দিবস পালন নয়, চাই আদর্শের অনুসরণ

‘ঈদে মীলাদুন্নবী’ নামক প্রচলিত নবী দিবস সমাগত। এই দিবসকে বরণ করে নেবার জন্য সারা দেশে চলছে ব্যাপক প্রস্ত্ততি। অতি গরীব মানুষটিও এদিনটি উদযাপনের জন্য আগে থেকেই প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। অধিকাংশ জনগণের অনুভূতির দিকে খেয়াল করে ইসলামী বা ধর্মনিরপেক্ষ সকল দলের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এদিন ও মাসকে, বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে উদযাপন করেন। বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও কোন কোন মাদরাসা ‘জশনে জুলূসে ঈদে মীলাদুন্নবী’ বের করে শহর-বন্দরের রাস্তাসমূহ প্রদক্ষিণ করে। ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলি জনপ্রিয়তা অর্জনের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় মিছিল নিয়ে গগনবিদারী শ্লোগানে রাস্তা মুখরিত করে তোলে। সরকারীভাবে অধিক আড়ম্বরের সাথে এ দিবস পালিত হয়। বিলাসী সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়াসী আয়োজন করা হয়। বড় বড় বুলি আওড়ানো ছাড়া যার ফলাফল হয় শূন্য। শহরের বিলাসবহুল হোটেলগুলো দেশী-বিদেশী আমন্ত্রিত মেহমানদের আপ্যায়নে সরগরম হয়ে উঠে। কোটি কোটি টাকা এ দিবসকে সামনে রেখে খরচ করা হয়। কিন্তু একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি, যে নবীর মহববতে এসব করছি, তিনি এতে খুশী না হয়ে বরং নাখোশ হবেন। ক্বিয়ামতের দিন হাউয কাওছারের পানি পান করার জন্য যখন আমরা সকলে তাঁর নিকটে ভিড় জমাবো, তখন ফেরেশতারা আমাদের সরিয়ে দিবেন ও রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের মত বিদ‘আতীদেরকে ‘সুহক্বান’ ‘সুহক্বান’ ‘দূর হও’ ‘দূর হও’ বলে তাড়িয়ে দিবেন’।[1]

আমরা কি তাহ’লে ছাহাবীদের চাইতে বেশী রাসূলপ্রেমী হয়ে গেলাম? রাসূলের ২৩ বছরের নবুঅতী জীবন ও তাঁর পরে আবুবকর, ওমর, ওছমান ও আলী (রাঃ)-এর দীর্ঘ ৩০ বছরের খেলাফতকাল এমনকি তার পরেও ৬০৫ বা ৬২৫ হিজরী পর্যন্ত কোন মুসলমান তো মীলাদ অনুষ্ঠানের নামও জানতেন না। রাসূলের প্রেমে গদগদ হয়ে কই তারা তো কোন রাষ্ট্রীয় বা সাধারণ অনুষ্ঠানও করেননি। রাস্তায় মিছিল করেননি। মিষ্টি বিলাননি। মীলাদুন্নবী, ইয়াওমুন্নবী, দাওয়াতুন্নবী বা সীরাতুন্নবী পালন করেননি। যেখানে জুম‘আর দিনকে ছিয়াম ও রাতকে ইবাদতের জন্য খাছ করে নিতে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) নিষেধ করলেন।[2] যেখানে নিজের জন্ম ও মৃত্যু দিবস সোমবার। নবুঅত প্রাপ্তির দিন সোমবার। ছওর গিরিগুহা থেকে মদীনায় হিজরতের দিন সোমবার। মদীনার উপকণ্ঠে ক্বোবায় উপনীত হওয়ার দিন সোমবার হওয়া সত্ত্বেও এই বিশেষ দিনে উম্মতকে দিবস পালনের ইঙ্গিত দিলেন না বা নিজেও কোন অনুষ্ঠান করলেন না; সেখানে আমরা কার অনুসরণে এসব করছি? আমরা কি তবে মীলাদের আবিষ্কারক ইরাকের এরবল প্রদেশের গবর্ণর আবু সাঈদ মুযাফফরুদ্দীন কুকুবুরীর (৫৮৬-৬৩০ হিঃ) অনুসরণ করছি? না খ্রিষ্টানদের পালিত যীশু খৃষ্টের কাল্পনিক জন্মদিন Xmas day বা বড় দিনের অনুসরণে আমাদের নবীর বড় দিন উদযাপন করছি? তাও আবার তাঁর কথিত মৃত্যু দিবসে জন্মদিবস পালন।

