পুঁজিবাদের চূড়ায় ধ্বস

Occupy Wall Street বা ‘ওয়াল স্ট্রীট দখল করো’ শ্লোগান দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শিক্ষার্থী ও সদ্য পাস করা বেকার যুবক গত ১৭ই সেপ্টেম্বর ’১১ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক রাজধানী নিউইয়র্কের রাস্তায় যে আন্দোলন শুরু করেছিল, তা মাত্র এক মাসের ব্যবধানে গত ১৫ই অক্টোবর বিশ্বের ৮২টি দেশের ৯৫১টি শহরে বিক্ষোভ আকারে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে লন্ডনের ধনীরা এখন দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা করছে। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, জাপান সর্বত্র হাযার হাযার মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছে। তাদের একটাই ক্ষোভ ৯৯ শতাংশ মানুষের রূযী মাত্র ১ শতাংশ মানুষ ভোগ করছে। মুনাফালোভী ব্যাংকার ও ধনী রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী যেন একসাথে ফুঁসে উঠেছে। বিশ্ব পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে  এটি এখন টাইম বোমায় রূপ নিয়েছে।

এটা কি একদিনে হয়েছে? এটা কি কোন সাময়িক ইস্যু? না, বরং এটি শত বছরের ধূমায়িত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী ও বিশ্বজনীন ইস্যু। যেখানেই পুঁজিবাদ, সেখানেই এ ক্ষোভ অবশ্যই থাকবে। পুঁজিবাদী ধনিক শ্রেণী বিভিন্ন নিয়ম-কানূন তৈরী করে দু’হাতে অপরের ধন লুট করছে। আর একে আইনসম্মত ও নিরাপদ করার জন্য তাদের অর্থে ও তাদের স্বার্থে গড়ে উঠেছে দেশে দেশে বিভিন্ন নামে শোষণবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থা সমূহ। মানুষ কেবল ক্ষোভ প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু এ থেকে মুক্তির পথ তারা জানে না। তাই দেখা যায় নানা মুণির নানা মত। হাঁ মানুষের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ এ থেকে মুক্তির পথ বাৎলে দিয়েছেন। যেটি হ’ল ছিরাতে মুস্তাক্বীম বা সরল পথ। মানুষকে অবশ্যই সে পথে ফিরে যেতে হবে, যদি তারা শান্তি চায়। আসুন একবার ফিরে তাকাই সেদিকে।

ভোগ ও ত্যাগ দু’টিই মানুষের স্বভাবসিদ্ধ বিষয়। দু’টির সুষ্ঠু সমন্বয়ে মানুষের জীবন শান্তিময় হয়। কিন্তু কোন একটিকে বেছে নিলে জীবন হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ব্যক্তির সীমাহীন ভোগবাদিতা ও লাগামহীন ধনলিপ্সাকে নিরংকুশ করা ও সম্পদ এক হাতে কুক্ষিগত করাই হ’ল পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলকথা। এর বিপরীতে ব্যক্তিকে মালিকানাহীন ও সম্পদহীন করে আয়-উপাদানের সকল উৎস সমাজ বা রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়াই হ’ল সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মূলকথা। বুঝাই যাচ্ছে যে, দু’টিই মানুষের স্বভাব বিরোধী ও চরমপন্থী মতবাদ এবং কোনটিই সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের কল্যাণবহ নয়। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। পুঁজিবাদী বিশ্বের মানুষ যেমন ফুঁসে উঠেছে, কম্যুনিষ্ট চীনের লৌহশৃংখলে আবদ্ধ মানুষ তেমনি কোন পথ না পেয়ে এখন আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। ফলে আত্মহত্যা প্রবণ দেশসমূহের তালিকায় চীন পৃথিবীতে শীর্ষে অবস্থান করছে। অন্যদিকে সমাজবাদী রাশিয়ায় ভিক্ষুকের সংখ্যা দুনিয়ায় সবচাইতে বেশী।

