প্রস্তাবিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা

১৯৭৫ সালে মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত ১ম বিশ্ব নারী সম্মেলনে অংশ গ্রহণের পর থেকে বাংলাদেশ সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পা রাখে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে গৃহীত নারী নীতি সমূহে জোরালো সমর্থন ও ভূমিকা রাখতে  শুরু করে। অতঃপর ডিসেম্বর ১৯৭৯-তে জাতিসংঘে ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ ‘সিডো’ (CEDAW) গৃহীত হয়। এ সনদে স্বাক্ষরকারী প্রথম ১০টি দেশের অন্যতম হ’ল বাংলাদেশ। এই সিডো-কে বলা হয় কুরআন ও ইসলামী পরিবার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটি ‘নীরব টাইম বোমা’। ফলে বিগত কোন সরকারই এ সনদ বাস্তবায়নে সাহসী হয়নি। অথচ গত ৭ই মার্চ ’১১ মন্ত্রীসভা এটি  হুবহু অনুমোদন করে। পরদিন সরকারী সংবাদ সংস্থা (বাসস) পরিবেশিত খবরে বলা হয় যে, ভূমি সহ সম্পদ, সম্পত্তি ও উত্তরাধিকারে নারীর সমানাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে নারী উন্নয়ন নীতিমালা ২০১১-এর খসড়া মন্ত্রীসভায় অনুমোদিত হয়েছে। এতে আলেম সমাজ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলে তিনদিন ধরে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর অফিস কক্ষে বসে ঘষামাজা করে অবশেষে ২৫(২) ধারায় বলা হয়, ‘উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি এবং বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রদান করা’। ২৩(৫) ধারায় বলা হয়, সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেওয়া। ১৭(৫) ধারায় বলা হয়, স্থানীয় বা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোন ধর্মের, কোন অনুশাসনের ভুল ব্যাখ্যার ভিত্তিতে নারী স্বার্থের পরিপন্থী এবং প্রচলিত আইন বিরোধী কোন বক্তব্য প্রদান বা অনুরূপ কাজ বা কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করা। ১৭(৩) ধারায় বলা হয়, নারীর মানবাধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান আইন সংশোধন ও প্রয়োজনীয় নতুন আইন প্রণয়ন করা’। অতঃপর ১৭(২) ধারায় গিয়ে আসল কথা ফাঁস করে দিয়ে বলা হয়, ‘নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো)-এর প্রচার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা’। ফলে জাতিসংঘ ঘোষিত এই ‘সিডো’ বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনে দেশের সংবিধান, আইন ও রাষ্ট্রীয় নীতি সবই বদল হ’তে পারে। একই সময় ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস মারিয়ার্টি সকল ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করার তাকীদ দিয়ে বক্তব্য দিলেন (১৫ মার্চ ইনকিলাব ১/৪ কলাম)। অন্যদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রধান অতিথির ভাষণে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী বললেন, আওয়ামী লীগ কখনোই কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করবে না। সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও বলেন, যাদের পুত্র সন্তান নেই তাদের মেয়েরা তাদের রেখে যাওয়া সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হ’তে পারে না। ভাইয়ের ছেলে-মেয়েরা সেসব সম্পত্তি দখল করে নেয়’ (তাঁর এ বক্তব্য একেবারেই অজ্ঞতা প্রসূত)। তিনি বলেন, নারী উন্নয়ন নীতিমালা ভালোভাবে পড়ে আপনারা বলুন কোথায় কোরআন-সুন্নাহর পরিপন্থী কথা আছে’। