمْعُ وَالطَّاعَةُ يَا اَمِيْرَ الْمُوْمِنِيْنَ- ‘এখন শুনব ও মানব হে আমীরুল মুমিনীন!’।[18]

(৬) একদিন তিনি খুৎবায় বলেন, তোমরা মহিলাদের মোহর ৪০০ দিরহামের বেশী দিয়োনা, যদিও সে ইয়াযীদ বিন হুছাইনের কন্যা হয় (ইনি ছিলেন ৬১ হিজরীতে কারবালায় ইমাম হোসায়নের সাথে শাহাদত বরণকারী মর্যাদাবান ব্যক্তি)। যদি কেউ বেশী ধার্য করে, তবে অতিরিক্তটা আমি বায়তুল মালে জমা করে নেব’। তখন কুরায়েশের জনৈকা মহিলা বলে উঠল আল্লাহ বলেছেন,وَآتَيْتُمْ إِحْدَاهُنَّ قِنْطَارًا فَلاَ تَأْخُذُوا مِنْهُ شَيْئًا، ‘আর যদি তোমরা স্ত্রীদের কাউকে অধিক ধন-সম্পদ দিয়ে থাক, তবে তা থেকে কিছুই ফেরৎ নিয়ো না’ (নিসা ৪/২০)। আল্লাহ তুমি ক্ষমা কর’। তখন ওমর (রাঃ) মিম্বরে উঠে বললেন, আমি তোমাদেরকে ৪০০ দিরহামের বেশী মোহর দিতে নিষেধ করেছিলাম। তবে তোমাদের মধ্যে যদি কেউ তার সম্পদ থেকে অধিক পরিমাণে মোহরানা দিতে চায়, সে দিতে পারবে’।[19] এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, ‘তখন ওমর বললেন, امْرَأَةٌ أَصَابَتْ وَرَجُلٌ أَخْطَأَ- ‘মহিলা ঠিক বলেছে ও পুরুষ ভুল বলেছে’ এই অংশটি মুনক্বাতে‘ বা ছিন্নসূত্র।[20]

ওছমান (রাঃ)-এর যুগে বাক স্বাধীনতা :

(১) ওছমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তিনি প্রাদেশিক গবর্ণরদের নিকট ফরমান জারি করেন, যেন তারা সকল নাগরিকের কথা শুনেন ও তাদের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। কেননা তারা আল্লাহর পথের দাঈ ও হেদায়াতের দিকে আহবানকারী। তারা কেবল মাল জমাকারী নন’। একইভাবে যাকাত ও খাজনা আদায়কারীদের নিকট তিনি ফরমান জারি করেন, তারা যেন অবশ্যই আমানত রক্ষাকারী হন এবং মানুষের কথা শোনেন ও হকদারকে তার হক যথার্থভাবে প্রদান করেন। তিনি তাদের উপর যুলুম করা হ’তে সতর্ক করে দেন। আর এ বিষয়টি তিনি প্রজাসাধারণকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেন’।[21]

(২) যখন আরব উপদ্বীপের বাহির থেকে এসে কিছু লোক তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকে, তখন তিনি গবর্ণরদের মদীনায় ডাকেন এবং তাদেরকে বলেন, وَيْحَكُمْ! مَا هَذِهِ الشِّكَايَةُ؟ وَمَا هَذِهِ الْاِذَاعَةُ؟ وَمَا يُعْصَبُ هَذَا إِلاَّ بِي-‘তোমাদের ধ্বংস হৌক, কি এসব অভিযোগ? কি এসব প্রচার? আমি মনে করি এগুলি সবই আমার বিরুদ্ধে জমায়েত মাত্র।[22] গবর্ণরগণ তাঁকে বিদ্রোহী নেতাদের ধরে এনে হত্যা করার পরামর্শ দেন। কিন্তু তিনি বলেন, فَالرِّفْقُ اَوْلَى وَالْمَغْفِرَةُ اَفْضَلُ ‘নম্রতা উত্তম এবং ক্ষমা করা শ্রেয়’। অতঃপর উক্ত মর্মে তিনি গবর্ণরদের প্রতি নির্দেশ দেন।[23]

