চলে গেলেন আফ্রিকার সিংহ

সাদ্দাম, বিন লাদেন অতঃপর গাদ্দাফীকে হত্যা করল আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ। ওবামা হুমকি দিলেন পূর্বের ন্যায় এই বলে যে, আবারও প্রমাণিত হ’ল, ‘আমেরিকা যা চায় তাই করে’। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ব্যক্তির এই দম্ভোক্তি আল্লাহ শুনেছেন ও দেখেছেন। নিশ্চয়ই আসমানী ফায়ছালা নেমে আসবে এ যুগের ফেরাঊনদের বিরুদ্ধে। তবে চলুন আমরা অতীত নিয়ে কিছু কথা বলি। (১) ১৯৬৭ সালের জুনে ইংল্যান্ডে সামরিক প্রশিক্ষণরত তরুণ ক্যাডেট মু‘আম্মার আল-ক্বাযযাফী (গাদ্দাফী) তার তিনজন সাথীকে নিয়ে লন্ডনের লেসাম্বাডর রেস্টুরেন্টের জুয়ার আড্ডায় দেখতে পান তার দেশের বাদশাহ ইদ্রীসের তৈল উপদেষ্টাকে এক ঘণ্টার মধ্যে দেড় লাখ পাউন্ড হারতে। আর তাকে অর্থের যোগান দিচ্ছে পাশে বসা গ্রীক জাহায কোম্পানীর এক মালিক। যিনি লিবিয়া থেকে তৈল নিয়ে তার জাহাযে করে ইউরোপে পেঁŠছে দিয়ে কোটি কোটি পাউন্ড শুষে নেন (২) ১৯৬৯ সালে তার নিজ জন্মস্থান সিরত বন্দর থেকে পাইপ লাইন বসিয়ে তৈল পরিবহনের শুরুতে বিদেশী অক্সিডেন্টাল কোম্পানীর আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বয়োবৃদ্ধ বাদশাহকে গার্ড অব অনার দেওয়ার অনুষ্ঠানে তিনি দেখতে পান দেশের মন্ত্রী ও সরকারী লোকদের চরম বিলাসিতা ও বিদেশী তোয়াজের মহড়া। অথচ তখন ত্রিপোলীর রাস্তায় চলত ছিন্ন পোষাক পরিহিত নগ্নপদ হাযার হাযার মানুষ। যখন ছিল না কোন উচ্চ শিক্ষার ব্যবস্থা, ছিল না যথেষ্টসংখ্যক হাসপাতাল। অথচ মন্ত্রীরা ঘন ঘন বিদেশে গিয়ে জুয়ার আসর মাত করত, আর দেশের টাকা লুট করে সুইস ব্যাংকে জমা করত (৩) ১লা সেপ্টেম্বর ’৬৯ বাদশাহ ইদ্রীস তখন রাষ্ট্রীয় সফরে তুরষ্কে। সুযোগ নিলেন গাদ্দাফী। কয়েকজন তরুণ সৈনিক বন্ধু মিলে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলেন। তখন তার বয়স মাত্র ২৭। ক্ষমতায় বসার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি আটক করলেন বাদশাহর সেই জুয়াড়ী তৈল উপদেষ্টাকে এবং অন্যান্য লুটেরা মন্ত্রী ও আমলাকে। (৪) কয়েকদিন পরে রাতের বেলায় ছদ্মবেশে ঢুকলেন রাজধানী ত্রিপোলীর এক নামকরা নৈশ ক্লাবে। মদে চুর নর্তকী ও তাদের ভোগকারীদের মাঝে দঁড়িয়ে হঠাৎ ছদ্মবেশ ফেলে বাঁশিতে ফুঁক দিলেন গাদ্দাফী। সাথে সাথে অপেক্ষারত সৈনিকেরা এসে দেড়শ’ নারী-পুরুষকে বন্দী করে নিয়ে গেল। ঐদিনের পর থেকে রাজধানীর সকল মদ্যশালা আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল যা গত ৪২ বছরে আর কখনো খোলা হয়নি (৫) কয়দিন পরে ছদ্মবেশে গেলেন এক হাসপাতালে। কোন ডাক্তার নেই। তার বারবার কাকুতি-মিনতিতে দয়াপরবশ হয়ে অবশেষে গল্পরত জনৈক নার্স বলল, তুমি কাল এসো’। ক্ষুব্ধ ব্যাঘ্র হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন, আমি কালকে যখন আসব, তখন তোমরা কেউ আর এখানে থাকবে না, থাকবে জেলে’।