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী পিতা-মাতার সম্পত্তি যাতে তাদের স্ত্রী-কন্যারা পেতে পারেন, সে ব্যাপারে পরামর্শ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহবান জানান (২৩ মার্চ ’১১, ইনকিলাব ১/৭ কলাম)। উক্ত আহবানের জওয়াবে সরকার সমর্থিত ৬ দলীয় ইসলামী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সংবাদ সম্মেলন করে আইনমন্ত্রী এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীকে একচোট নিয়ে বলেন, আসলে সরকারের ভিতরে ঘাপটি মেরে থাকা মহল বিশেষ সরকারকে বিতর্কিত করার হীন মানসিকতা নিয়ে রাজপথ উত্তপ্ত করার সুযোগ করে দিচ্ছে’ (১৫ মার্চ ’১১ ইনকিলাব ২/৫ কলাম)

উপরোক্ত আলোচনায় স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মহাজোট ঘোষিত কুরআন-সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন না করার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি একদিকে এবং সরকারের পিছনে অদৃশ্য থিংকট্যাংক-এর কর্মনীতি ঠিক তার বিপরীত দিকে ধাবিত হয়েছে। পিছনের সেই অপশক্তি কারা, সেটা বুঝতে কারু বাকী থাকার কথা নয়। যারা হত-দরিদ্র ও দুর্দশাগ্রস্ত অগণিত নারীর দুঃখ-বেদনা দূর করার চেষ্টা বাদ দিয়ে সরকারকে ঈমানদার জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেবার চক্রান্ত করছে।

প্রায় দেড় শতাধিক উপধারা সহ ৪৯টি ধারা সম্বলিত প্রস্তাবিত বিশালদেহী নারী উন্নয়ন নীতিমালাকে এক লাইনে ব্যক্ত করা যায়। যেটি বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ (২) ধারায় বর্ণিত হয়েছে যে, ‘রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন’।  সাথে সাথে সংবিধানের ৪১ (১-ক) ধারায় বলা হয়েছে ‘প্রত্যেক নাগরিকের যেকোন ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রহিয়াছে’। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা প্রভৃতি মৌলিক অধিকার ভোগ করার দিক দিয়ে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের অধিকার সমান। সাথে সাথে যে নারী যে ধর্মের অনুসারী, সেই ধর্ম অনুযায়ী সে তার জীবন পরিচালনা করবে। সংবিধানে এরূপ স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরেও নতুন করে নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্য কি? উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই একটা আছে। যেটা কোন সাধু উদ্দেশ্য নয়। বরং জাতিসংঘে গৃহীত ধর্মনিরপেক্ষ সনদ অনুযায়ী দেশ পরিচালনা করা এবং এ দেশের অধিকাংশ নাগরিকের অনুসৃত ইসলামী সমাজ ও পরিবার ব্যবস্থা ভেঙ্গে তছনছ করা। চাতুর্যপূর্ণ কথামালার ফাঁদে আটকিয়ে তারা জনগণকে বোকা বানাতে চান। সেই সাথে তারা পাশ্চাত্যের বস্ত্তবাদীদের ন্যায় এদেশের ধর্মপ্রাণ নারী সমাজকে স্রেফ ভোগ্যপণ্যে পরিণত করতে চান। জাতিসংঘে গৃহীত ‘নারীর প্রতি যাবতীয় বৈষম্য বিলোপ সনদ’ (সিডো) অমুসলিমদের জন্য এবং বিশেষ করে পাশ্চাত্যের নগ্নতাবাদীদের জন্য প্রযোজ্য হ’তে পারে। কেননা ঐসব দেশের অধিকাংশ নাগরিক পিতৃ পরিচয়হীন। এজন্য নারী যেহেতু দুর্বল এবং সন্তান যেহেতু তারাই গর্ভে ধারণ করেন, তাই পরিবারের বন্ধন, সহানুভূতি ও স্নেহ-ভালোবাসার