প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান : কিছু স্মৃতি

[প্রথিতযশা জ্ঞানতাপস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল এবং লেখকের পিএইচ.ডি থিসিসের মূল্যায়ন কমিটির সম্মানিত সদস্য প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান গত ২৮শে মার্চ রবিবার চট্টগ্রামে তাঁর দেওয়ানবাজারের বাড়ীতে নাশতার পর সকাল সাড়ে ৮-টায় পরিবারের সম্মুখে বসা অবস্থায় হঠাৎ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। ইন্না লিলল­া-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। বাদ যোহর নগরীর আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে ১ম জানাযা হয়। অতঃপর বাদ মাগরিব লোহাগড়া উপযেলার স্বগ্রাম চুনতীতে ২য় জানাযা শেষে তাঁকে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী, দুই পুত্র, দুই কন্যা ও নাতি-নাতিনী সহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে যান।

ড. মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান ১৯২৬ সালের ১৮ই এপ্রিল চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে বি.এ. (সম্মান) পরীক্ষায় ১ম শ্রেণীতে ১ম হয়ে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত হন। ১৯৫১ সালে ১ম শ্রেণীতে এম.এ. পাস করেন। ১৯৫৫ সালে কানাডার ম্যাকগীল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে দ্বিতীয় বার এম.এ. ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে আমেরিকার ক্যালিফোর্ণিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলি শাখার রিসার্চ ফেলো হিসাবে পলিটিক্যাল সায়েন্স অধ্যয়ন করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাস’ বিষয়ে পিএইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন।

১৯৬১ সালে করাচী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৬৬ সালে সেখান থেকে ইসলামাবাদ গমন করেন ও ইসলামিক রিসার্চ ইন্সষ্টিটিউটে সহযোগী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন।

১৯৭২ সালে দেশে ফিরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘সহযোগী অধ্যাপক’ পদে যোগদান করেন। অতঃপর ১৯৭৩ সালে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি ‘প্রফেসর’ পদে উন্নীত হন এবং ১৯৯২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। পরে এক্সটেনশনে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ‘প্রফেসর’ পদে বহাল থাকেন।

১৯৭৭ সালে তিনি ঢাকায় নবপ্রতিষ্ঠিত ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল পদে যোগদান করেন এবং ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক কাজ আনজাম দেন। ১৯৯০ সালে তিনি চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অনারারী ডাইরেক্টর জেনারেলের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পরে ঢাকার আরামবাগে অবস্থিত ‘বিশব সূফী ফাউন্ডেশনে’র কুরআন গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক পদে যোগদান করেন। ২০০২ সালে তিনি প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চ্যান্সেলর হিসাবে সাউদার্ন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডীন ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের হেড ছিলেন।

বাংলাদেশের ইতিহাস ও ইসলামী সংস্কৃতি বিষয়ে তাঁর ১৫টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন জার্ণালে তাঁর বহু প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘হিস্টরী অব দি ফারায়েযী মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ ছিল তাঁর ডক্টরেট থিসিস এবং ‘তিতুমীর এন্ড হিজ ফলোয়ারর্স ইন বৃটিশ ইন্ডিয়ান রেকর্ডস’ তার দু’টি মৌলিক গবেষণাগ্রন্থ। এছাড়া মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রীডম ইন বেঙ্গল, দি গ্রেট রিভোল্ট অব এইটিন ফিফটি সেভেন এন্ড দি মুসলিমস অব বেঙ্গল, বৃটিশ ইন্ডিয়ান রেকর্ডস রিলেইটিং টু দি ওয়াহাবী ট্রায়েল অব এইটিন-সিক্সটি ওয়ান, মুসলিম কমিউনিটিস অব সাউথ ঈষ্ট এশিয়া, পলিটিক্যাল ক্রাইসিস অব দি প্রেজেণ্ট এইজ-ক্যাপিটালিজম, কম্যুনিজম এন্ড হোয়াট নেক্সট ইত্যাদি তাঁর প্রকাশিত গবেষণামূলক গ্রন্থ।