লিবীয় বিপ্লবের এই তরুণ ব্যাঘ্রের দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের কথা বিদ্যুদ্বেগে ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। মযলূম মানবতা তাকে ত্রাণকর্তা হিসাবে বরণ করে নিল। অফিস-আদালত ঘুষমুক্ত হ’ল, দেশ থেকে মদ দূর হ’ল, দুর্নীতি উঠে গেল। এবারে নযর দিলেন বিদেশী আমেরিকান ও বৃটিশদের দিকে। প্রথমে তিনি আমেরিকার ‘হুইলাস’ বিমান ঘাঁটি গুটিয়ে নেবার নির্দেশ জারি করলেন। রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইল সারা আরব জাহান। কিন্তু না। সে নির্দেশ যথাযথভাবে পালিত হ’ল। এরপর বৃটিশদের পালা। নির্দেশ পেয়ে তারাও বেনগাজীর সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে গেল। এবারে পশ্চিমা প্রভাব দূরীকরণের দিকে মন দিলেন। সিনেমা-টিভিতে নগ্ন ছবি প্রদর্শন ও রাস্তায় নগ্ন মেয়েদের চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। লিবিয়াকে তার নিজস্ব ইসলামী সংস্কৃতি অনুযায়ী গড়ে তোলার দৃঢ় পদক্ষেপ শুরু হয়ে গেল সর্বত্র। মনোযোগ দিলেন দেশের অর্থনীতির দিকে। আল্লাহর দেওয়া নে‘মত ভূগর্ভের তৈলভান্ডার যা এতদিন বিদেশীরা নামমাত্র মূল্যে লুট করছিল, তিনি তার মূল্য বাড়িয়ে দিলেন। ফলে দ্রুত লিবিয়ার চেহারা পরিবর্তন হয়ে গেল। ফলে গাদ্দাফী শাসনের প্রথমার্ধেই লিবিয়া পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশে পরিণত হ’ল।

(১) ইতিপূর্বে লিবিয়ার সাধারণ মানুষের কোন ঘর-বাড়ি ছিল না। তারা তাঁবুতে যাযাবর জীবন যাপন করত। গাদ্দাফী নিজেও সেভাবে থাকতেন। তেলের টাকা হাতে পেয়ে এবার তিনি লিবীয়দের জন্য গৃহনির্মাণ শুরু করলেন। একসময় তার পিতা তাকে নিজের জন্য একটি বাড়ী নির্মাণ করতে বললে তিনি বলেন, একজন লিবীয়র গৃহনির্মাণ বাকী থাকতে আপনার ছেলে নিজের জন্য কোন বাড়ী বানাবে না (২) দেশে শিক্ষিতের হার ২৫ শতাংশ থেকে তিনি ৮৩ শতাংশে উন্নীত করেন (৩) তৈল ভান্ডার হওয়া সত্ত্বেও বড় বড় শহরগুলির বাইরে লিবীয়রা যেখানে বিদ্যুতের দেখা পেত না, সেখানে সর্বত্র ফ্রি বিদ্যুতের আলো ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং লিবীয় নাগরিকদের ভাষ্যমতে গত ৪২ বছরে কখনো বিদ্যুৎ চলে গেছে বলে তাদের জানা নেই (৪) তৈল বিক্রির টাকা ব্যাংকে জমা হ’লেই তার একটা অংশ প্রত্যেক লিবীয় নাগরিকের ব্যাংক একাউন্টে চলে যেত (৫) বিবাহ উপলক্ষে নবদম্পতির জন্য এককালীন ৫০ হাযার ডলার এবং সন্তান হ’লে ৫০০০ ডলার পাঠিয়ে দিতেন (৬) চিকিৎসা বা পড়াশুনার জন্য বিদেশ গেলে মাসিক ২৩০০ ডলার (৭) কোন কারণে কেউ বেকার হয়ে পড়লে তার একাউন্টে চলে যেত নির্দিষ্ট হারে বেকার ভাতা (৮) কেউ ব্যবসা করতে চাইলে বিনা সূদে ব্যাংক ঋণ দেওয়া হত এবং (৯) গাড়ি কিনতে চাইলে গাড়ির মূল্যের অর্ধেক সরকার বহন করত (১০) এতদ্ব্যতীত লিবীয় নাগরিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান বাবদ যাবতীয় খরচ সরকার বহন করত (১১) কৃষকদের জমি, বীজ, খামারবাড়ী ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি বিনামূল্যে দেওয়া হ’ত (১২) ১৯৮৩ হ’তে ৯০ সালের মধ্যে কোনরূপ বিদেশী ঋণ ছাড়াই ২৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে নির্মিত সারা লিবিয়া ব্যাপী ২৮৪০ কিঃ মিঃ দীর্ঘ ভূগর্ভস্থ পানির পাইপ লাইন ছিল বিশ্বের ৮ম আশ্চর্য। যা আজও লিবিয়াবাসীকে দৈনিক ৬৫ হাযার ঘন লিটার বিশুদ্ধ পানি নিয়মিতভাবে পৌঁছে দিচ্ছে। যাকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম মনুষ্য নির্মিত ভূগর্ভ নদী। এভাবে লিবীয় নাগরিকরা গাদ্দাফীযুগে বেদুঈন জীবন থেকে উত্তরণ করে রাজার হালে বাস করত (১৩) তার সময়ে তার দেশের কোন বৈদেশিক ঋণ তো ছিলই না। বরং তাঁর মৃত্যুকালে লিবিয়ার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫০ বিলিয়ন ডলার।