স্পর্শহীন এইসব অসহায় নারীদের প্রতি ‘বৈষম্য বিলোপ সনদ’ (সিডো) প্রয়োজন। মুসলিম সমাজে এরূপ সনদের কোন প্রয়োজন নেই। যেসব দেশে এ সনদ বাস্তবায়িত হয়েছে, সেসব দেশের নারীরা এর দ্বারা কতটুকু কল্যাণ লাভ করেছে? খোদ জাতিসংঘেরই নারী কর্মকর্তারা তাদের সহকর্মী পুরুষ কর্মকর্তাদের দ্বারা নিয়মিত ধর্ষিতা হন বলে পত্র-পত্রিকায় সম্প্রতি রিপোর্ট বের হয়েছে। ইরাকে দখলদার আমেরিকান নারী সৈন্যদের শতকরা ৯০ জন (বরং সকলেই) তাদের পুরুষ সৈন্যদের দ্বারা নিয়মিত ধর্ষিতা হন। এমনকি তারা আত্মরক্ষার জন্য গুলিভর্তি পিস্তল ব্যতীত টয়লেটে যেতে পারেন না। সম্ভবত ঐসব দেশে ব্যভিচার ও নারী নির্যাতন কোন অপরাধ নয়। কিন্তু আমাদের দেশে পরনারীর দিকে কপট উদ্দেশ্যে চোখ তুলে তাকানো অমার্জনীয় অপরাধ। তাই ইসলামী সমাজে পর্দানশীন নারীরা যত বেশী নিরাপদ, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে তার কল্পনাও করা যায় না। আর সে কারণেই তারা ‘সিডো’ সনদ রচনা করেছে নিজেদের বাঁচানোর জন্য। যদিও তাতে তারা বাঁচতে পারেনি। বরং দিন দিন তাদের অবস্থার অবনতি হচ্ছে। পাশ্চাত্যের শিক্ষিতা মহিলারা এখন দলে দলে ইসলাম কবুল করছেন। এমনকি সদ্য সাবেক বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের শ্যালিকা খ্যাতনাম্নী মহিলা সাংবাদিক ‘লোরেন বুথ’ সম্প্রতি মুসলমান হয়েছেন ও সাথে সাথে হিজাব পরিধান করে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটে আত্মসমর্পণ করে শান্তিময় জীবন শুরু করেছেন। জাতিসংঘের গৃহীত ‘নারীর প্রতি বৈষম্য বিলোপ সনদ’ তাদের জীবনে কোন কল্যাণ বয়ে আনেনি।

আল্লাহ প্রেরিত এলাহী ধর্মগুলি ব্যতীত বিগত যুগে পৃথিবীর কোন সমাজে নারীর কোন সম্মানজনক অধিকার স্বীকৃত ছিল না। এই সেদিনও ভারতে বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল এবং যুবতী বিধবাকে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় হাত-পা বেঁধে ছুঁড়ে মেরে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে উলুধ্বনি দিয়ে বলা হ’ত, ঐ যে সতী নারী স্বর্গে চলে গেল। আজও সেদেশে পিতৃ সম্পত্তিতে কন্যার উত্তরাধিকার স্বীকৃত নয়। আর তাই বিয়ের সময় কন্যাকে যত সম্ভব যৌতুক দিয়ে বিদায় করে দেওয়া হয়। বিকৃত ইহুদী ও খৃষ্টধর্মে নারীকে ‘সকল পাপের উৎস’ গণ্য করা হয় এবং তারা নারীকে Necessary evil অর্থাৎ ‘যরূরী পাপ’ বলে তাদের বিবাহের অনুমতি দেয়। তারা নারীকে ‘দোযখের দরজা’ বলে এবং তাদেরকে ‘পৃথিবীর সকল অশান্তির কারণ’ বলে মনে করে। সেজন্যে তারা  বলে ‘যে ব্যক্তি কন্যাকে বিয়ে দেয় না, সেই-ই উত্তম কাজ করে’। খৃষ্টান সমাজে ‘নারীকে পুরুষের সম্পত্তি’ মনে করা হয়। তাই সেখানে ‘নারীকে তালাক দেওয়ার অধিকার এককভাবে পুরুষের হাতে’। বিখ্যাত রাষ্ট্রনীতিবিদ জন স্টুয়ার্ট মিল (১৮০৬-৭৩) তাই তার Subjection of Woman নামক প্রবন্ধে বলেছেন যে, আমাদেরকে বারবার বলা হয় যে, সভ্যতা ও খৃষ্টবাদ নারীর ন্যায় সঙ্গত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে। অথচ আমরা দেখি যে, তারা স্বামীর সেবাদাসী ছাড়া কিছুই নয়। অন্তত আইনের চোখে তারা ক্রীতদাসীই বটে’। এখন পাশ্চাত্যে বিবাহ-পূর্ব মিলন, বিবাহ-পরবর্তী মিলন, বিবাহ ছাড়াই লিভ টুগেদার, কুমারী মাতা, সমকামিতা ইত্যাদি নোংরা প্রথা সমূহ চালু হয়েছে। এমনকি ঐসব দেশে প্রতি মিনিটে