তাঁর সাম্প্রতিক দু’টি ক্ষুদ্র প্রকাশনা হ’ল ‘ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিধারা’ এবং ‘আন্তর্জাতিক কৌশলনীতির নিরিখে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংস্থা’।

হাদীছের খেদমতে তাঁর সবচেয়ে বড় অবদান ছিল হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর নিকট থেকে তাঁর ছাত্র হাম্মাম বিন মুনাবিবহ সংকলিত ১৩৮টি হাদীছের প্রাচীনতম পান্ডুলিপির বাংলা অনুবাদ। যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় হাদীছ সংকলনের কাজ শুরু হয়েছিল।  হায়দরাবাদের খ্যাতনামা পন্ডিত ড. হামীদুল্লাহ (১৯০৮-২০০২ খৃ.) যা প্রথম দামেস্ক ও বার্লিন লাইব্রেরী থেকে উদ্ধার করেন এবং ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। অতঃপর ড. মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান সেটি বাংলায় অনুবাদ করেন। যা ২০১৮ সালে প্রথম চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয়। আমরা মনে করি, চট্টগ্রামের বায়তুশ শরফ ও ঢাকার সূফী ফাউন্ডেশনে যোগদান ছিল অতি চতুরতার নিকট অতি সরলতার সাময়িক পরাজয় মাত্রজীবন সায়াহ্নে হাদীছের খেদমত যেন তাঁর বিগত সকল ত্রুটি-বিচ্যুতির কাফফারা হয়, আমরা সেই দো‘আ করি]

স্মৃতিচারণ :

(১) ১৯৮৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের জন্য বাছাই পরীক্ষায় অংশগ্রহণকালে আমি সর্বপ্রথম স্যারের সাক্ষাৎ লাভ করি। আমার গবেষণা শিরোনাম দেখে ইউজিসি চেয়ারম্যান বাদে আটজন পরীক্ষকের সবাই আমার প্রতি উৎসুক ছিলেন। ফলে প্রত্যেকেই প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আমাকে ঝালাই করেন। সেই সাথে ছিলেন বৃটিশ কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি, যিনি আবেদনকারীর ইংরেজী ভাষায় দক্ষতা যাচাই করেন। প্রথম প্রশ্ন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ প্রফেসর মাহফূযুল্লাহ। তিনি বলেন, Mr. Ghalib, Explain your movement. আমি আহলেহাদীছ আন্দোলন সম্পর্কে সাধ্যমত ব্যাখ্যা দিলাম। এরপরেই প্রশ্ন করলেন ড. মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান, What is the difference between Ahlehadeeth movement and Tareeqa-i-muhammadia movement? আমি জবাব দিলাম। তিনি পুনরায় প্রশ্ন করলেন, Is it not the split off from the Tareeqa-i-muhammadia movement of Sayed Ahmad brelvi? আমি তার বিপরীত মত প্রকাশ করে জবাব দিলাম। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, What is the difference between Ahlehadeeth movement and Fara'idi movement? আমি জবাব দিলাম এবং স্যারের উক্ত ডক্টরেট থিসিসটি আমি আগেই পড়েছি সে কথা বললাম। সাথে সাথে সেখানে ৪১ পৃষ্ঠায় রেফারেন্স বই হিসাবে প্রদত্ত ‘আক্বীদায়ে মুহাম্মাদী বা মাযহাবে আহলেহাদীছ’ বইয়ের লেখক যে আমার পিতা, সে কথাও জানিয়ে দিলাম। তিনি খুশীতে যেন আত্মহারা হয়ে গেলেন। এরপর অন্যেরাও প্রশ্ন করলেন। সবশেষে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন?’ বইটির প্রথম সংস্করণ প্রত্যেকের হাতে এক কপি করে দিয়ে সালাম দিয়ে বেরিয়ে এলাম।

