নির্বাচনী যুদ্ধ

বিগত সংসদ নির্বাচনের পর এখন আসছে পৌরসভা নির্বাচন। এরপর আসবে ইউপি নির্বাচন। উদ্দেশ্য, দেশের সর্বত্র সুশাসন কায়েম করা। দলমত নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জীবনে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেওয়া। সমাজে ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হওয়া। জনগণের নির্বাচিত ব্যক্তিই জনগণকে অধিক জানেন, অতএব তিনিই জনগণের সত্যিকার বন্ধু- এরূপ একটা সুধারণা থেকেই বর্তমান যুগে নির্বাচনী রাজনীতির পদযাত্রা শুরু হয়েছে। আর এজন্য সৃষ্টি হয়েছে দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন প্রথা। সবাই ভোট চাইবে। ভোটার যাকে খুশী ভোট দিবে। কিন্তু প্রশ্ন: কোন জ্ঞানী ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন লোক কি নেতৃত্ব চেয়ে নিতে বাড়ী বাড়ী ঘুরতে চান? তাছাড়া অজ্ঞ ও বিজ্ঞের ভোটের মূল্য কি সমান? সমাজের অধিকাংশ সাধারণ লোকের ভোটে বিজ্ঞ লোক কিভাবে নির্বাচিত হবেন? এ জন্য জ্ঞানী ও যোগ্য লোকদের সুবিধাবাদী নীতি ও প্রতারণামূলক ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। অথবা সরে দাঁড়াতে হবে। আজকে সেটাই হয়েছে। জ্ঞানীরা এসব থেকে দূরে থাকেন। ফলে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধিই এখন সমাজে অসম্মানিত শ্রেণীভুক্ত হয়েছেন। ১০০ ভোটারের মধ্যে ১০ জন প্রার্থীর ৯ জনের প্রাপ্ত ভোট যদি ৮৯ হয়। অন্যের ১০টি ভোটের চাইতে একজনের প্রাপ্ত ভোট যদি ১১টি হয়, তাহ’লে তিনিই হবেন ১০০ জনের নির্বাচিত প্রতিনিধি। যদিও তিনি হলেন মূলত: ১১ জনের প্রতিনিধি। এই শুভংকরের ফাঁকি ছাড়াও রয়েছে বিরাট জান-মালের ক্ষয়ক্ষতি ও সময়ের অপচয়। রয়েছে ভয় প্রদর্শন, মিথ্যা আশ্বাস ও ধোঁকা-প্রতারণার গরমবাজারী। কেননা প্রত্যেক প্রার্থীই ১০০ ভোটারের মন জয় করার জন্য দু’হাতে পয়সা খরচ করে। অবশেষে ৯ জন ফেল করলে তারা সব হারায়। এই ভোটের জুয়ায় যে পাশ করে, তার প্রধান লক্ষ্য হয়- ব্যয়কৃত অর্থ সূদে-আসলে উঠিয়ে নেওয়া এবং আগামী ভোট আসার আগেই সম্ভাব্য প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা। এমনকি দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়া। এই নির্বাচনী যুদ্ধের আবশ্যিক পরিণতি হিসাবে সমাজের সর্বত্র সশস্ত্র ক্যাডারের একটি দল সৃষ্টি হয়েছে। যারা প্রার্থীর টাকা পেয়ে মিছিল-মিটিং করে, প্রতিপক্ষের ক্ষতি করে, এমনকি খুনোখুনিতেও লিপ্ত হয়। অথচ যে উদ্দেশ্যে এরা নির্বাচিত হন, তার কিছুই এদের দ্বারা সমাজ পায় না। ফলে সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের অধিকাংশ দুর্নীতির উৎস হ’ল রাজনীতিবিদরা অর্থাৎ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা। যদিও নিঃস্বার্থ ও জনদরদী রাজনীতিবিদগণের সম্মান ও মর্যাদা সর্বদা ছিল ও থাকবে। কিন্তু বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা রাজনীতিবিদ নন। তাদেরকে আনা হয় প্রশাসনকে সাহায্য করার জন্য। সমাজে শান্তি ও শৃংখলা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবে হয়ে থাকে তার উল্টা। আধুনিক প্রযুক্তি ছাড়াই দিল্লীতে বসে বাংলা পর্যন্ত বিশাল ভারতবর্ষের ১ লাখ ১৩ হাযার পরগণা শাসন করেছেন শেরশাহ (১৫৪০-৪৫ খৃঃ)। শায়েস্তা খাঁর আমলে (১৬৬৪-৮৮ খৃঃ) টাকায় ৮ মণ চাউল কিনেছে ঢাকার মানুষ। অথচ এদেশের মানুষ এখন পেটের দায়ে সন্তান বিক্রি করছে। নেতৃত্ব নিয়ে ঘরে ঘরে এরূপ মারামারি-কাটাকাটি তখন ছিল না। কিন্তু এখন সর্বত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থাকা সত্তেবও ছোট্ট একটি দেশ শাসন করতেও আমরা অপারগ। কারণ কী? এর গোড়ায় গলদ কোথায়? জবাব এই যে, এর প্রধান গলদ হচ্ছে নেতৃত্ব চেয়ে নেওয়ার রাজনীতি। যা তার মধ্যে নেতৃত্ব আদায় করে নেওয়ার হিংস্র মানসিকতা সৃষ্টি করে।

