কল্যাণমুখী প্রশাসন

আদর্শকে কেন্দ্র করেই মানুষের সার্বিক জীবন আবর্তিত হয়। আদর্শহীন মানুষ এমনকি নিজ পরিবারের সদস্যদের নিকটেও অবিশ্বস্ত ও অশ্রদ্ধার পাত্র। অনুরূপভাবে একটি জাতি উন্নত হয় তার আদর্শনিষ্ঠার কারণে। জাতিকে নীতি ও কল্যাণের পথে পরিচালনার জন্যই প্রয়োজন আদর্শবান ও কল্যাণমুখী প্রশাসন।

হাত, পা বা মাথা সবকিছু পরস্পরে পৃথক হ’লেও তারা একই দেহের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এমনিভাবে ধর্মীয় জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন পৃথক হ’লেও তার কোনটিই মানুষের জীবনসত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। বরং দেহের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মানুষের নিজ আদর্শ ও আক্বীদা-বিশ্বাস অনুযায়ী চলে। ইসলাম মানুষের সার্বিক জীবনে কল্যাণের পথ দেখায়। মুসলিমের নিকটে তাই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটি একেবারেই অচল। এক্ষণে প্রশ্ন হ’ল : বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে যেখানে আল্লাহ প্রেরিত দ্বীনের প্রবেশাধিকার নেই, সেখানে তাহ’লে কার পদচারণা চলছে? জওয়াব অতি পরিষ্কার...।

রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নিজস্ব কোন আদর্শ না থাকার ফলেই সম্ভবতঃ এদেশ চলে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন জনের কথায়। একদিকে সুন্দরী প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা গ্রহণ ও পুনরায় সরকারী হুকুমে তা বাতিল করণ। একদিকে খুন-ধর্ষণ, ছিনতাই-রাহযানির বিরুদ্ধে তার স্বরে চিৎকার, অন্যদিকে ডিশ এ্যান্টেনার মাধ্যমে দেশব্যাপী ভিসিআর-ভিসিপি, রঙিন টেলিভিশন ও ব্লু ফিল্মের নীল দংশন। একদিকে পুঁজিবাদ ও বুর্জোয়া অর্থনীতির বিরুদ্ধে রাজপথ সরগরম, অন্যদিকে সূদ-জুয়া-হাউজী-লটারীর সরকারী অনুমোদন ও গরীবের রক্ত শোষণ। একদিকে বলা হচ্ছে চাই আইনের শাসন, অন্যদিকে আইনের রক্ষকরাই আইন ভঙ্গের চ্যাম্পিয়ন। বলা হচ্ছে ‘পানি সমস্যার সমাধান, অমুক নেত্রীর অবদান’। দেখা যাচ্ছে পানিহীনতায় বৃহৎ নদীটি শুষ্ক এবং দেশ মরুভূমি হচ্ছে। একটি বিশেষ দলকে বলা হচ্ছে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি, তারাই আবার দেশের এক দশমাংশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভিনদেশের হাতে তুলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বলা হচ্ছে সন্ত্রাসমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই, অথচ চর দখলের মত হল দখল করা হচ্ছে। পাখির মত ছাত্র হত্যা করা হচ্ছে। এমনকি নিরীহ গাভী পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষিত জ্ঞানী লোকদের অনুগ্রহ লাভে ব্যর্থ হয়ে নিহতের তালিকায় শামিল হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির লালিত ছাত্র নামধারী দলীয় সন্ত্রাসী ও পুলিশ দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও প্রভোষ্ট পদমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের লাঠিপেটা করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ প্রশাসনের অন্যায় হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ভাইস চ্যান্সেলর সহ ৭০ জন প্রশাসনিক পদাধিকারী সর্বোচ্চ পদমর্যাদার অধ্যাপককে পদত্যাগ করে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন হ’তে নীরবে চলে যেতে হচ্ছে। এসবই রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দিকনির্দেশনাহীন চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ।

এদিকে ঢাকার একটি পরিচিত সাপ্তাহিকের সুপরিচিত সম্পাদক বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’ বন্ধের সরকারী ঘোষণাতে খুবই নাখোশ হয়েছেন এবং ‘বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার ও ঐসব মৌলবাদী দলগুলির চরিত্রে কোনো পার্থক্য নেই’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা আধুনিক সমাজের সুন্দর প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতার ভেতর সৌন্দর্যের বাইরে অন্য কিছু খোঁজার মত অশ্লীল লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে সীমিত। বাংলাদেশের সুস্থ সুন্দর আধুনিক প্রজন্মের কেউই এর বিপক্ষে নয়’।

কথায় বলে ‘জন্ডিসের রোগী সবকিছুকে হলুদ দেখে’। সম্মানিত সম্পাদক ছাহেব এই সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নিজের ঘরের স্ত্রী-কন্যাদেরকে মডেল হিসাবে বের করে এনে দাঁড় করাতে পারবেন কি? নারী ও পুরুষের স্বভাবগত চরিত্রে যে বিপরীতমুখী সম্পর্ক আছে তা কি তিনি অস্বীকার করবেন? নেগেটিভ ও পজেটিভ দু’টি তারের (ক্যাবল) উপরে যদি পর্দা না থাকে, তাহ’লে কি শর্ট সার্কিট হয়ে আগুন ধরে যাওয়া অবশ্যম্ভাবী নয়? আগুনের ক্রিয়া জ্বালানো, পানির ক্রিয়া নিভানো -এই ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াকে অস্বীকার করা যাবে কি? বেগানা নারী-পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া মানুষের একটি স্বভাবজাত বিষয়। একে কেউ অস্বীকার করতে পারবেন কি? প্রতিদিন সকালে দৈনিক পত্রিকার পাতা উল্টালে আমরা কি এসবের নোংরা চিত্র দেখতে পাই না? পিতা-মাতা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা প্রভৃতির মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভক্তি, প্রেম-ভালোবাসা ও স্নেহ-মমতার প্রতিক্রিয়া সঞ্জাত সম্পর্ক আছে বলেই সমাজ-সংসার আজও টিকে আছে। এই প্রতিক্রিয়ার পর্দা উঠানোটাই হ’ল প্রকৃত অশ্লীলতা। তবে কি প্রতিক্রিয়াহীন এবং শ্লীল-অশ্লীল ও ন্যায়-অন্যায় ভেদাভেদহীন পশুর সমাজে পরিণত হওয়ার জন্য সম্মানিত সম্পাদক ছাহেব নিজে একজন মুসলমান হয়েও আমাদেরকে উপদেশ দিচ্ছেন?

মূলতঃ রাজনীতিকগণ ও প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগণ হ’তে নিম্নপদস্থ ব্যক্তি ও তাদের দেখাদেখি সাধারণ নাগরিকগণ যেন নীতিহীনতার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। চরিত্রহীন জাতি পশুর চাইতে অধম। ‘যেমন খুশী তেমন সাজ’ এটা কোন রাষ্ট্রীয় নীতি হ’তে পারে না। অধঃপতিত এই সমাজকে বাঁচাতে গেলে তাই প্রয়োজন দেশপ্রেমিক নীতিবান ও কল্যাণমুখী রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। চাই সুনির্দিষ্ট আদর্শিক মানদন্ড। সে মানদন্ড হ’ল সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র বিধান ‘ইসলাম’। আসুন অতি বুদ্ধিমান হওয়ার দুর্বুদ্ধি ত্যাগ করে আল্লাহর বিধানের নিকটে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করি ও তা নিরপেক্ষ ও নিরাপোষভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে সমাজে সত্যিকারের শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন সেদিকে কান দিবেন কি?