উপরোক্ত দুই চরমপন্থী অর্থনীতির বাইরে সুষম অর্থনীতি এই যে, মানুষ তার মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সম্পদ উপার্জন করবে এবং প্রয়োজনের অতিরিক্ত বণ্টন করবে। এর ফলে সমাজে অর্থের প্রবাহ সৃষ্টি হবে। ধনী ও গরীবের বৈষম্য হ্রাস পাবে। প্রতিটি পরিবার সচ্ছল হবে। সমাজে কোন বেকার ও বিত্তহীন থাকবে না। সর্বত্র সুখ ও শান্তি বিরাজ করবে। এই আয় ও ব্যয়ের নীতিমালা মানুষ নিজে তৈরী করবে না। বরং আল্লাহ প্রেরিত অভ্রান্ত ও অপরিবর্তনীয় বিধান সমূহ সে মেনে চলবে। আল্লাহর বিধান সকল মানুষের জন্য সমান। তাই তা অনুসরণে সমাজে সৃষ্টি হবে বৈষম্যহীন ও সকলের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সত্যিকার অর্থে একটি মানবিক অর্থ ব্যবস্থা। যেখানে ধনী তার বিপদগ্রস্ত ভাইয়ের জন্য নিঃস্বার্থভাবে অর্থ ব্যয় করবে। গরীব তার ধনী উপকারী ভাইয়ের জন্য জীবন দিতে প্রস্ত্তত থাকবে। সকলে হবে সকলের তরে। কেউ হবেনা কেবল নিজের তরে। এই অর্থনীতিই হ’ল ইসলামী অর্থনীতি। যা যথাযথভাবে অনুসরণের ফলে সূদী শোষণে জর্জরিত আরবীয় সমাজ খেলাফতে রাশেদাহর প্রথম দশ বছরের মধ্যেই এমনভাবে দারিদ্র্যমুক্ত হয় যে, যাকাত নেওয়ার মত কোন লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। আজও তা সম্ভব, যদি না মুসলিম রাষ্ট্রগুলি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়নে আন্তরিক হয়।

রূযী হালাল না হলে ইবাদত  কবুল হয় না। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, অর্থব্যবস্থার সঙ্গে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা ওৎপ্রোতভাবে জড়িত। সেকারণ পুঁজিবাদ কেবল অর্থনীতির নাম নয়, বরং একটি সমাজ ব্যবস্থার নাম। একই অবস্থা সমাজতন্ত্রের। উভয় সমাজ ব্যবস্থা স্ব স্ব আক্বীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী পরিচালিত। ঐ দুই সমাজ ব্যবস্থায় মুনাফালোভী ব্যাংকার, মওজূদদার ব্যবসায়ী ও সূদী মহাজনদের প্রধান সহযোগী হ’ল শোষণবাদী ও ক্ষমতালোভী রাজনীতিকরা। এরা তাদের বশংবদ একদল বুদ্ধিজীবী ও শিক্ষিত শ্রেণী গড়ে তোলে। যারা বিভিন্ন চটকদার মতবাদ তৈরী ও প্রচার করে সাধারণ মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে। তারা তাদের সৃষ্ট ও পরিচালিত ব্যাংক-বীমা-ইনস্যুরেন্স ও নানাবিধ উপায়ে ব্যক্তিগতভাবে ও সমিতি করে কর্পোরেট বাণিজ্যের মাধ্যমে সমাজকে শোষণ করে এবং যাবতীয় আর্থিক উপায়-উপাদানকে নিজেদের করায়ত্ত করে। বর্তমানে বিশ্বায়নের ধুয়া তুলে তারা বিশ্ব শাসন ও শোষণে নেমেছে এবং একে একে বিভিন্ন দেশে তারা হামলা ও লুট করছে। এতে এক শতাংশ লোক সম্পদের পাহাড় গড়ছে। বাকীদের নাভিশ্বাস উঠছে। আজ তারই ফলশ্রুতিতে আমেরিকায় প্রতি ৬ জনে ১ জন ও ভারতে শতকরা ৭৭ জন দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাস করছে। ইংল্যান্ডে শতকরা মাত্র ৫ জন ব্যতীত বাকী সবাই অসুখী জীবন যাপন করছে। অথচ এইসব দেশেই বাস করে বিশ্বের সেরা ধনী ব্যক্তিরা।