বিদ্রোহীদের সাথে সংলাপ : ওছমান (রাঃ) বিদ্রোহী সাবাঈদের সন্দেহ দূরীকরণার্থে তাদের রাজধানীতে ডাকেন। ছাহাবায়ে কেরাম ও সাধারণ মুছল্লীদের উপস্থিতিতে এই বৈঠকটি মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হয়। তখন সাবাঈরা তাদের ধারণা অনুযায়ী ওছমান (রাঃ)-এর ভুলগুলি বলতে থাকে। তারপর ওছমান (রাঃ) দাঁড়িয়ে তাদের বদ্ধমূল ধারণাগুলির দলীল ভিত্তিক জবাব দেন এবং তারা তা স্বীকার করে নেয়।[24]

ছাহাবীগণকে রক্তপাতে নিষেধাজ্ঞা : বিদ্রোহীদের ঘেরাও করা সত্ত্বেও ওছমান (রাঃ)-এর শিথিলতার সুযোগে যখন তারা তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখনও পর্যন্ত তিনি ছাহাবীগণকে রক্তপাতে নিষেধ করছিলেন। তার কারণ ছিল-

(ক) রাসূল (ছাঃ)-এর অছিয়ত অনুযায়ী কাজ করা। যা তিনি গৃহবন্দী অবস্থায় বর্ণনা করেন। ওছমান (রাঃ)-এর গোলাম আবু সাহলাহ বলেন আমি বললাম, হে খলীফা! আমরা কি ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবনা? তিনি বললেন, না। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমার নিকট থেকে অঙ্গীকার নিয়েছেন এবং আমি সেই অঙ্গীকারের উপর দৃঢ় থাকব।[25] আর রাসূল (ছাঃ)-এর সেই অঙ্গীকারটি ছিল, হে ওছমান! সম্ভবতঃ আল্লাহ তোমাকে একটি জামা পরিধান করাবেন। যদি লোকেরা তোমার নিকট থেকে তা খুলে নিতে চায়, তবে সেটি তুমি খুলে দিয়োনা’।[26] আরেকটি বিষয় ছিল যে, একদিন রাসূল (ছাঃ) আবুবকর, ওমর ও ওছমান (রাঃ) ওহোদ পাহাড়ে ওঠেন। ফলে পাহাড়টি কাঁপতে থাকে। তখন রাসূল (ছাঃ) তাকে পদাঘাত করেন ও বলেন, স্থির হও হে ওহোদ! তোমার উপর আছেন একজন নবী, একজন ছিদ্দীক ও দু’জন শহীদ।[27] অন্য বর্ণনায় এসেছে, গৃহে অবরুদ্ধ থাকাকালে তিনি লোকদের বলেন, তোমরা সাক্ষী থাক কা‘বার রবের কসম! আমি সেই শহীদ’ কথাটি তিনি ৩ বার বলেন।[28]

(খ) তিনি বলেন,فَلَنْ أَكُونَ أَوَّلَ مَنْ خَلَفَ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِى أُمَّتِهِ بِسَفْكِ الدِّمَاءِ، ‘সুতরাং আমি রাসূল (ছাঃ)-এর উম্মতের মধ্যে ওয়াদা খেলাফকারী হয়ে প্রথম রক্তপাতকারী হ’তে চাইনা’।[29] উপরের ঘটনাটিতে ওছমান (রঃ)-এর খেলাফতকালে বাক স্বাধীনতার উদাহরণ, বিরোধীদের সাথে সংলাপ, প্রজাসাধারণের হক প্রদান ও সত্য ও ন্যায়ের উপর দৃঢ় থাকার দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়।

আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে বাক স্বাধীনতা : আমীরুল মুমিনীন চতুর্থ খলীফা হযরত আলী (রাঃ)-এর বিখ্যাত কিছু উক্তি আছে, যেগুলিতে বাক স্বাধীনতায় তাঁর শ্রদ্ধাশীলতার প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন তিনি বলেন,بِئْسَ الزَّادُ إِلَى الْمَعَادِ اَلْعُدْوَانُ عَلَى الْعِبَادِ- ‘আল্লাহর বান্দাদের সাথে বিদ্বেষ করা পরকালের পাথেয় হিসাবে কতইনা নিকৃষ্ট’।[30] তাঁর এ উক্তি থেকে প্রমাণিত হয় যে, মানুষের সাথে শত্রুতা করা ছিল তার নিকট অতীব অপসন্দনীয়।

তিনি বলতেন, لَيْسَ مِنَ الْعَدْلِ الْقَضَاءُ عَلَى الثِّقَةِ بِالظَّنِّ- ‘ধারণার বশবর্তী হয়ে কোন বিষয়ে ফায়ছালা করা ন্যায়সঙ্গত নয়’।[31]