কয়জন নারী ধর্ষিতা হয়, তারও রিপোর্ট বের হচ্ছে। জাহেলী আরবেও কমবেশী অনুরূপ অবস্থা কিছু কিছু লোকের মধ্যে বিদ্যমান ছিল। নারীরা পিতৃ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হ’ত না। ইসলাম আসার পরে সবকিছুর অবসান ঘটে এবং নারীরা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম তাদের মানবিক অধিকার ফিরে পায়। যা বিগত ও আধুনিক কোন সভ্যতাই তাদেরকে দেয়নি।                                                                                                                  

ইসলামের উত্তরাধিকার আইন :

ইসলামী পারিবারিক বিধানে নারী ও পুরুষ পরস্পরের পোষাক সদৃশ (বাক্বারাহ ১৮৭)। তারা একে অপরের পরিপূরক এবং কেউ কারু থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। ইসলামী পরিবারে ‘মায়ের পদতলে সন্তানের জান্নাত’ (নাসাঈ, মিশ, হা/৪৯৩৯)। ‘পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি’ (তির, মিশ, হা/৪৯২৭)। ‘রক্তের সম্পর্ক আরশের সাথে ঝুলন্ত’। যে তা দৃঢ় রাখে, আল্লাহ তার সাথে থাকেন। যে তা ছিন্ন করে, আল্লাহ তাকে পরিত্যাগ করেন’ এবং ‘ঐ ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ (মুত্তা, মিশ, হা/৪৯২১-২২)। ‘স্ত্রীর নিকটে স্বামী সবচেয়ে শ্রদ্ধার পাত্র (তির, মিশ, হা/৩২৫৫) এবং ‘ঐ স্বামীই সর্বোত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট সর্বোত্তম’ (তির, মিশ, হা/৩২৬৪)। ‘কন্যা সন্তানের প্রতি উত্তম আচরণ তার পিতা-মাতার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচার কারণ হবে’ (মুত্তা, মিশ, হা/৪৯৪৯)। ইসলামী পরিবারে নারী এবং তার সন্তানাদি ও পরিবারের ভরণপোষণ সহ যাবতীয় বাইরের দায়-দায়িত্ব পুরুষের। পক্ষান্তরে নারী হ’ল গৃহকত্রী। সন্তান পালন ও সংসার গোছানো তার প্রধান দায়িত্ব। সংসারে একজন নারী তার পিতার স্নেহ, ভাইয়ের ভালোবাসা, স্বামীর প্রেম ও সন্তানের শ্রদ্ধার বন্ধনে আবদ্ধ। কমপক্ষে উপরোক্ত চারজন পুরুষের নিরাপত্তা বেষ্টনীতে একজন নারী সর্বদা নিরাপদ আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত জীবন যাপন করে। কেবল হৃদয়ের বন্ধন নয়, বরং অর্থনৈতিক বন্ধনেও তারা আবদ্ধ। এজন্য ইসলাম নারীকে তার পিতা, ভাই, স্বামী ও সন্তানের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার প্রদান করেছে। এভাবে একটি মুসলিম পরিবার পরস্পরে অবিচ্ছিন্ন  একটি দেহের রূপ ধারণ করে। তাই উত্তরাধিকার বণ্টনে ইসলাম অত্যন্ত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে এবং নারী ও পুরুষের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। আল্লাহ বলেন, ‘পিতা-মাতা ও নিকটাত্মীয়দের পরিত্যক্ত সম্পদে পুরুষের অংশ রয়েছে... এবং নারীদের অংশ রয়েছে, কম হৌক বা বেশী হৌক একটি নির্ধারিত অংশ’ (নিসা ৭)। তিনি বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদের ব্যাপারে আল্লাহ এই বিধান দিচ্ছেন যে, একজন পুত্রের অংশ দু’জন কন্যার সমান হবে। যদি কন্যার সংখ্যা দু’য়ের অধিক হয়, তবে তারা পরিত্যক্ত সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ পাবে। আর যদি মাত্র একটি কন্যা সন্তান থাকে, তাহ’লে সে অর্ধেক পাবে... মৃতের ঋণ পরিশোধ ও অছিয়ত পূরণ করার পরে’ (নিসা ১১)। মৃতের স্ত্রী-কন্যারা তাদের জন্য নির্ধারিত অংশ ব্যতীত উদ্বৃত্ত