(২) আমার ডক্টরেট থিসিসের মূল্যায়ন কমিটির সদস্য হওয়ার কারণে ১৯৯০-এর নভেম্বরে আমি সাড়ে সাতশ’ পৃষ্ঠার হস্তলিখিত পান্ডুলিপি নিয়ে স্যারের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসায় যাই। সেখানে আমারই মত আরও চারজন গবেষক ছিলেন। মাগরিবের ছালাতে ইমামতির জন্য তিনি আমাকে নির্দেশ দেন। আমি আপত্তি করলে তিনি বলেন, আপনি কি জানেন না, একই স্থানে আহলুর রায় ও আহলুল হাদীছ থাকলে, আহলুল হাদীছ সেখানে ইমামতির হকদার হন? তখন আমি বাধ্য হয়ে ইমামতি করি। এরপর আমি একটানা ১২ দিন তাঁর বাসায় যাতায়াত করেছি ও পান্ডুলিপি দেখিয়েছি। প্রতিদিন তাঁর নিরহংকার ও বিনয়ী আচরণে মুগ্ধ হয়েছি।

(৩) চিটাগাং অবস্থানকালে একদিন আমি তাঁর সাথে বায়তুশ শারফ গমন করি। উদ্দেশ্য ছিল এই বিখ্যাত সমাজকর্মী ব্যক্তির সাথে পরিচিত হওয়া। দোতলায় উঠে আমার আগেই স্যার ভিতরে ঢোকেন ও সম্ভবতঃ আমার পরিচয় দিয়ে প্রবেশের অনুমতি চান। ভিতর থেকে উনি ডাক দিলে আমি সালাম দিয়ে প্রবেশ করি। কিন্তু দেখলাম যে, পীর ছাহেব অতি উঁচু একটি বড় শানদার চেয়ারে বসে আছেন। আর স্যার তার পায়ের নিকটে মেঝের উপর বসে আছেন। আমি দাঁড়িয়ে পীর ছাহেবের সাথে একহাতে মুছাফাহা করি। তিনি আমাকে বললেন, উত্তরবঙ্গে তো অনেক আহলেহাদীছ! আমি বললাম, জী! অতঃপর বেরিয়ে এলাম। স্যার অপ্রস্ত্তত হয়ে কিছু পরেই বেরিয়ে এলেন। আমি বললাম, স্যার আপনার মত একজন পন্ডিত ব্যক্তি পীরের পায়ের নিকট বসে আছেন। আর উনি বিশাল উঁচু চেয়ারে বসে কথা বলছেন, এটা কি ইসলামী আদবের খেলাফ নয়? স্যার আমার মেযাজ বুঝতে পেরে কথা না বাড়িয়ে আমার সাথে চলে এলেন।

(৪) এই সময় আমি একদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরীতে ফার্সীতে লেখা ‘তারীখে ফিরিশতা’ নামক বিশাল  গ্রন্থটি পড়তে থাকি। সেখানে ২৩ পৃষ্ঠায় গিয়ে পেলাম, ‘সুলতান মাহমূদ একজন আহলেহাদীছ বিদ্বান ছিলেন’। লেখাটি ফটো করে আমি যখন সন্ধ্যার পর স্যারের বাসায় গিয়ে দেখালাম, তিনি তাজ্জব হয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। অতঃপর বললেন, গবেষক বটে! আমি কোন দিন এটা ভাবিনি। আমি বললাম, স্যার আপনি ১৯৮৫ সালে কমনওয়েলথ স্কলারশিপের বাছাই পরীক্ষার সময় আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আহলেহাদীছ কি সাইয়িদ আহমাদ ব্রেলভীর তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া আন্দোলনের একটি বিচ্ছিন্ন উপদল নয়? আমি আপনার মতের বিরোধিতা করে জবাব দিয়েছিলাম। আজকে তার একটি প্রমাণ পেলেন তো? স্যার প্রাণখোলা হাসির সাথে আমাকে দো‘আ করলেন।

