কাশ্মীর ট্রাজেডী

ভারতের প্রথম গবর্ণর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন ও তৎকালীন ভারতীয় নেতৃবৃন্দের কূটচালের ফলশ্রুতি হিসাবে বিগত ৫২ বছর ধরে কাশ্মীরে যে রক্ত ঝরছে, গত কয়েক সপ্তাহে তা তীব্র আকার ধারণ করেছে। অতঃপর গত ২৬শে মে’৯৯ বুধবার সকাল সাড়ে ৭-টায় স্বাধীনতাকামী কাশ্মীরী মুজাহিদদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে ভারত পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ রেখা (LOC) বরাবর দ্রাস, কারগিল প্রভৃতি পাহাড়ী এলাকায় স্থল ও বিমান হামলা শুরু করেছে। মাত্র কয়েক শ’ মুজাহিদকে বিতাড়িত করার জন্য পৃথিবীর ৪র্থ বিমান শক্তির অধিকারী পারমাণবিক শক্তিধর ভারত হঠাৎ চন্ডমূর্তি ধারণ করে এমন সংহারী আক্রমণ শুরু করবে, তা ভাবতেও আশ্চর্য লাগে। যাকে রীতিমত মশা মারতে কামান দাগা বলা চলে। উল্লেখ্য যে, বিগত ৫২ বছরের মধ্যে এই প্রথম শান্তিকালীন সময়ে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার বিমান শক্তি ব্যবহার করল। ফলে ভারতীয় বিমান ২৭ তারিখে পাকিস্তানী এলাকায় ঢুকে পড়লে তার দু’টি মিগ-২৭ জঙ্গী বিমান ভূপাতিত হয়। একটির পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার অজয় আহুজা নিহত হন। অন্যটির পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট নচিকেতা গ্রেফতার হন। ওদিকে মুজাহিদদের স্টিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ২৮শে মে ভারতের ২টি এস আই-১৭ জঙ্গী হেলিকপ্টার ভূপাতিত হয় ও এর ৪ জন পাইলট নিহত হয়। কাশ্মীরের অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় মুজাহিদদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে যুদ্ধ সারা কাশ্মীরে দ্রুত বিস্তৃত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ইতিমধ্যে উভয়পক্ষে বহু হতাহত হয়েছে। সাধারণ মুসলিম নর-নারী, শিশু-বৃদ্ধ ঘরবাড়ি ছেড়ে প্রাণভয়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাচ্ছে। কসোভোর ন্যায় নিজের দেশেই কাশ্মীরী মুসলমানরা এখন উদ্বাস্ত্ত হ’তে চলেছে।

উল্লেখ্য যে, অধিকৃত কাশ্মীরের ১ কোটির ঊর্ধে মুসলমানকে দমন করার জন্য গত কয়েক বছরে ভারত সেখানে তার ছয় লাখ সৈন্য নামিয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে কাশ্মীরী মুসলমানদের উপর ইতিহাসের বর্বরতম নিষ্ঠুরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এ পর্যন্ত ৬০ হাযারের উপরে মুসলমান শহীদ হয়েছে। ভারতের ২৫টি রাজ্যের মধ্যে সবচাইতে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রাজ্য হচ্ছে কাশ্মীর। যার ৮২% মুসলমান। ভারত বিভাগের সময় নীতি অনুযায়ী এটা পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাশ্মীরী সন্তান নেহরু ও কাশ্মীরের হিন্দু শাসক হরি সিংয়ের মধ্যে চুক্তির ফলে এবং সাথে সাথে গবর্ণর জেনারেল মাউন্টব্যাটেনের সমর্থনের কারণে কাশ্মীরী সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগণের ইচ্ছা-আকাংখাকে পিষ্ট করে ভারত জোর করে কাশ্মীরকে নিজ অধিকৃত রাজ্যে পরিণত করে। অথচ হায়দারাবাদের মুসলিম শাসক নিযাম যখন পাকিস্তানে যোগ দিতে চান, তখন কিন্তু সেখানকার সংখ্যাগুরু হিন্দু প্রজাদের দোহাই দিয়ে ভারত সেটাকে নিজের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৪৮ সালে বিষয়টি জাতিসংঘে যায় ও সেখানে কাশ্মীরী জনগণের ইচ্ছার উপরে বিষয়টি ছেড়ে দিয়ে ‘গণভোট’ অনুষ্ঠানের পক্ষে প্রস্তাব পাস হয়। কিন্তু ভারত এযাবত তাতে কর্ণপাত করেনি। এভাবে বিভিন্ন ছলচাতুরী ও শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে গোয়া, মানভাদর, জুনাগড় প্রভৃতি দেশীয় রাজ্যগুলিকে ভারত গ্রাস করে নেয়। তার সর্বশেষ আগ্রাসনের শিকার হয়েছে সিকিম। এভাবে বলদর্পী ভারতের পার্শ্ববর্তী ছোট বড় সকল রাষ্ট্র আজ সদা ভীত ও সন্ত্রস্ত।