সব সম্পত্তির মালিক কখনোই হবেন না, যতক্ষণ মৃতের অন্য কোন নিকটাত্মীয় বা আছাবাহ থাকেন। যদি কেউ না থাকেন, তখনই কেবল উদ্বৃত্ত সম্পত্তির সবটা কন্যা পাবেন ‘রদ’-এর বিধান অনুযায়ী। কিন্তু স্ত্রী বা স্বামী নন। এমতাবস্থায় উদ্বৃত্ত সম্পদ ইসলামী রাষ্ট্রের বায়তুল মালে জমা হবে। অথবা জনকল্যাণে দান করে দিবে। ইসলামী উত্তরাধিকার নীতিতে মীরাছ লাভের ভিত্তি হ’ল রক্ত ও আত্মীয়তার সম্পর্ক। কিন্তু যদি কেউ হত্যাকারী হয় অথবা মুরতাদ হয়, তাহ’লে সে নিহত ব্যক্তির এবং মুসলিম আত্মীয়ের মীরাছ পাবে না। অনুরূপভাবে কোন জারজ সন্তান তার পিতার অংশ পাবে না। ইসলামের এই উত্তরাধিকার নীতি চিরন্তন বিধান হিসাবে অবতীর্ণ হয়েছে, যা পরিবর্তনযোগ্য নয়। কিন্তু ‘এক পুত্রের অংশ দু’কন্যার সমান’ এই বিষয়টিকে কথিত নারীবাদীরা টার্গেট বানিয়েছে এবং সরকারের ঘাড়ে বন্দুক রেখে কুরআনী বিধানকে ছিন্ন-ভিন্ন করে সেখানে জাতিসংঘের রচিত মনগড়া বিধান ‘সিডো’ চাপিয়ে দেওয়ার ও তা বাস্তবায়নের দুঃস্বপ্ন দেখা হচ্ছে। অথচ আল্লাহ বলেন, ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পরিপূর্ণ। তাকে পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ (আন‘আম ১১৫)

এক্ষণে ইসলামের উক্ত মীরাছ বণ্টন নীতি কত নিখুঁত ও দূরদর্শী, তা আমরা  ভেবে দেখব। যেমন (১) স্বাস্থ্য ও স্বভাবগত কারণে ইসলাম নারী ও পুরুষের দায়িত্ব ও কর্মক্ষেত্র পৃথক করে দিয়েছে এবং উভয়ের জন্য সকল ক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করেছে। সেকারণ নারীকে সন্তান ধারণ ও লালন-পালন এবং সংসার দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়েছে। সাথে সাথে তাকে পরিবারের ভরণ-পোষণ ও অর্থোপার্জন সহ অন্যান্য গুরুদায়িত্ব পালনের বোঝা বহন করা থেকে মুক্তি দিয়েছে এবং একাজ পুরুষের উপর চাপিয়েছে। উভয়ের বুদ্ধিমত্তা, শরীর ও স্বভাবকে আল্লাহ ভিতর ও বাইরের দায়িত্ব পালনের উপযোগী করে সৃষ্টি করেছেন। ফলে দায়িত্ব বেশী থাকার কারণে পুরুষকে মীরাছের অংশ বেশী দেওয়া হয়েছে।

(২)  নারীকে তার মৌলিক প্রয়োজন তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদির ব্যাপারে দায়মুক্ত রাখা হয়েছে এবং এসব দায়িত্ব পুরুষের উপর অর্পণ করা হয়েছে। সেকারণ পুরুষের অংশ দ্বিগুণ করা হয়েছে। (৩) মেয়েরা স্বামীর কাছ থেকে তার মর্যাদার প্রতি সম্মান হিসাবে মোহরানা লাভ করে থাকে। যা তার জন্য একটি উদ্বৃত্ত পাওনা স্বরূপ। যা তাকে সংসারে খরচ করতে হয় না। অথচ পুরুষ মোহরানা প্রদান করে থাকে। যা তার জন্য একটি বিরাট ব্যয় স্বরূপ। এরপরেও তাকে স্ত্রীর ভরণ-পোষণ সহ সংসারের সব খরচ বহন করতে হয়। দেখা যায় যে, মেয়ে যা পায়, তা থেকে যায়। কিন্তু ছেলে নিঃস্ব হয়ে যায়। যেমন ধরুন, পিতা ৩ লক্ষ টাকা রেখে মারা গেলেন। মীরাছ বণ্টনে ছেলে ২ লাখ ও মেয়ে ১ লাখ টাকা পেল। অতঃপর বিয়ের সময় মেয়ে ১ লাখ টাকা মোহরানা পেয়ে ২ লাখ টাকার মালিক হ’ল। অন্যদিকে ছেলে তার বিয়ের সময় মোহরানা ও অন্যান্য বাবদ ২ লাখ টাকা খরচ করায় সে নিঃস্ব হয়ে গেল। এরপরেও তার উপরে রইল সংসার পালনের দায়-দায়িত্ব। (৪) বোন তার ভাইয়ের তুলনায় অর্ধেক পেলেও সে তার মা, দাদা, স্বামী ও বৈপিত্রেয় ভাই এমনকি অবস্থা ভেদে অন্যান্য আত্মীয় থেকেও মীরাছ লাভ করে থাকে। যা একত্রে যোগ করলে ভাইদের তুলনায় বরং বেশী হয়ে