বন্যায় বিপর্যস্ত বাংলাদেশ

প্রায় আড়াই মাস যাবৎ স্থায়ী স্মরণকালের ভয়াবহতম সর্বগ্রাসী বন্যার ফলে বাংলাদেশের সার্বিক জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কোটি কোটি মানুষ হয়েছে দুর্গত ও দুর্দশাগ্রস্ত। অসংখ্য মানুষের জীবন ধারণের স্বাভাবিক ব্যবস্থা তছনছ হয়ে গেছে। বাসগৃহ ধ্বংস হয়েছে, জীবিকা বাধাগ্রস্ত হয়েছে, প্রায় অচল হয়ে পড়েছে জীবনের স্বাভাবিক গতি। পত্রিকান্তরে প্রকাশ কেবল সড়ক ও রেল যোগাযোগ খাতেই ক্ষতির পরিমাণ ২ হাযার ১শত কোটি টাকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ১৪ হাযার; যেগুলির সংস্কারের জন্য প্রয়োজন হবে ২১৬ কোটি টাকা। ফসলহানির পরিমাণ প্রায় ২০ লক্ষ টন। যার ফলে বর্তমান অর্থবছরে খাদ্য ঘাটতির পরিমাণ ৪০ লক্ষ টনে দাঁড়াবে বলে আশংকা করা হচ্ছে।

দীর্ঘস্থায়ী বন্যার কারণে রোগগ্রস্ত হয়েছে অসংখ্য মানুষ। মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় সহস্রাধিক। আশ্রয় কেন্দ্র সমূহে ত্রাণ সামগ্রী ছিল অপ্রতুল। ফলে ক্ষুধার জ্বালায় মা তার আদরের দুলাল তিন দিনের শিশুপুত্রকে পর্যন্ত বিক্রি করে ক্ষুধা নিবারণে উদ্যত হয়েছিল। অপর মা একই কারণে তার দুই শিশু কন্যাকে নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহুতি দিয়েছেন। জাতির এই চরম দুর্দিনেও এক শ্রেণীর এনজিও তাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধে দুর্গতদের উপরে এমনকি রিলিফের সামগ্রী বিক্রির জন্য চাপ প্রয়োগ করেছে। আর আত্মহত্যা করেছে জনৈক বোন। এটাই হ’ল দেশের রূঢ় বাস্তবতার কিছু ছিটেফোঁটা।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইতিপূর্বেও হয়েছে। কিন্তু এ বছরের ন্যায় ভয়াবহ ও এত প্রলম্বিত এবং এত মারাত্মক অবস্থার মুখোমুখি হ’তে হয়নি কখনো দেশবাসীকে। যদি প্রশ্ন করা হয় আমরা কেন বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগের শিকার হচ্ছি? আমাদের জীবনযাত্রা কেন বার বার ব্যহত হচ্ছে? যারা ‘প্রকৃতির খেয়ালীপনাই এর জন্য দায়ী’ বলেন, তারা নিজেদের হাতে সৃষ্ট সামাজিক অবক্ষয়কে পাশ কাটিয়ে যেতে চেষ্টা করেন, যা প্রকারান্তরে দায়িত্বহীনতার শামিল। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য যে, মানুষের জ্ঞান ও বিবেক যখন অন্ধ হয়ে যায়, মানুষ যখন আল্লাহ ও তাঁর প্রেরিত নবী-রাসূলের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পাপ-পঙ্কিলতায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়ে পড়ে, মানুষের নৈতিকতাবোধ যখন একেবারে শূন্যের কোঠায় নেমে যায়, তখন ঐ জাতির উপরে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেমে আসে। ইতিপূর্বেও আল্লাহপাক বহু জাতিকে তাদের কৃতকর্মের ফলে সমূলে ধ্বংস করেছেন।

বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি পূর্বের তুলনায় কোন অংশেই উন্নত নয়। বরং তার চাইতে অবনতিশীল। আড়াই বৎসরের শিশু কন্যা থেকে শুরু করে ৭০ বৎসরের বৃদ্ধাও এ দেশে নিরাপদ নয়। হত্যা, ধর্ষণ, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এ দেশের নিত্যকার ঘটনা। নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, ভিসিআর ও ডিশ এ্যান্টেনার নীল দংশন, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা, টিভি-সিনেমার অশ্লীল ছবি প্রদর্শনই নৈতিক অবক্ষয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। দেশের পেক্ষাগৃহ গুলোতে প্রতিনিয়ত ইংরেজী ছবির নামে রঙিন ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। অথচ প্রশাসন এ ব্যাপারে নিশ্চুপ। যে দেশে সরকারের নাকের ডগায় প্রতিনিয়ত অশ্লীল ছবি প্রদর্শিত হয়, পুলিশের সামনে এমনকি পুলিশের দ্বারা আইন ও সমাজ বিরোধী কাজ হয়, যে দেশের নেতারা সন্ত্রাসীদের লালন করেন ও আশ্রয় দেন, সে দেশে সামাজিক উন্নতি আশা করা ‘চোরকে চুরি করতে বলা আর মালিককে সজাগ থাকতে বলা’রই নামান্তর। কাজেই সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সংসদে গলা ফাটিয়ে বুলি আওড়ানোর কোন হেতুবাদ নেই। বরং সর্বাগ্রে নিজেরা সকল দুর্নীতি থেকে তওবা করে শক্তভাবে বন্যা পরবর্তী পুনর্বাসনে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা আমাদের নৈতিক ও ধর্মীয় দায়িত্ব। অতএব যার যা আছে সবকিছু নিয়ে দুর্দশাগ্রস্ত ভাইদের দুর্দশা লাঘবে এগিয়ে আসুন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!

পরিশেষে পত্রিকার স্বার্থে সেপ্টেম্বর’৯৮ সংখ্যা বন্ধ রেখে অক্টোবর’৯৮ থেকে ২য় বর্ষ ১ম সংখ্যা শুরু হ’ল। বর্ষ শুরুতে আমরা আমাদের সকল লেখক-লেখিকা, গ্রাহক-অনুগ্রাহক, বিজ্ঞাপন দাতা ও এজেন্ট ভাই-বোনকে আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই এবং ভবিষ্যৎ পদযাত্রায় আল্লাহর তাওফীক কামনা করি- আমীন!

[1]. ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, অক্টোবর ১৯৯৮।