ভারত তার বর্তমান হামলাকে পাকিস্তানী অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে হামলা বলে আখ্যায়িত করতে চায়। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা কি তাই? বাংলাদেশের মুক্তিযু্দ্ধকে দমন করার সময় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ভারতের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছিল। ভারত বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তখন সার্বিক সহযোগিতা দিয়েছিল। এমনকি অবশেষে নিজ সেনাবাহিনী নামিয়েছিল। যার ফলে দেশ দ্রুত স্বাধীন হয়েছে। অমনিভাবে কাশ্মীরী মুক্তিযোদ্ধাদের দমন করার সময় ভারত সরকার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছে। এর জবাবে পাকিস্তানের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান মির্যা আসলাম বেগ বলেছেন, ‘কাশ্মীরীদের সাথে জিহাদে শরীক হওয়ার জন্য সারা পৃথিবী থেকে যেমন- সুদান, মিসর, ইয়েমেন, বাহরায়েন, আফগানিস্তান এবং অবশ্যই পাকিস্তান থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা আসছেন। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে নয়’।

কিন্তু হঠাৎ করে ঠিক এই সময় ভারতের পক্ষ থেকে এই যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করার পিছনে উদ্দেশ্য কি? এটা পরিষ্কার যে, মাত্র এক ভোটের ব্যবধানে অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গিয়ে পাগলপারা বৃদ্ধ বাজপেয়ী আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনে আবার ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্য মরিয়া হয়ে বিনা উসকানিতে এই অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করেছেন। এবার আর ‘রাম মন্দির’ নয়, কাশ্মীর ইস্যুতেই তাঁকে নির্বাচনে জিততে হবে। অথচ গত নির্বাচনের সময় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, আর নির্বাচন করবেন না। জানা গেছে যে, ইতিমধ্যে সোনিয়া গান্ধীও এই হামলাকে সমর্থন দিয়েছেন। নিশ্চয়ই সেখানেও উদ্দেশ্য রাজনীতি।

লন্ডনের খ্যাতনামা সাপ্তাহিকী ‘দি ইকনমিস্ট’ ২২.৫.১৯৯১ইং সংখ্যায় বলেছিল যে, কাশ্মীরী জনগণকে গণভোটের সুযোগ দিলেই তারা পাকিস্তানের দিকে চলে যাবে। ভারতের তথাকথিত One nation theory বা ‘এক জাতীয়তা মতবাদ’ ধূলায় লুটাবে’। হয়তবা আসন্ন একবিংশ শতকে ভারতের জন্য নাটকীয় ভাঙ্গন ও অভিনব পরিবর্তন অপেক্ষা করছে। কেননা উক্ত আন্তর্জাতিক সাপ্তাহিকীটির অভিমত হচ্ছে যে, ‘ভারত মাঝে মাঝে নিজেও সন্দেহ করে যে, সে নিজে একটি অভিন্ন জাতি কি-না। কেননা অসংখ্য ভাষা ও বর্ণ, বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বিভক্ত ভারতের কয়েকটি রাজ্য এতই বড় যে, তারা নিজেরাই এক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা ও পরিচালনা করতে পারে’।

প্রশ্ন হচ্ছে, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের সোল এজেন্ট আমেরিকা ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলি থাকতে কাশ্মীরের ব্যাপারে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত ২৫৬ নং প্রস্তাবটি বিগত ৫০ বছরে কেন বাস্তবায়িত হ’ল না? কেন কাশ্মীরে তখন থেকেই দৈনিক রক্ত ঝরছে ও মা-বোনের ইযযত লুণ্ঠিত হচ্ছে? কেন মানবাধিকার নিয়মিতভাবে লংঘিত হচ্ছে?

ভুক্তভোগীরা বলেন, এর পিছনে আন্তর্জাতিক ইহূদী-খ্রিষ্টান ও ব্রাহ্মণ্যবাদী লবি গোপন অাঁতাতে কাজ করে যাচ্ছে। যাতে কাশ্মীরে আরেকটি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্রের উত্থান না ঘটে। যাতে একমাত্র পারমাণবিক শক্তিধর মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভারতের মাধ্যমে ধ্বংস কিংবা দুর্বল করা যায় এবং ইউরোপের মুসলিম দেশগুলোর মত দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদেরকেও চিরকাল উদ্বাস্ত্ত করে কিংবা পাশ্চাত্যের দেওয়া খুদকুঁড়ো খেয়ে করুণার ভিখারী হয়ে বেঁচে থাকতে হয়।

কাশ্মীর পাকিস্তান ভুক্ত হৌক বা স্বাধীন রাষ্ট্র হৌক এটা তাদের ব্যাপার। আমরা চাই সেখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বন্ধ হৌক। জাতিসংঘ প্রস্তাব অনুযায়ী তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠিত হৌক। পূর্বের তিনটি যুদ্ধের ন্যায় পুনরায় কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ না বাঁধুক। দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হৌক!