আজ থেকে অর্ধশতাব্দীকাল পূর্বে পাশ্চাত্য অর্থনীতিবিদ কোলিন ক্লার্ক বলেছিলেন, বর্তমান পুঁজিবাদী সমাজে সর্বাপেক্ষা কম ও সর্বাপেক্ষা বেশী আয়ের শতকরা অনুপাত হ’ল গড়ে ১ : ২০ লক্ষ। এই আকাশ ছোঁয়া অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যে মানুষ কিভাবে বসবাস করে, ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে বহু রক্তের বিনিময়ে রাশিয়া ও চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তথাকথিত শোষণহীন সমাজবাদী অর্থনীতি। কিন্তু মাত্র কিছু দিনের মধ্যেই এর তিক্ত ফল সেদেশের মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করে। একদিকে তারা মানুষের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা হরণ করে, অন্যদিকে তাদেরকে আয়-রোজগারহীন করে কার্যত: কারাবন্দীর অবস্থায় নিয়ে ফেলে। এর পরিণতিতে তাদের অর্থনৈতিক বৈষম্যের হার দাঁড়ায় অর্ধশতাব্দীকাল পূর্বের রাশিয়ার সরকারী রিপোর্ট অনুযায়ী ১ : ৩ লক্ষ। তাই বর্তমানে পুনরায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে যে বিশ্বজাগরণ দেখা যাচ্ছে, তা যদি ইসলামের দিকে ফিরে না এসে অন্যদিকে মোড় নেয়, তাহ’লে তার পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে। তা মানুষকে তার কাংখিত সুখ কখনোই এনে দিতে পারবে না।

পুঁজিবাদী সমাজে বসবাস করে পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী অর্থনীতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। তাই মুসলিম রাষ্ট্রগুলি এ ব্যাপারে আন্তরিক হ’লে তারাই বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ামক হ’তে পারত। কিন্তু তাদের মধ্যে ছালাত-ছিয়াম-হজ্জ প্রভৃতি বিষয়ে যত না আগ্রহ আছে, নিজেদের রূযী হালাল করার ও দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করার ব্যাপারে সে তুলনায় বিন্দুমাত্র আন্তরিকতা নেই। বরং এ বিষয়ে তারা পুঁজিবাদী বিশ্বের শতভাগ অনুসারী। ফলে সারা জীবন ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে পাশ্চাত্যের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে হচ্ছে। উন্নতির কোন লক্ষণ নেই।

ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের প্রকৃত মালিক হলেন আল্লাহ। মানুষ হ’ল তার যামিনদার। তাই মানুষ তার ইচ্ছামত আয় ও ব্যয় করতে পারে না। এ অর্থনীতিতে হালাল ও হারামের বাধ্যবাধকতা রয়েছে এবং রয়েছে আবশ্যিক ও ঐচ্ছিক ধন বণ্টনের নীতিমালা। এ অর্থনীতি মানুষকে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী আনন্দের বিপরীতে আখেরাতের চিরস্থায়ী শান্তির প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। এ অর্থনীতি মানুষকে মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল বানায়। ফলে এ সমাজে কোন আর্থিক হানাহানি বা বাণিজ্য যুদ্ধ কিংবা কোনরূপ অসুস্থ প্রতিযোগিতা থাকে না। এ সমাজের মানুষ ভোগে নয়, বরং ত্যাগে তৃপ্তি পায়। দেশের শাসক ও ধনিক শ্রেণী কি এ ব্যাপারে আন্তরিক হতে পারেন? যদি না পারেন তাহ’লে ওয়াল স্ট্রীট দখলের ঢেউ এদেশে আছড়ে পড়বে না, তার নিশ্চয়তা কে দিবে? আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!! [স.স.]