সমঝোতা ও শান্তি

সমঝোতা ও শান্তি ব্যতীত সমাজ এগোতে পারে না। কিন্তু সরকারী ও বিরোধী দলীয় রাজনৈতিক সমাজ ব্যবস্থায় দেশ এখন অশান্তির দাবানলে জ্বলছে। এরপরেও সমঝোতা থাকতেই হবে। প্রধানত: সমাজনেতা ও ধর্মনেতাদের পদস্খলনেই সমাজে আল্লাহর গযব নেমে আসে। আর এই দুই শ্রেণী যদি প্রকৃত আল্লাহভীরু হয়, তাহ’লে সমাজে আল্লাহর রহমত নাযিল হয়। তাই দেশের রাজনীতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমঝোতা কায়েম হওয়া সর্বাগ্রে যরূরী। আমরা এ দু’টি ক্ষেত্রে সমঝোতা বিষয়ে কিছু প্রস্তাবনা রাখতে চাই।-

(১) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে : (ক) সকলের মূল লক্ষ্য হবে জনকল্যাণ। অতএব হরতাল, ধর্মঘট, অবরোধ, গাড়ী ভাংচুর ইত্যাদি বন্ধের ব্যাপারে একমত হ’তে হবে। কেননা এতে কোন জনকল্যাণ নেই। আছে কেবলি জনদুর্ভোগ। তাই যেকোন সমস্যা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকেই সবচেয়ে বেশী নমনীয় হতে হবে। প্রয়োজনে সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দের পরামর্শ নিতে হবে। যেন সরকারী সিদ্ধান্তের পক্ষে সর্বাধিক জনমত ঐক্যবদ্ধ হ’তে পারে। সরকারকে মনে রাখতে হবে যে, তারা কোন দলের মুখপাত্র নন, বরং দেশের আপামর জনগণের মুখপাত্র। তাদেরকে অবশ্যই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ মানসিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে। কোনপ্রকার যিদ ও হঠকারিতার আশ্রয় নেওয়া যাবে না। হিংসা ও প্রতিশোধ নয়, ক্ষমা ও মহত্ত্ব দিয়ে অন্যকে জয় করতে হবে। পারস্পরিক আলোচনা ব্যর্থ হ’লে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে যেতে হবে এবং শারঈ সিদ্ধান্তের সম্মুখে সকলকে মাথা নত করতে হবে। কেননা আল্লাহর বিধান দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য কল্যাণময়। অমুসলিমদের ব্যক্তিগত ধর্মীয় রীতিনীতি এর  বাইরে থাকবে। কিন্তু ইসলামের বৈষয়িক বিধান সমূহ সবাইকে মেনে নিতে হবে। তাতে সকলের সমভাবে কল্যাণ হবে। যেমন সূদ ভিত্তিক পূঁজিবাদী অর্থনীতি বাতিল করে ইসলামী অর্থনীতি চালু করতে হবে। এতে অর্থনৈতিক শোষণ বন্ধ হবে এবং ধনী-গরীবের বৈষম্য কমে যাবে। ইসলামের ফৌজদারী আইন সমূহ চালু করতে হবে। তাতে চুরি-ডাকাতি, খুন-খারাবি, মদ, জুয়া, নারী নির্যাতন ইত্যাদি বন্ধ হবে। ইসলামের বিচার ব্যবস্থা চালু করতে হবে। তাতে অমানবিক ৫৪ ধারা ও অন্যায় হাজতী প্রথার অপপ্রয়োগ বন্ধ হবে এবং বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা থাকবে না।