প্রশ্ন হ’ল: এরূপ নির্বাচনের আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা আছে কি? রাষ্টের প্রধান তিনটি বিভাগ হ’ল বিচার, শাসন ও আইন বিভাগ। বিচার ও শাসন বিভাগে কোন নির্বাচন হয়না। জজ-ম্যাজিস্ট্রেটগণ এবং ডিসি, ইউএনও গণ হন সরকারের নিযুক্ত। বাকী আইনসভা বা জাতীয় সংসদ সদস্যগণ হন জনগণের নির্বাচিত। অন্যদের যোগ্যতা বিচার করা আবশ্যিক হ’লেও যারা আইনপ্রণেতা হবেন, তাদের কোন সততা-যোগ্যতা-দক্ষতা কিছুই বিচার করা হয় না। তাই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হন কোনরূপ ডিগ্রীহীন স্বশিক্ষিত দলনেতা। আর এইসব নেতারা যখন  শিক্ষা বিভাগ এবং শাসন ও বিচার বিভাগের উপর খবরদারী করেন, তখন দেশের অবস্থা যেমনটা হওয়া উচিত, তেমনটাই হচ্ছে। মানীর মান নেই, গুণীর কদর নেই। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, গুম, খুন, নারী নির্যাতন এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। পৃথিবীর যেসব দেশে এই নির্বাচনী জুয়া রয়েছে, সেসব দেশ এভাবে অশান্তির দাবানলে জ্বলছে মূলত: এই দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে। এতে সৎ ও যোগ্য লোক নির্বাচিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। কেউ হ’লেও নিজ দলীয় বা বিরোধী দলীয় চাপে তিনি সৎ ও নিরপেক্ষ থাকতে পারেন না।

অথচ ডিসি ও ইউএনও-দের সাথে অতিরিক্ত প্রশাসক দু’তিনজনকে নিয়োগ দিয়ে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। অতিরিক্ত যেলা প্রশাসক ও উপযেলা প্রশাসকদের কাজ হবে দৈনিক গ্রামে-গঞ্জে সফর করা ও জনগণের সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া ও তাদের কথা শোনা। যার যত সুনাম হবে, তার তত দ্রুত পদোন্নতি হবে ও তিনি পুরষ্কৃত হবেন। দুর্নাম হলে শাস্তি হবে। যেলা প্রশাসকের ন্যায় প্রয়োজনে ইউনিয়ন প্রশাসকও নিয়োগ করা যেতে পারে।