উল্লেখ্য যে, গযনীর সুলতান মাহমূদ (৩৬১-৪২১ হি.) একজন উঁচুদরের হানাফী আলেম ছিলেন। তাঁর রচিত ‘আত-তাফরীদ’ বইটি হানাফী ফিক্বহের একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। একদা নিজ দরবারে ইমাম ক্বাফফাল মারওয়াযীর নিকটে তিনি হানাফী ও শাফেঈ উভয় মাযহাবের ছালাতের দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন এবং ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক প্রমাণিত হওয়ায় তিনি সঙ্গে সঙ্গে ‘শাফেঈ’ মাযহাব গ্রহণ করেন। ছহীহ হাদীছকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কারণে ঐতিহাসিক ফিরিশতা সুলতান মাহমূদ সম্পর্কে বলেন, از  أئمہ  أہل  حديث  بود ‘তিনি ‘আহলেহাদীছ’ বিদ্বানগণের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন’ (তারীখে ফিরিশতা ১/২৩; থিসিস ২৪১ পৃ.)।  

ঐতিহাসিক ফিরিশতা তাঁকে শাফেঈ বলেননি। বরং ‘আহলেহাদীছ’ বলেছেন। কারণ শাফেঈরা ছহীহ তরীকায় ছালাত আদায় করেন তাদের ইমামের প্রতি আনুগত্যের কারণে। কিন্তু আহলেহাদীছগণ ছহীহ তরীকায় ছালাত আদায় করেন ছহীহ হাদীছের প্রতি আনুগত্যের কারণে। উভয়ের নিয়ত সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। তাই বিষয়টি সত্যসন্ধ ব্যক্তিদের জন্য শিক্ষণীয়।

(৫) ১৯৯২ সালের নভেম্বরে ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’ উদ্বোধন করার পর এর দোতলায় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর উপর একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। সেখানে তিনি উক্ত বিষয়ে প্রবন্ধ পাঠ করেন। অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন আমার থিসিসের সুপারভাইজর রাবি ইসলামের ইতিহাসের প্রফেসর ড. এ.কে.এম. ইয়াকূব আলী (পরবর্তীতে প্রফেসর এমিরেটাস), ইসলামিক স্টাডিজের প্রফেসর ড. এফ.এম.এ.এইচ. তাক্বী (পরবর্তীতে কলা অনুষদের ডীন) এবং অন্যান্য শিক্ষক ও সূধীবৃন্দ।

(৬) ১৯৯৩ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারীতে রাবির আই.বি.এস-এর এক সেমিনারে তিনি ‘ইমাম গাযালীর রাজনৈতিক দর্শন’-এর উপর ১১ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। সেমিনার শেষে তিনি ‘লেটার টাইপ’কৃত ফুল স্কেপ সাইজের উক্ত প্রবন্ধটি আমাকে দেন। যা আমরা আমাদের মাসিক ‘আত-তাহরীক’ জুলাই ২০২০, ২৩/১০ সংখ্যায় কিছু সংশোধনী সহ প্রকাশ করি। অতঃপর সংখ্যাটি তাঁর নিকটে সৌজন্য কপি প্রেরণ করি। তাতে তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে ফোন করেন ও প্রাণখোলা দো‘আ করেন।

(৭) এরপর ১৯৯৩ সালের ৪ঠা এপ্রিল রাবির আই.বি.এস-এর এক সেমিনারে তিনি ‘দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সংস্থা : সার্ক-এর স্বরূপ ও সম্ভাবনা’ বিষয়ে ৩৫টি রেফারেন্স বিশিষ্ট ‘লেটার টাইপ’কৃত ফুল স্কেপ সাইজের ৯ পৃষ্ঠার একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর আব্দুর রহীম-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সেমিনারে প্রবন্ধের বাইরে প্রশ্নোত্তরের সময় তিনি কতগুলি মূল্যবান কথা বলেছিলেন। যেমন (১) Diplomacy হ’ল কৌশল। সেটা বলে ফেললে Politics হয়ে যায়। (২) দল না থাকলে Politics হয় না এবং নেতৃত্ব হয় না। (৩) Politics-এর প্রথম পর্যায় হ’ল দলীয় রণনীতি। দ্বিতীয় পর্যায় হ’ল রাজনীতি। যা নির্ভর করে জনগণের গ্রহণযোগ্যতার উপর। রণনীতি ও জাতীয় স্বার্থ মিলিত হয়ে রাজনীতি তৈরী হয়। (৪) ভারতীয় কৌটিল্যবাদী শাসকরা যেহেতু কূটিল নীতির ভিত্তিতে দেশ শাসন করতে চেয়েছিল, সেহেতু একে কূটনীতি বলা হয়। তাই পরিভাষাটি গ্রহণযোগ্য নয়। একে কৌশলনীতি বলা উচিৎ।