যায়। (৫) কন্যা তার মীরাছ নিয়ে স্বামীগৃহে চলে যায়। স্বামীগৃহ তার নিজগৃহ বলে গণ্য হয়। স্বামী ও সন্তানদের উন্নতি ও সমৃদ্ধি তখন তার জীবনে মুখ্য বিষয় হয়। পক্ষান্তরে পুত্র তার পিতার সংসার, সম্মান, ঐতিহ্য ও পিতার আত্মীয়-পরিজন সবকিছুর দায়-দায়িত্ব বহন করে। সেকারণ তাকে কন্যার দ্বিগুণ অংশ দেওয়াটাই ন্যায়বিচার ও বিজ্ঞানসম্মত। (৬) ইসলামী অর্থনীতি পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী অর্থনীতির বিপরীত। তাই ইসলামী সমাজে পুঁজি সর্বদা আবর্তনশীল। পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখার জন্য কন্যাকে বঞ্চিত করে কেবল পুত্রকে উত্তরাধিকার দেওয়া হয়। এমনকি এজন্য দত্তক পুত্র গ্রহণ করে তাকেই উত্তরাধিকারী করা হয় এবং পুত্র একাধিক থাকলে পুঁজি ভেঙ্গে যাবার ভয়ে কেবল জ্যেষ্ঠ পুত্রকে অংশীদার করা হয়। এমনকি ‘এজমালি পারিবারিক সম্পত্তি নীতি’ গ্রহণ করা হয়। সেখানে ইসলামী সমাজে পুত্র, কন্যা ও অন্যান্য নিকটাত্মীয়কে অংশীদার ও মালিক করে সমাজে পুঁজি ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পুঁজিবাদী সমাজে যেখানে মাত্র কিছু ব্যক্তি ও পরিবারের হাতে এবং সমাজবাদী সমাজে কেবল সরকারের হাতে সকল পুঁজি সঞ্চিত হয়, সেখানে ইসলামী সমাজে পুঁজির প্রবাহ সৃষ্টি হয় এবং সর্বত্র রক্ত সঞ্চালনের কারণে সমাজদেহ সুস্থ ও গতিশীল থাকে। কেবল তাই নয়, বরং উত্তরাধিকার বণ্টনের সময় ওয়ারিছগণ ছাড়াও যদি কোন অসহায় আত্মীয়-স্বজন ও ইয়াতীম-মিসকীন এসে হাযির হয়, তাহ’লে তাদেরকেও কিছু দান করা ও তাদের সাথে সদাচরণ করার উপদেশ দেওয়া হয়েছে (নিসা ৮)। এর পরেও রয়েছে ফরয যাকাত-ওশর-ফিৎরা ও নফল ছাদাক্বা সমূহের এবং গরীব প্রতিবেশীদের ও অন্যদের প্রতি উদার হস্তে দান করার অবারিত প্রবাহ।

ইসলামী পরিবারে উত্তরাধিকার বণ্টন ইসলামী অর্থনীতির উপরোক্ত কল্যাণময় নীতিমালার আলোকেই গৃহীত হয়েছে, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে সরাসরি অবতীর্ণ। আল্লাহ বলেন, এটি হ’ল আল্লাহর সীমারেখা। অতএব  যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। যার নিম্নদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল বাস করবে। আর সেটাই হ’ল মহান সফলতা’। ‘পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তার রাসূলের অবাধ্যতা করল এবং তাঁর সীমারেখা সমূহ লংঘন করল, তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন, যেখানে সে চিরকাল থাকবে এবং তার জন্য থাকবে মর্মান্তিক শাস্তি’ (নিসা ১৪)

পরিশেষে আমরা বলব, পবিত্র কুরআনে ‘পুরুষ জাতি’ নামে কোন সূরা না থাকলেও সূরা নিসা বা ‘নারীজাতি’ নামে ১৭৬ আয়াত বিশিষ্ট বিরাট একটি সূরা রয়েছে। অতএব এই সূরা না পড়ে অথবা এর অন্তত ৭-৮, ১১-১৪ এবং শেষ আয়াতটি না পড়ে কোন নারী উন্নয়ন নীতিমালা গ্রহণ করা কোন মুসলমানের নিকট কাম্য নয়। বরং আমাদের কাম্য হবে যেন ইসলামের দেওয়া উত্তরাধিকার বণ্টন নীতিমালা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় এবং কোন নারী যেন তার আল্লাহ প্রদত্ত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, সে ব্যাপারে সরকার কঠোরভাবে নযরদারি করবে এবং ইসলামী বিধান সমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করবে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!! (স.স.)