স্বভাবধর্মের বিকাশ চাই!

গত ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে যা ঘটে গেল, তা রীতিমত বিস্ময়কর। যা পৃথিবীর তাবৎ রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিমন্ডলে দারুণ ঝাঁকুনি দিয়েছে। মেধা আল্লাহর দান। কিন্তু যখনই সেই মেধার স্বাভাবিক বিকাশে ও তার মূল্যায়নে সরকার নানাবিধ কোটা চাপিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, তখন শিক্ষার্থীরা তাদের বৈধ অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হয়। কিন্তু সরকার প্রধান সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে আখ্যায়িত করে কঠোর হস্তে দমনের নির্দেশ দেন। ফলে পুলিশ অস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের বুকে ১৬ই জুলাই মঙ্গলবার প্রকাশ্যে পুলিশ গুলি চালায় ও সেখানেই তাকে উপর্যুপরি গুলি করে হত্যা করে। এই নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ফলে একটি শান্ত আন্দোলন অশান্ত হয়ে ওঠে। তখন গণতন্ত্রের মানসকন্যা বলে খ্যাত শেখ হাসিনা ৫ই আগস্ট সোমবার গণভবনে তারই নিযুক্ত সেনাপ্রধানের বেঁধে দেওয়া ৪৫ মিনিট সময়ের মধ্যে তড়িঘড়ি বঙ্গভবনে গিয়ে পদত্যাগ পত্রে সই করেন। অতঃপর বোন রেহানাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তার পুরানো আশ্রয় আধিপত্যবাদী রাষ্ট্র ভারতে। যে দেশটির প্রতি তার কোন প্রতিবেশী দেশ কখনোই খুশী নয়। অন্য কোন দেশ তাকে আশ্রয় দিতে রাযী হচ্ছে না। ভিজিট ভিসার দেড় মাস মেয়াদের বেশী তিনি ভারতে থাকতে পারবেন না। তখন দেখা যাবে ইতিপূর্বে বাংলাদেশে আশ্রিত আসামের স্বাধীনতাকামী উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ২০১৮ সালে তারই করা ‘বন্দী বিনিময় চুক্তি’ বলে ভারত তাকে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠাবে। ফলে হাসিনার তৈরী ফাঁদে হাসিনা নিজেই আটকে যাবেন। যা তিনি কখনই ভাবেননি। অতঃপর হত্যা, গণহত্যা ও সর্বোচ্চ দায়িত্বে খেয়ানতের বিরুদ্ধে ‘মানবতা বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে’ মামলা হবে। যার পরিণতিতে মৃত্যুদন্ড অবশ্যম্ভাবী। কারণ এখন তার অনুগত আপিল বিভাগ ও প্রধান বিচারপতি নেই। সেই সঙ্গে যোগ হবে প্রধান আসামী হিসাবে ২০০৯ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারী পিলখানায় ৫৭ জন ফ্রন্টলাইন বিশেষজ্ঞ চৌকষ সেনা কর্মকর্তা সহ ৭৪ জন বিডিআর হত্যার মামলা। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের উপর গুলি চালিয়ে শেখ হাসিনা যেভাবে পদত্যাগ করে পালিয়েছেন, ১৯৭১ সালে টিক্কা খান তেমনি ‘মেট্টি চাহিয়ে, আদমী নেহী, অর্থাৎ মাটি চাই, মানুষ নয়’ বলে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে হারিয়েছিলেন। (পিলখানা সম্পর্কে দ্র. সম্পাদকীয়, ‘আমরা শোকাহত, স্তম্ভিত, শংকিত’ ১২/৬ সংখ্যা, মার্চ’০৯)

১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ভারতের সাথে ২৫ বছরের গোলামী চুক্তি সই করে যে স্বাধীন (!) বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পায়, সেখানে সংবিধানে ভারতের চাপানো ৪টি মূলনীতি যুক্ত করা হয়। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ। যা কখনোই এদেশের গণ মানুষের আক্বীদা-বিশ্বাসের অনুকূলে ছিল না। কোনদিন এর উপরে গণভোটও হয়নি। ফলে মানুষের স্বভাবধর্মের বিরোধী এইসব মতবাদের তলায় পিষ্ট এদেশের ৯১ শতাংশ মুসলিম নাগরিক সর্বদা ক্ষুব্ধ নিঃশ্বাস ছেড়ে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করেছে। এদেশের রাজনীতিতে চলেছে দল ও প্রার্থীভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা। যেখানে ইলিশ মাছ ও পুঁটি মাছে কোন প্রভেদ নেই। সম্মানী-অসম্মানী কোন ভেদাভেদ নেই। যেখানে কালো টাকা ও দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের কদর বেশী। যেখানে ঘুষ ও দুর্নীতির অবাধ লাইসেন্স থাকে। যেখানে শিক্ষামন্ত্রীরা হয় দেশের চিহ্নিত নাস্তিক ও ইসলামের শত্রু। দেশের অর্থনীতি চলে সূদের ভিত্তিতে। যা মানুষের রক্ত শোষণ করে। এদেশের বিচার বিভাগে চলে বিগত যুগের ফেলে আসা অন্যায়ভাবে কারাগারে পচানোর নিষ্ঠুরতম ব্যবস্থা। ২রা আগস্ট শুক্রবার জুম‘আর খুৎবায় আমরা সূরা নিসা ৭৫ আয়াত উদ্ধৃত করে আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলেছিলাম ‘তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর পথে যুদ্ধ করছ না? অথচ দুর্বল পুরুষ, নারী ও শিশুরা ফরিয়াদ করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক! এই অত্যাচারী জনপদ হ’তে তুমি আমাদের উদ্ধার কর। আর তোমার পক্ষ হ’তে আমাদের জন্য একজন নেতা নির্ধারণ করে দাও এবং তোমার পক্ষ হ’তে আমাদের জন্য সাহায্যকারী নিযুক্ত কর’। সেদিন সারা দেশের মানুষ যেন একই প্রার্থনা করেছিল। আর তাতে সাড়া দেন সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। ফলে ৫ই আগস্ট সোমবার বাংলাদেশের বুক থেকে আওয়ামী দুঃশাসনের জগদ্দল পাথর নেমে যায়। মানবতা হাফ ছেড়ে বাঁচে।