অনেকেই তাকে স্বৈরাচারী বলে সস্তা গালি দিয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁরা বুঝেন না যে, যিনি শূন্য থেকে দেশটিকে তুঙ্গে এনেছেন, তিনি কিভাবে তার জীবদ্দশায় তাকে আবার শূন্যে নিক্ষেপ করবেন? লিবীয় বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য এখানে এই যে, (১) বিপ্লবের সাথী অনেককে বিভিন্ন দায়িত্বে নিয়োগ করার পর তাদের দুর্নীতি ও বিশ্বাসঘাতকতা তাকে দারুণভাবে ব্যথিত করে (২) পরবর্তী যোগ্য ও দেশপ্রেমিক নেতা তিনি কাউকে পাননি (৩) কঠোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ বল্গাহীন চরিত্রের কিছু লোককে তার বিরোধী করে তোলে (৪) অবাধ লুটপাটে ব্যর্থ হয়ে আমেরিকা তার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএ-কে দিয়ে সর্বদা একদল লোককে গাদ্দাফীর বিরুদ্ধে তৈরী করতে থাকে। সম্প্রতি উইকিলিক্সের ফাঁস করা তথ্য অনুযায়ী গাদ্দাফী হত্যার পুরা ষড়যন্ত্র সিআইএ-র পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটেছে। যা তারা বহুদিন থেকে করে আসছিল। গাদ্দাফী সেটা বুঝতে পেরেই রাষ্ট্রক্ষমতা ছাড়তে চাননি। ২০০৯ সালে গাদ্দাফী জাতিসংঘে ভাষণ দেবার সময়সীমা ১৫ মিনিটের স্থলে দেড় ঘণ্টা বক্তৃতা করেন। এই সময় তিনি জাতিসংঘ সনদ ছিঁড়ে ফেলেন ও জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে ‘সর্ববৃহৎ সন্ত্রাসী সংগঠন’ হিসাবে আখ্যায়িত করেন। এছাড়াও আফ্রিকান ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসাবে তিনি ঔপনিবেশিক শাসনামলে অবাধ লুণ্ঠন ও শোষণের অভিযোগে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে ৭ লাখ ৭০ হাযার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। পাশ্চাত্যের লুটেরা শক্তির বিরুদ্ধে তার এই আপোষহীন দৃঢ়তাই তার জন্য কাল হয়। শুরু থেকেই আমেরিকা তাকে হত্যার চেষ্টা চালাচ্ছিল। ১৯৮৬ সালে ত্রিপোলীতে তার বাড়ীতে বিমান হামলা চালানো হয়। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান। কিন্তু তাঁর শিশু কন্যা নিহত হয়। অতঃপর গত আগষ্টে তার বাড়ীর উপর কয়েকবার বিমান হামলা করা হয়, যাতে তাঁর পরিবারের অনেকেই নিহত হন। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেলেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে জীবন দিতে হয়।

নিহত হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি বলেন, আমি দেশ ছেড়ে যাব না। ইহুদী-খৃষ্টান হায়েনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে দেশের মাটিতেই জীবন দেব। আল্লাহ তাঁর এই প্রার্থনা কবুল করেছেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে নিজ জন্মস্থানেই নিজ পুত্র ও সহকর্মীদের সাথে বিদেশী হামলায় মৃত্যুবরণ করেছেন। মানুষ হিসাবে তাঁর অনেক ভুল ছিল। আল্লাহ তাঁর ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করুন ও তাঁকে জান্নাত নছীব করুন। আমীন! [স.স.]