শেয়ার বাজার

১৯৯৬ সালের শেয়ার বাজার কেলেংকারির পর ২০১০-১১ সালে পুনরায় কেলেংকারি ঘটল। সেবারের কেলেংকারিতে ২০০ কোটি টাকার মত লোপাট হলেও এবার হয়েছে ১৫ হাযার কোটি টাকার উপর।  যার রেশ এখনো চলছে। সর্বস্ব হারিয়েছে প্রায় ৪০ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী। চলছে হাযার হাযার মানুষের আর্তনাদ-আহাজারি। কিন্তু নেপথ্য নায়করা থাকছে পূর্বের ন্যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তাদের টিকিতে হাত দেওয়ার ক্ষমতা সরকারের নেই। কেননা শেয়ার বাজার মূলতঃ পুঁজিপতিদের সৃষ্টি। আর বর্তমান সংসদের অধিকাংশ এমপি-ই হলেন পুঁজিপতি ব্যবসায়ী। সেকারণ অনেকেই এ সংসদকে ব্যবসায়ীদের ক্লাব বলেন। যাই হোক শেয়ার ব্যবসাটা কি, এ ব্যবসা শরী‘আতে বৈধ কি-না, এ ব্যবসায়ে জনগণের কল্যাণ বা অকল্যাণ কতটুকু- এগুলিই হবে আমাদের আলোচ্য বিষয়।

ইসলামে ব্যবসা হালাল ও সূদ হারাম। যৌথ ব্যবসার দু’টি নীতিই ইসলামে বৈধ। আর তা হ’ল মুযারাবা ও মুশারাকাহ। প্রথমটি হ’ল, একজনের টাকা ও অন্যজনের শ্রম। যেমন খাদীজার ছিল সম্পদ ও রাসূলের ছিল শ্রম। দ্বিতীয়টি হ’ল শরীকানা ব্যবসা। যাতে উভয়ে সম্পদ ও শ্রমে আনুপাতিক অংশীদার হবে। দু’টি ব্যবসাতেই লাভ-ক্ষতির অংশীদার উভয় পক্ষ হবে। এ দুই নীতির বাইরে ব্যবসায়ের যত পথ-পদ্ধতি আধুনিক যুগে বের হয়েছে, প্রায় সবগুলিই পুঁজিপতিদের পুঁজি বাড়ানোর অপকৌশল মাত্র। যা তাদেরই স্বার্থে তাদেরই নিয়োজিত অর্থনীতিবিদদের সৃষ্টি। আর শেয়ার বাজার তো আসলে কোন বাজারই নয়। এ এমন একটি বাজার যেখানে কোন মাল নেই, দোকান নেই। আছে কেবলই ক্রেতা। যাদের নযর থাকে কেবলই টিভি-কম্পিউটারের রূপালি পর্দার দিকে। শেয়ার বেচাকেনাকে কোম্পানীর অংশের বেচাকেনা ধরে নিয়ে একে বৈধতার সনদ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়ে থাকে। কিন্তু বর্তমান শেয়ার বাজার এমন একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ার বেচাকেনা হ’লেও কোম্পানীর লাভ-লোকসান বা বাস্তব অবস্থার সাথে এর তেমন কোন সম্পর্ক নেই। শেয়ারকে কেন্দ্র করে মূলতঃ Money-game-ই হচ্ছে শেয়ার বাজারের মূল ধারা। এখন শেয়ার ব্যবসা করার জন্য নিজের টাকা লাগে না। এজন্য মার্চেন্ট ব্যাংক হয়েছে। এরা কিন্তু মালের মার্চেন্ট নয়। বরং টাকার মার্চেন্ট। অর্থাৎ আপনি এদের কাছে শেয়ার বন্ধক দিয়ে যত টাকা খুশী নেবেন। বিনিময়ে এদের সূদ দিবেন। এদের উপস্থিতিতেই আপনি শেয়ার বিক্রি করবেন। আপনার লোকসান হলেও এদের লাভ ঠিক-ই থাকবে। শেয়ার বাজারের গতি নির্ধারণে এই সব ব্যাংকের উল্লে­খযোগ্য ভূমিকা থাকে। এরা জাহেলী যুগের আবু জাহল, উবাই ইবনু খালাফ ও বৃটিশ যুগের মাড়োয়ারী-কাবুলীওয়ালাদের মত।