এমনকি ছিফফীন যুদ্ধের পর বিদ্রোহী খারেজীদের কাউকে তিনি তার খেলাফত ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলপ্রয়োগ করেননি। বরং তিনি তাঁর কর্মচারীদেরকে তাদের সাথে মন্দ ব্যবহার করতে নিষেধ করেন। যতক্ষণ না তারা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে কিংবা সীমালংঘন করে।[32] আলী (রাঃ) খারেজীদের জেলখানায় বন্দী করেননি, তাদের পিছনে গোয়েন্দা লাগাননি, তাদের স্বাধীনতা সংকুচিত করেননি, তাদের সাথে লড়াই করেননি, যতক্ষণ না তারা রাহাযানী করেছে ও অন্যায়ভাবে রক্তপাত করেছে।[33]

ফরমান জারি ও অছিয়তের মাধ্যমে বাক স্বাধীনতার নিশ্চয়তা : খুলাফায়ে রাশেদীনের যুগে ফরমান জারি ও অছিয়তের মাধ্যমে বাক স্বাধীনতা রক্ষার অনেক নযীর পাওয়া যায়।

(১) আবুবকর (রাঃ) উসামা বিন যায়েদ ও তার সেনাবহিনীকে শামে রোমকদের বিরুদ্ধে অভিযানে প্রেরণকালে বলেন, উপাসনার স্থান সমূহে যারা তাদের ধর্মীয় 
নিদর্শনগুলিকে পরিচর্যা করে, তাদের ক্ষতিসাধন করবে না। তিনি বলেন, সত্বর তোমরা এমন সম্প্রদায়ের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে, যারা তাদের গীর্জাগুলিকে পরিত্যাগ করবে। সুতরাং তোমরা তাদেরকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিবে।[34]

(২) ওমর (রাঃ)-এর সময়ে ইহূদী-নাছারাদের ধর্মীয় ও বাক স্বাধীনতা রক্ষার প্রমাণ রয়েছে তাঁর বিখ্যাত উক্তির মধ্যে। যেখানে তিনি বলেন,وَإِنَّمَا أَعْطَيْنَاهُمُ الْعَهْدَ عَلَى أَنْ نُخَلِّيَ بَيْنَهُمْ وَبَيْنَ كَنَائِسِهِمْ يَقُوْلُوْنَ فِيْهَا مَا بَدَا لَهُمْ، وَأَنْ لاَ نَحْمِلَهُمْ مَا لاَ يُطِيْقُوْنَ، ‘আমরা তাদের গীর্জাসমূহে তাদের পসন্দমত আলোচনার স্বাধীনতা দিয়েছি। তাদের সাধ্যের বাইরে কিছুই আমরা তাদের উপর চাপিয়ে দেব না।[35]

(৩) ওছমান (রাঃ) তার খাজনা আদায়কারী কর্মচারীদের বলেন, তোমরা তাদেরকে প্রদত্ত ওয়াদা পূর্ণ কর। আর তোমরা ইয়াতীম ও যিম্মীদের উপর যুলুম করোনা। কেননা আল্লাহ তাদের সাথে বিতর্ক করবেন, যারা যুলুম করে।[36]

(৪) আলী (রাঃ) খেলাফতকালে মিসরের তৎকালীন গবর্ণর মালেক বিন আশতার নাখাঈ যখন তাঁর কাছে আসেন, তখন তিনি তাকে বলেন, তুমি যিম্মীদের সাথে খেয়ানত করোনা। চুক্তিবদ্ধদের সাথে সীমালংঘন করোনা। কেননা অজ্ঞ ও দুর্ভাগারাই কেবল আল্লাহর নিষিদ্ধ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে। আর আল্লাহ এই অঙ্গীকারকে তার বান্দাদের মধ্যে দেখতে চান।[37] (ক্রমশঃ)


[1]. আবুদাঊদ হা/২২১৪ সনদ হাসান; ছহীহ ইবনু হিববান হা/৪২৭৯, হাদীছ ছহীহ; ইবনু কাছীর ৮/৩৮।