এক্ষণে আমাদের একান্ত কামনা বাংলাদেশে স্বভাবধর্ম ইসলামের অবাধ ও সুষ্ঠু বিকাশ ঘটুক! আল্লাহ বলেন, ‘অতএব তুমি নিজেকে একনিষ্ঠভাবে ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখ। আল্লাহর ধর্ম, যার উপরে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই। এটাই সরল ধর্ম। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ জানে না’ (রূম ৩০/৩০)। যে স্বভাবধর্মকে ধ্বংস করে পিতা-মাতা, সমাজ ও রাষ্ট্র। বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূল (ছাঃ) উপস্থিত লক্ষাধিক মুমিনের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের প্রতিপালক মাত্র একজন। তোমাদের পিতাও মাত্র একজন। মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত’। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু (ছহীহাহ হা/২৭০০)। ইসলামে দলমত নির্বিশেষে সকল মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। যেখানে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বলে কোন ভেদাভেদ নেই। আল্লাহর দেওয়া সূর্যের কিরণ, চন্দ্রের জ্যোতি, মৃদুমন্দ বায়ু প্রবাহ, নদী-সাগর ও মহাসাগর যেমন সবার জন্য সমানভাবে কল্যাণকর, আল্লাহ প্রেরিত ইসলামের বিধান সমূহ তেমনি সকলের জন্য সমভাবে কল্যাণকর। দুই দিকে কুফরিস্তান ও একদিকে বঙ্গোপসাগর বেষ্টিত ৩য় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রটি ইসলামী চেতনা নিয়ে চিরদিন বেঁচে থাকুক, এই মুহূর্তে আমরা সেই প্রার্থনা করি।

রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য আমরা জাতির নিকটে নিম্নোক্ত প্রস্তাবসমূহ পেশ করতে চাই।- (১) রাষ্ট্রীয় আইনের মূল উৎস হবে কুরআন ও সুন্নাহ। যেখানে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের জন্য ইহকালীন ও পরকালীন মঙ্গল নিহিত রয়েছে। (২) অভ্যুত্থানকারীদের সম্মিলিত প্রস্তাবে দেশের একজন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। যিনি ইসলামী জ্ঞানে ও দৈহিক শক্তিতে যোগ্য হবেন। (৩) প্রেসিডেন্ট একটি সীমিত সংখ্যক ‘মজলিসে শূরা’ বা পার্লামেন্ট মনোনয়ন দিবেন। যারা তাঁকে ইসলামী বিধান মতে পরকালীন স্বার্থে সুপরামর্শ দিবেন। প্রয়োজনে রাষ্ট্রের অন্যান্য গুণী ও বিচক্ষণ ব্যক্তিদের নিকট থেকেও তিনি পরামর্শ গ্রহণ করবেন। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন ও দেশপ্রেমিক পত্র-পত্রিকা উক্ত ভূমিকা পালন করতে পারে। (৪) দল ও প্রার্থী ভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচন ব্যবস্থা থাকবে না। সরকারী ও বিরোধী দল বলে কিছু থাকবে না। প্রয়োজন বোধে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফোরামে মেধা, যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রতিনিধি মনোনয়ন দেওয়া হবে। নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য এবং প্রতিভা বিকাশের জন্য বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সমূহ থাকবে। মানবসেবা ও প্রশাসনকে দিক-নির্দেশনা দান হবে সকল সংগঠনের মূল লক্ষ্য। (৫) আইন, বিচার ও প্রশাসন বিভাগের কাঠামো আপাতত ঠিক রেখে চেয়ার থেকে দেশবিরোধী ও চিহ্নিত দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দিতে হবে এবং তদস্থলে আল্লাহভীরু ও যোগ্য লোকদের বসাতে হবে। পলাতক ও দেশের অর্থ পাচারকারীদের পাচারকৃত অর্থ দ্রুত ফেরত এনে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিতে হবে। মনে রাখা আবশ্যক যে, দক্ষিণ কোরিয়া স্বাধীন হওয়ার পর পাচারকারীদের আটক করে মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যে ৯০% পাচারকৃত অর্থ ফেরৎ আনতে সক্ষম হয়েছিল। কথিত ‘আয়না ঘর’ নামক নির্যাতন কক্ষগুলি চিরতরে বন্ধ করে দিতে হবে এবং যারা এগুলি করেছে, তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। প্রচলিত দীর্ঘসূত্রী বিচারব্যবস্থা বাতিল করে ইসলামের প্রত্যক্ষ বিচারব্যবস্থা ও দন্ডবিধি সমূহ চালু করতে হবে। প্রচলিত সূদী অর্থনীতি বাতিল করে নিখাদ ইসলামী অর্থনীতি চালু করতে হবে। যাতে দেশে যাকাত নেওয়ার মত কোন হকদার না পাওয়া যায়। যেমনটি হয়েছিল ২য় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন।-আমীন! (স.স.)