যখন কসোভো, কাশ্মীর, ফিলিস্তীন ও পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকা মুসলমানের রক্তে ভাসছে। ইযযতহারা মা-বোনদের আহাযারীতে আকাশ-বাতাস ভারি হচ্ছে। বাংলাদেশের সর্বত্র চলছে খুন-ধর্ষণ ও রাহাযানির ক্বিয়ামত সদৃশ মর্মন্তুদ জীবন যন্ত্রণা। যখন ইসলামের আইন ও বিধান জারির মাধ্যমে সামাজিক শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা প্রতিটি সুনাগরিকের আন্তরিক কামনা। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর রেখে যাওয়া অহি-র বিধানকে পাশ কাটিয়ে তাঁর নামে মিথ্যা প্রশংসার অনুষ্ঠান করে সেযুগের কুকুবুরীর মত এ যুগের মিথ্যা নবীপ্রেমিকগণ সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে রাজনৈতিক ও ব্যক্তি স্বার্থে কাজে লাগাচ্ছেন অবলীলাক্রমে বাধাহীন গতিতে।

অতএব দেশের দায়িত্বশীল সরকার ও সচেতন দ্বীনদার ভাইবোনদের প্রতি আমাদের আবেদন, শিরকী ও বিদ‘আতী অনুষ্ঠান সমূহের পিছনে অহেতুক অপচয় বন্ধ করে সেগুলি তাওহীদ ও সুন্নাহর পথে নির্ভেজাল দ্বীন প্রতিষ্ঠার খাতে ব্যয় করুন! শিরকের পক্ষে বিদ‘আতের পক্ষে যখন সরকারী ও বেসরকারী প্রচার মাধ্যমগুলি তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করছে, তখন তাওহীদ ও সুন্নাহর দাবীদারগণ নিশ্চুপ কেন? কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী জীবন গড়ার দৃপ্ত শপথে দীপ্যমান ভাই-বোনেরা কোথায়? কাল ক্বিয়ামতের মাঠে যখন বিদ‘আতীরা আপনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দায়ের করবে আপনাদের অলসতার বিরুদ্ধে, আপনাদের কৃপণতার বিরুদ্ধে, আপনাদের দায়িত্বহীনতার বিরুদ্ধে, তখন আপনি কি জওয়াব দিবেন? বন্ধুকে বাদাম না খাইয়ে সেই পয়সা দিয়ে একটা ছোট্ট পুস্তিকা কিনে তাকে পড়তে দিন। যদি বন্ধু এর দ্বারা বিদ‘আত হ’তে তওবা করেন, তবে তিনি ও তার পরবর্তী বংশধরগণ ইনশাআল্লাহ বিদ‘আত হ’তে মুক্ত থাকবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। ফলে তার ও তার আমলনামায় যত নেকী সঞ্চিত হবে, তার সমপরিমাণ নেকী আল্লাহর মেহেরবানীতে আপনার আমলনামায় জমা হবে বলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) ওয়াদা করেছেন।[3]

নেকী উপার্জনের এই সুন্দর সুযোগটি আপনি হাত ছাড়া করতে চান? একবার মনের চোখ দিয়ে তাকিয়ে দেখুন তো আপনার মৃত্যুকাতর পিতার পাংশু চেহারার দিকে। আপনাকে বড় করার জন্য, সুন্দর করার জন্য, সুখী করার জন্য যিনি তার সমস্ত জীবন উৎসর্গ করেছেন। একবার তাকিয়ে দেখুনতো আপনার কাফনে ঢাকা মায়ের বিবর্ণ চেহারার দিকে। দেহের শোষিত রক্তের সবটুকু দিয়ে বুকের সঞ্চিত সুধা উজাড় করে দিয়ে শীত-গ্রীষ্মের ও রাত্রি-দিনের সকল আরামকে হারাম করে যিনি আপনাকে মানুষ করেছেন তিলে তিলে। আজ তাঁরা কবরে শুয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন আপনার দো‘আর, আপনার ছাদাক্বার, আপনার উপহারের। কেন তাঁকে কিছু দিচ্ছেন না? কেন তাদেরকে ভুলে যাচ্ছেন? আপনি আপনার পিতাকে ভুললে আপনার সন্তানেরা আপনাকে ভুলবে- একথা ধরে নেওয়া যায়। অতএব আসুন! যার যা আছে তাই নিয়ে শিরক ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। মাল নিয়ে, জান নিয়ে, যবান ও কলম নিয়ে জিহাদের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। মুজাহিদের সম্মান ও মর্যাদা বসে থাকা অলসদের চাইতে বেশী। আসুন সেই মর্যাদা নিয়ে মৃত্যুর প্রস্ত্ততি গ্রহণ করি। আল্লাহ আমাদের কবুল করুন- আমীন!


[1]. বুখারী হা/৬৫৮৪; মুসলিম হা/২২৯০; মিশকাত হা/৫৫৭১।

[2]. মুসলিম হা/১১৪৪; মিশকাত হা/২০৫২।

[3]. মুসলিম হা/২৬৭৪; মিশকাত হা/১৫৮।