(খ) দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতব। এ প্রশ্নে সকলকে আপোষহীন ও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। স্বাধীনতার পক্ষ ও বিপক্ষ বলে জনগণকে বিভক্ত করা যাবে না। দেশ বাঁচলে সবাই বাঁচবে। দেশের শত্রু-মিত্র চিনতে হবে। যারা আমাদের দেশকে মরুভূমি বানিয়েছে, যারা আমাদের দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংস করছে, যারা আমাদের ভূমি ও পানি সীমায় আগ্রাসন চালাচ্ছে, যারা ধর্ম প্রচারের মুখোশে এদেশের মানুষকে খৃষ্টান বানাচ্ছে, যারা দেশের কয়লা ও তৈল-গ্যাস লুট করতে আসছে, যারা এদেশকে তাদের হুকুম-বরদার বানাতে চায়, ঐসব বিদেশী শক্তির ব্যাপারে সকল দলকে একমত থাকতে হবে। অন্য দেশের সঙ্গে সমতা ভিত্তিক বন্ধুত্ব হবে। কিন্তু কোন অবস্থাতেই কাউকে প্রভু মেনে নেওয়া যাবে না এবং তাদের ইন্ধনে ও তাদের স্বার্থে গণতন্ত্রের নামে দু’দলে মারামারি করে সমাজ ধ্বংস করা চলবে না। মোটকথা বাঁচার পথ কেবল একটাই খোলা আছে। আর তাহ’ল, মানুষ নয়, আল্লাহকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী বলে মেনে নিতে হবে। তাঁর বিধান ও হুকুমের সামনে সবাইকে মাথা নত করতে হবে। আল্লাহ প্রেরিত রজ্জু পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহকে হাতে-দাঁতে আঁকড়ে ধরতে হবে। আব্দুল্লাহদের উপরে হাবলুল্লাহকে স্থান দিতে হবে। দূর অতীতে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আরবদের মধ্যে ৬০,৮০,১২০ বছর যুদ্ধ চলেছে। মরেছে মানুষ শত শত। অবশেষে তা বন্ধ হয়েছে ইসলাম আসার পরে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করার ফলে। আজও তা সম্ভব একই পথে, একই নিয়মে।