[2]. বায়হাক্বী হা/১৫৬৩৯, ৭/৩৮২ ‘যিহারের আয়াত নাযিলের কারণ’ অনুচ্ছেদ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুজাদালাহ ২ আয়াত। তিনি এর সনদকে উত্তম ও শক্তিশালী বলেছেন; ইবনু জারীর ২৩/২২১। উক্ত মহিলার নাম বিভিন্নভাবে এসেছে। যেমন, খাওলা বিনতে ছা‘লাবাহ, খাওলা বিনতে মালেক বিন ছা‘লাবাহ, খুওয়াইলাহ বিনতে ছা‘লাবাহ, খাওলাহ বিনতে দুলাইজ (বায়হাক্বী হা/১৫৬৫০ মুরসাল), জামীলাহ। তবে খাওলা বিনতে ছা‘লাবাহ নামটিই সর্বাধিক প্রসিদ্ধ (ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইস্তী‘আব ৫৯১ পৃ.; তাফসীর ইবনে কাছীর)।

[3]. ইবনু কাছীর ৮/৩৮, ক্বাসেমী ৯/১৬৪, এটি গরীব সনদে উত্তম ও শক্তিশালী (وَهَذَا إِسْنَادٌ جَيِّدٌ قَوِيٌّ، وَسِيَاقٌ غَرِيبٌ); ইবনু জারীর, তাফসীর ত্বাবারী ২৩/২২১।

[4]. বায়হাক্বী হা/১৫৬৫০, ৭/৩৮৪-৮৫ বায়হাক্বী বলেন, এর সনদ মুরসাল। তবে শাওয়াহেদ আছে; তাফসীর ইবনু জারীর, ইবনু কাছীর।

[5]. কুরতুবী, তাফসীর সূরা হুজুরাত ৪ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/৫৬২, ৫৬৭ পৃ.।

[6]. বুখারী হা/৪৩৬৭ রাবী আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ)।

[7]. বুখারী হা/৪৮৪৫; তিরমিযী হা/৩২৬৬; তুহফা।

[8]. বুখারী হা/৬৪০১; মুসলিম হা/২৫৯৪; মিশকাত হা/৪৬৩৮।

[9]. ইবনু মাজাহ হা/৩৩১২ রাবী আবু মাসঊদ (রাঃ); ছহীহাহ হা/১৮৭৬।

[10]. বুখারী হা/৩৪৪৫; মিশকাত হা/৪৮৯৭, রাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ)।

[11]. বুখারী হা/৫২৮৩; মিশকাত হা/৩১৯৯ রাবী আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)।

[12]. সীরাতু ইবনে হিশাম ২/৬৬১; ইবনু কুতায়বাহ দীনাওয়ারী, উয়ূনুল আখবার ২২২ পৃ.; ইবনুল আছীর, আল-কামেল ফিত-তারীখ ১/৩৬১, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/২৪৮ ও ৬/৩০১ পৃ., সনদ ছহীহ।

[13]. তারীখু দিমাশক্ব ৫৫/২৭৭; সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/৩৭২ বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত। কিন্তু সনদ মুনক্বাতে‘। মূসা বিন আবু ঈসা বিশ্বস্ত ও মুসলিমের রাবী, তবে তিনি ওমর (রাঃ)-কে পাননি (মুহাক্কিক সিয়ার)।

[14]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ২/৩৭০।

[15]. ইসলাম ওয়েব.নেট, ফৎওয়া ক্রমিক : ১৭৫০৩৭।

[16]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াকক্বেঈন ১/৭০ পৃ.।

[17]. ইবনু সা‘দ, আত-ত্বাবাক্বাতুল কুবরা ৩/২৯৩, বর্ণনাকারীগণ ইবনু সা‘দের নিকট বিশ্বস্ত; বালাযুরী, আনসাবুল আশরাফ ১০/৩৪৬।

[18]. আলী ছাল্লাবী, আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব ১/১৪৭ পৃ.; ইবনু কুতায়বাহ দীনাওয়ারী, উয়ূনুল আখবার ১/২৩, ৫৫; ইবনুল জাওযী, মানাক্বিব ১/১৪০; ছিফাতুছ ছাফওয়া ১/৫৩৫; ইবনুল মুবার্রাদ হাম্বলী, মাহযুছ ছাওয়াব ২/৫৭৯; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াকক্বেঈন ২/১৮০।

[19]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা নিসা ২০ আয়াত, ২/২৪৪, সনদ উত্তম ও শক্তিশালী (إِسْنَادُهُ جَيِّدٌ قَوِيٌّ); হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৪/৫২১, হা/৭৫০২; বায়হাক্বী হা/১৪৭২৪, ৭/২৩৩ সনদ মুরসাল জাইয়েদ।