মার্চেন্ট ব্যাংকের মত রয়েছে মিউচুয়াল ফান্ড। এদের অন্য কোথাও ব্যবসা নেই। এরা স্রেফ শেয়ারের ব্যবসা করে। বিভিন্ন কোম্পানীর শেয়ারই এদের পুঁজি। আর তা হচ্ছে লিকুইড মানি-র মত। যেকোন সময় তা মার্কেটে বিক্রি করে দিয়ে নগদ টাকা পেতে পারেন। কমবেশী যাই-ই পাক, সবটাই তাদের লাভ। এক কথায় বলা যায় এগুলি ভদ্র নামের আড়ালে স্রেফ ফটকাবাজারী। আরেকটি গ্রুপ কাজ করে হুজুগ লাগানোর জন্য। তারা ছোট ছোট বিনিয়োগকারীদের অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রতারিত করে। রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার রঙিন স্বপণ দেখিয়ে তাদেরকে শেয়ার কিনতে প্রলুব্ধ করে। তারপর তাদের টাকাগুলো শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ হলেই তা লোপাট করে এই গোষ্ঠী সরে পড়ে। কিন্তু তারা থাকে সর্বদা নিরাপদ দূরত্বে। যেমন সঊদী যুবরাজ রূপালী ব্যাংক কিনবেন বলে সংবাদ এল। অমনি প্রতারক চক্র সজাগ হ’ল। ফলে অচল রূপালী ব্যাংকের ১০০/- টাকার শেয়ার সচল হয়ে ৩০০০/- টাকার উপরে উঠে গেল। পরে যুবরাজ যখন কিনলেন না, তখন শেয়ারে ধস নামল। বহুলোক ফতুর হ’ল। এখন শেয়ার বাজার নিজেই একটি স্বয়ং সম্পূর্ণ মার্কেটে পরিণত হয়েছে। লেনদেনের ক্ষেত্রে কোম্পানীর নামটাই কেবল ব্যবহৃত হয়। কোম্পানীর ব্যবসায়িক লাভ-ক্ষতির সঙ্গে উল্লে­খযোগ্য কোন সম্পর্ক এখন আর অবশিষ্ট নেই।

যদিও এগুলি রোধ করার জন্য এসইসি-র ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু তারা সবক্ষেত্রে সফল হতে পারেন না। যেমন বর্তমানে পারছেন না। কারণ পুঁজিপতিদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাওয়ার ক্ষমতা নিয়ন্ত্রক সংস্থা এসইসি-র নেই। নীতিবান কোন ব্যক্তি চেয়ারম্যান হলে তাকে হয় সরে দাঁড়াতে হবে, নয় ম্যানেজ্ড হ’তে হবে। নেপথ্যের শক্তির সঙ্গে পাল্ল­া দেওয়া তাদের কাজ নয়। হ্যঁা, সরকার তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রের ন্যায় এক্ষেত্রেও  দলীয় সরকার সর্বদা বিরোধী দলের উপরে দোষ চাপিয়ে বাঁচতে চায়।

এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল প্রচলিত শেয়ার ব্যবসা জুয়ার মধ্যে পড়ে কি-না।  উত্তরে বলা চলে যে, কোম্পা্নীর শেয়ার খরিদ ও তার লাভ-লোকসানের ভাগীদার হওয়ার বিষয়টি আকর্ষণীয়। কিন্তু সেটা আপনি পাবেন বছর শেষে কোম্পানী যখন তার লভ্যাংশ ঘোষণা করবে তখন। অথচ শেয়ার মার্কেট ওঠা-নামা করে মিনিটে-মিনিটে। নাম ব্যবহার করা হয় কোম্পানীর। তাহ’লে এটা কোন পর্যায়ে পড়বে? নিঃসন্দেহে এটি জুয়া খেলার মত। অতএব হারামের দরজা বন্ধ করাই ইসলামী ফিক্বহের অন্যতম প্রধান মূলনীতির দিকে তাকালে প্রচলিত শেয়ার ব্যবসাকে হারাম বলা ভিন্ন উপায় নেই। সাথে সাথে সম্পুরক প্রশ্ন এটাও চলে আসে যে, যদি কেউ বার্ষিক লভ্যাংশ বা ডিভিডেন্ট পাবার আশায় কোম্পানীর শেয়ার খরিদ করে, তাহ’লে সেটা জায়েয হবে কি?। উত্তরে বলা যায় যে, যদি ঐ কোম্পানীর মূলধনে ও লেনদেনে কোথাও সূদ মিশ্রিত না থাকে, অর্থাৎ সূদী ঋণ না থাকে এবং ব্যবসায়ে ও বিনিয়োগে ফটকাবাজারি ও হারাম মিশ্রিত না থাকে, তাহ’লে আপনি সেখানে যেতে পারেন। কিন্তু হাযারো শরীকানার ঐ ব্যবসায়ে কে আপনাকে ঐ নিশ্চয়তা দিবে? তাছাড়া এরূপ কোম্পানীর অস্তিত্ব এদেশে আছে কি? সন্দিগ্ধ বিষয় থেকে নিঃসন্দেহ বিষয়ের দিকে ধাবিত হওয়াই রাসূলের নির্দেশ এবং তা মেনে চলাই মুমিনের নাজাতের পথ। তাই জান্নাত পিয়াসী মুমিনের জন্য বর্তমান অর্থনীতিতে শেয়ার মার্কেটে প্রবেশ করা আদৌ বৈধ হবে না। কারণ- (১) এতে ক্রেতার অনেক সময় সম্যক জ্ঞান থাকে না কী বস্ত্তর শেয়ার তিনি ক্রয় করছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হারাম বস্ত্তর ক্রয়-বিক্রয় হারাম করেছেন (বু: মু:)। (২) যে বস্ত্তর শেয়ার কেনা-বেচা হয়, তা দেখা ও জানা-বুঝার সুযোগ এখানে থাকে না। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এমন ক্রয়-বিক্রয়কে ধোঁকা বলেছেন (মুসলিম)। (৩) শেয়ার ব্যবসার পণ্য আয়ত্তে নিয়ে আসার সুযোগ থাকে না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বস্ত্ত ক্রয়ের পর তা নিজ মালিকানায় নিয়ে আসার পূর্বে বিক্রয় করতে নিষেধ করেছেন (মুসলিম)। (৪) শেয়ার ব্যবসা একটি জুয়া মাত্র। যেখানে ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ মাল দেখে না। অথচ অনবরত দর উঠা-নামা করে। (৫) শেয়ার ব্যবসায় ফটকাবাজারীর প্রচুর সুযোগ রয়েছে। অনেক সময় কোম্পানী তার প্রকৃত তথ্য গোপন রাখে। কখনো কারখানা তৈরি না করেই তার শেয়ার বাজারে ছাড়া হয়। কোনরূপ ব্যবসা বা মালামাল ছাড়াই তারা এ লাভ করে থাকে। এছাড়াও নিত্যনতুন ছলচাতুরী শেয়ারবাজারে যুক্ত হচ্ছে। (৬) এতে সূদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ শেয়ার ব্যবসা ব্যাংক থেকে সূদের ভিত্তিতে ঋণ নিয়ে করা হচ্ছে। ফলে এতে দুনিয়া ও আখেরাতে জনগণের কোন কল্যাণ নেই। অতএব শেয়ার ব্যবসা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।

পরিশেষে আমরা বলব, এদেশের প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। তাদের নির্বাচিত সরকার মুসলমান। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ মুসলমানদের হাতে। তাহ’লে কেন এদেশে সূদ ও জুয়ার মত হারাম বস্ত্ত যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে? যারা রাজনীতি ও অর্থনীতির দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছেন, তাদেরকে আমরা আল্লাহ ভীতির উপদেশ দিচ্ছি এবং হারাম থেকে তওবা করে হালাল রূযীর পথে ফিরে আসার আহবান জানাচ্ছি। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!! (স.স.)