প্রবন্ধের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করে (১) সেমিনারের সভাপতি বলেন, প্রবন্ধটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ, চিন্তামূলক, সারগর্ভ ও তথ্যবহুল হয়েছে (২) ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. ইয়াকূব আলী বলেন, ১৯৮৫-১৯৯৩ পর্যন্ত আমরা সার্কের কোন অগ্রগতি লক্ষ্য করিনি। কারণ ছিল ভারতের মুরববীয়ানা। এটা না ছাড়লে সার্ক অদূর ভবিষ্যতে শেষ হয়ে যাবে (৩) দর্শন বিভাগের প্রফেসর ড. শাহজাহান বলেন, প্রবন্ধটি আমার কাছে অদ্ভূত লেগেছে। তিনি কূটনীতির বদলে কৌশলনীতি ব্যবহার করেছেন সম্ভবতঃ কুরআনের ‘হিকমত’ শব্দ থেকে। এছাড়াও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, আই.বি.এস-এর শিক্ষক প্রফেসর ড. যয়নুল আবেদীন, হিসাব বিজ্ঞানের প্রফেসর ড. অভিনব সাহা।

উত্তর দেওয়ার পর্বে প্রবন্ধ পাঠক প্রফেসর মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান বলেন, আমার প্রবন্ধটি ইবনু খালদূন-এর আলোকে প্রাচ্য বিশ্লেষণাত্মক আলোচনা। পাশ্চাত্যের আলোকে নয়। Western political science যা এদেশে পড়ানো হচ্ছে, তা পাশ্চাত্যের মেকিয়াভেলী দর্শনের অনুসারী। যার বক্তব্য ছিল, ‘রাজাকে হ’তে হবে সিংহের মত সাহসী এবং শিয়ালের মত ধূর্ত’। তিনি বলেন, যারা Political science পড়েন, তারা Diplomacy পড়েন না। তিনি বলেন, সার্ক (SAARC) হ’ল রাষ্ট্রপ্রধানদের সংস্থা। এর দ্বারা জনগণের কি উপকার হচ্ছে তার সম্ভাবনা দেখতে হবে। আমি এখনও কোন সম্ভাবনা দেখছিনা। কারণ রাষ্ট্রপ্রধানরা হ’লেন Diplomacy-এর আধার। সার্কের উদ্যোক্তা বাংলাদেশ। ভারত যেন কিছুটা বাধ্য হয়ে এখানে এসেছে। ভারত যখন নিজের সম্পদের সীমাবদ্ধতা বুঝবে, তখনই সার্কের সম্ভাবনা আছে। এতে ভারতে গরীবদের উন্নতি হবে। ভারত মহাসাগরকে নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে ভারত যে অর্থ ব্যয় করছে, সার্কের চেতনা বাস্তবায়িত হ’লে সে অর্থ তার জনগণের স্বার্থে ব্যয় করতে পারত। সার্কের অগ্রগতির উপর আমি কিছু বলিনি এ কারণে যে, এখানে ভারতই হ’ল মূল ফ্যাক্টর। কমন মার্কেট হ’লে ভারত কিছু লাভবান হবে। তবে বাকী দেশগুলি শোষিত হবে। সার্কের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক সমস্যার কোন সমাধান নেই। অথচ সেটাই আমাদের প্রধান সমস্যা। তিনি বলেন, ক্রিয়েটিভিটির দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির জুজুর ভয় দেখানো একটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত। ‘মৌলবাদ’ এটাও একটি জুজু। স্বাধীন দেশ হিসাবে এর কারণ উদ্ঘাটন করা উচিৎ। বধ করার চিন্তা অধীন রাষ্ট্রের চিন্তা থেকে উৎসারিত। যেমন বৃটিশ শক্তি সিপাহী বিদ্রোহ দমন করেছিল। কেউ এক্সিডেন্ট করলে বুদ্ধিমান লোকেরা সেখানে না দাঁড়িয়ে ঝামেলা এড়ানোর অজুহাতে দূরে চলে যায়। কিন্তু রিক্সাওয়ালা তাকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। অতএব মূল বিষয় হ’ল, মানবপ্রেম। ভারতের মধ্যে সেটা নেই। তিনি বলেন, সার্ক ১৭টি স্টাডি গ্রুপ তৈরী করেছে। কিন্তু তা না করে গবেষকদের গ্রুপ তৈরী করা উচিৎ ছিল। মূলতঃ ‘স্টাডি গ্রুপ’ না বলে ‘কূটনীতিক গ্রুপ’ বলাই ভাল। দেখবেন এইসব গ্রুপে কেবল ঝানু কূটনীতিকরা রয়েছেন। কিন্তু কোন বিদগ্ধ ‘প্রফেসর’ নেই। কারণ এইসব গ্রুপ প্রত্যেক রাষ্ট্রপ্রধানের গ্রহণযোগ্য সমাধান পেশ করে থাকে। আমি মনে করি সার্ক জাতিসংঘের ন্যায় একটি রাষ্ট্রপুঞ্জ। যার কোন সার্বভৌম ক্ষমতা নেই।