(২) ধর্মীয় ক্ষেত্রে : (১) যেসব বিষয়ে কুরআনে স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে, সে ব্যাপারে কোনরূপ মতভেদ চলবে না। যেমন (ক) আল্লাহর নিজস্ব আকার আছে। ‘তাঁর তুলনীয় কিছুই নেই’ (শূরা ১১, ইখলাছ ৪)। ‘তিনি আরশে সমাসীন’ (ত্বোয়াহা ৫)। অতএব যত কল্লা তত আল্লাহ, সকল সৃষ্টিই স্রষ্টার অংশ, তিনি নিরাকার, তিনি সর্বত্র বিরাজমান ইত্যাদি শিরকী আক্বীদা পোষণ করা যাবে না। (খ) রাসূল (ছাঃ) মাটির মানুষ ছিলেন (কাহফ ১১০)। তিনি নূরের নবী, তিনি মীলাদের মজলিস সমূহে হাযির হন ইত্যাদি শিরকী আক্বীদা ছাড়তে হবে। (গ) ‘মৃত মানুষকে কিছু শুনানো যায় না’ (ফাত্বির ২২)। তিনি জীবিত মানুষদের কোন উপকার বা ক্ষতি করতে পারেন না (আ‘রাফ ১৮৮)। কুরআনের এইসব স্পষ্ট বক্তব্য থাকার পরেও কবরপূজার পিছনে বা শহীদ মিনারের পিছনে দৌড়ানো যাবে না (২) রাসূলের যামানায় যেটা দ্বীন হিসাবে চালু ছিল না বা ছহীহ হাদীছে যার কোন ভিত্তি নেই, এমন কোন বস্ত্ত দ্বীনের নামে চালু করা যাবে না। যেমন কথিত ঈদে মীলাদুন্নবী, শবেবরাত, কুলখানি, চেহলাম, আশূরার তা‘যিয়া মিছিল, ওরস, ঈছালে ছওয়াব, এক মজলিসে তিন তালাককে তিন তালাক বায়েন গন্য করা ও তার প্রতিক্রিয়ায় হিল্লা প্রথা জায়েয করা ইত্যাদি (৩) কোন ব্যাপারে শরী‘আতে হুকুম না থাকলে তা ছেড়ে দেওয়া। যেমন প্রচলিত চার মাযহাব মান্য করাকে ফরয গন্য করা, ছালাতের শুরুতে মুখে নিয়ত পাঠ করা, ঈদের ছালাতে ছয় তাকবীর দেওয়া, এক গরুতে কুরবানী ও আক্বীক্বা দু’টিই করা, খাজনার জমিতে ওশর না দেওয়া, জানাযার ছালাতে সূরা ফাতিহা পাঠ না করা, ছালাত শেষে দলবদ্ধভাবে মুনাজাত করা ইত্যাদি (৪) কোন ব্যাপারে ছহীহ হাদীছ পেলে তা গ্রহণ করা এবং যঈফ হাদীছের উপর আমল ছেড়ে দেওয়া। যেমন ছালাতে নাভির নীচে হাত বাঁধা, রাফ‘উল ইয়াদায়েন না করা, জেহরী ছালাতে সশব্দে আমীন না বলা, ২০ রাক‘আত তারাবীহ পড়া ইত্যাদি। কেননা মুজতাহিদ ইমামগণ সকলেই বলে গেছেন, ‘যখন তোমরা ছহীহ হাদীছ পাবে, জেনে রেখ সেটাই আমাদের মাযহাব’ (শা‘রানী, কিতাবুল মীযান ১/৭৩)(৫) শরী‘আতের কোন বিষয়ে ব্যক্তিগত যিদ বা মাযহাবী সংকীর্ণতা না রাখা এবং আত্ম অহংকারে লিপ্ত না হওয়া। আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) বলেন, শেষোক্তটাই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকর’ (বায়হাক্বী, মিশকাত হা/৫১২২)(৬) সমাজে ভুল কিছু চালু থাকলে তা সংস্কারের জন্য চরমপন্থী না হওয়া। বরং মানুষকে সহানুভূতির সাথে বুঝিয়ে উত্তম পন্থায় সমাজ সংশোধনের চেষ্টা করা (হামীম সাজদাহ ৩৪)(৭) কোন বিষয়ে ব্যাখ্যাগত মতভেদ দেখা দিলে ছাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফে ছালেহীনের ব্যাখ্যাকে অগ্রাধিকার দেওয়া। যেমন জেহরী ছালাতে ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করা। এ ব্যাপারে রাবী হযরত আবু হোরায়রা (রাঃ) বলেন, তুমি ওটা চুপে চুপে পড়’ (মুসলিম)। অমনিভাবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবায়ে কেরাম মুক্বীম অবস্থায় এক গরুতে সাত ভাগা কুরবানী করেছেন বলে জানা যায় না ইত্যাদি। (৮) এর পরেও যদি কোন মতভেদ থাকে এবং সেখানে ঈমান ও কুফরের মত বিষয় না থাকে, তাহ’লে সেজন্য পরস্পরে সহনশীল থেকে মিলেমিশে কাজ করবে। ইনশাআল্লাহ এ পথেই ধর্মীয় বিভক্তি দূর হবে এবং সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্য কায়েম হবে।

আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা দৌড়ে এসো তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা ও জান্নাতের দিকে, যার বিস্তৃতি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল পরিব্যপ্ত। যা কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য প্রস্ত্তত করা হয়েছে’। ‘যারা (১) আল্লাহর পথে ব্যয় করে স্বচ্ছল ও অস্বচ্ছল অবস্থায় (২) যারা ক্রোধ দমন করে (৩) মানুষকে ক্ষমা করে...’ (৪) ‘যারা অশ্লীল কাজ করলে বা নিজের উপর যুলুম করলে আল্লাহকে স্মরণ করে ও তার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং (৫) জেনেশুনে নিজের অন্যায় কাজের উপর যিদ করে না। তাদের জন্যই রয়েছে পুরস্কার হিসাবে আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত...’ (আলে ইমরান ১৩৩-৩৬)। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন! (স.স.)