[20]. মুহাক্কিক তাফসীর ইবনু কাছীর, নিসা ২০ আয়াত ২/২৪৪।

[21]. ড. আলী মুহাম্মাদ মুহাম্মাদ আছ-ছাল্লাবী (বেনগাযী, লিবিয়া ১৯৬৩ খৃ.-বর্তমান), আল-হুর্রিইয়াত মিনাল কুরআনিল কারীম ৯৫ পৃ.; গৃহীত : ড. সালেম ভানসাভী, হুর্রিইয়াতুর রায় ৬৪ পৃ.।

[22]. ইবনুল আছীর, আল-কামেল ফিত-তারীখ ২/৯; তারীখ ইবনে খালদূন ২/১৪৪; তারীখে ত্বাবারী ২/৬৪৮; আহমাদ যাকী ছাফওয়াত, জামহারাতু খুত্বাবিল আরব ১/২৭১; আলী ছাল্লাবী, সীরাতে ওছমান বিন আফফান (রাঃ) ১/৪৬৮।

[23]. ড. মুনীর মুহাম্মাদ গাযবান, আমর ইবনুল ‘আছ আমীরুল মুজাহিদ ৪৪৭ পৃ.; গৃহীত : ছাল্লাবী, আল-হুর্রিইয়াত ৯৬ পৃ.; সীরাতে ওছমান বিন আফফান ১/৪৬৮।

[24]. ইবনুল ‘আরাবী, আল-‘আওয়াছেম মিনাল ক্বাওয়াছেম ৬১-১১১; তারীখু ত্বাবারী ৫/৩৫৫-৫৬; খালেদী, খোলাফায়ে রাশেদীন ১৫৮; আহমাদ রাতেব উরমূশ, আল-ফিৎনা ১০-১৪ পৃ.; আলী ছাল্লাবী, সীরাতু ওছমান বিন আফফান (রাঃ) ১/৪৭৫ পৃ.।

[25]. তিরমিযী হা/৩৭১১; হাকেম হা/৪৫৪৩; ইবনু মাজাহ হা/১১৩; মিশকাত হা/৬০৭০, ৬০৭২।

[26]. তিরমিযী হা/৩৭০৫; ইবনু মাজাহ হা/১১১; মিশকাত হা/৬০৬৮।

[27]. বুখারী হা/৩৬৭৫; মিশকাত হা/৬০৭৪ রাবী আনাস (রাঃ)।

[28]. তিরমিযী হা/৩৭০৩; নাসাঈ হা/৩৬০৮; মিশকাত হা/৬০৬৭ রাবী মুর্রাহ বিন কা‘ব (রাঃ); ইরওয়া হা/১৫৯৪।

[29]. আহমাদ হা/৪৮১, মুনক্বাতে‘ হওয়ার কারণে যঈফ; হায়ছামী, মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ ৩/২৭০, বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত, তবে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল মালেক বিন মারওয়ানের মুগীরা বিন শো‘বা (রাঃ) থেকে শ্রবণের বিষয়টি প্রমাণিত নয়।

[30]. তারীখু দিমাশক্ব ৪৮/৪২২; ইবনু হামদূন, তাযকিরাতুল হামদূনিইয়াহ ৩/৩৩২; ছাল্লাবী, আলী বিন আবু তালেব ১/৩৬৭।

[31]. যামাখশারী, রবীউল আবরার ১/২৬৯; ছাল্লাবী, আলী ইবনে আবু তালেব ২২৯ পৃ.।

[32]. ছাল্লাবী, আলী বিন আবু তালেব ১/৩৬৯, ২/৩৪৪ পৃ.; তারীখু ত্বাবারী ৫/৬৮৮, মুনকাতে‘ সনদে, তবে উক্ত মর্মে আছার বিদ্যমান; ইরওয়া ৮/১৬৭; মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ ১৫/৩২৬, ৩৯০৮৫; শাফেঈ, আল-উম্ম ৪/১৩৬; ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৭৭৭১।

[33]. ছাল্লাবী, আলী ইবনু আবি তালেব ৫৩৮ পৃ.; ড. মাহমূদ ইসমাঈল আম্মার, হুকূকুল ইনসান ৩১৪ পৃ.।

[34]. ছাল্লাবী, আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) ১৭২ পৃ.।

[35]. হামাদ মুহাম্মাদ আছ-ছামাদ, নিযামুল হুক্ম ফী ‘আহদিল খুলাফাইর রাশেদীন ১৭৭ পৃ.।

[36]. প্রাগুক্ত, ১৭৮ পৃ.।

[37]. প্রাগুক্ত, ১৭৮ পৃ.।