তিনি বলেন, দেশের সমস্যা দেশের মানুষের স্বাধীন চিন্তার আলোকে করতে হবে, অন্যের চিন্তার আলোকে নয়। যেমন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র সংযোজন ১৯৩৫ সালের ভারতীয় শাসন সংবিধানের আলোকে করা হয়েছে। অতএব ওয়াসার পানি দিয়ে নয়, টিউবওয়েলের পানি দিয়ে চিন্তাধারাকে ছাফ করতে হবে। তিনি মন্তব্য করেন, দেশে চাকরীর অর্থনীতি সৃষ্টি হয়েছে। স্বাবলম্বী হওয়ার অর্থনীতি নয়। চাকরী করলে তিনি হন ‘ছাহেব’। আর চাষ করলে তিনি হন ‘চাষা’ (সূত্র : সেমিনারে উপস্থিত লেখকের নিজস্ব নোট থেকে)

(৮) রাবিতে বিভাগীয় কাজ সেরে ২৮.৮.১৯৯৪ তারিখে ঢাকা যাওয়ার পথে বিমানে তিনি আমাকে পেয়ে খুবই খুশী হন। অতঃপর আমাকে তাঁর টাইপকৃত কয়েকটি প্রবন্ধ হস্তান্তর করেন। যেমন (১) বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ : উৎপত্তি, স্বরূপ ও সম্ভাবনার পুনর্মূল্যায়ন (পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮)। (২) ইবনে খালদূন (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩২, ১৬০টি রেফারেন্স সম্বলিত)। (৩) আবু নাছর আল-ফারাবী (পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৪, ৫৯টি রেফারেন্স সম্বলিত)। (৪) আল-কুরআনের দৃষ্টিতে মানব সৃষ্টিতত্ত্ব : মানুষের পরিচয় (পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৫)। (৫) আল-কুরআনের দৃষ্টিতে বিশ্বজগত : বিশ্বের উৎপত্তি-সৃষ্টিবাদ (পৃষ্ঠা সংখ্যা ১৮)।  