রাষ্ট্রের প্রধান ২টি স্তম্ভের ন্যায় আইন প্রণয়ন বিভাগটিও হবে সরকারের মনোনীত। দেশের যিনি প্রধান হবেন একমাত্র তিনিই হবেন নির্বাচিত। এবং তা হবে রাষ্ট্রের জ্ঞানী-গুণীদের মাধ্যমে দল ও প্রার্থীবিহীন নেতৃত্ব নির্বাচন নীতির অনুসরণে। সাধারণ জনগণ উপরোক্ত নির্বাচনকে সমর্থন করবে মাত্র। এই প্রযুক্তির যুগে সকলে ঘরে বসে অন-লাইনে ভোট দিবে। কোন ক্যানভাস, হৈ-হুল্লোড় ও টাকার ছড়াছড়ি থাকবে না। নির্বাচন কমিশন দায়িত্বশীল হবেন কিভাবে তাঁরা দল ও প্রার্থীবিহীন নির্বাচন পরিচালনা করবেন। নির্বাচিত নেতা জানতে বা বুঝতেও পারবেন না কারা তাকে ভোট দিয়েছে বা দেয়নি। এর ফলে তার মানসিকতা থাকবে সবার প্রতি উদার ও নিরাসক্ত। দলীয় চাপ থেকে তিনি মুক্ত থাকবেন ও নিরপেক্ষভাবে দেশ শাসন করতে পারবেন। সরকারী ও বিরোধীদলের কোন নামগন্ধ থাকবেনা। অতঃপর তিনি দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানী-গুণী ও বিশ্বস্ত এবং যোগ্য ও অভিজ্ঞ সীমিত সংখ্যক ব্যক্তিদের নিয়ে একটি পার্লামেন্ট মনোনয়ন দিবেন। যাদের পরামর্শে তিনি দেশ শাসন করবেন। যদি তিনি বা দেশের অধিকাংশ নাগরিক আল্লাহতে বিশ্বাসী হন, তাহ’লে তিনি আল্লাহকে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বলে মেনে নিবেন এবং আল্লাহর বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ করবেন। কোনভাবেই তিনি বা তার পার্লামেন্ট স্বেচ্ছাচারী হবেন না। ইনশাআল্লাহ এভাবেই দেশে শান্তি ফিরে আসবে।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তুমি নেতৃত্ব চেয়ে নিয়ো না। কারণ যদি চাওয়ার মাধ্যমে তোমাকে তা দেওয়া হয়, তাহ’লে তুমি তাতেই পতিত হবে। আর যদি না চাইতে দেওয়া হয়, তাহ’লে তুমি সাহায্যপ্রাপ্ত হবে’ (বু:মু:, মিশকাত হা/৩৬৮০)। তিনি বলেন, ‘আল্ল­াহর কসম! আমরা ঐ ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা অর্পণ করিনা, যে ব্যক্তি তা চেয়ে নেয় বা লোভ করে বা মনে আকাংখা পোষণ করে’ (বু: মু:, মিশকাত হা/৩৬৮৩)। তিনি আরও বলেন, ‘দুনিয়ায় যে ব্যক্তি নেতৃত্বের লোভ করে, ক্বিয়ামতের দিন তার জন্য তা লজ্জার কারণ হবে’ (বুখারী, মিশকাত হা/৩৬৮১)।

অতএব, ঘরে ঘরে নেতা হবার এই অন্যায় প্রতিযোগিতা ও দলাদলি-হানাহানির মূল উৎস বন্ধ করতে হবে। সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে তাই আমাদের পরামর্শ হ’ল: দল ও প্রার্থীবিহীন ইসলামী নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা অনতিবিলম্বে চালু করুন। সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিপতিদের প্রতারণামূলক এই নির্বাচন ব্যবস্থার লেজুড়বৃত্তি পরিহার করুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন! আমীন!! (স.স.)