(৯) ১৯৯৬ সালে বই আকারে আমাদের থিসিসটি বের হওয়ার খবরে খুশী হয়ে তিনি যে মূল্যবান বাণী প্রদান করেন, তা আমরা প্রকাশিত থিসিসের প্রথমে সন্নিবেশিত করি। বিদগ্ধ পাঠক তা পড়লেই বুঝতে পারবেন তাঁর জ্ঞানের গভীরতা এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ সম্পর্কে তাঁর স্বচ্ছ ধারণা।  

(১০) আমাদের বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমায় তাঁকে একবার আমরা দাওয়াত দেই। সেখানেও তিনি লিখিত ভাষণ দিয়েছিলেন এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। তিনি আমাকে নিয়ে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জনসভা করবেন বলে আবেগ প্রকাশ করেছিলেন।

(১১) মাসিক ‘আত-তাহরীক’ ১৯৯৯-এর জানুয়ারী সংখ্যা দরসে কুরআন কলামে ‘মা‘রেফতে দ্বীন’ নামে আমার যে প্রবন্ধটি বের হয়, তাতে মা‘রেফতী ছূফীদের আঁতে ঘা লাগে। তারা গিয়ে স্যারকে ধরেন। তখন তিনি বাধ্য হয়ে আমাকে ফোন করেন। জবাবে আমি যা বলার তা বললাম। তিনি বললেন, আপনাদের জিহাদে আমিও শরীক রইলাম।

(১২) সবশেষে গত বছরের মার্চে করোনাকালে চট্টগ্রামে অবস্থানরত রাবির ইসলামের ইতিহাস বিভাগের প্রফেসর বন্ধুবর ড. মুহিববুল্লাহ ছিদ্দীকীর সাথে যোগাযোগ হ’লে আমরা তাঁর ও স্যারের নামে মার্চ ২০২০ সংখ্যা আত-তাহরীক সৌজন্য কপি পাঠিয়ে দেই। সাথে ‘এক্সিডেন্ট’ ও ‘বিবর্তনবাদ’ বই দু’টি সহ আরও কিছু বই পাঠাই। তিনি সম্পাদকীয়গুলি পড়ে খুবই খুশী হন এবং আমার বড় ছেলের মোবাইলের মাধ্যমে আমার নিকট ভূয়সী প্রশংসা করেন। এভাবে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গত কয়েক মাসের মধ্যে তিন বার ফোন করেন। প্রতিবারই তিনি আমাদের আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন ও প্রাণভরা দো‘আ করেন। এর মধ্যে গত ৮ই সেপ্টেম্বর ২০২০ তিনি বহুক্ষণ ধরে আমাদের আন্দোলনের অগ্রগতিতে অনেক মূল্যবান পরামর্শ দেন। অতঃপর একদিন তিনি ‘বিবর্তনবাদ’ বইটি দশ কপি চেয়ে পাঠান। আমরা গত ১৮ই নভেম্বর ‘বিবর্তনবাদ’ ও ‘এক্সিডেন্ট’ বই প্রতিটি দশ কপি করে তাঁর নামে সৌজন্য পাঠাই। পরে তিনি ফোন করে ধন্যবাদ জানান এবং আমাকে হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক সংকলিত ও তাঁর অনূদিত ‘আল-ছহীফাহ আল-ছহীহাহ’ বইটি পাঠাবেন বলে ওয়াদা করেন। যেটি তাঁর প্রিয় ছাত্র ও আমাদের সহকর্মী প্রফেসর ড. মুহিববুল্লাহ ছিদ্দীকী গত ৮ই মার্চ ২০২১ তারিখে তাঁর নিজের একটি বইয়ের সাথে স্যারের উপরোক্ত বইটি পাঠিয়ে দেন। আজ তাঁর হঠাৎ মৃত্যুর পর এই উদারমনা মানুষটির জন্য আমরা প্রাণখোলা দো‘আ করছি, আল্লাহ যেন তাঁর সকল গোনাহ-খাতা মাফ করেন ও জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দান করেন- আমীন!